আসিফ আরসালান

অবশেষে গ্রেফতার হলেন সাবেক প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক। তিনি গ্রেফতার হয়েছেন ধানমণ্ডিতে অবস্থিত তার নিজের বাস ভবন থেকে। দু’তিন মাস আগে অবশ্য একাধিক গণমাধ্যমে বলা হয়েছিলো যে, খায়রুল হক পালিয়ে ইংল্যান্ডে অবস্থান করছেন। তার ইংল্যান্ডে অবস্থানের খবরটি বেশ কয়েকটি মহল থেকে সমর্থিত হয়েছিলো। যাইহোক, তিনি যখন যেখানেই থাকুন না কেনো তার গ্রেফতার হওয়ার খবরটি একটি বিরাট নিউজ। কারণ বাংলাদেশের সর্বনাশ যদি কেউ করে থাকেন তাহলে করেছেন তিন ব্যক্তি। প্রথম ব্যক্তি হলেন শেখ মুজিবুর রহমান। দ্বিতীয় ব্যক্তি হলেন শেখ মুজিবুর রহমানের কন্যা শেখ হাসিনা এবং তৃতীয় জন হলেন আটক এ বিচারপতি খায়রুল হক। শেখ মুজিব বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব বিপন্ন করেছিলেন ভারতের সাথে ২৫ বছরের গোলামী চুক্তি করে। এ কথা শুনে অনেকে দ্বিমত পোষণ করতেও পারেন। কিন্তু শেখ মুজিবের ইমেজ যারা বিল্ড আপ করেছেন তারা এ গোলামী চুক্তিতে শেখ মুজিবের ভূমিকা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তাকে লায়নাইজ (Lionise) করেছেন। কিন্তু সে ইমেজের বেলুন ফুটো করে দিয়েছেন স্বয়ং জ্যোতিন্দ্রনাথ দীক্ষিত। সংক্ষেপে সকলের কাছে তিনি জেএন দীক্ষিত নামে সমধিক পরিচিত।

জেএন দীক্ষিত বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর বাংলাদেশে প্রথম ভারতীয় হাইকমিশনার ছিলেন। শেখ মুজিবের আমলেও তিনিই বাংলাদেশে ভারতীয় হাইকমিশনার ছিলেন। পরবর্তীতে তিনি মনমোহন সিংয়ের আমলে ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন। সে জেএন দীক্ষিত বাংলাদেশের স্বাধীনতার ওপর একটি বই লিখেছেন। বইটির নাম, “Liberation and Beyond”। কিভাবে ঐ গোলামী চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিলো তার বিশদ বিবরণ দিয়েছেন মিস্টার দীক্ষিত। সংক্ষেপে, তৎকালীন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী এ চুক্তি সই করায় আগ্রহী ছিলেন না। কিন্তু তৎকালীন প্রমোদ তরী মেরি এ্যান্ডারসনে ভ্রমণকালে শেখ মুজিব এই চুক্তি করার জন্য নাছোড়বান্দা হয়ে ওঠেন। অবশেষে শেখ মুজিবকে অবলাইজ করার জন্য ইন্দিরা গান্ধী রাজি হন। তখন শুরু হয় চুক্তির ড্রাফট লেখার কাজ। এ কাজে দায়িত্ব দেওয়া হয় ভারতের তরফ থেকে জেএন দীক্ষিত এবং বাংলাদেশের তরফ থেকে দায়িত্ব দেওয়া হয় সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের নব প্রতিষ্ঠিত পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীন মহাপরিচালক শাহ এ এসএম কিবরিয়াকে। এই দায়িত্ব ছাড়াও জনাব কিবরিয়া তখন সচিব হিসাবে প্রশাসন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বও পালন করেন। জনাব কিবরিয়া গণঅধিকার পরিষদের সাবেক প্রেসিডেন্ট রেজা কিবরিয়ার পিতা। ড্রাফটি লেখা হয় মেরি এ্যান্ডারসনেই। সেই ড্রাফট উভয় প্রধানমন্ত্রী অনুমোদন করলে সেটিই হয়ে ওঠে বাংলা ভারত মৈত্রী ও নিরাপত্তা চুক্তির নামে বাংলা ভারত ২৫ বছর মেয়াদী গোলামী চুক্তি। এছাড়া বাকশাল প্রতিষ্ঠা, চতুর্থ সংশোধনী এবং ঐ সংশোধনীতে নিজেকে জাতির পিতা হিসাবে ঘোষণাকারী শেখ মুজিবের আমলেই দুর্নীতি ও লুটপাটের কারণে দেশে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ হয়। সে দুর্ভিক্ষে আনুমানিক ৫ থেকে ৬ লাখ লোক মারা যান। ভারতের নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন বলেছেন যে, বাংলাদেশে খাদ্যের অভাব ছিলো না। কিন্তু দুর্নীতি এবং অব্যবস্থাপনার কারণে বাংলাদেশে দুর্ভিক্ষ হয়েছিলো।

