জাফর আহমাদ
পৃথিবীতে শান্তি নেমে আসে আল্লাহর প্রতি আনুগত্য ও আত্মসমর্পণের মাধ্যমে। ইসলামের মূল লক্ষ্য হলো, সামাজিক শান্তি, নিরাপত্তা ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে আখিরাতের মুক্তি সুনিশ্চিত করা। আমরা সকলেই জানি মানুষসহ সকল সৃষ্টির সৃষ্টিকর্তা মহান আল্লাহ। তিনি প্রকৃতি সৃষ্টি করেছেন এবং প্রকৃতির জন্য একটি নিয়মও বেঁধে দিয়েছেন। প্রকৃতির নিয়মের সাথে মিল রেখে তিনি মানুষের স্বভাব-প্রকৃতিও তিনি সৃষ্টি করেছেন। প্রকৃতি আল্লাহর একান্ত বাধ্যগত। তাই মানুষ যখন আল্লাহর আনুগত্য করে এবং নিজেকে তাঁর কাছে সমর্পণ করে, তখন প্রকৃতি তার অনুকুলে যায়। প্রকৃতি তাকে সকল প্রকার সাহায্য-সহযোগীতা করে। ইসলামে মৌলিক লক্ষ্যকে বাস্তবায়ন করার জন্য প্রধান কাজ হলো, আল্লাহ নির্দেশিত ও রাসুলুল্লাহ (সা:) প্রদর্শিত জীবন ব্যবস্থার কাছে নিজেকে সমর্পণ করে দেয়া। এ আত্মসমর্পনের মাধ্যমেই মানুষ দুনিয়ার শান্তি ও আখিরাতের মুক্তি সুনিশ্চিত হয়। এর মাধ্যম সামাজিক শান্তি ও নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠা লাভ করে। সমাজব্যবস্থার সর্বস্তরে সৎকর্ম ও ন্যায়বিচার চালু হয়। সামাজিক সম্প্রীতি, পারস্পরিক শ্রদ্ধা, ভালবাসা, সহনশীলতা, সহাবস্থান মানুষের ব্যক্তি চরিত্রকে মাধুর্যপুর্ণ করে তুলে। সমাজের প্রতিটি সদস্যদের মধ্যে নিচের কাজগুলো পরিলক্ষিত হয়।
মানুষকে সহজেই ক্ষমা করে দেয়।
তাদের যা আছে তাতেই সন্তুষ্ট থাকে এবং মহান আল্লাহর কৃতজ্ঞতা আদায় করে।
সে হিংসা করে না বরং দু’আ করে।
সব চাওয়া-পাওয়া আল্লাহর কাছে সোপর্দ করে দেয়।
মানবিক গুণাবলীতে সে সমৃদ্ধশালী হয়। যথা নম্রতা, ভদ্রতা, বিনয়, সহমর্মিতা, সাহায্য-সহযোগীতা, ভালবাসা, সৌহার্দপূর্ণ আচরণ ও পরশ্রীমূখরতা ইত্যাদি।
মূলত বর্তমান পৃথিবী আল্লাহর আনুগত্য থেকে বেরিয়ে যাওয়া বা আল্লাহর সামনে পুরোপুরি আত্মসমর্পণ না করার কারণে আমাদের মধ্যে উল্লেখিত গুণাবলী আর সৃষ্টি হয় না। ফলে এ স্থান আজ দখল করে নিয়েছে দ্বন্ধ, মতবিরোধ, কুৎসিত পেশীশক্তির প্রদর্শন, পরশ্রীকাতরতা ও হিংসা-বিদ্বেষ জোর-জুলুম ইত্যাদি। মানুষের মধ্যে ভালবাসা ও সহনশীলতা নেই। ফলে পৃথিবীটা অশান্তির দাবানলে জ্বলছে। কোথাও শান্তি নেই-নিরাপত্তা নেই। দিকে দিকে যুদ্বের দামামা বাজছে, বারুদের গন্ধে আকাশ-বাতাস ভারী হয়ে উঠেছে। মানুষসহ সকল জীব-জন্তু শ্বাস-প্রশ্বাস গ্রহণ করতে পারছে না। আন্তর্জাতিক নিয়ম-কানুনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন করে শক্তিশালীরা দুর্বলদের সীমানা প্রাচীর অতিক্রম করছে। মানুষের জীবন, ইজ্জত-আব্রু ও মৌলিক অধিকার মারাত্মকভাবে লুন্ঠিত হচ্ছে। এক কথায় পৃথিবীটা একটি অগ্নীগর্ভের রূপ পরিগ্রহ করেছে। পৃথিবী টা মানুষের বসবাসের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে।
