জসিম উদ্দিন মনছুরি

বিগত সাড়ে ১৫ বছর আওয়ামী দুঃশাসনে বাংলাদেশ অস্তিতিশীল রাষ্ট্রে পরিণত হয়। বিরোধীদের দমনের জন্য এমন কোন পন্থা নেই; যা অবলম্বন করা হয়নি। জুডিশিয়াল কিলিং থেকে শুরু করে প্রকাশ্য হত্যা, দমন, পীড়ন, নির্যাতন, গুম ও দুর্নীতির স্বর্গরাজ্যে পরিণত হয় প্রিয় স্বদেশ। ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য পতিত স্বৈরাচারী ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রতিবেশী দেশ ভারতের সাথে এমন কিছু চুক্তি সম্পাদন করেন যা স্পষ্ট তো দেশের অস্তিত্বের জন্য হুমকিস্বরূপ। বলা হয়ে থাকে দেশটির মদদে ভোটবিহীন নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণের সমর্থনের তোওয়াক্কা না করে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত ছিল। দেশ বিরোধী চুক্তির মধ্যে ট্রানজিটচুক্তি, আদানীর সাথে চুক্তি এবং অসম বাণিজ্যিক চুক্তি অন্যতম। স্বৈরাচারী শেখ হাসিনার পেটুয়া বাহিনীর ভয়ে জনগণ মুখ খুলতে পারেনি। এমন কি স্বাধীনভাবে মতামত প্রকাশ ও স্বাধীনভাবে চলাচলের অধিকারটুকু পর্যন্ত হারিয়েছিলো বাংলাদেশের জনগণ। ২০২৪ গণঅভ্যুত্থানে লজ্জাজনকভাবে স্বৈরাচারীর পতন হলে একে একে দুর্নীতির চিত্র উঠে আসতে থাকে। শেখ হাসিনা ক্ষমতাচ্যুত হয়ে ভারতে পলায়ন করলে জনগণ আসার আলো দেখতে পান।

ফ্যাসিবাদের পতনের পর তাদের দোসররা বাংলাদেশকে অস্থিতিশীল ও নৈরাজ্য সৃষ্টি করার জন্য নানা অজুহাতে অস্থিতিশীল করার পাঁয়তারায় লিপ্ত রয়েছে। ক্ষমতার মোহে অন্ধ হয়ে স্বৈরাচারী শেখ হাসিনা ভারতকে দেশের অভ্যন্তরের জমি দিয়ে দিতেও কুণ্ঠাবোধ করেননি। এক সাক্ষাৎকারে শেখ হাসিনা বলেছিল ভারতকে আমরা যা দিয়েছি তা তারা আজীবন মনে রাখবে। হয়তো স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব বিকিয়ে দেয়ার মত চট্টগ্রামের মিরসরাই চিকেননেক খ্যাত বঙ্গোপসাগরের তীরবর্তী প্রায় ৯০০ একর জমি ভারতকে প্রদান করে তিনি তারই হয়তো ইঙ্গিত দিয়েছিলেন। এ চুক্তির কথা সম্পূর্ণভাবে আড়াল করে রাখা হয়েছিল জনগণ থেকে। যেখানে জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে তার মাত্র ২৫ কিলোমিটার দূরে রয়েছে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্য। তাছাড়া বঙ্গোপসাগরের নিকটবর্তী হওয়ায় সেখানে ভারত যেটিও নির্মাণ শুরু করেছিল। গত ৪ সেপ্টেম্বর ২০২৫ দৈনিক আমার দেশে ‘আদানির ৯০০ একর জমি নিয়ে বিপাকে সরকার’শিরোনামে একটি সংবাদ প্রকাশিত হলে জনগণ নড়েচড়ে বসে। পতিত আওয়ামী সরকারের প্রতি জনগণের ক্ষোভ ও ঘৃণা বাড়তে থাকে। আমার দেশ নিউজের সংবাদে বলা হয়, ভারতের বিতর্কিত শিল্পগ্রুপ আদানিকে পতিত শেখ হাসিনা সরকারের দেওয়া ৯০০ একর জমি নিয়ে বিপাকে পড়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। এ জমি এমন এক স্থানে অবস্থিত, যার সঙ্গে বাংলাদেশের নিরাপত্তার স্বার্থ জড়িত। চট্টগ্রামের মিরসরাই এলাকায় অবস্থিত বঙ্গোপসাগরের সঙ্গে সংযোগকারী এ জমিটি চট্টগ্রাম, কক্সবাজার ও তিন পার্বত্য জেলায় যাতায়াতের জন্য ‘চিকেন নেক’ হিসেবে পরিচিতি। এ জমির বিষয়ে চুক্তি পুনর্মূল্যায়নের জন্য বাংলাদেশ আট মাস আগে চিঠি দিলেও ভারত এখনো পর্যন্ত কোনো জবাব দেয়নি। ঢাকা এ চিঠির জবাবের অপেক্ষায় রয়েছে। ইতোপূর্বে এ জায়গায় বাংলাদেশ নৌবাহিনীর জন্য একটি স্থাপনা (নেভাল বেস) করার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছিল।

বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ (বেজা) সূত্র জানিয়েছে, ২০১৫ সালের ৬ জুন নরেন্দ্র মোদির ঢাকা সফরকালে অনুষ্ঠিত শীর্ষ বৈঠকে বাংলাদেশে একটি অর্থনৈতিক অঞ্চল করার প্রস্তাব পেশ করে ভারত। শেখ হাসিনা তাতে সম্মতি দিলে ওই বৈঠকেই যৌথ চুক্তি স্বাক্ষর হয়। পরবর্তীতে হাসিনা বাগেরহাটের মোংলায় বা রামপালের আশপাশে ১০০ একর জমি দেওয়ার প্রস্তাব করেন। ভারত এতে আপত্তি জানালে শেষ পর্যন্ত শেখ হাসিনার সরকার মোংলার পরিবর্তে রামপালে ৩০০ একর জমি দেয়।বেজার একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা আমার দেশকে জানান, ভারত প্রথমে রামপালের ৩০০ একর জমি বুঝে নিলেও পরবর্তীতে তারা বেঁকে বসে। শেখ হাসিনার সঙ্গে করা চুক্তি অনুযায়ী তারা রামপালের পরিবর্তে বাংলাদেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের জন্য গুরুত্বপূর্ণ চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ে বঙ্গোপসাগরের কোল ঘেঁষে এক হাজার ৫৫ একর জমি দাবি করে বসে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, ২০১৬ সালের ২০ নভেম্বর ঢাকায় অবস্থিত ভারতীয় হাইকমিশন বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে একটি চিঠি দেয়। পরবর্তীতে ওই চিঠিটি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একটি ফরোয়ার্ডিংসহ বেজাকে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। ভারতীয় হাইকমিশনের চিঠিতে বলা হয়, ২০১৫ সালে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর বাংলাদেশ সফরকালে অর্থনৈতিক অঞ্চলের জন্য জমি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। এ-সংক্রান্ত চুক্তির শর্ত অনুযায়ী গত অক্টোবর মাসে (২০১৬) মিরসরাইয়ে জমি চিহ্নিত করেছে এবং সেখানে যৌথ পরিদর্শন অনুষ্ঠিত হয়েছে বলেও ভারত চিঠিতে উল্লেখ করে। মিরসরাইয়ে ভারতের চিহ্নিত ওই পরিমাণ জমি বুঝিয়ে দেওয়ার যাবতীয় ব্যবস্থা করতে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বেজাকে অনুরোধ করে বলেও জানান সংস্থাটির একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা।

