মোহাম্মদ শিশির মনির ॥

২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়। ক্ষমতা গ্রহণের পরপরই তারা বিডিআর বিদ্রোহের নামে ৫৭ জন দেশপ্রেমিক সেনা অফিসারসহ ৭৪ জনকে হত্যা করে। ১৬ বছরের শাসনামলে পর্যায়ক্রমে আওয়ামী লীগ রাষ্ট্রের সকল প্রতিষ্ঠানকে অকার্যকর করে তোলে, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা হরণ করে এবং নির্বাচন কমিশনকে একটি আজ্ঞাবহ প্রতিষ্ঠানে পরিণত করে। একইসাথে ক্ষমতা সুসংহত করার জন্য আওয়ামী লীগ রাষ্ট্রের আইন শৃঙ্খলা বাহিনীকে জনগণের মুখোমুখি দাঁড় করায়। এভাবেই বিগত ১৬ বছরে আওয়ামী লীগ বাংলাদেশেকে একটি ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্রে পরিণত করে। ফ্যাসিবাদী ও বৈষম্যমূলক শাসনের প্রতিবাদে দেশের ছাত্র-জনতা সর্বাত্মক আন্দোলন গড়ে তোলে।

২০২৪ সালের ৩৬ জুলাই সার্বজনীন আন্দোলনের মাধ্যমে একটি সফল গণঅভ্যুত্থান সংঘটিত হয়। দেশের সকল শ্রেণী-পেশার মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে এই গণঅভ্যুত্থানে অংশগ্রহণ করে। সহস্রাধিক মানুষ এই গণঅভ্যুত্থানে শহীদ হন। ২০ হাজারের অধিক মানুষ আহত ও পঙ্গুত্ব বরণ করেন। আন্দোলনের মুখে টিকতে না পেরে ফ্যাসিস্ট সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ মন্ত্রী পরিষদ পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। তৎকালীন প্রধান বিচারপতিসহ আপীল বিভাগের বিচারপতিগণও পদত্যাগে বাধ্য হন। দেশের প্রশাসনিক কাঠামো ভেঙে পড়ে। অভ্যুথান পরবর্তী সময়ে (৫ আগস্ট থেকে ৮ আগস্ট পর্যন্ত) দেশে কোন সরকার বিদ্যমান না থাকায় সাংবিধানিক শূন্যতার (Constitutional Vacuum) সৃষ্টি হয়। অকার্যকর হয়ে পড়ে সংবিধানের অনেক বিধানাবলী যেমন: প্রথম ভাগের অনুচ্ছেদ- ৭ক, ৭খ চতুর্থ ভাগের দ্বিতীয় পরিচ্ছেদের সকল অনুচ্ছেদ যথা: ৫৫, ৫৬, ৫৭, ৫৮, ৫৮ক, ৫৯, পঞ্চম ভাগের অনুচ্ছেদ যথা: ৬৫-৯২। এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য ৮ আগস্ট, ২০২৪ এ জনগণের অভিপ্রায়ের পরম অভিব্যক্তি (solemn expression of the will of the people) এবং জাতীয় ঐকমত্যের (National Consensus) ভিত্তিতে বর্তমান সরকার গঠিত হয়। সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৭ এ বর্ণিত বিধানের আলোকে জনগণের অভিপ্রায়ই (will of the people) এই সরকারের বৈধতার স্বীকৃত উৎস এবং আইনি ভিত্তি।

বর্তমান সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর ফ্যাসিবাদী অবকাঠামোর বিলোপ ও রাষ্ট্র সংস্কারের উদ্দেশ্যে বিভিন্ন সংস্কার কমিশন গঠন করে। জুলাই গণঅভ্যুত্থান ও ফ্যাসিবাদী শাসনকালীন সময়ে সংঘটিত সকল ঘৃণ্য ও মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার সম্পন্ন করতে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল পুনর্গঠন করা হয়। বর্তমানে ট্রাইব্যুনালে বিচার প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে। অন্তবর্তীকালীন সরকার বিগত ৫ আগস্ট জাতির সামনে। জুলাই ঘোষণাপত্র প্রকাশ করেছে। সরকার দেশের গণতান্ত্রিক অগ্রযাত্রাকে সুগম করতে ইতোমধ্যেই জাতীয় নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট টাইমলাইন ঘোষণা করে।

সংস্কার কমিশন কর্তৃক প্রস্তাবিত প্রস্তাবনাসমূহ সকল রাজনৈতিক দলের ঐকমত্যের (Consensus) ভিত্তিতে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন কর্তৃক গৃহীত হওয়ার প্রক্রিয়া অব্যাহত রয়েছে। যেসব প্রস্তাবনা ঐকমত্য কমিশন কর্তৃক গৃহীত হবে সেসব প্রস্তাবনার উপর ভিত্তি করেই জুলাই সনদ (July Charter) প্রণয়ন হতে যাচ্ছে। জুলাই সনদ কার্যকরের বাস্তবসম্মত পদ্ধতি নিয়ে বিভিন্ন আলোচনা-পর্যালোচনা হচ্ছে। বিদ্যমান সাংবিধানিক কাঠামোতে জুলাই সনদ বাস্তবায়নের কোন সুযোগ নেই।

জনগণের অভিপ্রায়ের পরম অভিব্যক্তিরূপে গঠিত সরকার প্রক্লেমেশনের মাধ্যমে জুলাই সনদকে সংবিধানের অংশ হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করতে পারে। ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল অস্থায়ী সরকারের পঠিত ‘স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র’ (The Proclamation of Independence, 1971) মহান মুক্তিযুদ্ধের ঐতিহাসিক জীবন্ত দলিল, যা বাংলাদেশের প্রথম সংবিধান। গুরুত্বের বিবেচনায় জুলাই সনদ একই মর্যাদার অধিকারী। ইতিহাসে যে কয়টি প্রক্রেমেশন সবচেয়ে আলোচিত তন্মধ্যে ১৮৬৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট অব্রোহাম লিঙ্কন এর ঘোষিত Emancipation Proclamation অন্যতম। এটি যুক্তরাষ্ট্রের একটি ঐতিহাসিক দলিল। এর মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের কনফেডারেট রাজ্যগুলোতে দাসপ্রথা নিষিদ্ধ করা হয়, য্য নাগরিক অধিকার এবং মুক্তি সংগ্রামের ইতিহাসের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। এছাড়াও জুলাই সনদ বাস্তবায়নের আরেকটি কার্যকরী পদ্ধতি হতে পারে গণভোট (Referendum) । জুলাই সনদের কোন বিধানের সাথে বিদ্যমান সংবিধানের কোন অংশ সাংঘর্ষিক হলে জুলাই সনদ প্রাধান্য পাবে।

স্বাধীন বাংলাদেশ অভ্যুদয়ের পূর্বাপর সময়ে বিভিন্ন ক্রান্তিকাল অতিক্রম করেছে। ১৯৭০ সালের নির্বাচনের আইনগত ভিত্তি ছিল Legal Framework Order, 1970 (LFO) । ১৯৬৯ সালের মার্চ মাসে আইয়ুব খানের পতনের পর ইয়াহিয়া খান সামরিক শাসন জারি করেন। ১৯৬২ সালের সংবিধান স্থগিত হয়ে যায়। একটি নতুন সংবিধান প্রণয়নের জন্য নির্বাচিত প্রতিনিধির প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে সাধারণ নির্বাচন পরিচালনার আইনি ভিত্তি হিসেবে Legal Framework Order, 1970 (LFO) জারি করা হয়। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিলে গঠিত ‘অস্থায়ী সরকার’ ছিল বাংলাদেশের মুক্তিকামী জনতার সার্বভৌম ইচ্ছার প্রতিফলন। পরবর্তীতে এই সরকার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি লাভ করে। স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পর ১৯৭২ সালের ১৬ ডিসেম্বর সংবিধান কার্যকর করা হয়। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট শেখ মুজিবুর রহমান নিহত হলে খন্দকার মোশতাক আহমেদ The Proclamation on August 20, 1975 এর মাধ্যমে সামরিক শাসন জারি করেন। জারিপত্রের শুরুতে বলা হয় ‘ With the help and mercy of the Almighty Allah and relying upon the blessings of the people, have taken over all and full powers of the Government ’ একই বছরে বিচারপতি আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েম The Proclamation on November 8, 1975 জারির মাধ্যমে রাষ্ট্রপতি ও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক পদে অধিষ্ঠিত হন এবং মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানসহ তিন বাহিনীর প্রধানদের উপ-প্রধান সামরিক শাসক পদে নিয়োগ প্রদান করেন। উক্ত প্রক্লেমেশনে ১৫ আগস্ট জারিকৃত সামরিক শাসন অব্যাহত রেখে বলা হয় And whereas in the interest of peace, order, security, progress, prosperity and development of the country, I deem it necessary to keep in force the Martial Law Proclaimed on 15th August, 1975 । ১৯৭৬ সালের ২৯ নভেম্বর মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ১৯৭৭ সালের ২১ এপ্রিল তিনি রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব গ্রহণের পর ২২ এপ্রিল তিনি The Proclamation Order, 1977 (Proclamation Order No. 1 ) জারির মাধ্যমে সংবিধানের আমূল পরিবর্তন নিয়ে আসেন। রাষ্ট্রপতি হিসেবে তাঁর কার্যক্রমে জনগণের ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটানোর অভিপ্রায়ে The Referendum Order, 1977 (Martial Law Order No. 1 of 1977) এর অধীনে তিনি গণভোটের আয়োজন করেন। উক্ত গণভোট আদেশের প্রারম্ভে উল্লেখ করা হয় ‘ To ascertain the confidence of the people in him and in the policies and programmes enunciated by him, a countrywide referendum would be held on 30th May, 1977 on the basis of direct adult franchise ’। উক্ত গণভোটে ৮৮ ভাগ ভোটার তার প্রতি আস্থা প্রকাশ করেন। ১৯৭৯ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি সামরিক আইনের অধীনে জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। উক্ত নির্বাচনে বিএনপি সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে। ১৯৭৯ সালে ৭ এপ্রিল গেজেট প্রকাশের মাধ্যমে সামরিক আইন প্রত্যাহার করা হয়।

