॥ গতকালের পর ॥

উপরোক্ত চুক্তিগুলো প্রবাসী সরকারের প্রধানমন্ত্রী জনাব তাজউদ্দিন আহমদ স্বাক্ষর করেছিলেন। পরবর্তীকালে এ সাতটি চুক্তি ঈষৎ পরিমার্জিত রূপে ১৯৭২ সালের ১৯শে মার্চ ঢাকার বুকে বঙ্গভবনে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ও বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবর রহমান স্বাক্ষরিত ২৫ সালা ’বন্ধুত্ব সহযোগিতা ও শান্তি’ চুক্তিতে অন্তুর্ভুক্ত করা হয়েছিল। দেশের সকল রাজনৈতিক দল এর বিরোধিতা করেছিল। তৎকালীন সরকার দেশের স্বার্থের পরিপন্থী ও জাতিদ্রোহী অবস্থান থেকে এক চুলও নড়তে রাজী ছিলনা এবং চুক্তি সম্পাদনের পূর্বে পার্লামেন্টের বা বিশেষজ্ঞ মতামত গ্রহণেরও প্রয়োজন বোধ করেনি।

ভারতকে মরণ বাঁধ ফারাক্কা চালুর অনুমতি প্রদান ছিল তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারের ঘৃণ্যতম কাজগুলোর অন্যতম। এ বাঁধ চালু করার ফলে বাংলাদেশের এক তৃতীয়াংশ অঞ্চল মরুভূমিতে পরিণত হবার ঝুঁকিতে নিক্ষিপ্ত হয়। ফারাক্কায় পানি প্রত্যাহারের ফলে পদ্মা ও তার অববাহিকা অঞ্চলে সেচ ব্যবস্থায় বিপর্যয় ঘটে, ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নীচে নেমে যায়, গাছ-পালার পুষ্টি উপাদানে সংকট দেখা দেয় এবং আর্সেনিকের প্রাদুর্ভাব বিপদ সীমা অতিক্রম করে। লোনা পানির প্রাদুর্ভাবও বেড়ে যায় এবং এর ফলে উপমহাদেশের অন্যতম বৃহত্তম নিউজপ্রিন্ট মিল খুলনা নিউজ প্রিন্ট মিল সহ বাংলাদেশের হাজার হাজার শিল্প ইউনিট বন্ধ হয়ে যায়। শীত মওসুমে পদ্মার হার্ডিঞ্জ ব্রিজ ও গোদাগাড়ি পয়েন্টে এখন লঞ্চ, ষ্টীমারের পরিবর্তে গরুর গাড়ী চলে। নদী এখন চর। এছাড়াও ১৯৭৪ সালের ১৬ মে মুজিব ইন্দিরার মধ্যে সম্পাদিত এক চুক্তি অনুযায়ী তৎকালীন সরকার বাংলাদেশের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ বেরুবাড়ী ভারতের কাছে হস্তান্তর করে। কিন্তু তার পরিবর্তে তিন বিঘা করিডোরসহ বাংলাদেশের পাওনা ছিট মহলগুলোতে অদ্যাবধি আমাদের দখল ও সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়নি। নিজ ভূখন্ড বিদেশের হাতে তুলে দেয়া, স্বাধীন একটি দেশের সার্বভৌম ক্ষমতার বিসর্জন ও তার আভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করার অধিকার দান দেশপ্রেমের সংজ্ঞায় পড়ে কিনা তা অবশ্য পরীক্ষা সাপেক্ষ ব্যাপার।

