জাফর আহমাদ
মানুষকে পৃথিবীতে আনা হয়েছিল কল্যাণের নিমিত্তে। কিন্তু সে মানুষগুলোই এখন অন্য মানুষের জন্য জংগলের হিংশ্র প্রাণী থেকেও ভয়ংকর হয়ে উঠেছে। একটি কথা আমরা ভালো করেই জানি যে, বনের জন্তু-জানোয়ারগুলো তাদের নিজেদের জঠর জ্বালা নিবারণের জন্যই কেবল অন্য প্রাণীদের ওপর হামলে পড়ে। এ ছাড়া চর দখল, পেশীশক্তির প্রদর্শন ও নিজেদের জিঘাংসা চরিতার্থ করার জন্য কোন প্রাণী কখনো অন্য প্রাণীদের ওপর হামলে পড়ে না। কিন্তু মানুষ পশু থেকেও এতটাই নিম্নস্তরে পৌঁছে গেছে যে, আজ সারা পৃথিবীতে মানুষ মানুষের জন্য সবচেয়ে বেশি হুমকী ভাবতে শুরু করেছে। মানুষেরা মৌলিক মানবীয় গুণগুলো হারিয়ে এমন এক আজব প্রাণীতে পরিণত হয়েছে যে, এরা না মানুষ আর না পশু। কারণ আগেই বলা হয়েছে যে, পশু নিজেদের হিংসা, বিদ্বেষ ও জিঘাংসা চরিতার্থ করার জন্য কখনো অন্য পশুদের ওপর জুলুম-নির্যাতন চালায় না। অথচ মানুষ নামের প্রাণীটি খোদ নিজের জ্ঞাতি-গোষ্ঠী মানুষের ওপর সদাই এ জঘন্যতম কাজগুলো সংঘটিত করে থাকে। অথচ মানুষকে সৃষ্টিই করা হয়েছিল অন্য মানুষদের কল্যাণের নিমিত্তে।
আল্লাহ তা’আলা বলেন, “তোমরাই পৃথিবীর কল্যাণকামী জাতি, মানুষের কল্যাণের জন্যই তোমাদের কর্মক্ষেত্রে বের করে আনা হয়েছে।” (সুরা আলে ইমরান : ১১০) অর্থাৎ নবী (সা.) এর অনুসারীদের বলা হয়েছে যে, পৃথিবীতে তোমরাই এখন কেন্দ্রীয় জাতি। তোমাদের পূর্বে বনী ইসরাঈলীরা এ আসনে সমাসীন ছিল। কিন্তু তাদের অযোগ্যতা ও হটকারীতার কারণে তাদেরকে সেখান থেকে হটিয়ে দিয়ে তোমাদেরকে বসিয়ে দেয়া হয়েছে। কারণ নৈতিক চরিত্র ও কার্যকলাপের দিক দিয়ে এখন তোমরাই দুনিয়ায় সর্বোত্তম মানবগোষ্ঠী। সৎ ও ন্যায়নিষ্ঠ নেতৃত্বের জন্য যেসব গুণাবলীর প্রয়োজন সেগুলো মুহাম্মদ (সা:)-এর উম্মতদের মধ্যে সৃষ্টি হয়ে গেছে। আর এ সংগে তারা এক লা-শরীক আল্লাহকে বিশ্বাসগত দিক দিয়ে এবং কার্যত নিজেদের ইলাহ, রব ও সর্বময় প্রভু বলে স্বীকার করে নিয়েছে। কাজেই এ কাজের দায়িত্ব অর্থাৎ মানুষের কল্যাণের নেতৃত্ব তাদের মাথায় চাপিয়ে দেয়া হয়েছে। সুতরাং এ নেতৃত্বকে নিজেদের দায়িত্ব অনুধাবন করতে হবে এবং একই নেতৃত্ব পূর্বে যাদের ওপর ছিল তাদের ভুল-ত্রুটি যেন পুনরাবৃত্তি না ঘটে তা থেকে সাবধান থাকতে হবে।
