DailySangram-Logo-en-H90
ই-পেপার আজকের পত্রিকা

কলাম

জার্মানির নির্বাচনে মার্কিন হস্তক্ষেপ কী ফল আনলো

জার্মানির নির্বাচনে রক্ষণশীলদের জয় হয়েছে। এবার সবার দৃষ্টি ছিল আমেরিকার দৃষ্টিভঙ্গিকে জার্মান ভোটাররা কিভাবে দেখেন। সব কিছুরই একটা জবাব এসেছে নির্বাচনী ফলাফলে। দেখা যাচ্ছে মার্কিন সমর্থক কট্টর ডানপন্থীরা রয়েছে দ্বিতীয় অবস্থানে।

Printed Edition
Untitled-1

জার্মানির নির্বাচনে রক্ষণশীলদের জয় হয়েছে। এবার সবার দৃষ্টি ছিল আমেরিকার দৃষ্টিভঙ্গিকে জার্মান ভোটাররা কিভাবে দেখেন। সব কিছুরই একটা জবাব এসেছে নির্বাচনী ফলাফলে। দেখা যাচ্ছে মার্কিন সমর্থক কট্টর ডানপন্থীরা রয়েছে দ্বিতীয় অবস্থানে। ফ্রেডরিক মেৎর্স-এর নেতৃত্বাধীন রক্ষণশীলরা জার্মানির নির্বাচনে জয়লাভ করেছে। তবে প্রতিদ্বন্দ্বী দলগুলোর চেয়ে এগিয়ে থাকলেও তারা তাদের প্রত্যাশিত ৩০ শতাংশের চেয়েও কম ভোট পেয়েছে। সরকার গঠনে এগিয়ে থাকা ফ্রেডরিক বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের চাপ থেকে বের হতে হবে। তার এ বক্তব্যকে বিশ্লেষকরা দেখছেন একটি নতুন দৃষ্টিকোণ থেকে।

আয়তনের দিক থেকে জার্মানি ইউরোপের ৭ম বৃহত্তম রাষ্ট্র। উত্তর সাগর ও বাল্টিক সাগরের উপকূলীয় নি¤œভূমি থেকে মধ্যভাগের ঢেউ খেলানো পাহাড় ও নদী উপত্যকা এবং তারও দক্ষিণে ঘন অরণ্যাবৃত পর্বত ও বরফাবৃত আল্পস পর্বতমালা দেশটির ভূ-প্রকৃতিকে বৈচিত্র্যময় করেছে। জার্মানি বিশ্বের একটি প্রধান শিল্পোন্নত দেশ। এটির অর্থনীতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, চীন ও জাপানের পরে বিশ্বের ৪র্থ বৃহত্তম।

এত শক্তিমত্তা থাকার পরও বিশ^ রাজনীতিতে সে মাত্রায় নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি দেশটি। এঙ্গেলা মেরকেল দীর্ঘদিন দেশটির চ্যান্সেলর ছিলেন। তিনি আমেরিকার সাথে তাল মিলিয়ে চলেছেন। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রথম মেয়াদে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে জার্মানির সম্পর্ক মধুর ছিল না। এরপর ২০২১ সালে জো বাইডেন প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর দুই দেশের ঐতিহাসিক বন্ধন, নিরাপত্তার প্রয়োজনীয়তা এবং মূল্যবোধের ভিত্তিতে সবকিছুই পুনস্থাপনের লক্ষ্যে কাজ চালিয়ে যায় দেশ দুটি। তবে সবসময সম্পর্ক খুব মসৃণ ছিল তা বলা যাবে না।