সন্দেহ নেই আওয়ামী লীগ দেশপ্রেমের দাবিদার একটি রাজনৈতিক দল। কিন্তু স্বাধীনতার পর আওয়ামী লীগ নেতা কর্মীদের ছিনতাই, লুন্ঠন, পাচার, হত্যা, গুম ও ব্যভিচার দেশবাসীকে অতিষ্ঠ করে তুলেছিল। সরকারের ব্যর্থ প্রশাসনিক অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক পলিসি বাংলাদেশের অর্থনীতিকে ভারতীয় অর্থনীতির যোগানদার অর্থনীতিতে পরিণত করে। পণ্য দ্রব্যের মূল্য ক্রেতা সাধারণের নাগালে বাইরে চলে যায়। ক্ষেত, খামার ও কলকারখানায় উৎপাদন চরমভাবে ব্যাহত হয়, কলকারখানা ও কাঁচা পাটের গুদামে শুরু হয় অগ্নিসংযোগ ও স্যাবোটেজ। সর্বত্র দেখা দেয় খাদ্য সামগ্রী ও পণ্য দ্রব্যের তীব্র অভাব। ১৯৭৪ সালের শেষার্ধে দুর্ভিক্ষ অনাহারে মৃত্যুবরণ করে লক্ষ লক্ষ লোক। বিরোধী কন্ঠকে স্তব্দ করার লক্ষ্যে বিশেষ ক্ষমতা আইন, জননিরাপত্তা আইন প্রভৃতি প্রণয়ন ও নির্বিচার প্রয়োগ পরিস্থিতি সামাল দিতে ব্যর্থ হয়। অবশেষে ১৯৭৪ সালের ২৮ ডিসেম্বর সারাদেশে জরুরী অবস্থা ঘোষণা করা হয়। রক্ষীবাহিনীর অত্যাচার উচ্চমার্গে পৌছে। কিন্তু তাতেও এ দলের ক্ষমতা লিপ্সা শেষ হয়নি। ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারী সংবিধানে চতুর্থ সংশোধনী সংযোজনের মাধ্যমে সারা দেশে একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা হয়। সকল রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করে বাকশাল নামক একটি মাত্র দল প্রতিষ্ঠা করা হয়। দু’টি সরকার দলীয় ও দু’টি সরকারি মালিকানাধীন পত্রিকা ছাড়া আর সকল দৈনিক পত্রিকা নিষিদ্ধ ঘোষণা ও বন্ধ করে দেয়া হয়। প্রবীণ রাজনীতিক অলি আহাদের ভাষায়, ‘‘ক্ষমতার লোভ, একশ্রেণীর মেরুদ-হীন নেতা ও রাজনৈতিক কর্মী, নীতিহীন বুদ্ধিজীবি ও চরিত্রহীন টেন্ডলের যোগসাজশে বাংলার সর্বত্র নগরে, বন্দরে, কলকারখানায়, গ্রামে-গঞ্জে, ক্ষেতে খামারে দিল্লীর দাসেরা আওয়াজ তুলতে থাকে, এক নেতা এক দেশ বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ।’’

এখানে স্মরণ করা দরকার যে, ১৯৭৫ সালে ১৫ আগষ্টের ঐতিহাসিক বিপ্লবের পূর্বে নোয়াখালীর রামগতির তোরাবগঞ্জে ভারতীয় বিমানবাহিনীর একটি হেলিকপ্টার বিধ্বস্ত হয়েছিল। এতে এর আরোহী দু’জন সিনিয়র ভারতীয় সামরিক কর্মকর্তা নিহত হয়েছিল। পরদিন বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর একটি হেলিকপ্টারযোগে এ দু ভারতীয় কর্মকর্তার মৃতদেহ কোলকাতায় পাঠিয়ে দেয়া হয়। বাংলাদেশের আকাশসীমা লংঘন করে প্রতিবেশী দেশের একটি সামরিক হেলিকপ্টারের এত অভ্যন্তরে এসে বিধ্বস্ত হবার বিষয়টি ছিল অত্যন্ত রহস্যজনক। ভারতীয় দৈনিক আনন্দবাজার ও আজকাল বার বার সে দেশের সরকারের কাছে এ ব্যাপারে ব্যাখ্যা চেয়েও কোনও উত্তর পায়নি। বাংলাদেশের তরফ থেকেও এ ঘটনার উপর কোনও মন্তব্য বা ব্যাখ্যা দেয়া হয়নি। তবে কুটনৈতিক বাধা, সরকারি নিষেধাজ্ঞা এবং গোয়েন্দা বিধি-নিষেধ অতিক্রম করে যে গোপন তথ্যটি পরবর্তী কালে বেরিয়ে এসেছিল তাতে দেখা যায় যে, ঐ হেলিকপ্টারের আরোহীরা গুরুত্বপূর্ণ কিছু সামরিক দলিল বহন করছিলেন। এ দলিল অনুযায়ী বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে ভেঙে দিয়ে তাকে আগরতলা ভিত্তিক ভারতীয় বাহিনীর কম্যান্ডে ন্যস্ত করার প্রস্তাব ছিল। বাংলাদেশের তৎকালীন সেনাপ্রধান এ দলিলে স্বাক্ষর করার পর হেলিকপ্টার আরোহীরা আগরতলা কম্যান্ড এর কাছ থেকে প্রতিস্বাক্ষর করে কোলকাতা ফিরছিলেন বলে জানা যায়। ইতোমধ্যে ঢাকা সেনানিবাস ও বিমানবাহিনী হেড কোয়ার্টারের দেশপ্রেমিক কর্মকর্তারা বিষয়টি সম্পর্কে অবহিত হন এবং দেশ এবং সেনাবাহিনীকে রক্ষার জন্য হেলিকপ্টারটি ভুপাতিত করে সমস্ত ষড়যন্ত্র নস্যাত করে দেন। এ প্রেক্ষাপটে ১৫ আগষ্টের পট পরিবর্তন ঘটে। এতে দেশ ভারতীয় আধিপত্যবাদ থেকে যেমন মুক্ত হয়েছিল তেমনি গণতন্ত্রও ফেরত পেয়েছিল। আওয়ামী লীগ ও তার অঙ্গ সংগঠনের নেতা কর্মীরা যে লুটপাটের রাজত্ব কায়েম করেছিল তারও অবসান ঘটেছিল। তখনকার দিনের অবস্থা বর্ণনা করতে গিয়ে মাহবুবুল আলম চাষী যথার্থই বলেছেন, ‘‘Many of the freedom fighters, who were once eager to sacrifice their lives for the cause of their motherland, were now trying to devour the entire nation. Excesses committed by them made normal work nearly impossible. Situation became so unmanageable that once a leader of a foreign delegation asked me whether the country was really liberated or it was conquered. I wanted to know why she asked this question. She told in reply that in a liberated country every bodz felt safe and happy, while in a conquered country, people were afraid and conquerers looted and plundered the conquered land. In her opinion the general condition in Bangladesh was closer to the latter.’’

