ধন-সম্পদ, অর্থ-বিত্ত, যশ-খ্যাতি, রূপ-সৌন্দর্য, প্রভাব-প্রতিপত্তি, অর্জন-সাফল্য সব সময়ই ইতিবাচক হয় না বরং ক্ষেত্র বিশেষে তা ভাগ্যবিড়ম্বনার কারণও হতে পারে। একথা অনস্বীকার্য যে, চুরি-ডাকাতি কিন্তু বিত্তহীনদের বাড়িতে হয় না বরং ধনাঢ্যরাই বারবার এ ফিৎনা ও অনাকাক্সিক্ষত ঘটনার সম্মুখীন হোন। রং অনুজ্জল নারীদের বিয়ে বিলম্বিত হলেও তারা কিন্তু সচরাচর ইভটিজিং, যৌন হয়রানি বা ধর্ষণের শিকার হোন না বরং এসব ফিৎনায় অতিমাত্রায় ভিকটিম হোন উজ্জল, সুশ্রী ও সুন্দরী নারীরাই। যৌন হয়রানি ও ধর্ষণের হার অন্যদের চেয়ে সুন্দরীদের ক্ষেত্রেই বেশি। যা ‘সৌন্দর্য বিড়ম্বনা’ হিসাবে বিবেচনা করা হয়। যা এখন আমাদের সমাজের অবিচ্ছেদ্য অংশ।

অর্থ-বিত্ত মানবজীবনের অতি গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ। কারণ, সম্পদহীন মানুষ জাগতিক সমাজে একেবারেই মূল্যহীন। কিন্তু সে অর্থই আবার ক্ষেত্র বিশেষে অনর্থ ডেকে আনে; কারণ হয় ভোগান্তির। এজন্য কোন কোন ক্ষেত্রে চড়া মূল্য দেয়ারও রেকর্ড রয়েছে। অবশ্য, কালজয়ী ঔপন্যাসিক মীর মোশাররফ হোসেন তার ‘বিষাদ সিন্ধু’ উপন্যাসে অর্থকে সকল অনর্থের মূল হিসাবে বর্ণনা করেছেন। যদিও কথাটা সকল ক্ষেত্রে সমানভাবে প্রযোজ্য নয়। তারপর মানুষ যে অর্থলিপ্সায় পশুত্বের চরম পর্যায়ে নামতে পারে তা ইমাম হোসাইন (রা.) শাহাদাতের ঘটনায় সফল ও স্বার্থকভাবেই প্রমাণিত হয়েছে। তাই তো মীর মোশাররফ হোসেনের লেখনী থেকে বেড়িয়ে এসেছে, ‘অর্থ! হায়রে অর্থ! হায়রে পাতকী অর্থ! তুই জগতের সকল অনর্থের মূল। জীবের জীবনের ধ্বংস, সম্পত্তির বিনাশ, পিতা-পুত্রের শত্রুতা, স্বামী-স্ত্রীতে মনোমালিন্য, ভ্রাতা-ভগ্নিতে কলহ, রাজা-প্রজায় বৈরী ভাব, বন্ধু-বান্ধবে বিচ্ছেদ, বিবাদ, বিসংবাদ, কলহ, বিরহ, বিসর্জন বিনাশ-এ সকলই তোমার জন্য’।

‘সকল অনর্থের মূল ও কারণই তুমি। তোমার কী মোহিনী শক্তি! কী মধুমাখা বিষ সংযুক্ত প্রেম, রাজা-প্রজা, ধনী-নির্ধন, যুবক-বৃদ্ধ সকলেই তোমার জন্য ব্যস্ত-মহাব্যস্ত; প্রাণ ওষ্ঠাগত! তোমারই জন্য কেবলমাত্র তোমারই কারণে-কতজনে তীর, তরবারি, বন্দুক, বর্শা, গোলাগুলি অকাতরে বক্ষ পাতিয়া বুকে ধরিতেছে। তোমারই জন্যে অগাধ জলে ডুবিতেছে, ঘোর অরণ্যে প্রবেশ করিতেছে, পর্বত শিখরে আরোহণ করিতেছে......!’ মূলত, ইমাম হোসাইন (রা.)-এর শাহাদাত ছিলো তদানীন্তন কায়েমী স্বার্থবাদীদের স্বার্থ ও বৈষয়িক স্বার্থচিন্তার বহিঃপ্রকাশ। যা প্রখ্যাত ঔপন্যাসিক মীর মোশাররফ হোসেন ‘বিষাদ সিন্ধু’ উপন্যাসের প্রধান উপজীব্য।