পৃথিবীর বিভিন্ন জাতি-গোষ্ঠীর ন্যায় মুসলমানগণও যেদিন থেকে আল্লাহ ও তাঁর আনুগত্যকে বাদ দিয়ে অন্যান্য বিষয়ের উপর ভিত্তি করে নিজেদের জীবন গড়ে তুলছে, সেদিন থেকে তাদেরও কপাল পুড়তে শুরু করেছে। রাসুল (সা:)-এর অক্লান্ত পরিশ্রমে গড়া ‘বুনিয়ানুম মারচুচ’ ‘সুদৃঢ় প্রাচীর’এর ফাটল বা ভাঙনও সেখান থেকেই শুরু হয়েছে। বিজাতীয়দের ন্যায় মুসলমানদের মধ্যেও আজ বিভেদের পাহাড় পরিলক্ষিত হয়। আর এরই ফলশ্রুতিতে তাদের মধ্যেও অহংকার, ঘৃণা, তাচ্ছিল্য, বিদ্বেষ ও অবমাননা এবং জুলুম ও নির্যাতন দানা বেঁধে উঠেছে। অথচ এটি ছিল ইহুদী-খ্রীষ্টান ও পৌত্তলিকদের চরিত্র। জাতীয়তার ভিত্তিতে ইহুদীরা মনে করেছে তারাই আল্লাহর মনোনীত সৃষ্টি। এজন্য পৃথিবীর সকল অইসরাঈলীরা অধিকার ও মর্যাদার দিক থেকে নিম্ন পর্যায়ের। পক্ষান্তরে খ্রীষ্টানেরা বলেছে ঈশা আল্লাহর পুত্র (নাউযুবিল্লাহ), সুতরাং তারাই পৃথিবীর শ্রেষ্ট জাতি। হিন্দু জাতি পৃথিবীর অন্যান্য জাতি-গোষ্ঠী থেকে নিজেদেরকে শ্রেষ্ঠতর মনে করা ছাড়াও নিজেদের মধ্যেও অসংখ্য কঠিন ভেদনীতি চালু করে রেখেছে। তারা বর্ণাশ্রমের ভিত্তিতে ব্রাহ্মণদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠা করেছে এবং শুদ্রদের লাঞ্ছনার গভীর খাদে নিক্ষেপ করেছে। তাদের ঘরে অন্য ধর্মের কেউ ঢুকে পড়লে সেটিকে ধুয়ে-মুছে পবিত্র করে থাকে। এরাই আন্তর্জাতিক পর্যায়ে উদার গণতন্ত্র ও কট্রর সমাজনীতি শ্রেণী সংগ্রামের আগুন জ্বালিয়েছে, সাদা-কালো বর্ণবাদনীতি অসংখ্য বণী আদমের রক্ত ঝড়িয়েছে, আদিবাসী-অআদিবাসীর উচ্ছেদের সংগ্রাম তো চলছেই।
সারা পৃথিবীর চিকিৎসা বিজ্ঞানী, সমাজ বিজ্ঞানী, বুদ্ধিজীবিসহ প্রায় সকল চিন্তাবিদই আজ একটি বাস্তবতাকে খুব ভাল করে উপলব্ধি করতে সক্ষম হয়েছেন, সেটি হলো, ‘মরণব্যাধি এইডস্ থেকে বাঁচতে হলে ‘ধর্মীয় অনুশাসন মানতে হবে’ ‘ধর্মীয় জীবন-যাপন করতে হবে’। তারা নর-নারীর অবাধ মেলামেশা, উদ্দাম, উশৃংখল ও বিকৃত যৌনাচার এইডসের প্রধান কারণ হিসাবে উলেখ করেছেন। যার পরিণাম হলো নিশ্চিত মৃত্যু। আমরা বলতে চাই শুধূমাত্র মরণব্যাধি এইডস্ কেন? জীবনের সামগ্রীক কল্যাণ ও মুক্তির জন্য