॥ মো. জাহিদ হাসান ॥
শিক্ষাক্ষেত্র দেশের মৌলিক কাঠামোর অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি অংশ। আমাদের দেশে শিক্ষাক্ষেত্রে উন্নয়নের লক্ষ্যে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে জেলা এবং উপজেলা পর্যায়ে সরকারি কার্যালয় রয়েছে। শিক্ষায় উন্নয়ন আনয়নে প্রতিবছর শিক্ষাখাতে বাজেটে বড় বরাদ্দ থাকে। কিন্তু তারপরও এদেশের শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে জনমনে বরাবরই একটা হতাশা বিরাজমান। এর কারণ হলো মানসম্মত ও কার্যকরী শিক্ষার অভাব। বিগত বছরগুলোতে শিক্ষাক্ষেত্রে নানা দুর্নীতি ও সঠিক পরিকল্পনার অভাবে জাতির মেরুদ- অনেকটাই ভেঙে গেছে।
আমাদের দেশের অধিকাংশ শিক্ষার্থী দরিদ্র পরিবারের। তাই সুশিক্ষা গ্রহণের মাধ্যমে উন্নত জ্ঞান অর্জনের পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের মূল লক্ষ্য থাকে একটা চাকরি পাওয়া। শুধু চাকরি বললে ভুল হবে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর শেষ করার পর একজন শিক্ষার্থী প্রাণপণে চেষ্টা করে সরকারি চাকরি পেতে। কিন্তু আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে সরকারি চাকরিকে বলা হয়া সোনার হরিণ। পর্যাপ্ত কর্মসংস্থানের অভাবে লেখাপড়া শেষে এদেশের প্রচুর শিক্ষার্থী বেকার হয়ে ঘরে বসে থাকে। যা দেশের উন্নয়নের পক্ষে হুমকিস্বরূপ। বর্তমানে দেশে মোট বেকারের সংখ্যা ২৬ লাখ ৬০ হাজার। ২০২৩ সালের একই সময়ে এ সংখ্যা ছিল ২৪ লাখ ৯০ হাজার। সে হিসাবে এক বছরের ব্যবধানে দেশে বেকার মানুষের সংখ্যা বেড়েছে ১ লাখ ৭০ হাজার (৬ জানুয়ারি, ২০২৫) বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) প্রকাশিত প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে। বেকারত্বের পেছনে দেশের দারিদ্র্য ও জনসংখ্যা বৃদ্ধি, অপর্যাপ্ত কর্মসংস্থান ইত্যাদি দায়ী থাকলেও মূলত এর পেছনে চরমভাবে দায়ী রয়েছে দেশের প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থা। কেননা সুশিক্ষিত নাগরিক তৈরি হলে দেশে দক্ষ জনশক্তি তৈরি হবে, তখন জনসংখ্যা জনসম্পদে পরিণত হবে। আর জনসম্পদ তৈরি হলে কর্মসংস্থানের সুযোগ নিশ্চয় তৈরি হবে।
প্রথম থেকেই শুরু করা যাক। আমাদের দেশে অনেক শিশুর বয়স পাঁচ বছর না হতেই এখন কিন্ডারগার্টেন ও সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পাঠানো হয়। শিশুর যতœ ও পরিবেশের ব্যাপারে অভিভাবকেরা খুব বেশি সচেতন থাকে না। শুধু তাই নয়, অল্প বয়সেই শিশুকে পড়ালেখার জন্য মাত্রাতিরিক্তভাবে চাপ দেওয়া হয়। যা শিশুর স্বাভাবিক মেধাবিকাশে বাধার সৃষ্টি করে। এতো অল্প বয়সে শিশুদের পড়ালেখার চেয়ে নিয়মিত খেলাধুলা ও শারীরিক স্বাস্থ্যের দিকে বেশি