বেজার একজন কর্মকর্তা জানান, ভারতকে দেওয়া ৯০০ একর জমির কোনো মূল্য নির্ধারণ করেনি বাংলাদেশ। এ ছাড়া এসব জমিতে আদানির জন্য স্থাপনা নির্মাণে সব ধরনের উন্নয়নকাজ ভারতীয় প্রতিষ্ঠান করবে এমন কথাও বলা রয়েছে চুক্তিতে। সেখানে বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠানের প্রবেশাধিকার নিষিদ্ধ থাকবে।তিনি আরো বলেন, প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য ভারতীয় এলওসির অধীনে বিকল্প হিসেবে বাংলাদেশি প্রতিষ্ঠানগুলোকে নিলাম প্রক্রিয়ায় অংশ নেওয়ার অনুমতি দেওয়ার জন্য আমরা ভারতের এক্সিম ব্যাংক ও ভারতীয় কর্তৃপক্ষকে চিঠি দিয়েছিলাম। কিন্তু তারা আমাদের ওইসব চিঠির কোনো জবাব দেয়নি। ওই কর্মকর্তা জানান, মূলত মিরসরাইয়ে আদানির এ প্রকল্পটিতে বাংলাদেশের কোনো অধিকার রাখা হয়নি। ভূমি উন্নয়ন, অবকাঠামোগত উন্নয়ন, যন্ত্রপাতি স্থাপন ও লোকবল নিয়োগ থেকে শুরু করে যাবতীয় কর্মকাণ্ড ভারতই নিয়ন্ত্রণ করবে। ‘ওই জোনে কী ধরনের কার্যক্রম পরিচালনা হবে, সেটা নিয়েও প্রশ্ন করার এখতিয়ার আমাদের নেই’ এমনটিই জানিয়েছেন ওই কর্মকর্তা। মিরসরাইয়ে যে এলাকাটিতে ৯০০ একর জমি আদানিকে দেওয়া হয়েছে, সেটির এক পাশে বঙ্গোপসাগরের বিস্তীর্ণ উপকূল। আরেক পাশে ঢাকা-চট্টগ্রাম হাইওয়ে। আদানির এ প্রকল্প থেকে ভারতের ত্রিপুরার দূরত্ব মাত্র ২৫ কিলোমিটার। মিরসরাইয়ের বিভিন্ন ঠিকাদারি কাজের সঙ্গে যুক্ত এমন কজনের সঙ্গে কথা বলে আমার দেশ। ভারতের এ প্রকল্পের বিষয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে তারা জানান, যখন কোনো এলাকায় একটি মেগা প্রকল্প হয়, সেখানে এলাকাবাসীর জন্য কিছু কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হবে এমনটি সবাই আশা করেন। কিন্তু এ প্রকল্পের ধারেকাছেও কোনো বাংলাদেশি নাগরিকের প্রবেশ নিষিদ্ধ, কাজ তো দূরের কথা। শুনেছি, এখানে ইট, পাথর ও বালুসহ প্রয়োজনীয় সবকিছুই ভারত থেকে আনা হবে। এখানে শ্রমিক হিসেবে যারা কাজ করবে, তারাও ভারতের। এমন একটি প্রকল্প কীভাবে এ দেশে চলতে পারে? এ বিষয়ে বীর মুক্তিযোদ্ধা ও সামরিক বিশ্লেষক মেজর (অব.) মোহাম্মদ মোস্তফা আমার দেশকে বলেন, শুধু ক্ষমতায় টিকে থাকার হীনমানসিকতা থেকে শেখ হাসিনা ভারতকে এই বিপুল পরিমাণ জমি বিনামূল্যে দিয়েছেন। এখানে বাংলাদেশের কোনো স্বার্থ জড়িত নয়, পুরো প্রকল্পটিই ভারতের একতরফা স্বার্থে করা হয়েছে।

মিরসরাইভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান নয়া দালানের চেয়ারম্যান মুজাহিদুল ইসলাম গণমাধ্যমকে বলেন, গত বছর ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার পতন ও পলায়নের পর এ প্রকল্প ছেড়ে ভারতীয়রা চলে গেছে। এখন সেখানে আর কেউ নেই। শেখ হাসিনার পতনের আগে ওই এলাকায় বাংলাদেশের কেউই যেতে পারতেন না। ৫ আগস্টের পর এলাকাবাসীকে নিয়ে বেজা কর্মকর্তারা সভা করেছেন। তারা আমাদের জানিয়েছেন, ৭০০ একর নিয়ে কোনো চুক্তি হয়নি। এটি শুধু মৌখিক অঙ্গীকার ছিল। ফলে এটি এখন অবমুক্ত করা যাবে। আর ৯০০ একরের বিষয়ে চু্ক্িত রয়েছে। এটি বাতিলের প্রক্রিয়া করা হবে। মিরসরাইয়ে আদানির প্রকল্পকে বাংলাদেশের পেটের মধ্যে ‘একখণ্ড ভারত’ হিসেবে দেখছেন বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক ড. মাহবুব উল্লাহ। তিনি বলেন, সেখানে বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলের নামে ভারতকে যে জমি দেয়া হয়েছে, তাতে একটি ছোট ভারত তৈরি হবে। এটি দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের জন্য মারাত্মক হুমকি যা আমাদের জন্য বড়ই বিপজ্জনক। মিরসরাইয়ে ওই জায়গাটির অবস্থান হচ্ছে ফেনীর কাছাকাছি। ভারতের জন্য যেমন একটি চিকেন নেক আছে, আমাদের দেশের জন্যও ওই জায়গাটি একটি চিকেন নেক। এটিকে বিচ্ছিন্ন করে দিতে পারলেই আমাদের অস্তিত্ব বিপন্ন হবে। এসব প্রকল্প করার আগে শুধু অর্থনৈতিক দিক দেখলেই হবে না, দেশের জাতীয় নিরাপত্তাও দেখা জরুরি।

