ড. মোঃ আনোয়ার হোসেন
২০২৫ সালের এসএসসি ও সমমান পরীক্ষার ফল প্রকাশিত হয়েছে। এবারের এসএসসি ও সমমান পরীক্ষায় সব বোর্ডেই পরীক্ষার্থীরা খারাপ ফল করেছে। সম্প্রতি ফল প্রকাশের পর দেখা গেছে, বিগত ১৫ বছরের মধ্যে পাশের হার সর্বনিম্ন। এ বছর ফলাফলে গড় পাশের হার ৬৮ দশমিক ৪৫ শতাংশ। এবার জিপিএ-৫ পাওয়া শিক্ষার্থীর সংখ্যাও কমেছে। মোট জিপিএ ৫ পেয়েছে ১ লাখ ৩৯ হাজার ৩২ শিক্ষার্থী; আর গতবারের তুলনায় কমেছে ৪২ হাজার ১২৭। এসএসসি পরীক্ষায় সব শিক্ষা বোর্ড মিলিয়ে ফেল করেছে ৬ লাখ ৬৬০ শিক্ষার্থী। এর মধ্যে ৩ লাখ ২৪ হাজার ৭১৬ জন ছাত্র এবং ২ লাখ ৭৫ হাজার ৯৪৪ ছাত্রী রয়েছে। অর্থাৎ প্রতি ১০০ জনে ফেল করেছে ৩১.৫৫ শিক্ষার্থী। চলতি বছরের এসএসসি ও সমমান পরীক্ষায় দেশের ১৩৪টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কোনো পরীক্ষার্থী পাস করতে পারেনি।
এ বিষয়ে শিক্ষা উপদেষ্টা ড. চৌধুরী রফিকুল আবরার বলেছেন, বিগত সরকারের আমলে নিজেদের সাফল্য দেখানোর জন্য ছাত্রছাত্রীদের নম্বর বাড়িয়ে দিয়ে জিপিএ-৫-এর সংখ্যা বৃদ্ধি করে ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে ফল প্রকাশ করা হতো। এ ফলাফল প্রকাশিত হওয়ার পর কেউবা বলছেন এবার প্রকৃত মেধা যাচাই হয়েছে। এক নম্বর কম পেলেও বাড়িয়ে দিয়ে পাস করানো হয়নি। ৭৯ পেলেও এক নম্বর বাড়িয়ে দিয়ে এ প্লাস দেওয়া হয়নি। বলছেন মাগনা নম্বর এর যুগ শেষ, মেধার বাংলাদেশ। সারাদেশে ৬ লাখ ৬৬০ শিক্ষাথী অনুত্তীর্ণ হয়েছেন। এ বিষয়ে কারো কোন অনুশোচনা নেই, মাথাব্যাথা নেই, কোন ভুল নেই, কারো কোন দায়-দায়িত্ব নেই। কোন ধরনের জবাবদিহিতারও লেশমাত্র নেই। জীবনের গুরুত্বপূর্ণ দীর্ঘ দশটি বছর পথ পাড়ি দিয়ে এ একটি সনদের জন্য শিক্ষার্থীরা ও তাদের অভিভাবক অধীর আগ্রহে ছিলেন। কত স্বপ্ন ছিল তাদের মনে। সমস্যার সমাধান নিয়ে কোন পরিকল্পনা রয়েছে বলে মনে হচ্ছে না। এ ছয় লাখ শিক্ষার্থী ফেল করা মানে কমপক্ষে তিন লাখ ছাত্রছাত্রী ঝরে পড়বে। মেয়ে শিক্ষার্থীদের মধ্যে অনেকেই পড়ালেখা বন্ধ করে বিয়েতে বসতে বাধ্য হবেন।
ফলাফলের এহেন নিম্নমুখী হওয়ার অনেকগুলী কারণ থাকতে পারে। করোনা ভাইরাস সংক্রমণ হওয়ার পর হতে অদ্যাবধি বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থার ‘শি’ ও অবশিষ্ট রইল না। দীর্ঘ সময় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকার সুবাদে অনেক শিক্ষক ব্যবসায়ী অথবা বেসরকারী চাকরিজীবী বনে গেছেন। তারা এখনো ওই ব্যবসা এবং চাকরিটা মুল পেশা হিসেবে ধরে রেখেছেন, বরং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ক্লাস নেওয়াটা পার্টটাইম কাজ মনে করে করেন। একটা সময় আমরা খোঁজ খবর রাখতাম কবে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ হবে। এখন খোঁজ নিতে হয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কখনো খুলবে কিনা। যেন প্রতিযোগিতা করে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করা হচ্ছে। পৃথিবীর যত ভাইরাস