অর্থাৎ ‘মুক্তিযোদ্ধাদের অনেকেই যারা এক সময় মাতৃভূমির জন্য জীবন বিসর্জন দিতে প্রস্তুত ছিল তারা এখন গোটা জাতিকে গিলে খাবার জন্য উদ্যত হয়ে পড়তে দেখা গেল, তাদের বাড়াবাড়ির ফলে স্বাভাবিক কাজকর্ম চালিয়ে যাওয়া কঠিন হয়ে পড়লো, পরিস্থিতির এতই অবনতি ঘটলো যে, একবার বিদেশী এক প্রতিনিধি দলের নেতা আমাকে প্রশ্ন করেই বসলেন যে, এ দেশটি আসলে কি স্বাধীন করা হয়েছে না জয় করা হয়েছে। আমি তার এ প্রশ্নের কারণ জানতে চাইলাম, তিনি বললেন যে, স্বাধীন একটি দেশে প্রত্যেকটি লোক নিরাপদ থাকে এবং নিজেকে সুখীও পরিতৃপ্ত বোধ করে। পক্ষান্তরে বিজিত একটি দেশের মানুষ ভীত সন্ত্রস্ত্র থাকে এবং বিজেতারা বিজিত দেশে লুটপাট চালায়। তার দৃষ্টিতে বাংলাদেশের অবস্থা শেষোক্ত দেশের অবস্থার খুবই কাছাকাছি।’ জনাব চাষীর এ উদ্বৃতি থেকে বিদেশীদের কাছে তৎকালীন বাংলাদেশের ইমেজ সম্পর্কে কিছুটা আভাস পাওয়া যায়। ১৯৭৫ সালের ১৮ জানুয়ারী বাংলাদেশ পরিস্থিতির উপর বিএসএফ এর গোলক মজুমদার কর্তৃক ভারত সরকারের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিশেষ সচিব শ্রী রুস্তমজীকে লেখা এক গোপনীয় পত্রেও অনুরূপ একটি চিত্র পাওয়া যায়। এতে তিনি বলেছেন, ‘‘Conditions continue to be difficult in Bangladesh. Salt sells at Tk. 100.00 per seer while the cost of mustard oil is Tk. 250.00 per seer. The general public has become disgusted with corruption amongst high officials and politicians. Some sections have started openly questioning the competence of Sheikh Mujibur Rahman to administer the country. The opposition forces are trying hard to put up a strong front against the Awami League and armed clashes are not at all uncommon, specially in the country side. Quite a few police and army posts have been attacked and daring decoity have taken place in Dacca in broad day light. Students are becoming restive. There is a tendency to blame India for all ills of Bangladesh and in the process communal feelings are developing quite fast. Hindus are becoming more and more frustrated and there is a growing feeling amongst them that they are not wanted in Bangladesh .’’ রুস্তমজীকে লেখা গোলক মজুমদারের এটিই একমাত্র পত্র নয়, আরো অসংখ্য পত্রে তিনি তৎকালীন বাংলাদেশের অবস্থা তুলে ধরেছিলেন যা কোন ক্রমেই সুখকর ছিলনা।