অবশ্যই ধর্মীয় অনুশাসন মানতে হবে। ধর্মীয় অনুশাসন বলতে আল-কুরআনের শাসনকেই বুঝায়। জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রই আজ বিশাল ধ্বংসের দিকে দ্রুতগতিতে এগিয়ে যাচ্ছে। চারদিকে শুধু অবক্ষয় আর অবক্ষয়। ব্যক্তি ও জাতীয় চরিত্রের অধঃপতন, পারিবারিক ও সামাজিক সুশৃংখল অবকাঠামোর ভাঙন, সামাজিক ও রাজনৈতিক অসহিষ্ণুতা এবং রাষ্ট্রীয় নির্যাতন ও সন্ত্রাসসহ পৃথিবী আজ এক জংগলী আবাসনের রূপ নিয়েছে। দুর্নীতি, দুষ্কর্ম ও দুঃশাসন পৃথিবীকে গ্রাস করে ফেলেছে। ভোগের রাজ্যে চলছে অত্যধিক মাতলামী। চারদিকে মানুষ মানুষের রক্তের হোলী খেলায় মেতে উঠেছে। মোটকথা মানুষের ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র ও আন্তর্জাতিক জীবন আজ মরনব্যাধী এইডস্-এ আক্রান্ত। সামগ্রীক এ ধ্বংস থেকে বাঁচতে হলে এবং সুন্দর এক পৃথিবী গড়ার জন্য আল-কুরআনের কাছে অবশ্যই ফিরে আসতে হবে। এ কুরআনকে শুধু তেলাওয়াত নয়, বরং এর গভীওে প্রবেশ করে একে অনুধাবন করতে হবে এবং কুরআন অনুযায়ী ব্যক্তি, পরিবার ও সমাজকে গড়ে তুলতে হবে।
মনে করুন, ছিপি আঁটা এক শিশি মধু, শিশির বাইর থেকে ছাটাছাটি করলে কি মধুর স্বাদ ও উপকার পাওয়া যাবে? কখনো না। বরং মধুর স্বাদ পেতে হলে ছিপি খোলে মুখে ঢালতে হবে এবং গিলতে হবে। তাহলে মধুর স্বাদ এবং উপকার দুটোই পাওয়া যাবে। আল কুরআন ছিপি আঁটা এক শিশি প্রাণ সঞ্চিবিনী মধু ও মহৌষধ। বর্তমানে আমরা এ কুরআনের বাইর থেকে ছাটাছাটি করে থাকি অর্থাৎ মাথায় রেখে সম্মান প্রদর্শন করি এবং চুমু দিয়ে, বুকে জড়িয়ে ভালবাসা প্রকাশ করে থাকি। কিন্তু তার বিশাল ভুবনে প্রবেশ করি না। আমরা যদি ভেতরে প্রবেশ করে গভীর ভাবে তেলাওয়াত করতাম এবং কুরআনের আলোকে আমাদের ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র গঠন করে পৃথিবীবাসীর সামনে এর স্বাক্ষ্যকে বাস্তবে উপস্থাপন করতে পারতাম, তবে আল কুরআনের বাস্তব কার্যকারিতা ও নৈতিক প্রভাব দেখে দুনিয়াবাসী উপলব্ধি করতে পারতো। পৃথিবী মরণব্যাধি এইডস্-এর ন্যায় এক বাক্যে বলে উঠতো যে, ঝঞ্চা-বিক্ষুব্ধ পৃথিবীকে সুস্থ জীবনে ফিরিয়ে আনতে দলে দলে কুরআনের কাছে চলো। রাসুল (সা:) মানুষের ব্যক্তি, পরিবার ও মদীনা নামক রাষ্ট্রে আল-কুরআনকে প্রতিষ্ঠা করে দুনিয়াবাসীর সামনে অনন্য নজির স্থাপন করে গেছেন। পৃথিবী বিখ্যাত রক্ত পিপাসু মানুষগুলো আল-কুরআনের বদৌলতে মানবতার পরম বন্ধুতে পরিণত হয়েছিল।
