প্রফেসর তোহুর আহমদ হিলালী

সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম দেশে মানুষের মাঝে পরস্পরিক সম্পর্ক ও আর্থিক লেনদেন বড়ই কদর্যপূর্ণ। আমাদের আচার-আচরণ ও আর্থিক লেনদেন প্রমাণ করে না যে, আমরা মুসলিম। মানুষের সাথে উত্তম ব্যবহার এবং লেনদেনে স্বচ্ছতা ইসলামে গুরুত্বপূর্ণ আমল। কুরআন ও হাদিস অধ্যয়ন করলে দেখা যায় সকল নেকি রয়েছে উত্তম আচরণ ও আর্থিক লেনদেনে স্বচ্ছতার মধ্যে। সুরা হুমাজায় বলা হয়েছে, যারা মানুষকে সামনা-সামনি গালাগাল ও পেছনে দোষ প্রচার করে তাদের ধ্বংস নিশ্চিত। এতটুকু অন্যায়ের কারণে যদি ধ্বংস নিশ্চিত হয় তাহলে যারা গুম-খুন ও মানুষের প্রতি নানাভাবে জুলুম করে তাদের পরিণতি কী হতে পারে? মানুষের সাথে যারা দুর্ব্যবহার করে, কষ্ট দেয়, সম্মান নষ্ট করে এদের প্রতি আল্লাহপাকের চরম ক্রোধ প্রকাশ পেয়েছে এ সুরায় এবং বলা হয়েছে তাদের জন্য রয়েছে হুতামা। আর সেটা হলো আল্লাহর আগুন, প্রচণ্ডভাবে উত্তপ্ত-উৎক্ষিপ্ত। মোট কথা সকল সৃষ্টি আল্লাহর পরিবার এবং তাঁর পরিবার বিশেষ করে তাঁর শ্রেষ্ঠতম সৃষ্টি ও খলিফার সাথে জুলুমকারীর জন্য আল্লাহর জান্নাতে ইঞ্চি পরিমাণ জায়গাও বরাদ্দ নেই। হ্যাঁ, কেউ যদি ফিরে আসে (তওবা করে) তবে তার বিষয়টি স্বতন্ত্র।

ইসলামের আলোকে আমাদের ব্যবহারিক জীবন গড়ে না উঠায় চরিত্রের দিক দিয়ে আমরা এক নিকৃষ্টতম জাতিতে পরিণত হয়েছি। ইসলামের একটি বড়ো দিক হলো আচার-আচরণ ও লেনদেন। আচার-আচরণ ও লেনদেনে পরিশুদ্ধ না হলে পরিপূর্ণ ইসলাম মানা হয় না এবং আংশিক মানা প্রসঙ্গে আল্লাহপাক বলেন, ‘তোমরা কি কিতাবের কিছু অংশ মানবে এবং কিছু অংশ অমান্য করবে, তাহলে দুনিয়ার জীবনে রয়েছে জিল্লতি ও আখিরাতে রয়েছে ভয়াবহ আজাব’- সূরা বাকারা ৮৫। বর্তমানে সারাবিশ্বে আমরা জিল্লতির জীবনই যাপন করছি। আল্লাহপাক মুসলিম উম্মাহকে বিশ্বশাসনের জন্য বাছাই করেছেন; অথচ আজ আমরা শাসক নই বরং কাফির-মুশরিকদের দ্বারা শাসিত ও পদানত। অথচ আল্লাহপাকের বাণী, ‘তোমরা শ্রেষ্ঠতম জাতি, তোমাদের সৃষ্টি করা হয়েছে মানবজাতির কল্যাণের জন্য, তোমরা মানুষকে সৎ কাজের আদেশ দেবে ও অসৎ কাজ থেকে বিরত রাখবে’- সূরা আলে ইমরান ১১০। মানবজাতির কল্যাণের জন্যই আমাদের উত্থান এবং আমাদের দায়িত্ব হলো ভালো কাজের আদেশ ও মন্দ কাজে নিষেধ করা। এ ক্ষমতা তাদেরই যারা রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্বের আসনে সমাসীন। কালিমা তাইয়্যেবার দাবিই হলো তাগুতকে অস্বীকার করে কেবল আল্লাহকে মেনে চলা। ফলে সকল নবি-রসূলের সাথে সমসাময়িক রাজশক্তির দ্বন্দ্ব ছিল এবং এ দ্বন্দ্ব কেয়ামত পর্যন্ত থাকবে।