ব্যাক্টেরিয়া আগাছা পরগাছাসহ মানব সৃষ্ট ও প্রাকৃতিক দুর্যোগ সবই যেন একমাত্র শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে থাকে। অন্য কোথাও এসবের যেন কোন অস্তিত্ব নেই। এক জেলায় বন্যা হলে পুরো বিভাগে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেয়া হয়। রমজান মাসে সরকারের অন্যান্য ডিপার্টমেন্ট কাজ করতে কোন সমস্যা হচ্ছে না, কেবল শিক্ষকদের ক্লাস নিতে সমস্যা। ক্লাস নিতে গেলে তাদের গলা শুকিয়ে চৌচির হয়ে যায়। ক্লাস বন্ধ হওয়া মাত্রই পুরো রমজান মাস এমনকি ঈদের দিনও শিক্ষকগণ প্রাইভেট পড়ালেও গলা শুকায় না। দাখিল আলিম ও কামিল মাদরাসার শিক্ষকগণ আরো এক ধাপ এগিয়ে। তাদের দৃষ্টিতে রমজানে ক্লাস নেওয়া ঠিক নয়। অন্যদিকে কওমি মাদরাসা রমজান মাসে কোন অবস্থাতেই বন্ধ রাখার পক্ষে নয়। ঈদের দিনও তাদের ছাত্রছাত্রীরা কালেকশনে ব্যস্ত থাকেন। অর্থাৎ শিক্ষার স্বার্থে নয়, নিজেদের ব্যক্তি স্বার্থে সবাই কাজ করেন।
বাংলাদেশে এমনও বিদ্যালয় রয়েছে যেখানে একজনও প্রকৃত ছাত্রছাত্রী নেই। অথচ বিদ্যালয়টি এমপিও ভুক্ত। এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রতিবছর ওয়েব সাইটের মাধ্যমে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরকে তাদের অনেক ছাত্রছাত্রী দেখাচ্ছেন। বাস্তবতা হলো ছাত্রছাত্রী হিসেবে বিদ্যালয়ের পার্শ্ববর্তী গৃহবধূ অথবা কিছু সংখ্যক বখাটে লোকের নাম দেখাচ্ছেন। উপবৃত্তির টাকা আত্মসাৎ করছেন। এসব বিদ্যালয়ের নামের জমিও নিষ্কণ্টক নয়। এসব বিদ্যালয় শিক্ষক নিয়োগ হয় লক্ষ লক্ষ টাকা উৎকোচ গ্রহণের মাধ্যমে। বাংলাদেশে এরকম হাজারো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রকৃতপক্ষে নিবন্ধিত হওয়ার কথা নয়।
এ ক্ষেত্রে আমি একটি ঘটনার কথা উল্লেখ করছি। আমি সবেমাত্র ১৫বছর বয়সী কিশোর, নোয়াখালী জেলা স্কুল হতে এসএসসি পরীক্ষা সম্পন্ন করে আসলাম। আড়াই মাসের মধ্যে ফলাফল পাওয়ার প্রত্যাশী। বাবা ও একই সময় সরকারি চাকরি হতে অবসর গ্রহণ করলেন। সুযোগ-এ সপরিবারে আমার প্রিয় গ্রাম-এ সময় কাটালাম। তৎকালীন ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান এবং বিদ্যালয় এর ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি আমাকে বাজারে দেখে বললেন, বাবা তোমার প্রতি আমার আবদার আছে। বাড়ি হতে মাত্র আধা কিলোমিটার দূরত্বে একটা বালিকা বিদ্যালয় রয়েছে, ওই বিদ্যালয়ের ১৬ জন ছাত্রী পরের বছর এসএসসি পরীক্ষায় অবতীর্ণ হবেন। তারা গণিতে খুব কাঁচা। অর্থাৎ আমি কলেজে ভর্তি হওয়া অবধি পরবর্তী এসএসসি পরীক্ষার্থীদের গণিত ক্লাসটা আমাকে নিতে হবে। আমি রাজি হয়ে গেলাম। ওই বিদ্যালয়ে আমি প্রায় ২ মাস ১৫ দিন ক্লাস নিয়েছিলাম। প্রধান শিক্ষিকা ইংরেজি ক্লাস নিতেন, আমি পাশের কক্ষ থেকে খুব আগ্রহ নিয়ে শুনতাম তার ক্লাস নেওয়া। আমি খুব অবাক হতাম যে তিনি একেবারে সাধারণ ইংরেজি শব্দ উচ্চারণ করতে ভুল করতেন। গ্রামারে একেবারে কাঁচা ছিলাম। চিৎকার আর খিস্তি খেউর করাটাই ছিল