অধ্যক্ষ মিজানুর রহমান

সাড়ে চারশ’ কোটি বছরের এ পৃথিবীটা মূলত একই মানচিত্র। কালের ব্যবধানে মানুষ এ অখণ্ড মানচিত্রকে বিভাজন করা শুরু করে। বর্তমানে দু’শতাধিক ভাগে ভাগ করে ভিন্ন ভিন্ন রাষ্ট্রীয় মানচিত্র, পতাকা, সংবিধান রচিত হয়েছে। এসব রাষ্ট্রে আর সময়ের ব্যবধানে রাজনৈতিক ক্ষমতার পরিবর্তন ও পলাবদল একটি চলমান প্রক্রিয়ার রূপ ধারণ করেছে। মানচিত্র, পতাকা, সংবিধান, রাজনৈতিক ক্ষমতার পালাবদলের বিনিময়ে পরিপূর্ণভাবে মানবাধিকার নিশ্চিত হয়েছে এটা হলফ করে বলা যাবে না।

কালের বিবর্তনে বিশ্ব মানচিত্র যে কারণে বিভাজন করা হয়েছে, তার উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য অনেকাংশেই বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়ে ওঠেনি বলে রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের ধারণা। তারা মনে করেন, অধিকাংশ দেশের নাগরিকরা তাদের জীবনের বিনিময়ে যে স্বাধীনতা অর্জনের মাধ্যমে যে মানচিত্র ও সার্বভৌমের অধিকারী হয়েছেন, সে অর্জিত স্বাধীনতা আদতে কতটুকু অর্থবহ হয়েছে এটা একটা আন্তর্জাতিক প্রশ্ন বটে। এরপর প্রশ্ন হলো, মানবরচিত সংবিধানের কত শতাংশ সেদেশের জনগণ ধারণ করতে পেরেছে এটিও প্রশ্নাতীত ব্যাপার।

বর্তমানে পৃথিবীতে প্রচলিত গণতন্ত্র, রাজতন্ত্র ও স্বৈরতন্ত্রের অনুসারী অন্তত ৬৫টি দেশে চলছে মানবাধিকার ও মানচিত্র দখলের যুদ্ধ। প্রতিনিয়ত বিশ্বের প্রভাবশালী রাষ্ট্রগুলো ছোট ছোট রাষ্ট্রযন্ত্রকে প্রতিনিয়ত-ধামকি দিচ্ছে আণবিক, পারমাণবিক ও রাসায়নিক অস্ত্রে ব্যবহারের। যে কারণে সমগ্র বিশ্ববাসী এক চরম ঝুঁকিতে দিনাতিপাত করছেন।

প্রাচীনকালে কোন আলাদা দেশ, মানচিত্র, জাতীয় পতাকা, সংবিধান বা ক্ষমতাধর কোন রাজনৈতিক দল ছিলনা। তখন মানুষ গোত্রভিত্তিক পাহাড়ে জঙ্গলে বসবাস করতো। অন্ন যোগাড় করে ক্ষুধা নিবারণ ও প্রজনন করা ছাড়া তাদের আর কোন আশা আকক্সক্ষা ছিল না। কালের বিবর্তনে মানুষ জননিরাপত্তার স্বার্থে পাহাড়ের গুহায় বা গাছের ডুম দিয়ে প্রাচীর নির্মাণ করে বিশ্রাম করা শুরু করে। এরপর আসে বস্ত্র পরিধান অভ্যাস, সংখ্যা গণনা শেখার পালা। প্রচলিত নীতির লঙ্ঘন করলে অপরাধীকে নাকে ক্ষত দিয়ে ক্ষমা প্রার্থনার রেওয়াজ যখন থেকে শুরু হয়েছে, ধরে নেয়া যায় তখন থেকেই আইন বিচারের রেওয়াজ চালু হয়েছে। এ প্রচলিত অলিখিত রেওয়াজ থেকেই আদতে সভ্যতার ক্রমবিকাশ শুরু হয়। পরবর্তীতে গোত্রে গোত্রে সীমানা নির্ধারণী ও অধিকার প্রতিষ্ঠায় ক্ষমতার লড়াই থেকে রাজনীতির হাতে খড়ি আদি জামানার মানুষের।

কালের বিবর্তনে মেসোপোটেমিয়া সভ্যতা, সুমেরীয় সভ্যতা, ব্যবিলেনীয় সভ্যতা, এসিরীয় সভ্যতা, মিশরীয় সভ্যতা, সিন্দু সভ্যতা, চৈনিক সভ্যতা, ঈজিয়ান সভ্যতা, গ্রীক সভ্যতা, রোমান সভ্যতা, মায়া সভ্যতা, আজটেক সভ্যতা, ইনকা সভ্যতা, স্পেন সভ্যতা, গ্রীক সভ্যতা ও আরব সভ্যতার মতো বিচিত্র ধরনের সভ্যতার বির্তনের মাধ্যমে বিশ্ববাসী এখন নিজেদের আধুনিক সভ্যতার অধিকারী বলে দাবি করছে। এ দাবিটা আদতে কতটা যৌক্তিক তা পর্যালোাচনা করা যুক্তিযুক্ত ভেবেই আজকের এ লেখা।