বাংলাদেশের সর্বনাশের জন্য দায়ী দ্বিতীয় ব্যক্তি হলেন শেখ মুজিবের কন্যা শেখ হাসিনা। শেখ হাসিনার কুকর্ম সম্পর্কে ইতোমধ্যে অনেক কথা প্রকাশিত ও প্রচারিত হয়েছে। সেজন্য তার ব্যাপারে আর বিস্তারিত বিবরণে গেলাম না।

বাংলাদেশের সর্বনাশের জন্য দায়ী তৃতীয় ব্যক্তি হলেন সাবেক প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক। তার গ্রেফতারের পর বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, রাষ্ট্রদ্রোহের অপরাধে খায়রুল হকের বিচার হওয়া উচিত। তিনি আরো বলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে সাবেক প্রধান বিচারপতি খায়রুল হকের দেওয়া রায় রাষ্ট্রবিরোধী ছিলো। আইন অনুযায়ী তার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানাচ্ছি। দেরিতে হলেও তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ায় আমরা সন্তুষ্ট।

খায়রুল হকের রায়ের পর আওয়ামী লীগ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করেছে জানিয়ে তিনি আরও বলেন, এরপর দেশের সব রাজনৈতিক সংকটের জন্য এটি দায়ী। তিনি বিচার বিভাগের প্রতি আস্থার জায়গাটিকে ধ্বংস করেছেন। মির্জা ফখরুল একটুও বাড়িয়ে বলেন নি। খায়রুল হকের মিস ক্যারেজ অব জাস্টিস অর্থাৎ অবিচার বা বে ইনসাফির অপকীর্তি নিয়ে মহাকাব্য লেখা যেতে পারে। আজকের এ কলামে সংক্ষেপে এতটুকু বলবো যে, এ ব্যক্তি রায় লেখার নামে দিনকে রাত করেছেন।

এসব কাহিনী কমবেশি সকলেই জানেন। তবে প্রায় ১৪ বছরের পুরাতন কাহিনী হিসাবে বর্তমান প্রজন্ম নাও জানতে পারেন এবং তার আগের প্রজন্ম ভুলেও যেতে পারেন। সকলেই জানেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বা কেয়ারটেকার সরকারের কাহিনী। আওয়ামী লীগের প্রবল আন্দোলনের ফলে তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া কেয়ারটেকার সরকার ব্যবস্থা সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করতে বাধ্য হন। এ সংশোধনীর নাম ত্রয়োদশ সংশোধনী বা সংবিধানের ১৩ নম্বর সংশোধনী। এ সংশোধনীতে বলা হয়, ভবিষ্যৎ নির্বাচনের বেলায় নির্বাচনের ৩ মাস আগে সরকার পদত্যাগ করবে এবং কেয়ারটেকার সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করবে।