পাকিস্তানী কর্তৃপক্ষের বৈষম্যমূলক আচরণ, মানবাধিকার লংঘন, গণতন্ত্র হত্যা ও অত্যাচার-অবিচারের বিরুদ্ধে এ দেশের মানুষ রুখে দাঁড়িয়েছিল এবং ইনসাফ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করে জানমাল কুরবানি করেছে। তাদের রক্তের সাথে যারা বিশ্বাস ঘাতকতা করে দেশ শাসন করেছেন, লুটপাট, অত্যাচার নিপীড়ন ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ধ্বংসে পাকিস্তানীদেরও ছাড়িয়ে গেছেন তাদের দেশ প্রেমের স্কোর অবশ্য নির্ণিত হয়নি।

স্বাধীনতার হিফাজতঃ কিছু করণীয় : ১) স্বাধীনতা অর্জনের তুলনায় স্বাধীনতার হেফাজত বা সুরক্ষা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও কঠিন একটি কাজ। এজন্য প্রয়োজন জাতির ইস্পাত কঠিন ঐক্য। সংকীর্ণ স্বার্থ, রাজনৈতিক ঈর্ষা-বিদ্বেষ, ক্ষমতার লোভ ও বিদেশী শক্তির আনুগত্য এবং দালালী এই ঐক্যের পথে বড় অন্তরায়। রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্ধীদের উপর অত্যাচার, নির্যাতন এবং গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের প্রতি অবজ্ঞা ঐক্য বিনষ্ট করে। জাতীয় ঐক্য ছাড়া স্বাধীনতা রক্ষা করা যায় না। ফিলিপাইনের জাতীয় বীর ডঃ রিজালের ভাষায় ডWhy liberty if the slaves of today become the tyrants of tomorrow? রাজনৈতিক প্রতিহিংসা, অত্যাচার, নির্যাতন, রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস, ক্ষমতাসীন দলের সীমাহীন দলীয়করণ, রাষ্ট্রযন্ত্র, রাষ্ট্রীয় সম্পদ ও সুযোগ সুবিধার পক্ষপাতদুষ্ট ব্যবহার জাতি প্রেম দেশাত্মবাবোধক কাজ নয়। এর ফলে জাতির মধ্যে বিভ্রান্তি ও বিভক্তি দেখা দেয়, পারস্পরিক আস্থাহীনতার জন্ম হয় এবং শত্রুরা উৎসাহিত হয়। দেশ রক্ষা এবং স্বাধীনতা হেফাজতের জন্য এ প্রবণতা রোধ করা অপরিহার্য।

২) ১৭৫৭ সালে মীর জাফর, জগৎশেঠ, উমি চাঁদের ন্যায় জনবিচ্ছিন্ন বিশ্বাসঘাতকদের ষড়যন্ত্র এবং ব্যক্তি স্বার্থের বিনিময়ে বিদেশীদের কাছে দেশ ও জাতীয় স্বার্থ বিক্রির ফলে বাংলার স্বাধীনতা অস্তমিত হয় এবং ধীরে ধীরে সমগ্র ভারতবর্ষে পরাধীনতার অমানিশা নেমে আসে। এ স্বাধীনতা ফিরিয়ে আনতে পৌনে দু’শ বছরের সংগ্রাম প্রয়োজন হয়েছিল। এ সংগ্রামে কোটি কোটি মানুষকে অমানুষিক নির্যাতন ভোগ করতে হয়েছে। এখানে একটি বিষয় প্রণিধানযোগ্য। যারা বিশ্বাসঘাতক ও দালাল ছিল সংখ্যায় তারা ছিল হাতে গোনার মত। কিন্তু তাদের সংকীর্ণ স্বার্থের বলি যারা হয়েছিল তারা ছিল সংখ্যায় কোটি কোটি এবং বংশ পরম্পরায় প্রায় দু’শ বছর গোলামীর জিঞ্জিরে আবদ্ধ। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় যে মীর জাফররা মরে না, তারা Recycled হয়। তাদের ক্ষমতা লিপ্সা এবং ষড়যন্ত্রও অব্যাহত থাকে। স্বাধীনতার সুরক্ষার জন্য এদের মুখোশ উন্মেচনের শক্তিশালী ব্যবস্থা থাকা উচিত। এ ব্যবস্থার অনুপস্থিতিতে স্বাধীনতা নিরাপদ থাকতে পারে না। জনসচেতনতা ও জনগনের সতর্কতাই এর নিশ্চয়তা দিতে পারে।