জ্ঞান-বিজ্ঞান, শিল্প- সাহিত্য, তথ্য ও প্রযুক্তি বিষয়ক যথেষ্ট সভ্যতার কারণেই বিংশ শতাব্দী আধুনিক সভ্য হিসেবে পরিগণিত হচ্ছে। কালের বিবর্তনে জ্ঞানের উন্মুক্ত ব্যবহারে মানুষ পূর্বেকার তুলনায় যথেষ্ট উৎকর্ষ সাধন করতে সক্ষম হয়েছে। অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসা ও সংস্কৃতিতে এক অভূতপূর্ব সফলতা লাভ করেছে এ শতাব্দীর মানবজাতি।

মানবসৃষ্টির পর থেকেই তাদের কিসে কল্যাণ আর কিসে অকল্যাণ সাধন সম্ভব তা মহান স্রষ্টা ছাড়া আর কেউ বেশি বুঝবে এটা স্বীকার্য নয়। তিনি মানবজাতিকে সৃষ্টির পর মহান সৃষ্টিকর্তা যুগে যুগে অসংখ্য নবী ও রাসুলকে প্রেরণ করেছেন। তাদের জীবনের একমাত্র মিশন ছিল তাওহীদ, রিসালাত ও আখিরাত সম্পর্কীয়। একত্ববাদের প্রচার, তাদের আদর্শের প্রচার, ও পরকালের বিশ্বাস স্থাপনের বিষয়ে তারা মানবজাতিকে সচেতন করতেন।

পৃৃথিবীতে যত সম্পদ আছে, তন্মধ্যে মানবজাতি যেমন শ্রেষ্ঠ, তেমনি সবচেয়ে নিকৃষ্ট প্রাণী হিসেবেও এদের জুড়ি নেই। শিক্ষিত, জ্ঞানী ও ডিগ্রী অর্জন করলেই সভ্য হয়না। সভ্য মন আর বিবেক যদি অশিক্ষিত থেকে যায় তাহলে এ প্রজাতির সভ্যতার পরাজয় অনিবার্য। এজন্য শিক্ষা, প্রশিক্ষণও গবেষণা ব্যবস্থাপনার টেকসই উন্নয়ন করা অনিবার্য। শিক্ষা, সংস্কৃতি সাহিত্য দর্শন ও গবেষণা বিপন্ন মানবতার অমানবিক রোগারোগ্যের যে প্রতিষেধক। দেশে যে সমাজে এসব বিষয়ে উদাসীন ও অসতর্ক সে দেশ তত পিছিয়ে পড়বে বলে প্রমাণিত।

পৃথিবীর জীবন প্রকৃতিকে সাজাতে হলে এসব বিষয়ে গুরুত্ব দেওয়া সময়ের দাবি। ক্ষণিকের এ নশ্বর জীবনকে অর্থবহ করতে হলে সময়কে মূল্যায়ন করতে হবে। যুগের চাহিদা মোতাবেক জ্ঞানার্জন করতে হবে, ভাষাজ্ঞান ও কারিগরি শিক্ষার প্রতি মনোনিবেশ করতে হবে। ইনসান কিভাবে ইনসানিয়াত অর্জন করতে পারে সে বিষয়ে শিক্ষা কারিকুলাম ঢেলে সাজাতে হবে।

বর্তমান পৃথিবীতে লোভ হিংসা অহংকার, অশ্লীলতা, নেশা, যৌনাচার, খুন, গুম, অত্যাচার, অনাচার শতগুণে বেড়েছে। সে সাথে ক্ষমতার দাম্ভিকতা জলবায়ু পরিবর্তন ও প্রাকৃতিক দুর্যোগকেও হার মানিয়েছে। পৃথিবীব্যাপী এখন একটাই শ্লোগান “বিপন্ন পৃথিবী-বাঁচাও মানবসভ্যতা”। কারণ এখনও পৃথিবীর বহুদেশে মারণাস্ত্রের যুদ্ধ চলছে। আণবিক পারমাণবিক অস্ত্রের ভয়ে দিনাতিপাত করতে হচ্ছে সমগ্র পৃথিবীর মানুষকে। নৈতিক অবক্ষয় আজ দৃশ্যমান। অর্থনৈতিক শোষণ, রাজনৈতিক নিপীড়ন, আর সাংস্কৃতির আগ্রাসন গোটা পৃথিবীকে এক মহা গোলক ধাঁধায় ফেলে দিয়েছে। সুদ, ঘুস, মাদক, অশ্লীল আকাশ অপসংস্কৃিতর সয়লাব হয়ে গেছে সমস্ত দুনিয়া।