মিরসরাইয়ে ৯০০ একর জমিতে আদানির প্রকল্পকে চালিয়ে নেওয়া দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব ও নিরাপত্তার জন্য উপযোগী নয় বলে মনে করছেন বেজার কর্মকর্তারা।

ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর ঘনিষ্ঠ আদানি গ্রুপের সঙ্গে অদ্ভুত বিদ্যুৎ সরবরাহ চুক্তি (২৫ বছর মেয়াদী চুক্তি অনুযায়ী বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জ্বালানি হিসেবে আমদানি করা কয়লা ব্যবহার হবে। কিন্তু যে পদ্ধতিতে কয়লা আমদানি করা হবে তাতে আমদানি খরচ বেশি দেখানোর সুযোগ রয়েছে। এতে আদানির মুনাফা বৃদ্ধির বিশেষ সুযোগ রয়েছে), রেল ট্রানজিট সংক্রান্ত চুক্তি (যাতে ভারতের ট্রেন বাংলাদেশের দর্শনা দিয়ে প্রবেশ করে চিলাহাটি-হলদিবাড়ি সীমান্ত দিয়ে ফের ভারতে যেতে পারে), ফেনী নদী থেকে ১ দশমিক ৮১ কিউসেক পানি প্রত্যাহার করে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের সাবরুম শহরে সরবরাহে সমঝোতা, চট্টগ্রাম ও মোংলা বন্দর দিয়ে ভারত থেকে এবং ভারতে পণ্য আনা-নেওয়ায় স্ট্যান্ডার্ড অপারেটিং সিস্টেম (এসওপি) স্বাক্ষর ইত্যাদি দেশের মানুষের মনে নানা সন্দেহ-সংশয় তৈরি করেছে। এসব চুক্তিতে বাংলাদেশের লাভ কোথায় এমন প্রশ্ন যেমন এসেছে, তেমনি প্রকাশ হয়েছে দেশের সার্বভৌমত্ব নিয়ে উদ্বেগও।

হাসিনার সরকার ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর বিভিন্ন পক্ষ থেকে ভারতের সঙ্গে হওয়া চুক্তি ও সমঝোতার পর্যালোচনা বা পুনর্বিবেচনার দাবি তোলা হচ্ছে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক শিক্ষক, বুদ্ধিজীবী আনু মুহাম্মদ বলেন, ভারত প্রসঙ্গে বাংলাদেশের জনগণের সুনির্দিষ্ট কিছু বক্তব্য, অভিযোগ ও সমস্যা আছে। এটা সাম্প্রদায়িক কোনো বিষয় নয়। এটি আধিপত্যের সমস্যা। শেখ হাসিনার সরকার শর্তহীনভাবে আত্মসমর্পণ করেছে। একের পর এক চুক্তি করেছে। এর প্রধান কারণ ছিল নির্বাচন ছাড়া চিরস্থায়ী ক্ষমতা তৈরি করা। সে কারণে তার পুরো নির্ভরশীলতা তৈরি হয় ভারত রাষ্ট্রের ওপরে। তিনি এ সময় ভারতের সঙ্গে করা সব চুক্তির পাশাপাশি অন্যান্য দেশের সঙ্গে সই করা চুক্তিগুলো প্রকাশ করার দাবি জানিয়ে বলেন, যেসব চুক্তি জনস্বার্থবিরোধী, দেশের জন্য ক্ষতিকর সেগুলো বাতিল করা, চুক্তি বাতিলের পথ অনুসন্ধান করা সরকারের প্রথম দায়িত্ব।

এ বিষয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পাদিত চুক্তি ও সমঝোতা শুধু পরররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে হয়নি, বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, সংস্থা ও প্রতিষ্ঠানের সঙ্গেও হয়েছে। এসব মন্ত্রণালয়, সংস্থা ও প্রতিষ্ঠান চাইলে তাদের চুক্তি -সমঝোতা পর্যালোচনা ও পুনর্বিবেচনা করতে পারে।

ভারতের সঙ্গে অসম চুক্তি-সমঝোতা স্মারক বাতিল করা সম্ভব কি না জানতে চাইলে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের শিক্ষক প্রফেসর ড. সাহাব এনাম খান বলেন, কোনো দেশের সঙ্গে চুক্তি বাতিলের ক্ষেত্রে আইনগত বাধ্যবাধকতা রয়েছে। চুক্তি চাইলেই বাতিল করা সম্ভব নয়। বাতিলের ক্ষেত্রে কোন চুক্তির কোন ধারায় কী আছে, সেটা বিবেচনায় নিতে হবে। তবে সমঝোতা সই যে কোনো পক্ষ সহজে বাতিল করে দিতে পারে। তিনি আরও বলেন, জনস্বার্থে সব চুক্তিই প্রকাশ করা উচিৎ। তবে কিছু চুক্তি থাকে নিরাপত্তাজনিত, হয়তো সেগুলো প্রকাশের সুযোগ থাকে না। এমন দু-একটা বাদে জনসম্পৃক্ত সব চুক্তিই প্রকাশযোগ্য।

