মো. রেজুয়ান খান

শ্রুতি রয়েছে যে, বৈসাবির শিকড় মূলত দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বৌদ্ধ সংস্কৃতির সঙ্গে গভীরভাবে যুক্ত। থাইল্যান্ড, মায়ানমার, লাওস ও কম্বোডিয়া এসব দেশগুলোতে একই সময়ে নববর্ষ উদযাপিত হয়- যা ‘সংক্রান্ত’ নামে পরিচিত। ধারণা করা হয়, শত শত বছর আগে আরাকান ও বার্মা (বর্তমান মায়ানমার) থেকে মারমা জনগোষ্ঠী পার্বত্য চট্টগ্রামে আসার সময় তাদের সাংগ্রাই উৎসব সঙ্গে নিয়ে আসে। একইভাবে চাকমা ও ত্রিপুরাদের নিজস্ব সংস্কৃতি ও উৎসবও ধীরে ধীরে একসঙ্গে মিলিত হয়ে ‘বৈসাবি’ নামকরণ হয়েছে। চাকমা, মারমা ও ত্রিপুরা বৃহত্তর মঙ্গোলয়েড জনগোষ্ঠীর অন্তর্গত। বৈশাখ মাসে তিব্বত থেকে শুরু করে বাংলাদেশ পর্যন্ত নতুন বছর শুরু হয়। পার্বত্য এলাকার জনগোষ্ঠীর সকলেই নিজেদের নববর্ষ পালন করে থাকে এ সময়টিতে। বৈসাবি নামটি তিনটি জনগোষ্ঠীর উৎসবের আদ্যক্ষর নিয়ে তৈরি হয়েছে। চাকমাদের ‘বিঝু’, মারমাদের ‘সাংগ্রাই’ ও ত্রিপুরাদের ‘বৈসু’- এ তিন উৎসব মিলেই ‘বৈসাবি’। তবে শুধু বৈসাবি পাহাড়ের সকল সম্প্রদায়ের নববর্ষ ও চৈত্র সংক্রান্তির অনুষ্ঠানের বহুমাত্রিকতাকে প্রকাশ করে না। এখানে স্পষ্ট করে বলা প্রয়োজন - ‘বিহু, বিঝু, বিষু, বৈসু, চাংক্রান, সাংক্রান, সাংগ্রাইন, সাংগ্রাইং নামগুলো। ‘বৈসাবি’ উৎসব নামকরণের পাশাপাশি চৈত্র সংক্রান্তি উৎসব উদযাপনে অন্যান্য উৎসবগুলোর নাম থাকলে বৈষম্য অনেকটা ঘুচে যেতো বলে মনে করা হয়। যদিও প্রতিটি জাতি-গোষ্ঠীর মধ্যে উদযাপনের ধরন কিছুটা আলাদা, তবু উৎসবের মূল চেতনায় থাকে আনন্দ, ভালোবাসা ও নতুন বছরের শুভ সূচনা। চাকমারা তিন দিনব্যাপী বিঝু পালন করে। পার্বত্য জনগোষ্ঠীর ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির বহিঃপ্রকাশ ঘটে এই উৎসবের মাধ্যমে।

