প্রতিপক্ষ বিরোধী দলের নেতাদের শায়েস্তা করার জন্য ২০০৮ সালের বিতর্কিত নির্বাচনের পর ক্ষমতায় এসে পুরনো আইন সংশোধন করে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনাল চালু করেছিলেন শেখ হাসিনা। আইন সংশোধন করেই তিনি ক্ষান্ত হননি। এর রেট্রোসপেকটিভ ইমপ্যাক্টও দেয়া হয়েছিল। যে ট্রাইব্যুনাল ও বিশেষ আইনটি প্রণয়ন করা হয়েছিল বিদেশী নাগরিক ও যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য, সে আইনকে নিজের নিজ দেশের নাগরিক তথা রাজনৈতিক প্রতিপক্ষদের দমনে শেখ হাসিনা নির্দয়ভাবে ব্যবহার করেছিলেন। খায়েশ পূরণও হয়েছে তার। একে একে জামায়াত ও বিএনপির ৬ শীর্ষ নেতাকে ফাঁসি দিয়ে হত্যা করা হয়েছে। ভিকটিম সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরিসহ অনেকেই তখন বলেছিলেন এই ট্রাইব্যুনাল যেন অব্যাহত রাখা হয়। তাহলে ক্ষমতার পালাবদল হলে হয়তো শেখ হাসিনাকেও বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হতে পারে। সেই কথা যে এভাবে মিলে যাবে কে জানতো। শেখ হাসিনার প্রতিষ্ঠিত সে ট্রাইব্যুনালেই গত সোমবার এক ঐতিহাসিক রায়ে মানবতাবিরোধী অপরাধ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হওয়ায় শেখ হাসিনাকে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করেছে ট্রাইব্যুনাল। এ দৃষ্টান্ত আবারও প্রমাণ করলো, ‘দিন কারো সমান যায় না আর পরের জন্য গর্ত করলে সে গর্তে একসময় নিজেকেও পড়তে হয়।’ শেখ হাসিনা অপরাধ করে পার পেলেন না। বিশ্বের ইতিহাসে কোনো নারী সরকার প্রধানের বিরুদ্ধে মৃত্যুদণ্ড ঘোষিত হওয়ার নজির এবারই প্রথম। আরো অনেক নিন্দনীয় রেকর্ডের সাথে আরো একটি রেকর্ড করার সুযোগ মিলে গেল শেখ হাসিনার।
শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে যে পূনর্গঠিত ট্রাইব্যুনালে যে অভিযোগগুলো আনা হয় সেগুলো কবল হত্যা কিংবা নির্যাতন সংক্রান্ত নয় বরং স্পষ্টতই ছিল মানবতাবিরোধী অপরাধ। শুধু জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের সময়ই দেড় হাজারের বেশি মানুষকে বর্বরোচিতভাবে হত্যা কিংবা ১৫ হাজারের বেশি মানুষকে আহত করাই নয় বরং তার শাসনামলের পুরোটা সময় গুম, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের মতো অপরাধ সংঘটিত হয়েছে নিয়মিতভাবেই। এর বাইরেও বিএনপি নেতা-কর্মীদের ওপরে এবং একটা সময় পর্যন্ত জামায়াতে ইসলামীর কর্মীদের ওপরেও পরিকল্পিতভাবে হেফাজতে নির্যাতন, গায়েবি মামলাসহ নানা রকম নিপীড়নও মানবতাবিরোধী অপরাধের আওতায় পড়েছে। যদিও সাম্প্রতিক রায়টি কেবল জুলাই হত্যা সংশ্লিষ্ট অপরাধের কারণেই। আশা করা হচ্ছে, খুব দ্রুত অন্যান্য মানবতা বিরোধী অপরাধেও শেখ হাসিনার সাজা ঘোষিত হবে।
শেখ হাসিনাকে দোষী সাব্যস্ত করে রায়ে ট্রাইব্যুনাল তার রায়ে বলেন, প্রথম ঘটনা হচ্ছে উসকানি, দ্বিতীয়টি হত্যা করার আদেশ, তৃতীয়টি হচ্ছে নিষ্ঠুরতা প্রতিরোধে নিক্রিয়তা এবং দুর্বৃত্তদের বিরুদ্ধে শান্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে ব্যর্থতা, যা আন্তর্জাতিক অপরাধ আইনের সংশ্লিষ্ট বিধান অনুসারে শাস্তযোগ্য। এ তিন ঘটনায় মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য স্বাভাবিক মৃত্যু না হওয়া পর্যন্ত কারাদণ্ড দেওয়া হলো। রায়ে আদালত আরো বলেন, “অনেকগুলো ঘটনা আছে। একটি হচ্ছে আন্দোলনকারীদের হত্যা করতে শেখ হাসিনা ড্রোন, হেলিকপ্টার ও লেথাল উইপন ব্যবহারের আদেশ দিয়েছেন, যার মাধ্যমে তিনি মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ সংঘটন করেছেন। রায়ে আরও বলা হয়, চারখাঁরপুলে ছয়জনকে হত্যা, যা সংঘটিত হয়েছে তাঁর আদেশের পরিপ্রক্ষিতেই সংঘটিত হয়েছে। একইভাবে অন্য একটি ঘটনায় তিনি একইভাবেৎ মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছেন। এ ঘটনায় আশুলিয়ায় ছয়জনকে হত্যার পর লাশ পুড়িয়ে দেওয়া হয়। রায়ে ট্রাইব্যুনাল বলেন, ‘এই তিনটি ঘটনায় শেখ হাসিনাকে একটি সাজা প্রদানের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছি, যা হচ্ছে মৃত্যুদণ্ডের সাজা।’
শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলার প্রথম মামলাটির রায়ে প্রত্যাশিতভাবেই পাঁচটি অভিযোগের মধ্যে তিনটির জন্য তিনি সর্বোচ্চ শাস্তি, মৃত্যুদণ্ড পেয়েছেন। বাকি দুটির জন্য পেয়েছেন আমৃত্যু কারাদণ্ড। গত বছরের ১৮ জুলাই শেখ হাসিনার সঙ্গে শেখ ফজলে নূর তাপসের এবং পরবর্তী সময় হাসানুল হক ইনুর কথোপকথন অনুযায়ী শেখ হাসিনা ড্রোন ব্যবহার করে আন্দোলনকারীদের অবস্থান নির্ণয়, আন্দোলনরত ছাত্র-জনতাকে হেলিকপ্টার ও লেথাল উইপন ব্যবহার করে হত্যার নির্দেশ দেন। অপরাধ সংঘটনে আসামীরা তাঁদের অধীনস্থ ব্যক্তিদের কোনো বাধা প্রদান করেননি। ফলে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট চানখাঁরপুলে ছয়জন আন্দোলনকারীকে পুলিশ গুলী করে হত্যার ঘটনা ঘটে। একই দিন পুলিশ কর্তৃক আশুলিয়ায় ছয়জন আন্দোলনকারীকে হত্যার পর লাশ পুড়িয়ে দেওয়া হয়।
এ তিনটি ঘটনায় জুলাই আন্দোলনের সময়ে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় দোষী সাব্যস্ত করে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। গণ-অভ্যুত্থানের সময় হত্যাকাণ্ডসহ মানবতাবিরোধী অপরাধের ঘটনায় এ প্রথম কোনো মামলার রায় হলো। অপর আসামি সাবেক পুলিশপ্রধান চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনকে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। রায়ে জানানো হয়, বাংলাদেশে শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খান কামালের সম্পত্তি রাষ্ট্রের অনুকূলে বাজেয়াপ্ত হবে। এ মামলা সংশ্লিষ্ট যাঁরা ২০২৪ সালের জুলাই আন্দোলনে নিহত হয়েছেন, তাঁদের কনসিডারেবল অ্যামাউন্ট (উল্লেখযোগ্য পরিমাণ) আন্দোলনকারীদের ক্ষতিপূরণ দিতে সরকারকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি আহত আন্দোলনকারীদের আঘাতের মাত্রা ও ক্ষতি বিবেচনায় পর্যাপ্ত ক্ষতিপূরণ দিতে পদক্ষেপ নিতে বলা হয়েছে।