এবারের নির্বাচনে এএফডিকে প্রকাশ্যেই সমর্থন যুগিয়েছেন ট্রাম্পের পক্ষের লোক ধনকুবের ইলন মাস্ক ও যুক্তরাষ্ট্রের ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভ্যান্স, যা জার্মান ভোটারদের দারুণভাবে হতাশ করেছে। মিউনিখ সফরের সময় ভ্যান্স ভোটে হস্তক্ষেপ করেছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। আর ইলন মাস্ক তার এক্স প্লাটফরমে বারবার মন্তব্য করেছেন। চার বছর আগের চেয়ে এএফডির সমর্থন বেড়েছে দশ শতাংশ। অ্যালিস ভাইডেল টিকটক ক্যাম্পেইন থেকেও লাভবান হয়েছেন। বড় সংখ্যা তরুণ ভোটাররা তাকে ভোট দিয়েছে। প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প মেৎসের জয়কে স্বাগত জানিয়েছেন। তবে তিনি বলেছেন, এটা প্রমাণ হয়েছে জ্বালানি ও অভিবাসনের মতো বিষয়গুলো নিয়ে আমেরিকানদের মতো জার্মানরাও ক্লান্ত। এ নির্বাচনে যুক্তরাষ্ট্রের হস্তক্ষেপের সমালোচনা করেছেন সম্ভাব্য চ্যান্সেলর ফ্রেডরিক মেৎর্স। তিনি দলের বিজয়ের পর বলেন, জার্মানিকে অবশ্যই যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে ‘স্বাধীনতা’ অর্জন করতে হবে।

গত সোমবার সন্ধ্যায় বার্লিনে ক্রিশ্চিয়ান ডেমোক্রেটিক ইউনিয়নের সভাপতি ও সম্ভাব্য চ্যান্সেলর ফ্রেডরিক মেৎর্র্স নির্বাচনোত্তর অনুষ্ঠানে যুক্তরাষ্ট্রের এ সমালোচনা করেন। তাঁর দল ছাড়াও সোশ্যাল ডেমোক্র্যাট পার্টির নেতা বর্তমান চ্যান্সেলর ওলাফ শলৎজ যুক্তরাষ্ট্রের নেতাদের এমন আচরণের নিন্দা করেছেন।

কেন তারা একথা বলেছেন আর আমেরিকার নিন্দাই করলেন? দেখা গেছে জার্মানির নির্বাচনী প্রচারে যুক্তরাষ্ট্রের ব্যাপক হস্তক্ষেপের ঘটনা ঘটেছে। হস্তক্ষেপকে ভালচোখে দেখেনি এ দুটি জোট তথা দলের নেতারা। ভালভাবে নেননি ভোটাররাও। আমেরিকার সমালোচনা করে মেৎর্র্স বলেছেন, প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এবং তাঁর পরামর্শদাতা ইলন মাস্ক কর্তৃক জার্মানির নির্বাচনী প্রচারে হস্তক্ষেপকে রাশিয়ার কর্মকা-ের মতোই মনে করেন। তিনি বলেন, ওয়াশিংটনের হস্তক্ষেপগুলো মস্কোর হস্তক্ষেপের চেয়ে কম নাটকীয় ছিল না। তবে শেষ পর্যন্ত তা ব্যর্থ হয়েছে। মেৎর্র্স মনে করেন, নির্বাচন নিয়ে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও তাঁর সহযোগীদের নানা মন্তব্য ও উসকানি থেকে এটা স্পষ্ট হয়ে গেছে, বর্তমান মার্কিন সরকার ইউরোপের ভাগ্যের প্রতি উদাসীন। বিশেষ করে তিনি প্রযুক্তি ধনকুবের ইলন মাস্কের বক্তব্যের সমালোচনা করেন। মাস্ক বারবার প্রকাশ্যে জার্মানির কট্টরবাদী অল্টারনেটিভ ফর ডয়েচল্যান্ড (এএফডি) দলটির পক্ষে ভোট দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন।

বিশ্লেষকরা বলেছেন, দেশটিতে জোট সরকার গঠিত হতে পারে। অবশ্য জোট সরকার দেশটাতে নতুন নয়। সে আলোচনার আগে ফলাফলটা দেখা যাক। জার্মানির ২১তম জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে গত ২৩ ফেব্রুয়ারি। এতে একক কোনো দল সংখ্যাগরিষ্ঠতা বা সরকার গঠনের মতো ভোট পায়নি। সর্বশেষ ফলাফল অনুযায়ী ৬৩০ আসনের মধ্য ক্রিশ্চিয়ান ডেমোক্রেটিক ইউনিয়ন পার্টি (সিডিইউ ও সিএসইউ) ২০৮ আসন, কট্টরবাদী অলটারনেটিভ ফর ডয়েচল্যান্ড (এএফডি) ১৫২ আসন, সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক পার্টি (এসপিডি) ১২০টি আসন, পরিবেশবাদী গ্রিন পার্টি ৮৫টি আসন এবং বাম দল দ্য লিংকে পেয়েছে ৬৪ আসন।

