মোসাদ্দেক হোসেন

বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চল বরং এক অনুভূতির নাম যেখানে জনপদ আছে, নদী আছে, ইতিহাস আছে। এ অঞ্চল এক অবহেলিত জনপদের নামও। নানা সমস্যায় সীমান্তে প্রায়ই ঝড়ে পড়ে প্রাণ। ১৬ এপ্রিল ২০২৫। লালমনিরহাটের হাতীবান্ধা সীমান্ত। এদিন বাংলাদেশ ভূখণ্ডে প্রবেশ করে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী (BSF)। ধরে নিয়ে যায় এক তরুণ হাসিনুর রহমানকে। কিছুক্ষণের মধ্যে তার ডান চোখে গুলি করে হত্যা করা হয় বলে প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান। হৃদয়বিদারক এ ঘটনার একদিন পেরিয়েও তা হলো না কোনো জাতীয় পত্রিকার প্রথম পাতায়, থাকলো না টিভি টকশোর আলোচনায়, হলো না তীব্র কোনো প্রতিবাদ। কারণ কি, সে উত্তরবঙ্গের সন্তান?

এটাই কি আমাদের রাষ্ট্রের নীতি? ঘটনা যদি রাজধানীতে ঘটে, তবে তা সংবাদ। আর মৃত্যু যদি সীমান্তে ঘটে, তবে তা নিছক পরিসংখ্যান? সীমান্ত হত্যাকাণ্ড নতুন কিছু নয়। ২০০০ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত মানবাধিকার সংগঠনগুলোর তথ্য অনুযায়ী, বিএসএফের হাতে প্রাণ গেছে ১,২৩৬ জন বাংলাদেশির, আহত হয়েছেন আরও সহস্রাধিক। ২০২৪ সালেও নিহত হয়েছেন অন্তত ২৫ জন, যাদের অধিকাংশই ছিলেন উত্তরাঞ্চলের দরিদ্র কৃষক বা দিনমজুর। অথচ আন্তর্জাতিক আইনে সীমান্তে প্রাণঘাতী অস্ত্রের ব্যবহার কেবল চূড়ান্ত পর্যায়ে অনুমোদিত। বাস্তবে কিন্তু উত্তর সীমান্তে এই নীতি প্রতিদিন লঙ্ঘিত হয়।

এমন প্রেক্ষাপটে প্রশ্ন আসে কেন সীমান্ত হত্যাগুলো রাষ্ট্রীয়ভাবে গৃহীত তীব্র প্রতিবাদের ভাষা পায় না? কেন আন্তর্জাতিক মঞ্চে কূটনৈতিক চাপের মুখে ফেলতে পারি না প্রতিবেশী রাষ্ট্রকে? একদিকে যখন সীমান্তে খুন হয় আমাদের নাগরিক, তখন অন্যদিকে রাষ্ট্রীয় নীরবতা যেন সেই হত্যাকেই বৈধতা দেয়।

এর পেছনে আছে দীর্ঘমেয়াদি এক প্রান্তিকীকরণ। উত্তরবঙ্গ দীর্ঘদিন ধরে অবহেলিত অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিকভাবে। এক সময় মঙ্গাপীড়িত নামে পরিচিত এই জনপদ আজো অবকাঠামো, কর্মসংস্থান ও শিক্ষার দিক থেকে পিছিয়ে। এই বৈষম্য শুধু উন্নয়নেই নয়, গণমাধ্যম কাভারেজ এবং নীতিনির্ধারণেও স্পষ্ট। ঢাকার এক মহল্লায় একটি অগ্নিকাণ্ডে যেভাবে মিডিয়া তৎপর হয়, পঞ্চগড় সীমান্তে একটি প্রাণহানি তেমন প্রতিক্রিয়া তো দূরে থাক, জানাও যায় না।

এমন উদ্বেগজনক পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য তিনটি স্তরে পদক্ষেপ জরুরি :

১. রাষ্ট্রীয় দায়বদ্ধতা : সীমান্ত হত্যা বন্ধে জোরালো কূটনৈতিক পদক্ষেপ নিতে হবে। প্রতিটি মৃত্যুর জন্য জবাবদিহিতা চাইতে হবে, এবং তা আন্তর্জাতিক মহলে তুলে ধরতে হবে।

২. গণমাধ্যমের দায়িত্ব : ‘প্রান্তের মানুষও মানুষ’-এ দর্শনকে কেন্দ্র করে সংবাদ কাভারেজ নিশ্চিত করতে হবে।

৩. উত্তরবঙ্গের উন্নয়ন : আলাদা বরাদ্দ, পরিকল্পনা এবং রাজনৈতিক গুরুত্ব দিতে হবে, যাতে মানুষ কেবল বেঁচে না থাকে-সম্মান নিয়ে বাঁচে।

হাসিনুরের মৃত্যু আমাদের রাষ্ট্র, সমাজ ও মিডিয়ার এক ভয়াবহ শূন্যতার দিকে আঙুল তুলেছে। সীমান্তে পড়া একটি লাশ যেন কেবল মৃতদেহ নয় তা একটি প্রশ্ন, একটি চ্যালেঞ্জ। আমরা যদি এ প্রশ্নের জবাব না দিই, তবে ভবিষ্যতে আরও অনেক হাসিনুর রক্তাক্ত ইতিহাসে হারিয়ে যাবে। রক্ত কথা বলে-এ আশাবাদ থাকুক। কিন্তু সে রক্তের ভাষা বুঝতে আমাদের বিবেককে জাগাতে হবে, কণ্ঠে আনতে হবে প্রতিবাদের জোর।

লেখক : শিক্ষার্থী, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়।