এর বাইরে মানবতাবিরোধী অপরাধের এ মামলায় অপর অভিযোগের তিনটি ঘটনায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালকে আমৃত্যু কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। ওই ঘটনাটি হচ্ছে, ২০২৪ সালের ১৪ জুলাই গণভবনে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে শেখ হাসিনা আন্দোলনকারীদের ‘রাজাকারের বাচ্চা’ সম্বোধন করে উসকানিমূলক বক্তব্য দেন। একই দিন রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি মাকসুদ কামালের সঙ্গে শেখ হাসিনার কথোপকথন আন্দোলনকারীদের রাজাকার বলে তাঁদের ফাঁসি দেবে বলে উসকানি ও আদেশ দেন এবং অপরাধ সংঘটনে আসামিরা তাঁর অধীন ব্যক্তিদের কোনো বাধা প্রদান করেননি। ফলে রংপুরে আবু সাঈদকে পুলিশ গুলি করে হত্যা করে। এ তিনটি ঘটনায় শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খান কামালকে আমৃত্যু কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে।
রায়ে সাবেক আইজিপি চৌধুরি আব্দুল্লাহ আল মামুনের অপরাধ প্রমাণিত হলেও তাকে তুলনামূলক কম সাজা হিসেবে ৫ বছরের কারাদণ্ড দিয়েছে ট্রাইব্যুনাল। এর কারণ হিসেবে আদালত বলেন, এ মামলার বিচারের ক্ষেত্রে তিনি অবদান রেখেছেন পরিস্থিতি সম্পর্কে তাঁর জানা সম্পূর্ণটা ও সত্য প্রকাশের মাধ্যমে। এমনকি তিনি স্বীকার করেছেন এবং তিনি ৩৬ দিনের আন্দালনের সব ঘটনায় সম্পৃক্ত ছিলেন। তাঁর অবদান, স্বীকার করার সঙ্গে বস্তুগত সাক্ষ্যপ্রমাণ বিবেচনায় তাঁর সাজা প্রদানের ক্ষেত্রে নমনীয়তা দেখানো হচ্ছে, যেখানে অপরাধের সম্পৃক্ততায় সর্বোচ্চ শাস্তি। কিন্তু তাঁর অবদান বিবেচনায় নিয়ে তাঁকে পাচ বছরের কারাদণ্ড প্রদান করা হয়েছে।
শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে গণ-অভ্যুত্থান পৃথিবীর ইতিহাসে এক অভাবনীয় উদাহরণ হয়ে থাকবে। কোনো রকমের অস্ত্র ছাড়া শুধু নৈতিক শক্তিকে পুঁজি করে যে ছাত্র জনতা রাষ্ট্রীয় বাহিনীর বিরুদ্ধে রাজপথে নেমে এসেছিল তাদের বিরুদ্ধে শেখ হাসিনার নির্দেশে অকল্পনীয় বর্বরতা চালানো হয়েছে। জনগণের ট্যাক্সের টাকায় কেনা অস্ত্র ব্যবহার করা হয়েছে করদাতা জনগণের বিরুদ্ধেই। বিক্ষোভ দমনে শেখ হাসিনা ঠাণ্ডা মাথায় মারণাস্ত্র ব্যবহার করতে নির্দেশ দিচ্ছেন এমন ফোন রেকর্ড আছে। আল-জাজিরা এবং বিবিসির মতো প্রতিষ্ঠান তাদের ডকুমেন্টারিতে সেই অডিও ব্যবহার করার জন্য নিজেরা ফরেনসিক টেস্ট করে নিশ্চিত হয়েছে সেটা তাঁরই কল রেকর্ড; কোনো প্রযুক্তির সহায়তায় তৈরি করা নয়। এক্ষেত্রে বিশেষভাবে উল্লেখ করতে হয় যে, জাতিসংঘের মানবাধিকার হাইকমিশনকে দিয়ে একটি পূর্ণাঙ্গ তদন্ত করানো শেখ হাসিনার বিচারের ক্ষেত্রে অন্তর্বর্তী সরকারের একটা অসাধারণ সিদ্ধান্ত ছিল। সে তদন্তের রিপোর্টে সংস্থাটি জানিয়েছিল, জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের সময় বাংলাদেশে উচ্চমাত্রায় মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত হয়েছিল। এসব অপরাধের সিদ্ধান্ত, নেতৃত্ব, পরিচালনা এবং সমন্বয়ের ক্ষেত্রে শেখ হাসিনাই ছিলেন প্রধান ব্যক্তি।