দুর্নীতি আর অমানবিক কর্মযজ্ঞ পৃথিবীর সমস্ত অর্জিত সভ্যতাকে ম্লান করে দিয়েছে। সকল সেক্টরে সৎ ও যোগ্য লোকের আজ দারুণ অভাব। জননিরাপত্তা ও মানবাধিকার আজ প্রশ্নবিদ্ধ। এর প্রধান কারণ হলো, অধিকাংশ মানুষ তার সৃষ্টিকর্তাকে আদতে অস্বীকার করা শুরু করছে, তাঁর প্রদত্ত বিধানের পরিবর্তে মানবরচিত মতাদর্শকে প্রাধান্য দিতে শুরু করেছে। মূলত সৃষ্টিকর্তাই তো সবচেয়ে ভাল জানেন যে, কী নিয়মে, কোন বিধানের আলোকে মানুষ তাদের দৈনন্দিন জীবন পরিচালনা করলে তাদের কল্যাণ হতে পারে। অপরদিকে কী করলে মানুষের বিপদ আপদ ও অকল্যাণ নেমে আসতে পারে।

এ বিষয়গুলো বিবেচনা করেই তিনি যুগে যুগে পথ প্রদর্শক পাঠিয়েছেন। এবং অতঃপর সবশেষে এমন একজন পথপ্রদর্শক ও বার্তাবাহক পাঠালেন যিনি মাত্র ২৩ বছরের ব্যবধানে একটি অসভ্য দুনিয়াকে সভ্যতার কেন্দ্রবিন্দুতে নিয়ে আসতে সক্ষম হয়েছিলেন। যে কারণে তার সমকক্ষ আর কোন বক্তি পৃথিবীতে আগমন ঘটেনি, ভবিষ্যতেও আগমন ঘটবে না বলে বিশ্ববিখ্যাত জীবন বিধান ‘আল কুরআন’ এ এটি দৃপ্তকন্ঠে ঘোষিত হয়েছে।

মাত্র ২৩ বছরে নাযিলকৃত এ গ্রন্থের মূল আলোচ্য বিষয় মাত্র কয়েকটি শব্দে প্রকাশ করা যেতে পারে, তাহলো, তাওহীদ, রিসালাত, তাকওয়া, তামান্না, জান্নাত ও জাহান্নাম। অর্থাৎ একক, সতর্কবার্তা, আত্মগঠন, আশা-ভরসা ও আরাম-ব্যারাম। এই শব্দগুলোর বিষয়বস্তু বোঝাবার জন্যই এতবড় একটি বই মানুষের জন্য আকাশ থেকে মহান আল্লাহপাক সময় ও পরিস্থিতির আলোকে সর্বজনীন ও বিশ্বজনীনভাবে নাযিল করেছেন।

যাঁরা এসব শব্দের ব্যাখ্যা নিজেরা বুঝবে এবং অপরকে বুঝাবে তাঁরা হলেন বার্তাবাহক হযরত মুহাম্মাদের অংশীদার। তাঁদের জন্য অতঃপর যাঁরা এদের অনুসারী হয়ে দুনিয়ার জীবনযাপন করতে সচেষ্ট হবেন, তাদের জন্য রয়েছে রবের নিকট মহাপুরস্কার চিরস্থায়ী জান্নাত বা আরামদায়ক ভুবন। আর যারা এর আংশিক বা সম্পূর্ণভাবে বিপরীত জীবন যাপন করবে তাদের জন্য রয়েছে অস্থায়ী অথবা চিরস্থায়ী জাহান্নাম বা পীড়াদায়ক জগত। যা কোন পৃথিবীর কোন প্রাণী দেখা ও অনুভব করার ক্ষমতা রাখেন না। এখানেই সৃষ্টিকর্তার একক বাহাদুরী, যার সমকক্ষ আর কেউ নেই।

তদুপরি এ ঐশী বিধানের অনুসারীদের উগ্রবাদী, মৌলবাদী ও ধর্মান্ধতার তকমা দিয়ে এক শ্রেণির ভোগবাদী, বস্তুবাদী, নাস্তিক্যবাদীরা নিজেদের খেয়াল খুশি মতো সংবিধান রচনা করে সে আলোকে জীবন যাপন করতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন, আদতে তারা মরীচিকায় পানি খুঁজে তা দিয়ে নিজেদের ও অধিবাসীদের তৃষ্ণা নিবারণের বৃথা চেষ্টা করে চলেছেন শত শত বছর যাবৎ। মূলত তারা পানির সন্ধানও পায়নি, তৃষ্ণা মিটাতে পারেনি। পরিণতিতে ইহজগতে ও পরজনমে মহাসর্বনাশ ছাড়া আর কিছুই তাদের ভাগ্যে জুটেনি।

লেখক : সাংবাদিক।