আজকের পৃথিবী অশান্তির দাবানলে জ্বলছে। কোথাও শান্তি নেই-শান্তিন নেই। শান্তির পিপাসায় মানুষ পৃথিবীর বিভিন্ন মতবাদের দ্বারস্থ হয়ে ব্যর্থ মনোরথ হয়ে বার বার ফিরে আসছে। মনে করুন বিশাল সমুদ্র, যার পানি দরুন মিষ্টি, এর পাশে দাঁড়িয়ে কোন ব্যক্তি যদি তৃষ্ণার্থ হয়ে মরতে থাকে, তবে তার চেয়ে বড় বোকা আর কে হতে পারে? সমুদ্র থেকে এক অঞ্জলি পানি পান করলেই তো তার তৃষ্ণা মিটে যায়। সারা পৃথিবীর মানুষ আজ শান্তির পিপাসায় কাতরাচ্ছে। এ পিপাসা নিবারণের জন্য চলে যাচ্ছে ড্রেনের পঁচা ও পূঁতি গন্ধময় পানির কাছে। তা পান করে রোগ-বালাই ও ব্যধি ছড়িয়ে পড়ছে মানুষের ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র ও বিশ্বময়। ড্রেনের পঁচা পানি হলো, মানুষের মনগড়া মতবাদ, যা মানুষের মস্তিস্ক প্রসূত। অথচ লোকটি আগে দেখল না তার ঘরে পানি আছে কিনা। তার ঘরে যে পানি আছে তার নাম ‘আবে হায়াত’ তথা ‘আল-কুরআন’।
আল-কুরআন মহান আলাহ রাব্বুল আলামীনের পক্ষ থেকে সকল মানুষের হেদায়াতের মশাল, দুনিয়া ও আখিরাতের মুক্তির সনদ। এটি একক কোন ব্যক্তি, গোষ্ঠী বা দলের সম্পদ নয়। বরং কুরআন সকল মানুষের এক অতুলনীয় ও অমুল্য সম্পদ। যা অবতীর্ণ করা হয়েছে মানুষদেরকে অন্ধকার থেকে আলোর পথে নিয়ে আসার জন্য। আলাহ তায়ালা বলেন, “আলিফ-লাম-রা। হে মুহাম্মদ! এটি একখান কিতাব, যা আমরা তোমার প্রতি নাযিল করেছি, যেন তুমি মানুষদেরকে জমাট বাঁধা অন্ধকার থেকে বের করে আলোতে লয়ে আস।” (সুরা ইবরাহিম : ১) আবু মুসা (রা:) থেকে বর্ণিত। রাসূল (সা:) বলেছেন: যে জ্ঞান ও সঠিক পথÑনির্দেশ দিয়ে আল্লাহ আমাকে পাঠিয়েছেন, তার দৃষ্টান্ত মাটির ওপর বর্ষিত প্রচুর বৃষ্টির মত। যে মাটি পরিস্কার ও উর্বর, তা ঐ পানি গ্রহণ করে অনেক ঘাস ও শস্য উৎপন্ন করে। আর যে মাটি শক্ত, তা ঐ পানি ধরে রাখে। আলাহ তার সাহায্যে মানব-জাতির কল্যাণ করেন। মানুষ তা নিজেরা পান করে, পশুদেরকে পান করায় এবং সেচের মাধ্যমে ফসল উৎপন্ন করে। আর কিছু অনূর্বর মাটি থাকে যা বৃষ্টির পানি ধরে রাখেনা এবং ঘাসও উৎপন্ন করেনা। এটাই হচ্ছে তার দৃষ্টান্ত যে আল্লাহর দ্বীনের জ্ঞান অর্জন করে এবং তাতে লাভবান হয়। আল্লাহ আমাকে যা দিয়ে পাঠিয়েছেন তা নিজে শিক্ষা করে এবং অন্যকে শিক্ষা দেয়। আর ঐ লোকেরও দৃষ্টান্ত যে, তার দিকে মাথা তুলেও তাকায় না এবং আমাকে আল্লাহর যে পথ-নির্দেশ দিয়ে পাঠান হয়েছে তাও গ্রহণ করেনা। (বুখারী : ৭৯, কিতাবুল ইলম,বাবু ফাদলি মান আলিমা ওয়া আল্লামা, মুসলিম : ২২৮২, আহমাদ : ২৭৬৮২)
লেখক : ব্যাংকার।