যদিও রয়টার্সকে দেয়া সাক্ষাতকারে তাৎক্ষনিক প্রতিক্রিয়ায় শেখ হাসিনা এ রায়কে মিথ্যা, বানোয়াট ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে আখ্যা দিয়েছেন তবে বাস্তবতা হলো, আওয়ামী লীগের প্রাণভোমরা হিসেবে বিবেচিত শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে দেয়া এ রায়ের প্রতিক্রিয়ায় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের যতটা সহিংস ও বিক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া প্রত্যাশা করা হয়েছিল বাস্তবে তার কিছুই দেখা যায়নি। আর আইনের প্রক্রিয়ার কথা যদি বলা হয়, তাহলে শেখ হাসিনার হাতে এখন একটাই অপশন আছে আর তাহলো দেশে এসে সারেন্ডার করে কারাগারে যাওয়া এবং এক মাসের মধ্যে এ রায়ের বিরুদ্ধে সুপ্রীম কোর্টের আপীল বিভাগে আপীল করা। কেননা আন্তর্জাতিক অপরাধ আইন অনুযায়ী কোনো পলাতক আসামী পলাতক থাকা অবস্থায় তার বিরুদ্ধে দেয়া রায়ের বিপরীতে আপীল করার সুযোগ পাবেন না।
রায়ের পর জুলাই ভিকটিম ও যোদ্ধাসহ সবার দাবি শেখ হাসিনাকে ফিরিয়ে এনে বিচারের মুখোমুখি করা এবং ভারতকে হাসিনাকে বন্দী হিসেবে বিনিময় করতে বাধ্য করা হোক। তবে বাস্তবতা হলো, শেখ হাসিনার জীবদ্দশায় তাঁকে দেশে এনে রায় কার্যকর করা যাবে, এ সম্ভাবনা এখনো দেখা যাচ্ছে না। ভারত সরকার যেভাবে তাঁর আশ্রয় ও নিরাপত্তা বিধান করছে তাতে এটা প্রায় নিশ্চিত যে ভারত শেখ হাসিনাকে ফেরত দেবে না। ভারতের মানসিকতার প্রমাণ পেতে পারি স্বয়ং প্রধান উপদেষ্টাসহ বাংলাদেশ বারবার আপত্তি জানানোর পরও ভারত শেখ হাসিনাকে ক্রমাগত বাংলাদেশের বিরুদ্ধে উসকানিমূলক কথা বলায় বাধা দিচ্ছে না। এমনকি রায় ঘোষণার আগের দিনও তিনি তাঁর বক্তব্যে গণ-অভ্যুত্থানের শক্তিগুলোর বিরুদ্ধে মারাত্মক সব হুমকি দিয়েছেন।
তাছাড়া শেখ হাসিনা এবং তার অনুসারীরা এ বিচার নিয়ে নানা ধরনের অভিযোগ তুলেছেন, নানা বিষয়ে আপত্তি উপস্থাপন করেছেন। কার্যত শেখ হাসিনার আমলে এই ট্রাইবুনালেই বিচারের নামে যেভাবে প্রহসন করা হয়েছে, সেদিক থেকে চিন্তা করলে আসামী শেখ হাসিনা অনেক বেশি সুযোগ পেয়েছেন। যদিও তিনি সাহস করে দেশে এসে এই বিচারিক প্রক্রিয়া মোকাবেলা করতে পারেননি যেমনটা জামায়াতের শীর্ষ নেতারা করেছিলেন। জামায়াত নেতাদের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলায় বিদেশ থেকে আইনজীবী বা পর্যবেক্ষক কাউকেই আসার অনুমতি দেয়া হয়নি। মানবাধিকার কত সংস্থা তখন আপত্তি জানিয়েছিল, বিচারের প্রক্রিয়া অস্বচ্ছ, আন্তর্জাতিক মানসম্মত নয়- এগুলো বলে বিবৃতি দাবি করেছিল। আওয়ামী লীগ পাত্তা দেয়নি। বলেছিল, এগুলো নাকি আসামী পক্ষের লবিস্টরা টাকা দিয়ে নিয়ে এসেছে।