নতুন পার্লামেন্ট বা বুন্ডেস্ট্যাগকে নির্বাচনের ৩০ দিনের মধ্যে, অর্থাৎ আগামী ২৫ মার্চের মধ্যে তার প্রথম অধিবেশন আহ্বান করতে হবে। তবে জোট আলোচনা সাপেক্ষে আরও বেশি সময় নিতে পারে। জার্মান প্রেসিডেন্টকে পার্লামেন্ট অধিবেশন শুরু করার সংকেত দিতে হবে। এ ক্ষেত্রে নিয়ম অনুযায়ী, সব থেকে বেশি আসন পাওয়া দল ক্রিশ্চিয়ান গণতান্ত্রিক ইউনিয়নকে জোটসঙ্গী খুঁজে আগামী ২৫ মার্চের মধ্য সরকার গঠন করতে হবে। এ ক্ষেত্রে দলগুলোকে আলোচনা সাপেক্ষে জোট সরকার রূপরেখা তৈরি করবে এবং এ রূপরেখা জোটের দলগুলোকে পৃথকভাবে বিশেষ সম্মেলনের মাধ্যমে দলীয় কর্মীদের সমর্থন পেতে হবে। সদ্য নির্বাচিত পার্লামেন্ট সদস্যদের ভোটে নতুন চ্যান্সেলর নির্বাচিত না হওয়া পর্যন্ত বর্তমান চ্যান্সেলর ওলাফ শলৎজ তাঁর পদে বহাল থাকবেন।

বিশ্লেষকরা বলছেন, জোট বেঁধে সরকার গড়ার ঐতিহ্য অনুযায়ী, সিডিইউ ও সিএসইউ ও এসপিডির সঙ্গে পরিবেশবাদী গ্রিন পার্টি মিলে জোট গঠিত হতে পারে। গ্রিন পার্টিকে বাইরে রেখেও জোট সরকার গঠনের কথা আলোচনায় রয়েছে। তবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর জার্মান গণতন্ত্র এই প্রথম পার্লামেন্টে ১৫২টি আসন নিয়ে কট্টরবাদী এএফডি প্রধান বিরোধী দল হতে যাচ্ছে। নির্বাচনে জার্মান ভোটারদের বিপুল অংশগ্রহণ ছিল। ৮৩ শতাংশ ভোটার উপস্থিত ছিলেন। মেৎর্সের দল ক্রিশ্চিয়ান ডেমোক্রেটিক ইউনিয়ন (সিডিইউ) এবং তাদের জোটভুক্ত দল ক্রিশ্চিয়ান সোশ্যাল ইউনিয়ন (সিএসইউ) ২৮ দশমিক ৬ শতাংশের বেশি ভোট আশা করেছিল। তবে এত ভোটার উপস্থিতির পরও তারা তা পায়নি।

এএফডির সঙ্গে কাজ করার সম্ভাবনা খারিজ করে দিয়েছেন মেৎর্র্স। জার্মানিতে সাধারণত মূলধারার দলগুলোকে কট্টর ডানপন্থীদের সঙ্গে জোট করতে দেখা যায় না। সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটদের মেৎর্সের জোটে যোগ দেওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকলেও এ দল নির্বাচনে তাদের এযাবৎকালের সবচেয়ে খারাপ ফল করেছে। সোশ্যাল ডেমোক্র্যাট নেতা ও বিদায়ী চ্যান্সেলর ওলাফ শলৎজ বলেন, নির্বাচনের ফলাফল তাঁর দলের জন্য একটি তিক্ত পরাজয়। তিনি জোট গঠনের আলোচনায় অংশ নেবেন না বলে জানিয়ে দিয়েছেন। ৬৯ বছর বয়সী মেৎর্র্স কখনো মন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেননি। তবে প্রচারকালে তিনি প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, জার্মান চ্যান্সেলর হলে ইউরোপে নেতৃত্ব দেবেন এবং ইউক্রেনের প্রতি সমর্থন জোরদার করবেন।