নজর রাখা উচিত অভিভাবকদের। বেশিরভাগ শিশু-কিশোর অপরাধমূলক কাজে জড়িয়ে পড়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে গিয়ে অসৎ সঙ্গ পেয়ে। তাই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়ালেখার বাইরে শিশুদের পরিবেশের প্রতি খেয়াল রাখার দায়িত্ব পালন করতে হবে শিক্ষকদেরকেই। এছাড়া শিশুদের জন্য অনুশীলনমূলক নৈতিক শিক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে। যার ফলে জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার পাশাপাশি শিক্ষার্থীরা সৎ মনস্তত্বের অধিকারী হয়ে ভবিষ্যতে দূর্নীতিমুক্ত দেশ গড়তে ভূমিকা রাখবে। আমাদের দেশে দারিদ্র্যের কারণে গ্রামের অধিকাংশ শিক্ষার্থী অল্পতেই পড়ালেখা ছেড়ে শিশুশ্রমে জড়িয়ে পড়তে বাধ্য হয়।
প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, বর্তমানে দেশে শিশুশ্রমে জড়িত আছে ৪ শতাংশ শিশু। এর মধ্যে ৮ শতাংশই কোনো না কোনো ঝুঁকিপূর্ণ কাজে জড়িত। শিশুশ্রমে জড়িত এসব শিশুদের স্কুলে না যাওয়ার সম্ভাবনা আগের চেয়ে ৮ গুণ বেড়েছে। তবে লক্ষণীয় যে, দরিদ্র ও মেধাবী শিশুদের লেখাপড়া চালিয়ে যেতে সচেতনতা তৈরি ও সরকারি সহায়তার তেমন কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয় না। এটি দেশের শিক্ষা উন্নয়নের অন্যতম প্রধান একটি প্রতিবন্ধকতা। খেয়াল করলে দেখবো যে দেশের সরকারি প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের অধিকাংশ শিক্ষক পাঠদানে পর্যাপ্ত দক্ষ নয়। এর মূল কারণ বিগত বছরগুলোতে শিক্ষক নিয়োগে দূর্ণীতি এবং শিক্ষকদের যথাযথ প্রশিক্ষণের অভাব। সঠিক পাঠদানের অভাবে শিক্ষার্থীরা পড়ালেখায় প্রাথমিক ধারণা থেকে চরম বঞ্চিত হয়। যার ফল তাদের ভোগ করতে হয় পরবর্তীতে গিয়ে। স্কুল পর্যায়ে এমন অনেক শিক্ষার্থী রয়েছে যারা ইংরেজি এবং অনেক বাংলা শব্দের মোটামুটি উচ্চারণটুকু করতে পারেনা। অথচ ক্লাসের বাইরে আলাদা করে চলে শিক্ষকদের কোচিং ব্যবসা চলে, যেখানে খুব যতœসহকারে পড়ানো হয়। এছাড়া অধিকাংশ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পাঠ্যবই ঠিকভাবে না পড়িয়ে শিক্ষার্থীদের দিয়ে গাইড বইয়ের প্রশ্ন মুখস্থ করানো হয়। যা সৃজনশীল শিক্ষাপদ্ধতির চরম পরিপন্থি। অনেক আগেই সৃজনশীল শিক্ষাপদ্ধতি চালু হলেও এর কার্যকরী প্রয়োগের অভাবে অনেক শিক্ষার্থীদের জন্য এটি ফলপ্রসূ হচ্ছে না। সৃজনশীলতার অভাবে আমাদের দেশের মানুষের মধ্যে উদ্ভাবন ক্ষমতা নেই বললেই চলে। বহির্বিশ্বের তুলনায় জ্ঞান-বিজ্ঞানে আমাদের দেশ বর্তমানে অনেক পিছিয়ে রয়েছে। এর পেছনে আরও একটি বড় কারণ হলো মেধা পাচার। দেশের মাটিতে পড়ালেখা করে সব বড় বড় ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার পাড়ি জমায় বিদেশে।
সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ক্লাসরুম সংকট, কম্পিউটার ল্যাব, পাঠাগারের অভাব, বিনোদনের অভাব, শিক্ষকের অভাব যেন লেগেই থাকে। এ ধরনের সমস্যা শুধু স্কুল পর্যায়েই নয়, দেশের সরকারি কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় গুলোতেও কমবেশি রয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মধ্যে স্বেচ্ছাচারী মনোভাব একটু বেশিই লক্ষ্য করা যায়। শিক্ষকদের মূল কাজ হচ্ছে শিক্ষার্থীদের সময়মতো ক্লাস নেওয়া ও সঠিকভাবে পাঠদান করা। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক বিভাগের শিক্ষকেরা স্বাধীনতাচেতা মনোভাব ও সমন্বয়হীনতার কারণে রুটিন অনুযায়ী ক্লাস নেন না। এতে শিক্ষার্থীদের প্রচুর সময় নষ্ট হয় এবং সিলেবাসের সব পড়া শেষ না করেই পরিক্ষায় বসতে হয়। এ সমস্যা আবার সেশনজট নামক ভয়াবহ সমস্যারও কারণ। দায়িত্বরত কিছু শিক্ষকদের অপ রাজনীতি ও সুবিধাবাদি মনোভাবের কারণে এবং সঠিক পরিকল্পনার অভাবে একজন স্নাতক পড়ুয়া শিক্ষার্থীর ৪ বছরের জায়গায় কোনো কোনো বিভাগে ৬-৭ বছর লেগে যায় সার্টিফিকেট অর্জন করতে। বাংলাদেশের সরকারি আইন অনুযায়ী ছেলেদের বিয়ের বয়স সর্বনি¤œ ২১ এবং মেয়েদের ১৮ বছর। কিন্তু নানা জটিলতার কারণে আমাদের দেশের একজন ছেলে বা মেয়ে শিক্ষার্থীর পড়ালেখা শেষ করতে প্রায় ২৫ বছর সময় লেগে যায়। এরপর চাকরির নানা জটিলতায় আরও ২-৩ বছর বা তারও বেশি সময় চলে যায়।
এতো দীর্ঘ সময় একজন শিক্ষার্থীর খরচ বহন করা এদেশের অধিকাংশ পরিবারের জন্য অসহনীয় হয়ে পড়ে। তাই জট নিরসন সহ অন্যান্য সমস্যা দ্রুত সমাধান করে শিক্ষার্থীদের পড়ালেখা দ্রুত শেষ করার ব্যবস্থায় সরকারের যথাযথ উদ্যোগ নেওয়া অতি আবশ্যক। এদেশের শিক্ষাব্যবস্থায় আরও একটি বড় সমস্যা হলো কারিগরি শিক্ষার অভাব এবং পড়ালেখার বিষয় অনুযায়ী কর্মসংস্থানের অভাব। কারিগরি শিক্ষার যথাযথ প্রয়োগ থাকলে শিক্ষার্থীরা পড়ালেখা শেষে শুধু সরকারি চাকরির আশায় বসে না থেকে নিজে কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করে স্বনির্ভরতা অর্জনের মাধ্যমে দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারবে।
সভ্য ও উন্নত জাতি গঠন করতে হলে শিক্ষার কোনো বিকল্প নেই। তবে সে শিক্ষাকে অবশ্যই উন্নত ও সুশিক্ষা হতে হবে। তা না হলে শিক্ষাক্ষেত্র বেকার তৈরির কারখানায় পরিণত হবে। তাই যত দ্রুত সম্ভব আমাদের দেশের শিক্ষাব্যবস্থার নানা আঙ্গিকে প্রয়োজনীয় সংস্কারের যথাযথ উদ্যোগ নিয়ে তা বাস্তবায়ন করা প্রয়োজন। অন্যথায় প্রচলিত শিক্ষা দেশে সুনাগরিক তৈরিতে সহায়ক হবে না।
লেখক : শিক্ষার্থী, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া।