অথচ শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে যেসব অপরাধে মৃত্যুদন্ডের রায় দেয়া হলো তা সর্বতোভাবে দৃশ্যমান এবং এগুলো সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত। ফ্যাসিবাদী আমলে জাতিসংঘ এবং জাতিসংঘ মানবাধিকরা কমিশনের নানা অবজারভেশন নিয়েও আওয়ামী লীগ পরিহাস করেছে। আর শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং রিপোর্ট দিয়েছে খোদ জাতিসংঘই। জাতিসংঘের ঐ রিপোর্টের রেফারেন্সও মামলার রায়ে বারবার দেয়া হয়েছে। এ রায় আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে উত্তীর্ণ এবং এক্সপার্টদের রেফারেন্সে সমৃদ্ধ একটি রায়। আওয়ামী আমলে ট্রাইব্যুনালের রায় লিখে দেয়া হতো বিদেশ থেকে। জনৈক আহমেদ জিয়াউদ্দিন এই গুরু দায়িত্বটা পালন করতেন। এটি স্কাইপে স্ক্যান্ডালের মাধ্যমে গোটা দেশ জানতে পেরেছে। এ অনিয়ম ও বিচারিক অনাচারের বিষয়টি তখনকার আওয়ামী নেতাদের অনেকেই জানতেন কিন্তু এরপরও তারা বরদাশত করেছিলেন। এছাড়া প্রসিকিউশন আর বিচারকদের মধ্যে সখ্যতা ছিল ওপেন সিক্রেট। অথচ সে বিচার তাদের কাছে ভালো ছিল, গ্রহণযোগ্যও ছিল। অথচ এবারের বিচার নিয়ে তাদের যত আপত্তি।
আওয়ামী আমলের আরেকটি বাস্তবতার কথাও বলা দরকার। ঐ আমলে জামায়াত বা যে কোনো মহলকে বিবৃতি দিতে কিংবা রায়ের প্রতিক্রিয়া জানানোর ক্ষেত্রে খুব সতর্ক থাকতো। বিবৃতির একটি শব্দও কোনোভাবে যেন আদালতের বিরুদ্ধে না যায়, সে জন্য অসংখ্যবার সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা এডিট করতেন। এরপরও জামায়াতের তৎকালীন দায়িত্বশীলদের অনেককেই ভুগতে হয়েছে। মাওলানা রফিকুল ইসলাম খান, সেলিম উদ্দিনকে আদালত অবমাননার মামলা ফেইস করতে হয়েছে। বর্ষীয়ান সাংবাদিক ও দৈনিক সংগ্রামের সাবেক সম্পাদক আবুল আসাদকে আদালতের কাঠগড়ায় গিয়ে দাঁড়াতে হয়েছে। অথচ এবার শেখ হাসিনার রায়ের পর অনেককেই নানা ধরনের আগ্রাসী মন্তব্য করতে দেখা গেল। কিন্তু কারো বিরুদ্ধেই তেমন কোনো প্রতিক্রিয়া বা আদালত অবমাননার পদক্ষেপ চোখে পড়লো না। এমন বাস্তবতার আলোকে বলা যায়, শেখ হাসিনার মামলাটি যেভাবে উন্নত বিচারিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে অগ্রসর হয়েছে আর রায়ের পর এত সরব ভূমিকার পরও তার সমর্থকেরা যেভাবে স্বস্তিতে আছেন, সেদিক থেকে তারা অনেকটাই সৌভাগ্যবান। তবে রাজনীতিবিদ হিসেবে শেখ হাসিনার গ্রহণযোগ্যতা এ রায়ের মাধ্যমে শেষ হয়ে গেল। আইনের উর্ধ্বে কেউ নয় এবং প্রত্যেককে তার কর্মফল ভোগ করতে হয়- এ সত্যগুলো জনগণ যেন নতুন করে অনুধাবন করলো। আশা করছি, রাজনীতিবীদসহ সংশ্লিষ্ট সকল মহল শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে দেয়া এ মৃত্যুদণ্ডের রায় থেকে যথাযথ শিক্ষা গ্রহণ করবেন।