ট্রাম্পের অভিনন্দন বানী সত্ত্বেও ফ্রেডরিক মেৎর্র্স বলেন, জার্মানি এখন চাপের মধ্যে রয়েছে। তবে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে তাঁদের প্রথম কাজ হবে ইউরোপে ঐক্য তৈরি করা এবং ইউরোপকে শক্তিশালী করা। জার্মানির এই নেতা আরও বলেন, ধাপে ধাপে যুক্তরাষ্ট্রের চাপ থেকে বের হতে হবে। সে জন্য আগামী জুন মাসের শেষে ন্যাটো শীর্ষ সম্মেলনের জন্য তিনি অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছেন। মেৎর্র্স ধারণা করছেন, ন্যাটো সামরিক জোট এমন থাকবে না। দ্রুত ইউরোপীয় নিজস্ব প্রতিরক্ষা সক্ষমতা প্রতিষ্ঠা করার প্রয়োজন হবে এবং তা সময় বলে দেবে। সম্প্রতি কিয়েভ এবং ইউরোপীয় নেতাদের বাদ দিয়ে রাশিয়ার সঙ্গে ইউক্রেন নিয়ে শান্তি আলোচনা এগিয়ে নেওয়ার জন্য ট্রাম্পের প্রচেষ্টায় ইউরোপজুড়ে রাজনীতিকেরা হতবাক হয়ে যান। ফলে ইউরোপীয় নেতারা তাঁদের ঐক্যবদ্ধ প্রতিক্রিয়া নিয়ে আলোচনা করেন।

নির্বাচনী ফলে ইলন মাস্কের পছন্দের দল কট্টর ডানপন্থী অলটারনেটিভ ফর জার্মানি বা এএফডি ২০ দশমিক ৮ শতাংশ ভোট পেয়ে দ্বিতীয় স্থানে আছে। তারা কী বলছে? এএফডির চ্যান্সেলর প্রার্থী অ্যালিস ভাইডেল সমর্থকদের নিয়ে বিজয়োল্লাস করেছেন। যদিও তার দল আরও ভালো ফল আশা করেছিলো। দলটির সদর দপ্তরেও কিছুটা হতাশা দেখা গেছে। তিনি বলেন, ফ্রিডরিক মেৎর্সের কোয়ালিশন গড়ার চেষ্টা শেষ পর্যন্ত ব্যর্থতায় পর্যবসিত হবে। তার মতে, আমাদের নতুন নির্বাচন হবে- আমাদের আবার চার বছর অপেক্ষা করতে হবে বলে আমি মনে করি না। তবে বিশ্লেষকরা তার এ কথাকে খুব মূল্য দিতে চাইছেন না।

জার্মানিতে কট্টর ডানপন্থীদের সাথে মূলধারার দলগুলোর কাজ করার ক্ষেত্রে একটি প্রচলিত মত আছে। তবে মেৎসের সবচেয়ে সম্ভাব্য পার্টনার সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটরা নির্বাচনে সবচেয়ে খারাপ ফল করেছে। তাদের ভোটের পরিমাণ ১৬ দশমিক ৪ শতাংশ। দলটির নেতা বিদায়ী চ্যান্সেলর ওলাফ শলৎজ বলেছেন, নির্বাচনের ফল তাদের জন্য তিক্ত পরাজয় নিয়ে এসেছে এবং তিনি কোয়ালিশন সরকার গঠনের বিষয়ে কোন আলোচনায় অংশ নেবেন না। প্রাথমিকভাবে অনেকে ধারণা করেছিলেন যে কোয়ালিশন সরকার গঠনের জন্য এই দুই দলই যথেষ্ট হবে। গত চার বছর একটি তিন দলীয় কোয়ালিশন সরকার দেখেছে জার্মানি। সেখানকার আরেকটি দল গ্রিন।

মেৎসের জয়কে দ্রুতই ইউরোপের বড় অংশ জুড়ে স্বাগত জানানো হচ্ছে। ফ্রান্সে এমানুয়েল ম্যাক্রঁ বিশ্ব ও ইউরোপের বড় চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় অনিশ্চয়তার এই সময়ে ঐক্যের কথা বলেছেন। অন্যদিকে যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী যৌথ নিরাপত্তা ও উভয় দেশের উন্নতির ওপর জোর দিয়েছেন। তাদের সমর্থন ও সহায়তা নিয়ে নতুন সরকার কতখানি অগ্রসর হতে সেটা এখন দেখার বাকি। এ জন্য কিছু সময় অপেক্ষা করতেই হবে।

লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক।