জাফর আহমাদ

আল্লাহ তা’আলা বলেন, “হে ঈমানদারগণ! তোমরা পরস্পরের ধন-সম্পদ অন্যায়ভাবে খেয়ে ফেলো না। লেনদেন হতে হবে পারস্পরিক রেজামন্দির ভিত্তিতে। আর নিজেকে হত্যা করো না। নিশ্চিত জানো, আল্লাহ তোমাদের প্রতি মেহেরবান।” (সুরা নেসা: ২৯) অন্য এক আয়াতে আল্লাহ তা’আলা বলেন, “আর তোমরা নিজেদের মধ্যে তোমাদের মাল অবৈধ পদ্ধতিতে খেয়ো না এবং শাসকদের সামনেও এগুলোকে এমন কোন উদ্দেশ্যে পেশ করো না যার ফলে ইচ্ছাকৃতভাবে তোমরা অন্যের সম্পদের কিছু অংশ খাওয়ার সুযোগ পেয়ে যাও।” (সুরা বাকারা: ১৮৮)

আয়াতে অন্যায়ভাবে বলতে এমন সব পদ্ধতি ও উপায় অবলম্বনের কথা বুঝানো হয়েছে যা সত্য ও ন্যায়নীতি বিরোধী এবং নৈতিক দিক দিয়েও শরীয়াতের দৃষ্টিতে নাজায়েজ। অন্যের সম্পদ আত্মসাৎ করা আসলে নিজেকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দেয়ার নামান্তর। এর ফলে সমাজ ব্যবস্থায় বিপর্যয় দেখা দেয়। এর অনিষ্টকর পরিণতি থেকে হারামখোর ব্যক্তি নিজেও রক্ষা পেতে পারে না এবং আখিরাতে এর কারণে মানুষ কঠিণ শাস্তির অধিকারী হয়। আয়াতে উল্লেখিত “আর নিজেকে হত্যা করো না” মুফাস্সিরগণ দু’টো ব্যাখ্যা উপস্থাপন করেছেন। এক, পরস্পরকে হত্যা করো না, দুই, আত্মহত্যা করো না। মহান আল্লাহ এ ক্ষেত্রে এমন ব্যাপক অর্থবোধক শব্দ ব্যবহার করে রেখেছেন এবং বাক্য এমনভাবে গঠন করেছেন যার ফলে এ দুটি অর্থই এখান থেকে পাওয়া যেতে পারে এবং দুটো অর্থই সত্য।

উল্লেখিত আয়াতে ‘লেনদেন’ মানে হচ্ছে পরস্পরের মধ্যে স্বার্থ ও মুনাফার বিনিময় করা। যেমন ব্যবসায়, শিল্প ও কারিগরী ইত্যাদি ক্ষেত্রে হয়ে থাকে। সেখানে একজন অন্যজনের প্রয়োজন সরবরাহ করার জন্য পরিশ্রম করে এবং তার বিনিময় দান করে। এখানে সকলে সমান সুযোগ সুবিধা ভোগ করে এবং উভয়েই উপকৃত হয় বিধায় এটি শরীয়াত সম্মত হালাল পন্থা। পারস্পরিক সম্মতি অর্থ হচ্ছে, কোন অবৈধ চাপ বা ধোঁকা ও প্রতারণার মাধ্যমে লেনদেন হবে না। ঘুষ ও সুদের মধ্যে আপাত: সম্মতি থাকে কিন্তু আসলে এ সম্মতির পেছনে থাকে মানসিক চাপ ও অক্ষমতা। প্রতিপক্ষ নিজের অপারগতা ও অক্ষমতার কারণে বাধ্য ও অন্যনোপায় হয়ে চাপের মুখে ঘুষ ও সুদ দিতে রাজী হয়। জুয়ার মধ্যেও বাহ্যিক দৃষ্টিতে সম্মতি বা রেজামন্দী মনে হয়। কিন্তু আসলে জুয়াতে অংশগ্রহণকারী প্রত্যেক ব্যক্তি একমাত্র সে-ই বিজয়ী হবে এ ভ্রান্ত আশায় এতে অংশগ্রহণে রাজি হয়। পরাজয়ের উদ্দেশ্য নিয়ে কেউ এতে অংশগ্রহণ করে না। প্রতারণা ও জালিয়াতির কারবার্ওে বাহ্যত সম্মতিই দেখা যায়। কিন্তু এখানেও সম্মতির পেছনে এ ভুল ধারণা কাজ করে যে, এর মধ্যে প্রতারণা ও জালিয়াতী নেই। দ্বিতীয় পক্ষ যদি জানতে পারতো যে, প্রথম পক্ষ তার সাথে প্রতারণা ও জালিয়াতী করছে তাহলে সে কখনো রাজি হবে না। এ জন্য পারস্পরিক সম্মতি বলতে সংশ্লিষ্ট লেনদেনে উভয়ের উপকার থাকতে হবে।