প্রত্যেক মানুষ তার কর্মের স্বীকৃতি চান। উন্মুখ হয়ে থাকেন যশ-খ্যাতির জন্য। এজন্য মেধা, শ্রম ও অর্থ খরচ করতেও কসুর করেন না। আর সে খ্যাতিই কারো কারো জন্য কাল হয়ে দাঁড়ায়। এজন্য ভাগ্যবিড়ম্বনার মুখোমুখি হতে হয়। পরিস্থিতি এমন প্রান্তিকতায় নেমে যায় যে, সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে আত্মগোপনেও যেতে হয়। বিষয়টি ‘খ্যাতির বিড়ম্বনা’ শীর্ষক ‘রম্য’ নাটিকায় নাট্যকার রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সফল ও স্বার্থকভাবে প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর উকিল দুকড়ি দত্ত চরিত্রের মাধ্যমে তা খুবই প্রাণবন্ত ও হৃদয়গ্রাহী করে উপস্থাপন করেছেন। বস্তুত, উকিল দুকড়ি দত্ত ছিলেন পেশায় একজন আইনজীবী। পেশাগত কারণেই তিনি ব্যাপক অর্থ-বিত্তের মালিক হয়েছিলেন। কিন্তু এক শ্রেণির স্তাবক বা চাটুকাররা তাকে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে ব্যাপকভাবে জনহিতৈষী বা দেশহিতৈষী হিসাবে প্রচার-প্রচারণা চালিয়েছিলো। এতে তার সুখ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছিলো লোক-লোকান্তরে। যা প্রথম দিকে দুকড়ি দত্তের কাছে বেশ উপভোগ্যই হয়ে উঠেছিলো কিন্তু পরিণামটা খুব সুখকর হয়নি। উকিল দুকড়ী দত্তের সুখ্যাতি তাকে মোটেই স্বস্তি দেয়নি বরং এজন্য তাকে অনেক বিড়ম্বনার মুখোমুখি হতে হয়েছে। অত্যন্ত জনহিতৈষী হিসাবে প্রচার পাওয়া উকিল বাবুকে খ্যাতির বিড়ম্বনার পাগল প্রায় হতে হয়েছিলো। আর এজন্য তার আত্মগোপন ছাড়া কোন গত্যন্তর ছিলো না। শেষ পর্যন্ত খ্যাতির বিড়ম্বনা সামাল দিতে তাকে সে পথেই অগ্রসর হতে হয়েছে।