তার পুঁজি। ম্যানেজিং কমিটির দালালি করাটা তার এক নাম্বার কাজ ছিল। পরে অবশ্য জানলাম এ প্রধান শিক্ষিকা টাকার বিনিময়ে নিয়োগ পেয়েছিলেন। ওই বিদ্যালয়-এর গণিত কোর্স কমপ্লিট করলাম। আমার টাকা পয়সার কোনো ডিমান্ড ছিল না। তথাপি ম্যানেজিং কমিটি আমাকে ৪০০ টাকা দিল। তৎসময়ে আমাকে দিতে হবে বলে ছাত্রী প্রতি তিন হাজার টাকা করে কর্তৃপক্ষ ৪৮ হাজার টাকা সংগ্রহ করেছে। বাকি টাকা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান এবং বিদ্যালয় এর ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি সহ অন্যরা এই ৪৭ হাজার ৬০০ টাকা আত্মসাৎ করেছেন। এ হল রক্ষক হয়ে কিভাবে ভক্ষক বনে যান তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ। বাস্তবিক পক্ষে ওই গ্রামে কোন মাধ্যমিক বিদ্যালয় প্রয়োজন ছিল না। পার্শ্ববর্তী দুই গ্রামে দুটা ভালো বিদ্যালয় রয়েছে, গ্রামবাসী তাদের সন্তানদের ঐসব বিদ্যালয় পড়াতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন।
মূলত এ সকল বিদ্যালয় দুটি কারণে এখনো টিকে আছে। প্রথমত আমরা অন্যদের চেয়ে কম কোথায় অর্থাৎ ইগো। ক্ষমতাশালী ব্যক্তি-গণ আইন-কানুনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে জাল জালিয়াতি করে দলিল দস্তাবেজ প্রদর্শন করে এসব বিদ্যালয়-র অনুমোদন গ্রহণ করেন। হাজারো ভালো বিদ্যালয় এমপিও সুবিধা না পেলেও, ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে এসব ভুয়া বিদ্যালয় এমপিও করার মাধ্যমে অযোগ্য শিক্ষকগণ বছরের পর বছর সরকারের টাকা আত্মসাৎ করছেন। অর্থাৎ কিছু লোক খেয়ে পড়ে বাঁচতে হবে, এ উদ্দেশ্যেই এসব বিদ্যালয় দাঁড়িয়ে আছে। যখন যে দল ক্ষমতায় আসে তারা ক্ষমতার অপব্যবহার করে নিজেদের বাড়ির দরজায় বা মহল্লায় এই ধরনের কিছু ভুয়া প্রতিষ্ঠান সৃজন করেন।
আমরা দেশব্যাপী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মাদকবিরোধী কার্যক্রম করে থাকি। আমরা মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তর হতে হালনাগাদ তথ্য সংগ্রহ করে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ভিত্তিক ছাত্র-ছাত্রীর সংখ্যা অনুযায়ী মাদক বিরোধী লিফলেট এর প্যাকেট করে থাকি। আমি প্রতিদিন একাধিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হতে তথ্য পাই এ পরিমাণ ছাত্রছাত্রী নেই। আমার অফিস হতে তাদের বলা হয় শিক্ষা অধিদপ্তর এর তথ্য অনুযায়ী আপনার ছাত্রছাত্রী এত। তারা বলে প্রদত্ত ছাত্র-ছাত্রী সংখ্যা হতে অনেক কম রয়েছে। অনেক সময় এটাও স্বীকার করে যে বিদ্যালয় টিকিয়ে রাখার জন্য বেশি ছাত্রছাত্রী দেখানো হয়েছে।
এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে শনাক্ত করে নিবন্ধন বাতিল করার এখনই উপযুক্ত সময়। বাংলাদেশের শিক্ষা ক্ষেত্রে বাজেট পৃথিবীর অধিকাংশ দেশ হতে কম। এ কম সংখ্যক টাকা হতেও অধিকাংশ অর্থ এভাবে লোপাট ও অপচয় হচ্ছে। বাংলাদেশ সরকার এসব বিষয়ে সতর্ক দৃষ্টি রাখা এখন সময়ের দাবি ।
লেখক : প্রাবন্ধিক।