বিশ্বনবী (সা.) ছিলেন সদাচরণের মূর্ত প্রতীক। মানুষ কষ্ট পায় এমন কথা, আচরণ ও কাজ থেকে তিনি মুক্ত ছিলেন এবং এব্যাপারে তিনি তাঁর উম্মতকে খুবই সতর্ক করেছেন। তিনি বলেছেন, ঐ ব্যক্তি মুমিন নয়, মুমিন নয়, মুমিন নয় যার হাত ও মুখের অনিষ্ট থেকে অন্যরা নিরাপদ নয়। গীবত সম্পর্কে মহান আল্লাহপাক সতর্ক করে বলেছেন, গীবত মরা ভাইয়ের গোশতো খাওয়ার সমতুল্য। রসূল (সা.) বলেছেন, গীবত জেনা অপেক্ষাও জঘন্য। অথচ আজ মুসলমানের কাছে গীবত ডালভাতের মতো সহজ হয়ে গেছে। ফেসবুকে ঢুকলে গীবতের ছড়াছড়ি, কতভাবে মানুষের সম্মানহানি করা যায় তারই প্রতিযোগিতা চলে। হিংসা-বিদ্বেষ জঘন্যতম অপরাধ এবং এ অপরাধ শুধু কবিরা গুনাহ নয়, মানুষের নেক আমল ধ্বংসকারী এক ভয়াবহ অপরাধ। রসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, আগুন যেমন শুকনা কাঠকে জ¦ালিয়ে ভস্ম করে দেয় ঠিক তেমনি হিংসা মানুষের নেক আমল ধ্বংস করে দেয়। অথচ আমাদের সমাজে হিংসা-বিদ্বেষের চাষ হয়। দেশে খুন-খারাবি ও জুলুম-নির্যাতনের বড়ো কারণ হিংসা-বিদ্বেষ ও প্রতিশোধ পরায়ণতা। আল্লাহপাক হিংসুকের অনিষ্ট থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য সূরা ফালাকে তাঁর কাছে সাহায্য চাইতে বলেছেন। রসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, আল্লাহপাক বিশেষ বিশেষ দিনে বা মুহূর্তে তাঁর অগণিত বান্দাকে ক্ষমা করে দেন কিন্তু ক্ষমা থেকে বঞ্চিত হয় মুশরিক ও হিংসুক। হিংসুক হয় প্রতিশোধ পরায়ণ এবং সে মানুষকে ক্ষমা করতে পারে না। অথচ আল্লাহর কাছে ক্ষমা পাওয়ার সহজতম উপায় হলো তাঁর বান্দাদের ক্ষমা করা। রসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, যে তার ভাইয়ের অপরাধ ক্ষমা করবে আল্লাহপাক কিয়ামতের দিন তার অপরাধ ক্ষমা করবেন। ক্ষমা করার ফলে যদি জালেমের অপরাধ করার প্রবণতা বৃদ্ধি পায় তাহলে ক্ষমা সমর্থনযোগ্য নয়। ক্ষমা হলো মানুষকে ফিরে আসার সুযোগ দান।

আল্লাহর রসূল (সা.) সদাচরণ ও আর্থিক স্বচ্ছতার উপর খুবই গুরুত্ব প্রদান করেছেন। তাঁর বাণী, জমিনে যারা আছে তাদের সাথে সদাচরণ করো তাহলে আসমানে যিনি আছেন তিনিও তোমাদের সাথে সদাচরণ করবেন। সমাজের হতদরিদ্র মানুষগুলো নানাবিধ সেবাকর্মে নিয়োজিত। গৃহকর্মে, অফিসে, রিক্সা চালক, বিভিন্ন যানবাহনে হেলপার-ড্রাইভার, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, কল-কারখানা ও বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে নিয়োজিত কর্মী-সমাজে এদের সংখ্যাই বেশি এবং এই মানুষগুলো অল্পতেই তুষ্ট। একটু ভালো ব্যবহার পেলেই তারা খুশি। এ মানুষগুলো সম্পর্কে রসূলুল্লাহ (সা.) কতো কথাই না বলেছেন। তিনি বলেছেন, শ্রমজীবী মানুষ আল্লাহর বন্ধু। আল্লাহর বন্ধুদের সাথে উত্তম আচরণের বিনিময়ে আল্লাহপাকের সন্তুষ্টি লাভ করা সহজ। উত্তম আচরণ ঘর থেকে শুরু করে সবার সাথে করতে হবে। যে যত অবহেলিত তার সাথে উত্তম আচরণের তাগিদটা যেন তত বেশি। কত চমৎকার কথা প্রিয়তম নবী মুহাম্মদ (সা.)-এর মুখ থেকে বেরিয়ে এসেছে। তোমাদের মধ্যে ঐ ব্যক্তি উত্তম যে তার স্ত্রীর নিকট উত্তম। আবার বলেছেন, তোমাদের মধ্যে ঐ ব্যক্তি উত্তম যে তার অধীনস্থদের নিকট উত্তম। শুধু মানুষ নয়, আল্লাহপাকের সকল সৃষ্টি সদাচরণের দাবিদার। একজন মুমিন অহেতুক গাছের একটি পাতাও ছিঁড়তে পারে না।