বিশ্বনবী (সা.)ও তাঁর অনুসারীদেরকে এ দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করার জন্য বিভিন্নভাবে উৎসাহিত করেছেন। যেমন হযরত আবু হুরাইরা (রা:) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা:) বলেছেন: যে লোক কোন ঈমানদারের দুনিয়া থেকে কোন মুসীবাত দূর করে দিবে, আল্লাহ তা’আলা বিচার দিবসে তার থেকে মুসীবাত সরিয়ে দিবেন। যে লোক কোন দুস্থ লোকের অভাব দূর করবে, আল্লাহ তা’আলা দুনিয়া ও আখিরাতে তার দুরবস্থা দূর করবেন। যে লোক কোন মুসলিমের দোষ-ত্রুটি লুকিয়ে রাখবে আল্লাহ তা’আলা দুনিয়া ও আখিরাতে তার দোষ-ত্রুটি লুকিয়ে রাখবেন। বান্দা যতক্ষণ তার ভাইয়ের সহযোগীতায় আত্মনিয়োগ করে আল্লাহ ততক্ষণ তার সহযোগীতা করতে থাকেন। যে লোক জ্ঞানার্জনের জন্য রাস্তায় বের হয়, আল্লাহ এর বিনিময়ে তার জন্য জান্নাতের পথ সহজ করে দেন। যখন কোন সম্প্রদায় আল্লাহর গৃহে একত্রিত হয়ে আল্লাহর কিতাব পাঠ করে এবং একে অপরের সাথে মিলে (কুরআন) অধ্যায়নে লিপ্ত থাকে তখন তাদের উপর শান্তিধারা অবতীর্ণ হয়। রহমত তাদেরকে আচ্ছন্ন করে ফেলে এবং ফেরেশতাগণ তাদেরকে পরিবেষ্টন করে রাখেন। আর আল্লাহ তা’আলা তাঁর নিকটবর্তীদের (ফেরেশতাগণের) মধ্যে তাদের কথা আলোচনা করেন। আর যে লোককে আমলে পিছনে সরিয়ে দিবে তার বংশ (মর্যাদা) তাকে অগ্রসর করে দিবে না। (মুসলিম : ৬৭৪৬,আন্ত. নাম্বার : ২৬৯৯, কিতাবুয যিকর ওয়াদ দু’আ ওয়াত তাওবা ওয়াল ইসতেগফার, বাবু ফাদলিল ইজতেমা আ’লা তিলাওয়াতিল কুরআন ওয়া আ’লা যিকরে, ইফা: ৬৬০৮, ই.সে.৬৬৬১)
মূলত মানুষের মধ্যে অকল্যাণ সৃষ্টি হয় পারস্পরিক বিভেদ থেকে। তার চেয়েও মারাত্মক হলো, অহংকার। ভেদনীতি সৃষ্টি হয়েছে অহংকারকে ভর করে অথবা অহংকারের কারণে ভেদনীতি প্রবর্তিত হয়েছে। এ ভেদনীতির সমর্থনে দর্শন রচনা করা হয়েছে। মত ও বিশ্বাস আবিষ্কার করা হয়েছে। আইন তৈরি করা হয়েছে। নৈতিক নীতিমালা রচনা করা হয়েছে। বিভিন্ন জাতি ও রাষ্ট্র এটিকে তাদের স্থায়ী ও স্বতন্ত্র বিধান হিসেবে গ্রহণ করে বাস্তবে অনুসরণ করেছে। এরই ভিত্তিতে ইহুদীরা নিজেদেরকে আল্লাহর মনোনীত সৃষ্টি বলে মনে করেছে এবং তাদের বিধি-বিধানে পর্যন্ত অইসরাঈলীদের অধিকার ও মর্যাদা ইসরাঈলীদের চেয়ে নিম্নপর্যায়ে রেখেছে। এ ভেদনীতিই হিন্দুদের মধ্যে বর্ণাশ্রমের জন্ম দিয়েছে যার ভিত্তিতে ব্রাহ্মণদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে এবং শুদ্রদের চরম লাঞ্চনা গভীর খাদে নিক্ষেপ করা হয়েছে। কালো ও সাদার মধ্যে পার্থক্য টেনে আফ্রিকা ও আমেরিকায় কৃষ্ণাংগদের ওপর যে অত্যাচার চালানো হয়েছে তা ইতিহাসের পাতায় অনুসন্ধান করার প্রয়োজন নেই বরং প্রায়শই খবরের কাগজে নিজ চোখে দেখতে পাওয়া যায়। ইউরোপ-আমেরিকা এশিয়া ও আফ্রিকার সাথে যে ধরনের আচরণ করে তাতে এটা ভাবা স্বাভাবিক যে, তাদের গণ্ডির বাইরে জন্মগ্রহণকারীদের জান-মাল তাদের জন্য হালাল এবং ঠুনকো অজুহাতে একটি দেশের সার্বভৌম সীমানা তছনছ ঢুকে পড়া তাদের জন্য খুবই সহজ ব্যপার। তাদেরকে লুট করা, ক্রীতদাস বানানো এবং প্রয়োজনে পৃথিবী পৃষ্ঠ থেকে নিশ্চিহ্ন করে দেয়ার অধিকার তাদের আছে।
সমাজ ভাঙনের কার্যকরী ভূমিকা পালনকারী এ সমস্ত গোমরাহী দূর করার জন্য আল কুরআন পথনির্দেশনা দান করেছে। কুরআন বলছে মর্যাদার যে বৃত্ত তোমরা গড়ে তুলেছো, তা সঠিক নয়। আল্লাহ তা’আলা বলেন, “হে মানবজাতি, তোমাদেরকে একজন পুরুষ এবং একজন নারী থেকে সৃষ্টি করেছি। তারপর তোমাদেরকে বিভিন্ন জাতি ও গোষ্ঠীতে বিভক্ত করে দিয়েছি যাতে তোমরা পরস্পরকে চিনতে পারো। তোমাদের মধ্যে যে অধিক আল্লাহভীরু বা মুত্তাকী সে-ই প্রকৃতপক্ষে আল্লাহর কাছে অধিক মর্যাদার অধিকারী। নিশ্চয়ই আল্লাহ মহাজ্ঞানী ও সবকিছু সম্পর্কে অবহিত।” (সুরা হুজরাত : ১৩)
সৃষ্টির সূচনা থেকেই সবার মূল উৎস এক। একমাত্র পুরুষ এবং নারী থেকে আমাদের গোটা মানবজাতি অস্তিত্ব লাভ করেছে। বর্তমান পৃথিবীতে যত বংশধারা দেখা যায় প্রকৃতপক্ষে তা একটি মাত্র প্রাথমিক বংশধারার বিভিন্ন শাখা-প্রশাখা। যা একজন মা ও একজন বাপ থেকে শুরু হয়েছিল। এ সৃষ্টিধারার কোথাও এ বিভেদ এবং উচ্চ নীচের কোন ভিত্তি নেই। কিন্তু আমরা বিভিন্ন ভ্রান্ত ধারনায় লিপ্ত আছি। আমাদের প্রত্যেকের স্রষ্টা আল্লাহ তা’আলা। এমন নয় যে, বিভিন্ন মানুষকে ভিন্ন ভিন্ন রব সৃষ্টি করেছেন। একই সৃষ্টি উপকরণ দিয়ে আমাদের প্রত্যেককে সৃষ্টি করা হয়েছে। এমন নয় যে, মানুষের মধ্যে কিছু লোককে মূল্যবান কোন বিশেষ উপাদান বা পবিত্র কোন উপাদান দ্বারা সৃষ্টি করা হয়েছে আর অপর কিছু লোককে অপবিত্র নিম্নমানের উপাদান দ্বারা সৃষ্টি করা হয়েছে। একই নিয়ম পদ্ধতিতে সকলেই জন্মলাভ করেছে।
