মো. কামরুল হাসান

বিয়ে একটি সামাজিক ও ধর্মীয় স্বীকৃতি যার মাধ্যমে দীর্ঘস্থায়ী ও টেকসই একটি বন্ধনে আবদ্ধ হয় নারী ও পুরুষ। কিন্তু আজকাল বিয়েটা বন্ধন নয়, দামি আয়োজনের প্রতিযোগিতা হিসেবে পরিগণিত হচ্ছে। দুটি মনের পবিত্র যোগসংযোগ স্থাপনের চেয়ে এখানে মুখ্যত হয় প্রদর্শন। সোকল্ড সোসাইটি ডিমান্ড! মান-সম্ভ্রমের মাপকাঠি নির্ধারণ হচ্ছে জাঁকজমকপূর্ণ আয়োজন ও খরচের উপর! পাত্রের যোগ্যতা নির্ধারণ হচ্ছে শুধু আকর্ষণীয় চাকরি আর অর্থ-সততা ও ব্যক্তিত্ব এখানে গৌণ। পাত্রির যোগ্যতার মাপকাঠি হয়ে যাচ্ছে কেবল বাহ্যিক সৌন্দর্য আর পিতার অর্থসম্পদ!

মানুষের জীবনের অন্যতম অপরিহার্য অনুষঙ্গ বিয়ে। বিয়ের মাধ্যমে একটি সার্থক ও শাশ্বত জীবন পরিপূর্ণতা লাভ করে। কিন্তু কালক্রমে এ বিয়ে এখন অনেক কঠিন প্রথার হাটে বিয়ের অনেক দাম এখন! এর নেপথ্যে আছে মূলত তথাকথিত সমাজ ও সমাজের প্রচলিত প্রথা! সমাজ আমাদের উপর কতগুলো রীতি-নীতি ও প্রথা চাপিয়ে দেয় যা সামাজিক জীব হিসেবে সর্বাগ্রে উপেক্ষা করা কঠিন। উদাহরণ হতে পারে, সদ্য স্নাতক পাশ একজন তরুণ, ২৫ বছর ছুঁইছুঁই-বিয়ের বাজারে তার দাম নেই। জন্মের পর থেকেই ছেলে মানুষ হিসেবে সমাজ কতগুলো মানসিক দায়বদ্ধতা চাপিয়ে দেয় তাকে। ভাল চাকরি, গাড়ি-বাড়ি না হলে কন্যার পিতা মাত্রই শ্লেষের ভঙ্গিতে বলবেন, “ছেলের আয়-রোজগার কত? কী করে?” অথচ একই বয়সে ভদ্রলোক নিজেও আয়-রোজগার করেন নি, গাড়ি বাড়ি নিজের উপার্জনে করতে পারেননি! ফলে, বিয়ে হচ্ছে কঠিন থেকে কঠিন। বিয়ের সামাজিক সৌন্দর্য ম্লান হচ্ছে, আধ্যাত্মিক তাৎপর্য হারিয়ে যাচ্ছে। এভাবে বিয়ে সামাজিক আনন্দের উৎসব না হয়ে চাপ ও উদ্বেগের কারণ হচ্ছে! পক্ষান্তরে, সমাজে নেতিবাচকতা স্বাভাবিক চিত্র, তথাকথিত প্রেম, অনৈতিকতা, অশ্লীলতা নরম্যালাইজ হচ্ছে। সমাজ সেটিকে স্বীকৃতি দিচ্ছে, প্রাকে-প্রাকারে এপ্রিশিয়েট করছে।

বিয়ের ক্ষেত্রেই আসে চিত্র-বিচিত্র সামাজিক বাস্তবতা। যথাযথ আয়োজন না করলে সম্মানহানি হবে-এমন বোধ প্রবলভাবে জেঁকে বসেছে। ধনী পরিবারগুলোতে এক গভীর স্নায়ু প্রতিযোগিতা চলে শুধু প্রদর্শনের জন্য, মাঝারী পরিবারগুলোতেও এটি প্রকট আর নিম্মআয়ের শ্রমজীবী পরিবারের জন্য বিবাহের উপযুক্ত কন্যা একটা উদ্বেগ যেন! বিয়ের আয়োজন মানেই দুশ্চিন্তার ঢেঁকুর! মধ্যবিত্ত, নিম্মমধ্যবিত্ত ও নিম্মবিত্ত পরিবারগুলোতে বিয়ের খরচ মেটাতে হিমশিম খেতে হয়, খরচ নির্বাহ করতে সম্পদ বিক্রয় ও ঋণের বোঝা টানতে হয়।

অনেক মেয়ের পিতা-মাতা সন্তানের বিয়ের জন্যই অর্থসঞ্চয় করেন, ফলত দুঃখ কষ্টে দিনানিপাত করতে হয়। শুধু অর্থনৈতিক সামর্থ্য না থাকার কারণে গ্রামীণ প্রত্যন্ত অঞ্চলের অনেক মেয়ের বিয়ে হতে দেরি হয় কিংবা যেনতেন লোকের সাথে বিয়ে দেয়া হয়-ফলে এক অন্ধকার অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দেয়া হয় মেয়েটিকে!