কেয়ারটেকার সরকারের অধীনে ৩টি নির্বাচন হয়। এ ৩টি নির্বাচনই সর্বোত্তম নির্বাচন হিসাবে বিবেচিত হয়েছে। ২০০৯ সালে ক্ষমতায় এসে শেখ হাসিনা বুঝতে পারেন যে, পরবর্তী নির্বাচন কেয়ারটেকার সরকারের অধীনে হলে তিনি আর ক্ষমতায় আসতে পারবেন না।

কেয়ারটেকার সরকার বাতিলের দাবিতে সর্বপ্রথম হাইকোর্টে রিট পিটিশন করা হয় ১৯৯৮ সালে। ২০০৪ সালের ৪ অগাস্ট হাইকোর্ট এ রিট খারিজ করেন এবং কেয়ারটেকার সরকারকে বৈধ ঘোষণা করেন। ২০০৫ সালে হাইকোর্টের এ রায়ের বিরুদ্ধে সুপ্রীম কোর্টে অর্থাৎ আপিল বিভাগে আপিল করা হয়। দীর্ঘদিন এ আপিল পড়ে থাকে। ৩০ সেপ্টেম্বর ২০১০ সালে খায়রুল হক প্রধান বিচারপতি হলে মামলাটি আবার সচল করা হয়। অতঃপর ২০১০ সালের ১০ মে আপিল বিভাগ খায়রুল হকের নেতৃত্বে কেয়ারটেকার সরকার ব্যবস্থা বাতিল করেন। বাতিল রায়ের সময় সুপ্রীম কোর্টের ৭ বিচারপতির ফুল বেঞ্চ রায় দেন। প্রথমে পক্ষে ৩ জন এবং বিপক্ষেও ৩ জন ছিলেন। তখন প্রধান বিচারপতি হিসাবে খায়রুল হক রায়ের পক্ষে অবস্থান নিলে ৪-৩, অর্থাৎ পক্ষে ৪ জন এবং বিপক্ষে ৩ জন অবস্থান নেন। এভাবে কেয়ারটেকার সরকার বাতিল হয়। কিন্তু এ রায় লেখা নিয়ে সবচেয়ে বড় জালিয়াতি করেন খায়রুল হক, যা বিচার বিভাগের ইতিহাসে সবচেয়ে নিকৃষ্ট প্রতারণা ও জালিয়াতি হিসাবে চিহ্নিত থাকবে।

কেয়ারটেকার সরকার বাতিলের ক্ষেত্রে সব সময়ের মতো প্রথমে Short verdict বা সংক্ষিপ্ত রায় দেওয়া হয়। সংক্ষিপ্ত রায়ে বলা হয়, কেয়ারটেকার সরকার বাতিল করা হলো। তবে পরবর্তী ২টি নির্বাচন কেয়ারটেকার সরকারের অধীনে হতে পারে। সুতরাং সকলে ধরেই নিয়েছিলেন যে, ২০১৪ এবং ২০১৮ সালের নির্বাচন কেয়ারটেকার সরকারের অধীনে হবে। এর পরেই সে Big fruad বা মহাজালিয়াতি হয়।

এরপর পূর্ণাঙ্গ রায় লেখার কথা। এ ধরনের অতীব রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সম্পর্কিত রায় প্রধান বিচারপতিই লিখে থাকেন। এক্ষেত্রেও খায়রুল হকই রায় লেখার দায়িত্ব নেন। জাস্টিস খায়রুল হক অবসর গ্রহণ করেন ২০১১ সালের ১৭ মে। অথচ তিনি পূর্ণাঙ্গ লিখিত রায় দাখিল করেন ২০১২ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর। অর্থাৎ অবসর গ্রহণ করার ১৬ মাস পর তিনি এ রায় দাখিল করেন। সাবেক প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহা দ্ব্যর্থহীন ভাষায় ঘোষণা করেন যে, অবসর গ্রহণের পর কোনো বিচারপতি আইনগতভাবে কোনো রায় লিখতে পারেন না। তবে অনেক সময় বড় এবং গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে অবসর গ্রহণের পর দু’তিন মাস পর্যন্ত রায় লেখা যেতেও পারে। কিন্তু সংক্ষিপ্ত রায় ঘোষণার ১৬ মাস পর কোনো অবসরপ্রাপ্ত ব্যক্তি পূর্ণাঙ্গ রায় লিখতে পারেন না।

