আরশী আক্তার সানী

ঘুষ ছাড়া ফাইল নড়ে না, এটা আর কেবল একটা কথা বা অভিযোগ নয় বরং এটা আমাদের সিস্টেমের এক অন্ধকার দিক। আজকাল যেকোনো অফিসে, হাসপাতাল বা স্কুলে যতই নথিপত্র সঠিক হোক না কেন, যদি টাকা না দাও, তাহলে কিছুই হবে না। ঘুষের অদৃশ্য দেয়াল আমাদের সব কিছু আটকে রাখে।

আমি একদিন জমির কাগজ পেতে গিয়ে দেখলাম, পুরো অফিসটা থমকে গেছে। বসে থাকা লোকেরা চুপ করে বলল, কিছু টাকা দিলে আজকেই হয়ে যাবে। যখন আমি বললাম, কেন? আমি তো সব ডকুমেন্ট নিয়ে এসেছি, তারা শুধু হাসে, যেন এটা স্বাভাবিক ব্যাপার। তখন আমি বুঝতে পারলাম এটা আর শুধু কিছু অসৎ কর্মকর্তার সমস্যা নয়। এটা পুরো একটা সিস্টেমের অবক্ষয়। আমার এক আত্মীয় যখন সরকারি হাসপাতালে ভর্তি হতে যায়, তাকে বলল, আপনি কিছু খরচা না করলে দ্রুত চিকিৎসা হবে না। সেদিন আমি শুধু হতাশই নই, ভয়ও পেয়েছিলাম। আমাদের দেশের পরিস্থিতি কি এমন হয়ে গেছে যে, স্বাস্থ্য পরিষেবা, শিক্ষা বা সরকারি সুযোগ এগুলোও এখন কেবল টাকা দিয়েই পাওয়া যায়? কেন আমাদের নাগরিক অধিকার পেতে টাকা দিতে হবে?

এটা এক ধরনের শোষণ, যেখানে কেবল গরিব মানুষেরই ক্ষতি হচ্ছে। তাদের জন্য কোনো পথ নেই, তারা ঘুষ না দিলে কিছুই পায় না। আর যারা টাকা দিতে পারে, তাদের জন্য সব কিছু সহজ। আমাদের প্রশাসনিক সিস্টেমের দায়িত্বে যারা আছেন, তাদের দায়িত্ব হচ্ছে জনগণের সেবা করা, কিন্তু তারা যদি জনগণের ওপর চাপিয়ে দেয় যে, পয়সা দিতে না পারলে কিছু হবে না, তাহলে এর দায় কার? অনেকেই মনে করে, সব দেশে তো এমনই হয়, বা কিছু তো করার নেই। কিন্তু আমি বলি, যদি এ ধরনের নীরবতা আমাদের সবার মধ্যে থাকে, তাহলে কীভাবে বদলাবে কিছু? যদি আমাদের সমাজে এভাবে ঘুষের সংস্কৃতি চালু থাকে, তাহলে আমাদের ভবিষ্যত কেমন হবে? আমাদের সন্তানদের কি একইভাবে এসব নিয়ে বাঁচতে হবে? কেন তাদেরও চুপ করে সিস্টেমের সঙ্গে চলে যেতে হবে? সরকারি দপ্তরগুলোয় ঘুষের ব্যাপারটা যেন এখন একটা নিয়ম হয়ে গেছে। ফাইল এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় যেতেই ঘুষের দৌরাত্ম্য চলে আসে। আজকাল সবাই জানে ঘুষ না দিলে কাজ হবে না। এটা শুধু টাকা বা মালিকের সুবিধা নয়; এই ঘুষ আমাদের দেশের নৈতিকতাকেই প্রশ্নবিদ্ধ করে দেয়।

ঘুষ নেওয়ার কারণ : বেতন দিয়ে সংসার চলে না অনেকেই কাজ করেন, কিন্তু মাসের শেষ নাগাদ টানাটানি। তখন অন্য কোনো উপায় খোঁজা ছাড়া উপায় থাকে না। এমন দাবি ঠিক নয়। এটা একশ্রেণির মানুষের অভ্যাসে পরিণত। অভাবের কথাটা মোটেই ঠিক নয়।

অফিসের কাজ সহজে হয় না ফাইল নাড়াতে গেলে, কিংবা কোনো অনুমোদন নিতে গেলে, এমন এক ব্যবস্থা আছে যেন না দিলেই কাজ আটকে যায়। কে কাকে জবাবদিহি করবে? কেউ যদি ধরা না পড়ে, তাহলে ভয়ও থাকে না। এ ভয় না থাকাটাই বড় সমস্যা। সবাই নিচ্ছে, আমি নিলে দোষ কোথায়? চারপাশে যখন সবাই নিচ্ছে, তখন অনেকেই নিজের কাছে এটা ন্যায্য মনে করে ফেলে। দ্রুত টাকার মালিক হওয়ার লোভে কেউ কেউ সোজাসাপ্টা বলে, আমি ছোট চাকরি করে কতদূর যাবো? তাই সুযোগ পেলেই নেই। সমাজে দেখনদারি কার কী আছে, কে কী পরছে, কোথায় যাচ্ছে এ প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে গিয়ে অনেকে ঘুষের আশ্রয় নেয়।

আমাদের এভাবে ঘুষ দেওয়া এবং নেওয়া বন্ধ করতে হবে। এজন্য প্রশাসনিক এবং সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি করা জরুরি। শুধু আইনি ব্যবস্থা নয়, আমাদের প্রত্যেক নাগরিকের দায়িত্ব ঘুষের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে প্রতিবাদ জানানো। আর যদি আমাদের এ প্রতিবাদ সফল হয়, তাহলে আমরা হয়তো ভবিষ্যতে আমাদের সন্তানদের একটা সৎ, স্বচ্ছ সমাজ উপহার দিতে পারব।

এ সংস্কৃতি বদলানোর জন্য আমাদের সাহসী হতে হবে। আর সাহসী হতে হলে প্রথমে নিজেদের চুপ থাকা বন্ধ করতে হবে। এখন সময় এসেছে ঘুষ ছাড়া ফাইল নড়বে, এমন একটা সমাজ গড়ার।

লেখক : শিক্ষার্থী, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।