৩) রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের অস্তিত্বের পেছনে এদেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠির আদর্শিক স্বকীয়তাই মুখ্য ভূমিকা পালন করেছে। এ উপমহাদেশের হিন্দু এবং মুসলিম এই দু’টি জনগোষ্ঠি দু’টি স্বতন্ত্র সত্তা এবং আলাদা জাতি। এ তত্ত্বের ভিত্তিতে ১৯৪৭ সালে ভারতবর্ষ ভাগ হয়ে হিন্দু অধ্যুষিত অঞ্চল নিয়ে ভারত এবং মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চল নিয়ে পাকিস্তান গঠিত হয়েছিল এবং ধর্মীয় বিভাজনের ভিত্তিতেই গণভোটের মাধ্যমে বৃহত্তর সিলেট আসাম থেকে এবং পূর্ব বাংলা পশ্চিম বাংলা থেকে আলাদা হয়ে পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চল তথা পূর্ব পাকিস্তানের অংশে পরিণত হয়েছিল। জনগণের মৌলিক আকিদা বিশ্বাস তথা ইসলামী আদর্শই ছিল এক্ষেত্রে মূল চালিকা শক্তি। গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের ধ্বংস সাধন, প্রসাদ রাজনীতির ষড়যন্ত্র, অত্যাচার, অবিচার এবং অর্থনৈতিক শোষণ বঞ্চনা ১৯৭১ সালে এ দেশের মানুষকে সশস্ত্র মুক্তি যুদ্ধের দিকে ঠেলে দেয় এবং স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটে। পতাকার এ পরিবর্তন এবং নতুন এ দেশের সৃষ্টি দ্বিজাতিতত্ত্বকে অস্বীকার করেনি বরং লাহোর প্রস্তাবে বর্ণিত উপমহাদেশের মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চলসমূহ নিয়ে একাধিক মুসলিম রাষ্ট্র গঠনের মূল ধারণাকে শক্তিশালী করেছে। বলা নিষ্প্রয়োজন যে দ্বিজাতিতত্তব তথা আদর্শিক স্বাতন্ত্রের বিষয়টি মুখ্য না থাকলে ভারতীয় সংবিধানে বর্ণিত রাষ্ট্রীয় মূলনীতির আদলে গঠিত আদর্শের ধারক বাহক হিসেবে তার থেকে আলাদা হয়ে স্বতন্ত্র স্বাধীন একটি রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের টিকে থাকার কোনও যৌক্তিকতা নেই। একটি মহল ইসলামকে গৌণ বিষয়ে পরিণত করে এ দেশে ভারতীয় আদর্শ চাপিয়ে দিতে চায়। সংবিধান থেকে পঞ্চম সংশোধনী বাতিল, রাষ্ট্রীয় আদর্শ হিসাবে সর্ব শক্তিমান আল্লাহর উপর আস্থা ও বিশ্বাস সম্পর্কিত ধারার অবলোপনের চেষ্টা এরই একটি অংশ। এ প্রচেষ্টাকে সফল হতে দেয়া যায়না। এ ব্যাপারে দেশের মানুষ যাতে অতন্ত্র প্রহরীর ন্যায় কাজ করতে পারে তার জন্য দেশ প্রেমিক রাজনৈতিক দল ও সংগঠনগুলোকে জনমত গঠনে নিরলস প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে।