উপরের আলোচনাটা একটা রম্য-নাটিকার কাহিনী বিশেষ। কিন্তু বাস্তবেও এর প্রয়োগ বা প্রভাব একেবারের উপেক্ষা করার মত নয়। ‘উপকারীকে বাঘে খায়’ আর ‘উপকারী অর্জুন গাছের ছাল থাকে না’ কথাগুলো কারো অজানা নয়। এর বাস্তব প্রয়োগটা আমাদের দেশে রাজনীতিতে লক্ষ্য করা যায়। যেসব রাজনীতিক ও রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব দেশ ও জাতির কল্যাণে কাজ করে গণমানুষের কাছে অধিকতর গ্রহণযোগ্যতা ও জনপ্রিয়তা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছিলেন, তাদের মধ্যে কাউকে কাউকে নির্মম পরিণতি ভোগ করতে হয়েছে। এমনকি জীবনও বিসর্জন দিতে হয়েছে কাউকে কাউকে। এর বাস্তব প্রমাণ শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান। ১৯৭৫-এর রক্তাক্ত ও অনিবার্য পট পরিবর্তনের পর তিনি অতি অল্প সময়ের মধ্যেই দেশে স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছিলেন। তিনি দেশে একদলীয় বাকশালী শাসনের বিলুপ্তি সাধন করে দেশে বহুদলীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার অগ্রনায়ক ছিলেন। শহীদ রাষ্ট্রপতি অতি অল্প সময়ের মধ্যেই বাকশালী-ফ্যাসিবাদীদের ধ্বংসস্তূপে দাঁড়িয়ে নতুন বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয়ে নিরলসভাবে কাজ করা শুরু করেছিলেন এবং ব্যাপক সাফল্যও তার হাতে এসে ধরা দিয়েছিলো। আন্তর্জাতিক সম্পর্কেও সৃষ্টি হয়েছিলো ঐতিহাসিক বিবর্তন। নতজানু পররাষ্ট্রনীতির পরিবর্তে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো স্বাধীন ও সম্মানজনক পররাষ্ট্রনীতি। তিনি বাংলাদেশের একজন আদর্শ রাষ্ট্রনায়কে পরিণত হয়েছিলেন। তার সুনাম-সুখ্যাতি শুধু দেশেই নয় বরং আন্তর্জাতিক বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছিলো। কিন্তু তার এ জনপ্রিয়তাই তার জন্য কাল হয়ে দাঁড়িয়েছিলো। যারা চাননি যে, রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বে দেশ আত্মনির্ভরশীল ও সমৃদ্ধশালী হয়ে বিশ্ব দরবারে মাথা উঁচু করে দাঁড়াক, তাদের কাছেই তিনি চক্ষুশূলে পরিণত হয়েছিলেন। ফলে তাকে অতি অল্প সময়ের মধ্যেই শাহাদাত বরণ করতে হয়েছিলো। কারণ, বিভীষণরা তার এ জনপ্রিয়তা ও সাফল্য সহ্য করতে পারেনি। তাই তাকে শাহাদাত বরণ করে নিতে হয়েছিলো।

রাষ্ট্রপতি জিয়ার শাহাদাতের পর দেশ ও জাতির ক্রান্তিকালে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি হিসাবে রাষ্ট্রের হাল ধরেছিলেন বিচারপতি আব্দুস সাত্তার। তিনিও শহীদ জিয়ার ধারাবাহিক পথেই অগ্রসর হলেন। ফলে তার যশ-খ্যাতি ও জনপ্রিয়তা একেবারে তুঙ্গে উঠেছিলো। সঙ্গত কারণেই তিনি ১৯৮১ সালের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে ভূমিধস বিজয় পেয়েছিলেন। কিন্তু ষড়যন্ত্রকারীদের তাও সহ্য হয়নি। তাই ১৯৮২সালে বন্দুকের নলের মুখে একজন অতিজনপ্রিয় এবং বিপুল ভোটে নির্বাচিত রাষ্ট্রপতিকে ক্ষমতা হারাতে হয়েছিলো। জনপ্রিয়তা, রাজনৈতিক প্রজ্ঞা, কর্তব্য নিষ্ঠা ও সততা তার কাল হয়ে দাঁড়িয়েছিলো। এজন্য তাকে দিতে হয়েছিলো বেশ চড়া মূল্য।