একে তো খায়রুল হক অবসর গ্রহণের ১৬ মাস পর রায় জমা দেন। তারপরেও পূর্ণাঙ্গ রায়ে তিনি আর একটি জালিয়াতি করেন। সংক্ষিপ্ত রায়ে বলা হয়েছিলো যে, পরবর্তী দু’টি নির্বাচন কেয়ারটেকার সরকারের অধীনে হতে পারে। কিন্তু পূর্ণাঙ্গ রায়ে এ অংশটি তিনি বাদ দেন। অর্থাৎ পরবর্তী দু’টি নির্বাচন যে কেয়ারটেকার সরকারের অধীনে হতে পারে এ অংশ তিনি বাদ দেন। ফলে রায়টি শুধুমাত্র এমন হয় যে, কেয়ারটেকার সরকার বাতিল করা হলো। এতবড় জালিয়াতি পৃথিবীর কোনো বিচার বিভাগে হয়নি।

সুপ্রীম কোর্ট দেশের সর্বোচ্চ আদালত। সেখানে জাস্টিস খায়রুল হকের এ অপকর্ম রাষ্ট্রদ্রোহীতার পর্যায়ে পড়ে। তাই বিএনপির মহাসচিব যথার্থই বলেছেন যে, রাষ্ট্রদ্রোহের অপরাধে খায়রুল হকের বিচার হওয়া উচিত।

খায়রুল হকের বিচার সম্পর্কে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর আমীর ড. শফিকুর রহমান তার ফেসবুক পেজে দেওয়া পোস্টে বলেন, “অপেক্ষায় রইলাম। এবিএম খাইরুল হক ফ্যাসিস্ট আমলে প্রধান বিচারপতির দায়িত্বে ছিলেন। নাহ, কোনোমতেই তিনি তার দায়িত্বের মর্যাদা উপলব্ধি করেননি এবং আমানত রক্ষা করেননি।

এই মর্যাদাপূর্ণ চেয়ারে বসে ইতিপূর্বে কেউ দেশ ও জাতির এত বড় ক্ষতি করেনি। তার হঠকারী রায়ের মাধ্যমে রাজনৈতিক মাফিয়াদের হাতে গুম, খুন, লুণ্ঠনসহ সকল অপকর্মের লাইসেন্স ও হাতিয়ার তুলে দেওয়া হয়েছিল। তাকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী দেরিতে হলেও পাকড়াও করেছে। জাতি এখন তার সুষ্ঠু বিচার এবং ন্যায্য শাস্তি দেখতে চায়। তার ক্ষেত্রে আমরা শুধু ন্যায়বিচারই প্রত্যাশা করি। ন্যায়বিচারেই তিনি ইতিহাসের শিক্ষণীয় শাস্তি পাওয়ার উপযুক্ত হবেন-এই আশাই রাখি।”

বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব এ্যাডভোকেট রুহুল কবির রিজভী বলেন, খায়রুল হককে সবার আগে গ্রেফতার করা উচিত ছিলো। দেরি হলেও তাকে গ্রেফতার করা হয়েছে এ কারণে ডক্টর ইউনূসকে আন্তরিকভাবে ধন্যবাদ জানাই। এ ধরনের সত্যিকার অর্থেই যারা দুর্বৃত্ত তাদের বিচার হোক। যাতে আর কোনোদিন নতুন করে গণতন্ত্র বিরোধী কোনো ধরনের আইন প্রণয়ন করতে না পারে।

খায়রুল হক সম্পর্কে আজ এখানেই শেষ করছি। তার সম্পর্কে আগামীতে আরো কয়েকটি কলাম লিখতে হতে পারে। যেমন বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা। বেগম খালেদা জিয়াকে ক্যান্টনমেন্টের বাড়ি থেকে উচ্ছেদসহ আরো অনেক বিতর্কিত রায়।

[email protected]