এ আয়াতের আলোকে অন্যায়ভাবে ধন-সম্পদ উপার্জন করা হারাম। আল্লাহ তা’আলা বলেন, “হে ঈমানদারগণ! যদি তোমরা যথার্থই আল্লাহর ইবাদতকারী হয়ে থাকো, তাহলে যে সমস্ত পাক-পবিত্র জিনিস আমি তোমাদের দিয়েছি সেগুলো নিশ্চিন্তে খাও এবং আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করো।” (সুরা বাকারা: ১৭২) অর্থাৎ যদি তোমরা ঈমান এনে কেবলমাত্র আল্লাহর বিধানের অনুসারী হয়ে থাকো, যেমন তোমরা দাবি করছো তাহলে অবাঞ্ছিত আচার-আচরণ ও বিধি-নিষেধ ছুঁড়ে মারো। আল্লাহ যা কিছু হারাম করেছেন তা থেকে অবশ্যি দূরে থাকো। কিন্তু যেগুলো আল্লাহ হালাল করেছেন কোন প্রকার ঘৃণা-সংকোচ ছাড়াই সেগুলো পানাহার করো। মনে রাখতে হবে, সালাত পড়া ও কিবলার দিকে মুখ করা সত্বেও কোন ব্যক্তি ততক্ষণ ইসলামে পুরোপুরি প্রবেশ করতে পারে না যতক্ষণ না সে পানাহারের ব্যাপারে অতীতের জাহেলী যুগের বিধি-নিষেধ পরিহার না করে। কিন্তু দুঃখজনক সত্য হলো, বর্তমান যুগের মানুষ আবার জাহেলী যুগে ফিরে গিয়ে অবৈধভাবে ধন-সম্পদ আহরণ করার কাজে প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হয়েছে। নিয়মিত সালাত পড়ছে, রমযানের সাওম পালন করছে, কিন্তু উপার্জনের ক্ষেত্রে হালাল-হারামের পরোয়া করছে না।

আবু হুরাইরা (রা.) সূত্রে নবী (সা.) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, এমন এক যুগ আসবে, যখন মানুষ পরোয়া করবে না যে, সে কোথা হতে উপার্জন করল, হালাল না হারাম হতে। (বুখারী: ২০৫৯, কিতাবুল বুয়ু, বাবু মান লাম ইউবালু মিন হাইছু কাসাবাল মালু, বুখারী:২০৮৩, আ:প্র:১৯১৬, ইফা:১৯৩১) বর্তমান যুগের মুসলমানদের ধন-সম্পদ উপার্জনের পন্থা দেখে সহজেই অনুমান করা যায় যে, উল্লেখিত হাদীসে রাসুলুল্লাহ (সা.) এর ভবিষ্যত বাণীর সে যুগটি হলো, বর্তমান সময়ের পৃথিবী। বর্তমান পৃথিবীর গুটিকয় মুসলিম বাদ দিলে অধিকাংশ মুসলিমদের ধন-সম্পদ আহরণের ক্ষেত্রে হালাল-হারামকে একাকার করতে দেখা যায়। তারা ভালো করেই জানে তাদের এ পন্থা হারাম। তাদেরকে অবশ্যই আল্লাহর কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হবে। তবুও তারা এ ব্যাপারে নির্ভিক।

আবু হুরাইরা (রা.) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন: “আল্লাহ তা’আলা পবিত্র, তিনি পবিত্র ও হালাল বস্তু ছাড়া গ্রহণ করেন না। আর আল্লাহ তা’আলা তাঁর প্রেরিত রাসুলদের যে হুকুম দিয়েছেন মু’মিনদেরকেও সে হুকুম দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, “হে রাসুলগণ! তোমরা পবিত্র ও হালাল জিনিস আহার কর এবং ভাল কাজ কর। আমি তোমাদের কৃতকর্ম সম্বন্ধে জ্ঞাত।” (সুরা আল মু’মিন: ৫১) তিনি আরো বলেছেন, “তোমরা যারা ঈমান এনেছো শোন। আমি তোমাদের যে সব পবিত্র জিনিস রিযক হিসেবে দিয়েছি তা খাও”-(সুরা বাকারা: ১৭২) অতঃপর তিনি এক ব্যক্তির কথা উল্লেখ করলেন, যে দূর-দূরান্ত পর্যন্ত দীর্ঘ সফর করে। ফলে সে ধূলি ধূসরিত রুক্ষ কেশধারী হয়ে পড়ে। অতঃপর সে আকাশের দিকে হাত তুলে বলে, “হে আমার রব! অথচ তার খাদ্য হারাম, পানীয় হারাম, পরিধেয় বস্ত্র হারাম এবং আহার্যও হারাম। কাজেই এমন ব্যক্তির দু’আ তিনি কি করে কবুল করতে পারেন?” (মুসলিম:২২৩৬, আন্ত. নাম্বার:১০১৫, কিতাবুয যাকাত, বাবু কবুলিস সাদাকাতে মিনাল কাসাবে....., ইফা:২২১৫, ই.সে:২২১৬)