নতুন বছরকে বরণ ও পুরোনো বছরকে বিদায় করতে চৈত্র সংক্রান্তির এ দিনে প্রতিবছরের ন্যায় পাহাড়ে চলছে জাঁকজমকপূর্ণ আনন্দের রব। নানা আয়োজনে জমে উঠেছে উৎসবমুখর আনন্দের এ পরিবেশ। ‘বিহু, বিঝু, বিষু, বৈসু, চাংক্রান, সাংক্রান, সাংগ্রাইন, সাংগ্রাইং বাহারি ফুল আর পাতার সমাহারে বিভিন্ন নামে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মিলনমেলায় পরিণত হবে পার্বত্য অঞ্চলের পাহাড়ি জনপদ এবং রাজধানীতে বসবাসরত পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি-বাঙালি অধিবাসী। পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের তত্ত্বাবধানে প্রতিবছরের ন্যায় এবারও রাজধানীতে বসবাসরত পাহাড়ি তরুণ-তরুণী, বৃদ্ধ, জায়া-জননীরা মিলেমিশে প্রাণের এ উৎসবে অংশ নিতে যাচ্ছে। রাজধানীর প্রাণকেন্দ্র বেইলি রোডের পার্বত্য কমপ্লেক্স হতে রমনা পার্কের লেকে ফুল ভাসানোর মধ্য দিয়ে পাহাড়ি-বাঙালিরা এবারও মেতে ওঠবে। প্রত্যাশা করা হচ্ছে যে, বাংলাদেশের দিন বদলের সাক্ষী সেসকল বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সহযোদ্ধারাও এবার মাতিয়ে তুলবে এ উৎসবকে। বৈসাবির মন-মাতানো এমন রং প্রতিবছরের চৈত্র সংক্রান্তিতে সব বয়সের পাহাড়ি মানুষের মনে দামামা হয়ে বেজে ওঠে। আগামী ১২ এপ্রিল থেকে শুরু হবে পাহাড়িদের প্রধান এই সামাজিক উৎসব। এই উৎসব ঘিরে সব সম্প্রদায়ের কৃষ্টি, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির মেলবন্ধন ঘটতে যাচ্ছে। এদিকে পার্বত্য চট্টগ্রামের আনাচে-কানাচে বৈসাবি উৎসবের রং লেগেছে। বর্ণিল সাজে সাজানো হচ্ছে পাহাড়। বসেছে আনন্দ উল্লাস আর নাচ-গানের আসর। পুরাতন বছরের বিদায় ও নতুন বছরের আগমনের উৎসব বৈসাবিকে ঘিরে নতুন সাজে সেজেছে পাহাড়ি জনপদ বান্দরবান। তঞ্চঙ্গ্যা সম্প্রদায়ের ঐতিহ্যবাহী ঘিলা খেলার মধ্য দিয়ে জেলায় আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হচ্ছে বৈসাবি উৎসব। পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয় ১২ এপ্রিল রাজধানীতে বৈসাবি শোভাযাত্রা উদ্বোধনের উদ্যোগ নিয়েছে।

১০ ভাষাভাষীর ১১টি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর নারী-পুরুষ, তরুণ-তরুণীরা বৈসাবি উৎসবে যোগ দিবে। এ মেলায় চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা ও তঞ্চঙ্গ্যা তরুণ-তরুণীদের রং বে-রঙের সাজ আনন্দ বাড়িয়ে দিবে কয়েকগুণ। বর্ষবরণ ও বর্ষবিদায় উৎসবকে পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর লোকজন ভিন্ন ভিন্ন নামে পালন করে। চাকমারা বিঝু, মারমারা সাংগ্রাই, ত্রিপুরারা বৈসু, তঞ্চঙ্গ্যারা বিসু হিসেবে পালন করে বৈসাবি উৎসবকে। বছরের শেষ দুই দিন ও নতুন বছরের প্রথম দিন এ উৎসব পালন করা হয়।

বিঝু চাকমা সম্প্রদায়ের অন্যতম প্রধান আনন্দ-উৎসব। বাংলা বছরের শেষ দুদিন ও নববর্ষের দিন এ উৎসব পালন করা হয়। ১২ এপ্রিল পালন করা হয় ফুলবিঝু। এদিন ভোরের আলো ফোটার আগেই ছেলেমেয়েরা বেরিয়ে পড়ে ফুল সংগ্রহের জন্য। সংগৃহীত ফুলের একভাগ দিয়ে বুদ্ধকে পূজা করা হয় আর অন্যভাগ জলে ভাসিয়ে দেওয়া হয়। বাকি ফুলগুলো দিয়ে ঘরবাড়ি সাজানো হয়। চৈত্র মাসের শেষ দিন অর্থাৎ ১৩ এপ্রিল পালন করা হয় মূল বিঝু। এদিন সকালে বুদ্ধমূর্তি স্নান করিয়ে পূজা করা হয়। ছেলেমেয়েরা তাদের বৃদ্ধ ঠাকুরদা-ঠাকুরমা এবং দাদু-দিদাকে স্নান করায় এবং আশীর্বাদ নেয়। এদিন ঘরে ঘরে পোলাও, পায়েস, পাচন (বিভিন্ন রকমের সবজির মিশ্রণে তৈরি এক ধরনের তরকারি)সহ অনেক সুস্বাদু খাবার রান্না করা হয়। ১৪ এপ্রিল বাংলা নববর্ষের প্রথম দিন পালন করা হয় গোজ্যেপোজ্যে দিন (অবসর বা রেস্ট নেওয়ার সময়)। রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান পাহাড়ে বসবাসকারী জনপদগুলো এই দিনে মেতে ওঠে ভিন্ন এক আনন্দে। নিজস্ব সংস্কৃতির অনুষ্ঠান ফুলি বিঝু সকলের মনকে আনন্দে রাঙ্গিয়ে দিবে এবারের এ আসর। বড় কোনো গাছ থাকলে তার নিচে প্রদীপ জ্বালিয়ে তাকে সম্মান জানিয়ে থাকে। গৃহপালিত পশুদের বিশ্রাম ও বিঝু উৎসব চলাকালে কোনো জীবিত প্রাণী হত্যা করা নিষেধ রয়েছে চাকমা সম্প্রদায়ের মধ্যে।