লেনদেনে স্বচ্ছতা আমাদের দীনের প্রাণ। আমাদের সকল ইবাদত তখনই আল্লাহর নিকট গৃহীত হবে যখন আমাদের উপার্জন হালাল হবে। আমাদের মাঝে নিরেট নাস্তিকের সংখ্যা একেবারেই হাতে গোনা। বিশ্বাসীর সংখ্যাই বেশি। তাওহিদ, রেসালাত ও আখেরাত সম্পর্কে যে বিশ্বাস, আমাদের আমল তা প্রমাণ করে না। সুদ, ঘুস, ওজনে কম দেয়া, ভেজাল প্রদান, মিথ্যা কসম খাওয়া ইত্যাদি অনৈতিক কাজে আমাদের যেন কোনো জুড়ি নেই। দুর্নীতিতে আমরা চ্যাম্পিয়ন। পরকালে বিশ্বাসী ও আল্লাহর আদালতে জবাবদিহি করতে হবে এমন বিশ্বাসী লোকদের আর্থিক ক্ষেত্রে এতো অসাধুতা অকল্পনীয়। জনৈক ব্যক্তিকে মলিন বেশে মসজিদে আল্লাহর কাছে খুব কান্নাকাটি করতে দেখে রসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, তার দোয়া মঞ্জুর হবে কীভাবে যার পোশাক, খাদ্যখাবার, বাহন সবই হারাম উপার্জনের। যুদ্ধের ময়দানে এক ব্যক্তিকে বীরবিক্রমে লড়াইরত দেখে রসূল (সা.) তার সম্পর্কে বলেন, লোকটি জাহান্নামি। সাহাবায়ে কেরাম তাজ্জব হয়ে যান। আহত হওয়ার পর কষ্ট সহ্য করতে না পেরে লোকটি একপর্যায়ে আত্মহত্যা করে। পরে তার মালসামানের মাঝে একটি পেয়ালা পাওয়া যায় যা জমা দানের কথা।

এতটুকু খেয়ানতের কারণে একজন মুজাহিদকে জাহান্নামে যেতে হলে যারা রাষ্ট্রীয় সম্পদের খেয়ানত করে বা জনগণের হক নষ্ট করে তাদের পরিণতি কী হতে পারে? রসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, আমরা কাউকে দায়িত্ব প্রদান করলে এক টুকরো সুতা বা তার চেয়ে ক্ষুদ্র জিনিস যদি কেউ খেয়ানত করে তাহলে কিয়ামতের দিন খেয়ানতকারী খেয়ানতের বোঝা মাথায় করে উত্থিত হবে। আমাদের দায়িত্বও একটি আমানত। দায়িত্ব পালনে অবহেলাও খেয়ানত। রসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, কারো উপর কোনো দায়িত্ব অর্পিত হলে সে নিজের কাজ যত নিষ্ঠা ও আন্তরিকতার সাথে পালন করে, তার উপর অর্পিত দায়িত্ব সেভাবে পালন না করলে তাকে উল্টাভাবে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে। আমানত সংরক্ষণ ও প্রতিশ্রুতি পালন মানবচরিত্রের মৌলিক গুণ। এর উপর নির্ভর করে আমাদের ঈমান ও দীন। আল্লাহপাক আমাদেরকে ব্যবহারিক জীবনে দীন পরিপূর্ণভাবে পালনের তৌফিক দান করুন।

লেখক : শিক্ষাবিদ।