৪) অরক্ষিত স্বাধীনতা দেশকে পরাধীনতার দিকে ঠেলে দেয়। আদর্শিক, সাংস্কৃতিক ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের সংরক্ষণ ও বিকাশ স্বাধীনতার রক্ষাকবচ। আকাশ সংস্কৃতির আগ্রাসনের এ যুগে যদি ইসলামী আদর্শ ও মূল্যবোধ ভিত্তিক সংস্কৃতিকে রক্ষা করার জন্য উপয্ক্তু পদক্ষেপ গ্রহণ করা না হয় তাহলে আদর্শকে বাচিয়ে রাখা সম্ভবপর নয়। দেশের মানুষ বিশেষ করে যুব সমাজ যদি আদর্শ বিচ্যুত হয়ে পড়ে তাহলে দেশ টিকে থাকতে পারে না। বিজাতীয় সংস্কৃতির আগ্রাসন রোধ করতে হলে নিজস্ব সংস্কৃতিতে উজ্জীবিত শক্তিশালী গণমাধ্যম বিশেষ করে প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার সৃষ্টি করতে হবে এবং সেগুলো পরিচালনার জন্য আদর্শনিষ্ঠ জনবল তৈরী করতে হবে। এক্ষেত্রে উন্নত জ্ঞান, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি আহরণ এবং বুদ্ধি বৃত্তির কোনও বিকল্প নেই।

৫) দেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব ও অখ-তা রক্ষায় সেনাবাহিনীর ভূমিকা অপরিসীম। আধুনিক যুদ্ধ বিদ্যার সর্বশেষ কৌশল এবং যথাসম্ভব সর্বোন্নত যুদ্ধ উপকরণে তাদের সমৃদ্ধকরণ ও সেগুলো ব্যবহারে উন্নতর প্রশিক্ষণ দিতে হবে। সেনাবাহিনী ও প্রতিরক্ষা বাহিনীর অপরাপর সংস্থাগুলোকে অবশ্যই দলীয় প্রভাব এবং সংকীর্ণ রাজনীতির উর্ধ্বে রেখে তাদের পেশাগত দক্ষতা বৃদ্ধির ব্যবস্থা করা অপরিহার্য। সেনাবাহিনীর দলীয়করণ কিংবা তাদের উপর রাজনৈতিক প্রভাব সৃষ্টি তাদের বিশৃঙ্খলার দিকে ঠেলে দিতে পারে এবং এর ফলে বিদেশী হামলা মুকাবিলা করা এবং স্বাধীনতার হেফাজত তাদের জন্য কঠিন হয়ে পড়তে পারে।

স্বাধীনতার হেফাজতের জন্য উপরোক্ত ব্যবস্থাগুলো গ্রহণ করা ছাড়াও সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে দেশপ্রেমকে উজ্জীবিত করা এবং দেশাত্মবোধক কাজ কর্মকে পুরস্কৃত করা প্রয়োজন। এছাড়াও দেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব, জাতীয় আদর্শ এবং প্রাকৃতিক সম্পদসমূহের সুরক্ষাসহ গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় ইস্যুসমূহে রাজনৈতিক দলসমূহের ঐকমত্য অপরিহার্য। জাতীয় ঐক্য ও সংহতি ছাড়া স্বাধীনতা রক্ষা করা যায় না। পাশাপাশি সার্বভৌম সমতার ভিত্তিতে সকল দেশের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখা এবং ক্ষমতায় যাওয়া বা কাউকে ক্ষমতা থেকে সরানোর জন্য বিশেষ কোনও বহিঃশক্তির আধিপত্যের কাছে নতি স্বীকারের দৃষ্টি ভঙ্গি পরিহার করাও জরুরী। এ ব্যাপারে দেশপ্রেমিক শক্তিকেই এগিয়ে আসতে হবে।

শেষ করার আগে স্যার ওয়াল্টার স্কটের একটি উদ্বৃতি দিতে চাই, তিনি বলেছেন, ‘‘স্বদেশ প্রেমিকের ধর্ম বীরের ধর্ম, ভীরুর ধর্ম নয়। হয়ত গৃহলক্ষ্মীর আহ্বান তোমাকে মুহূর্তের জন্য বিমনা করবে। হয়ত পুরানো স্মৃতির মায়া তোমাকে আকর্ষণ করবে। কিন্তু জীবনের প্রতি পদে যারা ভয়ে ভয়ে ছোট ছোট বিধি নিষেধের গন্ডিতে নিজেদের বেঁধে রেখে গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে যায় তাদের মত তোমাকে অচেনা অজানায় অখ্যাতির বিড়ম্বনা সহ্য করতে হবে না। আগামী দিনের পৃথিবী তোমাকে জানাবে সত্যিকারের শ্রদ্ধার্ঘ, হে বিদ্রোহী বীর, এগিয়ে চল।’’ (সমাপ্ত)