ত্রিপুরা সম্প্রদায়ের অন্যতম প্রধান উৎসব চৈত্র মাসের শেষ দুদিন এবং বৈশাখ মাসের প্রথম দিন এ তিনদিন ব্যাপী পালিত হয় বৈসু। ত্রিপুরাদের এ উৎসবের প্রথম দিনকে বলা হয় হারি বৈসু, দ্বিতীয় দিনকে বৈসুমা এবং তৃতীয় বা শেষ দিনটিকে বলা হয় বিসি কতাল। মূলত আগামী দিনের সুখ ও সমৃদ্ধির জন্য উপরওয়ালার কাছে প্রার্থনা করা হয়ে থাকে এ দিনে। তিনদিনব্যাপী এই বৈসু উৎসবের প্রথম দিন হারি বৈসু। হারি বৈসুতে ভোরবেলায় ফুলগাছ থেকে ফুল তোলার হিড়িক পড়ে যায়। সেই ফুল দিয়ে বাড়িঘর সাজানো ও সেই ফুল দিয়ে মন্তির ও পবিত্র স্থানগুলোতে শ্রদ্ধা নিবেদন করা হয়। বৈসাবি উৎসবের জনপ্রিয় খাবার ‘গণত্মক বা পাচন’ রান্না চলবে ত্রিপুরাদের প্রায় ঘরে ঘরে। এছাড়া পিঠা, সেমাই, মুড়ি-মুড়কি, চানাচুর, বিভিন্ন ধরনের ফল ও ঠান্ডা পানীয় তো থাকছেই। ২৫ থেকে ৩০ ধরনের সবজির মিশ্রণে রান্না করা হয় বিশেষ সবজি। এতো বিশাল সবজি আইটেম করতে গিয়ে অনেকসময় বনজঙ্গলের পরিমাণ কমে যাচ্ছে বলে ধারণা করা হয়ে থাকে।

ত্রিপুরা ও মারমাদের পানি উৎসব প্রায় কমবেশি অনেকের কাছে জনপ্রিয়। এটি বৈসাবি উৎসবেরই একটি অংশ। এ উৎসবে সবাই সবার দিকে পানি ছুড়ে আনন্দ উল্লাসে মেতে ওঠেন, যেন গত বছরের সকল দুঃখ, গ্লানি ও পাপ ধুয়ে যায়। এর আগে হয় জলপূজা। এর মাধ্যমে পরস্পরের বন্ধন আরো দৃঢ় হয়। মারমা সম্প্রদায়ের মধ্যে তাদের প্রিয় মানুষটির দিকে পানি ছিটানোর মাধ্যমে সবার সামনে ভালবাসা প্রকাশ করা হয়। ভালোবাসার এমন বর্ণাঢ্য উচ্ছ্বাস ও বর্ণাঢ্য অনুভূতি ‘গান্ধর্ব্য’ কেবল বৈসাবি উৎসবেই শোভা পায়।

বান্দরবানের তঞ্চঙ্গ্যা জনগোষ্ঠী তিনদিন ব্যাপী ঐতিহ্যবাহী বিষু উৎসব পালন করে থাকে। এদিন সাংগু নদীতে কলাপাতায় ভক্তি ও শ্রদ্ধাভরে গঙ্গাদেবীর পূজা করে থাকেন এ সম্প্রদায়ের মানুষ। বিষু উৎসবে ঘিলা খেলার মাধ্যমে তঞ্চঙ্গ্যা জনগোষ্ঠীর বিষু উৎসব শুরু হবে। তারপর ২০ থেকে ৩০ পদের সবজি দিয়ে তাদের তৈরি ঐতিহ্যবাহী পাজন ভোজন সম্পন্ন করবে। বান্দরবানের মারমা সম্প্রদায় এবার চার দিনব্যাপী সাংগ্রাই উৎসবের আয়োজন করা হয়েছে। উৎসবকে ঘিরে দুদিনব্যাপী পানিখেলা, পিঠা তৈরি, বলীখেলা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানসহ নানা আয়োজন চলবে। সাংগ্রাই উৎসবের মূল আকর্ষণ-মৈত্রী পানিবর্ষণ জলকেলি উৎসব অনুষ্ঠিত হবে। মারমা তরুণ-তরুণীরা মেতে উঠবে জলকেলি বা পানি ছিটানো খেলায়। এছাড়া দিনব্যাপী চলবে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। বৌদ্ধবিহারসমূহে (ক্যায়াং) অনুষ্ঠিত হবে মঙ্গল প্রদীপ প্রজ্বালন। এ সময় হাজার হাজার প্রদীপ প্রজ্বলনের মাধ্যমে পাহাড়ি নারী-পুরুষরা প্রার্থনায় দেশ ও জাতির মঙ্গল কামনা করবেন।

অসমের জাতীয় উৎসব হলো বিহু। বিহু সমাজের সবাই উদ্যাপন করে থাকে। এর মূলত অংশ হলো কৃষি ভিত্তিক উৎসব। বি শব্দটির অর্থ প্রার্থনা এবং শু শব্দের অর্থ শান্তি ও সমৃদ্ধি। বিশু শব্দ থেকে বিবর্তনের ধারায় বিহু শব্দের উৎপত্তি। জনশ্রুতি যে, বিহু মূলত আসামের চুটিয়া উপজাতিদের মধ্যে প্রচলিত। এক্ষেত্রে হু শব্দটি তারা দান অর্থে ব্যবহার করে থাকে। পার্বত্য চট্টগ্রামে অসম জাতি চৈত্র সংক্রান্তিতে বিহু উৎসব উদ্যাপন করে থাকে। ১১টি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী সম্প্রদায়ের বসবাস খ্যাত বান্দরবানে ম্রো সম্প্রদায় চৈত্র সংক্রান্তিতে চাংক্রান উৎসব পালনের মাধ্যমে বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেছে। প্রতিবছর বর্ষবরণ উপলক্ষে ম্রো সম্প্রদায়ের পিঠা উৎসব, ঐতিহ্যবাহী খেলাধুলা এছাড়া ম্রোদের তৈরি বিশাল আকারের বাঁশের প্লোং বাঁশি বাদ্যযন্ত্রের আকর্ষণকে বহুমাত্রায় বাড়িয়ে দিয়েছে। ম্রো সম্প্রদায়ের লোকজন ঐতিহ্যবাহী চাংক্রান উৎসবের আয়োজন চলবে এবারের ‘বৈসাবি’তে। উৎসবকে ঘিরে ম্রোরা পানিখেলা, তৈলাক্ত বাঁশে আরোহণ, লাঠি দিয়ে সৃজনশীল কায়দায় শক্তি প্রদর্শন প্রতিযোগিতা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে।

পাহাড়ের লোক সংস্কৃতি, ঐতিহ্য ও পরিচিতি চৈত্র সংক্রান্তির এসব উৎসবের মাধ্যমে প্রকাশ পাবে। পার্বত্য চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী খেলাধুলা, পিঠা উৎসব, জলকেলি উৎসব, হরেক রকমের বাহারি পোশাক পরিচ্ছদ, লোকনৃত্য পরিবেশন, গান, বাদ্য, পাজন খাওয়ার ধুম সবকিছুই উৎসুক জনতার চোখকে রাঙিয়ে ও ধাঁধিয়ে দিবে এবারের পাহাড়ি চৈত্র সংক্রান্তির বিঝু, সাংগ্রাই, বৈসু, বিষু, চাংক্রান, বিহু উৎসবগুলোকে।

লেখক: তথ্য অফিসার, পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়।