হাশরের মাঠ ভয়াবহ। সেদিন পাপী গোনাহগারেরা ঘামতে থাকবে। পাপের সাথে মিল রেখে প্রত্যেকের কষ্টের ও ঘামের পরিমাণ হবে। আবু হুরাইরা (রা.) হতে বর্ণিত। রাসুলূল্লাহ (সা.) বলেছেন: কিয়ামতের দিন মানুষের ঘাম ঝরবে। এমনকি তাদের ঘাম যমীনে সত্তর হাত পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়বে এবং তাদের মুখ পর্যন্ত ঘামে ডুবে যাবে; এমনকি কান পর্যন্ত। (বুখারী : ৬৫৩২, কিতাবুর রিকাক, বাবু ক্বাউলিহি তা’আলা : আলা ইয়াজুন্নু উলাইকা......, মুসলিম : ২৮৬৩, আহমাদ: ৯৪২৬. আ.প্র:৬০৮২, ইফা:৬০৮৮) সে মাঠের সময়ের পরিক্রমা সম্পর্কে আল্লাহ তা’আলা বলেন, “সেই দিনের পরিমাণ তোমাদের গণনায় সহস্্র বৎসর।” (সুরা সাজদা: ৫) “ওই দিনের ব্যাপ্তি পঞ্চাশ হাজার বছর।” (সুরা মা’আরিজ: ৪)

সেদিনের সেই ভয়াবহ হাশরের মাঠে আদম সন্তানের ৫টি প্রশ্নের উত্তর না দেয়া পর্যন্ত দু’পা উঠাতে দেয়া হবে না। আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) হতে বর্ণিত। নবী (সা.) বলেছেন: কিয়ামতের দিবসে পাঁচটি বিষয় সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ হওয়ার আগ পর্যন্ত আদম সন্তানের পদদ্বয় আল্লাহর নিকট হতে সরতে পারবে না। তার জীবনকাল সম্পর্কে, কিভাবে তা অতিবাহিত করেছে? তার যৌবনকাল সম্পর্কে, কি কাজে তা বিনাশ করেছে; তার ধন-সম্পদ সম্পর্কে, কোথা হতে তা উপার্জন করেছে এবং তা কী খাতে খরচ করেছে এবং সে যতটুকু জ্ঞান অর্জন করেছিল সে মোতাবেক কী আমল করেছে। (তিরমিযি: ২৪১৬, কিতাবু সিফাতিল কিয়মাহ ওয়ার রিকায়িকি....., বাবুল কিয়ামাহ) খাওলাহ আনসারীয়া (রা.) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি নবী (সা.) কে বলতে শুনেছি যে, কিছু লোক আল্লাহর দেয়া সম্পদ অন্যায়ভাবে ব্যয় করে, কিয়ামতের দিন তাদের জন্য জাহান্নাম নির্ধারিত। (বুখারী: ৩১১৮, কিতাবু ফারদেল খুমুসি, বাবু ক্বাউলিহি তা’আলা খুমুসু লিল্লাহি ওয়ার রাসুলি....., ইফা: ২৮৯৪, আ.প্র: ২৮৮৪)

যারা হারাম পন্থায় সম্পদের পাহাড় গড়েছে, তাদের সম্পদ একদিন দুনিয়া ও আখিরাতে তাদের জন্য ধ্বংস ডেকে আনবে। এই সমস্ত হারামখুররা আল্লাহর কাছে অপবিত্র। আল্লাহ তাদেরকে কখনো পবিত্র করবেন না। তাদের অবৈধ সম্পদ সেদিন তাদের কোন উপকারে আসবে না ধন-সম্পদ সেখানে কেবলমাত্র এমন অবস্থায় উপকারী হবে যখন মানুষ দুনিয়ায় ঈমান ও আন্তরিকতা সহকারে তা আল্লাহর নির্ধারিত পথে উপার্জন করে এবং তা আল্লাহর নির্দেশিত পথে ব্যয় হয়। নয়তো কোটিপতি ও বিলিয়ন সম্পদের মালিকরাও সেখানে পথের ভিখারী হবে। আল্লাহ তা’আলা বলেন, “যেদিন অর্থ-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি কোন কাজে লাগবে না, তবে যে বিশুদ্ধ অন্তঃকরণ নিয়ে আল্লাহর সামনে হাজির হবে।” (সুরা শুয়ারা) ৮৮-৮৯।

লেখক: ব্যাংকার