ভারতের সঙ্গে চুক্তি বাতিল বা পর্যালোচনার বিষয়ে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা এম তৌহিদ হোসেন বলেন, ভারতের সঙ্গে যেসব চুক্তি হয়েছে, সবতো আর আমাদের মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে হয় না, সেখানে কিছু গোপনীয় আছে কি না আমার জানা নেই। তবে, বাই অ্যান্ড লার্জ যে চুক্তি হয়ে থাকে, সেগুলো কিন্তু ওপেন (প্রকাশিত)। এখানে গোপনীয় কিছু নেই। তবে অসামাঞ্জস্য চুক্তির কথা যদি বলেন, আপনি দরকষাকষি যদি করেন, সেটা করবেন চুক্তির আগে। চুক্তির পরে নয়। আর চুক্তির পর পর্যালোচনা করতে চাইলে সেটা দু’পক্ষ মিলেই করতে হবে। এক তরফাভাবে বাতিল করতে পারবেন না।

স্বাধীনতা পরবর্তী ৫৪ বছরে বাংলাদেশ ভারতকে কী সুবিধা দিয়েছে, কতটা পেয়েছে? প্রথম চুক্তিটি ছিল ২৫ বছর মেয়াদি মৈত্রী চুক্তি। এর পরপরই হয় দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য চুক্তি। দু’দেশের মধ্যকার এ বাণিজ্য চুক্তি যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের জন্য অপরিহার্য ছিল। বলা যায়, ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত দু’দেশের মধ্যে সহযোগিতার সম্পর্ক দ্রুতগতিতে এগিয়েছে। আবার একই সঙ্গে সেই সময়টা ছিল চোরাচালানের জন্য শ্রেষ্ঠ সময়। আর এতে বাংলাদেশই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ১৯৭৫ সালে আওয়ামী লীগ সরকারকে উৎখাত করার পর ফারাক্কা বাঁধসহ নানা বিষয় নিয়ে ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি ঘটেছিল। এরশাদ আমলে অবশ্য সম্পর্কের মধ্যে উত্থান-পতন ছিল কম। দু’দেশের মধ্যে সম্পর্ক নিয়ে আবারও ব্যাপক আলোচনা শুরু হয় ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর। এ সময় দু’দেশের মধ্যে সম্পর্কের ক্ষেত্রে দৃশ্যমান অনেক ধরনের অগ্রগতি দেখা দেয়। ক্ষমতা আঁকড়ে ধরার ক্ষেত্রে রাজনৈতিক সমর্থনও পেয়েছিল আওয়ামী লীগ সরকার। তবে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটলে ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক নিয়ে আবারও টানাপোড়েন দেখা দিয়েছে। বাণিজ্যব্যবস্থা নিয়ে পাল্টাপাল্টি ব্যবস্থাও নেওয়া হয়েছে। এর প্রতিক্রিয়া দেখা দিচ্ছে অর্থনীতিতে। তবে এর প্রভাব শেষ পর্যন্ত কত দূর পর্যন্ত গড়ায়, সেটাই এখন দেখার বিষয়।

বাংলাদেশের অখণ্ডতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষায় অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উচিত হবে চুক্তি ও সমঝোতা চুক্তি গুলি যাচাই-বাছাই করা এবং দেশ বিরোধী চুক্তিগুলো থেকে নিজেদেরকে সরিয়ে নেওয়া। আওয়ামী সরকার যেভাবে ভারতের সাথে দেশকে বিকিয়ে দিয়েছে তাতে দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব বড় ধরনের হুমকির সম্মুখীন বলে সংশ্লিষ্টদের অভিমত। আশা করি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দেশের স্বাধীনতা ও সর্বমোট রক্ষায় প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করবে এবং ভারতের সাথে সংঘটিত দেশ বিরোধী চুক্তিগুলো অতি শিগগির বাতিল করবে। দেশের ১৮ কোটি জনগণের এমনটাই প্রত্যাশা।

লেখক : প্রাবন্ধিক।