একটি স্নিগ্ধ ও শাশ্বত বন্ধনের প্রাম্ভিক পর্যায়েই দু পক্ষের অযৌক্তিক প্রত্যাশা, সামাজিক বহুমুখী চাপ, প্রথাগত আয়োজনের বাইরে গেলে আত্মীয়ের শ্লেষ, স্বজনদের মনোমালিন্য বিয়েকে কঠিন করছে। ভালোবাসা, সৌহার্দ্য ও দায়বদ্ধতার বিপরীতে মুখ্যত হচ্ছে লোক দেখানো প্রথার চর্চা ও তথাকথিত সামাজিক সংস্কৃতির অনুশীলন।

ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে প্রায় সব ধর্মই বিয়ের ক্ষেত্রে সারল্য, সৌহার্দ্য, সমতা, সংযম ও আন্তরিকতাকে প্রাধান্য দেয়। রাসূল (সা:) বলেন, “সবচেয়ে কল্যাণকর বিয়ে হলো যেখানে খরচ কম।” অথচ, ধর্মীয় রীতি-নীতি ও নির্দেশনা মানুষ তোয়াক্কা করছেনা, আড়ম্বরের অতিরঞ্জন প্রকট আকার ধারণ করছে যা আমাদের বন্ধন ও পারিবারিক সম্পর্ক কাঠামো ধ্বংস করছে।

একসময় যৌতুকের রেওয়াজ তীব্র ছিল। ছেলেপক্ষকে কনে পক্ষের উপঢৌকন, নগদ অর্থ বা স্বর্ণালঙ্কার দিতে হতো। রোজায় ইফতার, দু’ঈদে ঈদ সামগ্রী ইত্যাদি রেওয়াজ খুব প্রচলিত ছিল। চাহিদামত না দিতে পারলে স্বামীর বাড়ি পরিণত হত নরকে। উপর্যুপরি নির্যাতনের শিকার হতো নারী। এখনো কতিপয় পরিবারে এসব চিত্র নিত্য-নৈমিত্তিক! তবু সময় বদলেছে। যুগের হাওয়ায় যৌতুক আদান-প্রদানের ধরণ পাল্টেছে। তবে মুসলিম পরিবারগুলোতে যৌতুকের ভয়াবহ প্রভাব কমে আসছে বলা যায়। গ্রামীণ হিন্দুপরিবারগুলোতে এখনো যৌতুক প্রাসঙ্গিক, ঐতিহ্যের ধারক ও বাহক! এ ব্যাপারটাকেও সমূলে উৎপাটন করার পথে অগ্রসর হতে হবে। কনে পক্ষ হতে ছেলের প্রতি অযাচিত, অযৌক্তিক দেনমোহরের চাপ বিয়েকে কঠিন করে। ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্যের মধ্যে থেকে ছেলের সামর্থ্যের উপর ভিত্তি করে দেনমোহর নির্ধারণ হওয়া উচিত। দেনমোহরকে কখনোই অর্থনৈতিক মানদণ্ডে মেয়ের ভবিষ্যতে নিরাপত্তা হিসেবে আখ্যা দেয়া উচিত নয়। একটি পবিত্র বন্ধনকে শুধু টাকার অঙ্কে নিরাপত্তা দেয়াটা অত্যুক্তি, অপরিণামদর্শীতার পরিচয়। এতে করে পবিত্র বন্ধন বিয়ের অসম্মান করা হয়।

পরিশেষে, আমাদের সামগ্রিক চিন্তার সংস্কার প্রয়োজন। দৃষ্টিভঙ্গির উৎকর্ষ সাধন করতে হবে, আমাদের উপলব্ধিবোধ সারল্য, নির্মোহ ও ধর্মীয় অনুশাসন অনুধাবন করতে হবে। জীবনের সবচেয়ে পবিত্র অনুষঙ্গ বিয়েকে সহজ করতে হবে। সম্পর্কের মানের দিকে খেয়াল রাখতে হবে, বিয়েকে দাম দিয়ে নয়, মান দিয়ে উপলব্ধি করতে হবে। সরল ও সহজ বিয়ের বহুল প্রচার করতে হবে। তবেই দীর্ঘকালের ঐতিহ্যের পারিবারিক কাঠামো আবার প্রাণ ফিরে পাবে, সভ্যসমাজ বিনির্মানে আশাবাদী হওয়া যাবে।

লেখক : শিক্ষার্থী, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।