কল্যাণ কামনা একটি ব্যাপক বিষয়। একজন মানুষ অন্য মানুষের দুনিয়া ও আখিরাত উভয় জীবনের জন্য কল্যাণ কামনা করবে। মানুষকে মানুষের কল্যাণের জন্যই প্রেরণ করা হয়েছে। মানুষের প্রথম ও প্রধান কল্যাণ হলো. তাঁকে অকল্যাণের পথ থেকে ফিরিয়ে কল্যাণের পথ প্রদর্শন করা। যে সমস্ত কাজ মানব সমাজে দুর্ভোগ সৃষ্টি করে, জলে-স্থলে বিপর্যয় ছড়িয়ে পড়ে সে সমস্ত কাজ বন্ধ করা ‘কল্যাণ কামনা’-এর অন্তর্ভূক্ত। আল্লাহ তা’আলা বলেন, “তোমরাই শ্রেষ্ঠ উম্মত, মানবতার কল্যাণের জন্য তোমাদেরকে প্রেরণ করা হয়েছে, তোমরা সৎ কাজের তথা কল্যাণের পথ অবলম্বনের জন্য আদেশ করবে এবং অসৎ, অকল্যাণ, পরিণামে যাতে দু:খ থাকে তা থেকে বিরত রাখবে। (ইমরান : ১১০) অন্যত্র আল্লাহ বলেন, “তোমাদের মধ্যে এমন একটি দল থাকা চাই যারা মানুষদেরকে কল্যাণের দিকে ডাকবে, তারা সৎ কাজ, কল্যাণের পথ অবলম্বনের জন্য আদেশ করবে এবং অসৎ,অকল্যাণ, পরিণামে যাতে দু:খ থাকে তা থেকে বিরত রাখবে। (ইমরান : ১০৪) সার্বিক কল্যাণ কামনা মানে: মু’মিন এমন এক জীবনব্যবস্থা গড়ে তুলবে,যাতে সার্বিকভাবে সকল মানুষ সুখে-শান্তিতে বসবাস করতে পারে এবং যার মাধ্যমেই আখিরাতে মুক্তি সুনিশ্চিত হয়।
কিন্তু অতীব দুঃখের সাথে উল্লেখ করতে হয় যে, মুসলমানদের মাঝে আজ কল্যাণ কামনা বহুলাংশে কমে গেছে। বস্তুবাদী চিন্তা-চেতনা আমাদেরকে দূর দিগন্তের অজানা ঠিকানায় নিয়ে গেছে। আজ এ ধরনের মানুষ পাওয়া খুব সহজ হয়ে দাঁড়িয়েছে যে, যখনই একটু প্রতিপত্তি,যশ, ধন-সম্পদ ও বড় কোন পদ-মর্যাদায় অভিসিক্ত হয় তখন তিনি তার আশ-পাশের ভাইদের কল্যাণ কামনা তো দূরের কথা তাদেরকে তখন আর মানুষ বলে গণ্য করেন না। একটি আদর্শবাদী দলের জন্য এটি যেমন আত্মঘাতী আচরণ, তদ্রুপ একটি জাতির জন্য এটি দুর্ভাগ্য বয়ে আনে। কোন মু’মিন এ ধরনের আচরণ করার অর্থ হলো নিজ বিশ্বাসের মধ্যে গোলমাল সৃষ্টি হয়েছে। কারণ রাসুল (স:) বলেছেন, “আমার প্রাণ যার হাতে, সে সত্তার শপথ করে বলছি, কোন মু’মিন সে পর্যন্ত ঈমানদার হতে পারবে না যে পর্যন্ত সে নিজের জন্য যা পছন্দ করে তা তার ভাইয়ের জন্য পছন্দ করবে।” (বুখারী : ১৩, ইফা : ১২, কিতাবুল ঈমান, বাবু মিনাল ঈমানে.....ও মুসলিম) হাদীসের অর্থ দাঁড়ায় ব্যক্তির ঈমান সে পর্যন্ত পরিপূর্ণ হবে না যে পর্যন্ত না সে অন্য ভাইয়ের জন্য নিজের অনুরূপ কল্যাণ ও মঙ্গলের চিন্তা করে। অন্য একজন মু’মিনের কল্যাণ চিন্তা করা অতি উঁচু মর্যাদা এবং আল্লাহর কাছে সম্মানের বিষয়। আল্লাহ আমাদেরকে সে ধরনের মহাসম্মানিত বিষয়ে সম্মানিত করুন।
লেখক : ব্যাংকার।