৩০ মে ১৯৮১ মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান শহাদাত বরণ করলে বিচারপতি আব্দুস সাত্তার রাষ্ট্রপতির দায়িত্বে অধিষ্ঠিত হন। ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ তৎকালীন সেনাপ্রধান হোসেইন মোহাম্মদ এরশাদ সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করে নিজেকে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক (CMLA) ঘোষণা করেন। ১৯৮২ সালের ২৭ মার্চ তিনি সংসদ ভেঙে দিয়ে সংবিধান স্থগিত করেন। ১৯৮৬ সালের ১১ নভেম্বর সামরিক আইন প্রত্যাহার করে আংশিক সাংবিধাানিক শাসন বলবৎ করেন। পরবর্তীতে ১৯৮৮ সালের মার্চ মাসে সংসদীয় নির্বাচনের আয়োজন করলে দেশের সকল বিরোধী দল উক্ত নির্বাচন বর্জন করে। ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনের প্রেক্ষিতে জাতীয় ঐকমত্যের আলোকে এরশাদ তৎকালীন প্রধান বিচারপতি শাহাবুদ্দিন আহমেদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করেন।

পূর্বের শাসকগণ সামরিক আইন জারির মাধ্যমে সংবিধানের উল্লেখযোগ্য বিধানাবলি স্থগিত করেছেন। প্রয়োজনীয়তার নীতির (Doctrine of Necessity) ভিত্তিতে দেশ পরিচালনা করেছেন। কিন্তু ২০২৪ এর জুলাই গণঅভ্যুত্থান এক্ষেত্রে সম্পূর্ণ ব্যতিক্রম। এটি ধর্ম, বর্ণ, শ্রেণী ও গোত্র নির্বিশেষে দেশের সকল মানুষের অংশগ্রহণে স্বতঃস্ফূর্ত গণঅভ্যুত্থান। পরবর্তীতে অন্তবর্তীকালীন সরকারের গঠন প্রক্রিয়াও সম্পন্ন হয়েছে জনগণের পরম অভিব্যক্তির প্রতিফলনরূপে (solemn expression of the will of the people) । এ সংক্রান্তে সংবিধানের ১০৬ অনুচ্ছেদের অধীন সুপ্রিম কোর্ট যে মতামত প্রদান করেছেন এর কোন কার্যকারিতা নেই। বাংলাদেশের জনগণের ইচ্ছার সরাসরি প্রতিফলনই জুলাই ঘোষণা ও জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি। রাষ্ট্রপতির ঘোষণাপত্র (Presidential Proclamation) বা গণভোট (Referendum) জুলাই ঘোষণা ও জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি প্রদানের স্বীকৃত ও বাস্তবসম্মত পদ্ধতি।

* ১৭ আগস্ট জাতীয় সেমিনারে পঠিত প্রবন্ধ, ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউট, রমনা, ঢাকা।