এমনই জনপ্রিয় ও সুখ্যাতির বলী হতে হয়েছে বিএনপির চেয়ারপার্সন সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়াকে। তার আপোষহীন ইমেজ, দেশপ্রেম ও আকাশচুম্বী জনপ্রিয়তার জন্য তাকেও ব্যাপক মূল্য দিতে হয়েছে। তার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষরা তাকে রাজনৈতিক ও আদর্শিকভাবে মোকাবেলা করতে ব্যর্থ হয়ে নানাবিধ ষড়যন্ত্রের আশ্রয় নিয়েছে। একটি ভুয়া, সাজানো ও পাতানো মামলায় ষড়যন্ত্রমূলকভাবে তাকে সাজা দেয়ার কারণে তাকে দীর্ঘ পরিসরে কারাভোগ করতে হয়েছে। উল্লেখ করা দরকার যে, ২০০১ সালে ৪ দলীয় জোট নির্বাচনে বিজয়ের পর ঐক্যবদ্ধভাবে সরকারও গঠন করেছিলো। সে সরকারে জামায়াতের ২ শীর্ষনেতা তথা সংগঠনটির আমীর শহীদ মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী ও সেক্রেটারি জেনারেল শহীদ আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ সরকারে প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন। তারা পর্যায়ক্রমে ৩টি মন্ত্রণালয় অত্যন্ত সততা, দক্ষতা, প্রজ্ঞা ও দূরদর্শিতার সাথে পরিচালনা করে পুরোপুরি সফল হয়েছিলেন। ৪ দলীয় জোট সরকার ক্ষমতা হারানোর পর অনেক মন্ত্রীদের বিরুদ্ধে ব্যাপক দুর্নীতি ও অনিয়মের অভিযোগ উঠলেও জামায়াতের ২ মন্ত্রীর বিরুদ্ধে কোন প্রকার অভিযোগ উত্থাপন করা সম্ভব হয়নি। আর এর মূল্য পরিশোধ করতে হয়েছে তাদের জীবন দিয়ে। কারণ, মহল বিশেষ তাদের এ সফলতা সহ্য করতে পারেনি।

পছন্দ হয়নি আমাদের বৃহত নিকট প্রতিবেশীরও। তারা ধরেই নিয়েছিলো যে, যদি জামায়াত এভাবে নিজেদের ক্লিন ইমেজ ধরে রাখতে পারে, তাহলে প্রতিপক্ষদের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ ঝুঁকির মধ্যে পড়বে। তাই জামায়াতের দু’জন সাবেক মন্ত্রী সহ আরো কয়েকজন শীর্ষনেতার বিরুদ্ধে কথিত মানবতাবিরোধী অপরাধের চার্জ আনা হয়েছিলো। দলীয় প্রসিকিউশন, সাজানো সাক্ষী ও ফরমায়েসী বাদীর মাধ্যমে কথিত বিচারের নামে প্রহসন করে শুধু সাবেক ২ জন অতিজনপ্রিয় মন্ত্রীকে শুধু ফাঁসিতে ঝোলানো হয়নি বরং ভবিষ্যতে যাতে এ শূন্যতা পূরুণ হতে না পারে, সে জন্য অধ্যাপক গোলাম আযম, মাওলানা একেএম ইউসুফ, মাওলানা আব্দুস সুবহান, আল্লামা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী, মোহাম্মদ কামারুজ্জামান, আব্দুল কাদের মোল্লা, মীর কাসেম আলী এবং এটিএম আজহারুল ইসলামের মত শীর্ষনেতাদের বিরুদ্ধে একই ধরনের চার্জ আনা হয়েছিলো। এদের মধ্যে কেউ কেউ কারা নির্যাতনে শহীদ হয়েছেন। আবার কাউকে কাউকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে শহীদ করা হয়েছে। জুলাই বিপ্লব পরবর্তী সময়ে শুধুমাত্র এটিএম আজহারুল ইসলাম স্ব-সম্মানে মুক্তি লাভ করেছেন। এদের প্রত্যেকের অপরাধ ছিলো সততা, যোগ্যতা, কর্তব্য নিষ্ঠা ও দেশপ্রেম। তারা প্রত্যেকেই ছিলেন ক্ষুধা, দারিদ্র্য, অপশাসন ও দুঃশাসন ম্ক্তু এক মানবিক বাংলাদেশের স্বপ্নদ্রষ্টা।

শুধু আমাদের দেশেই নয় বরং আন্তর্জাতিক অঙ্গনে এমন অসংখ্য নজীর রয়েছে। যারা স্ব স্ব ক্ষেত্রে খ্যাতি ও জনপ্রিয়তার কারণেই নানাভাবে বিড়ম্বনার শিকার হয়েছেন। এমনকি তাদের অনেককেই নিজের জীবন দিয়ে সে মূল্য পরিশোধ করতে হয়েছে। স্বাধীনচেতা এবং আপোষহীন মনোভাব ও প্রজাবৎসল হওয়ার কারণেই পলাশীর যুদ্ধ নামক প্রহসনের পরাজয়ের পর নবাব সিরাজকে শহীদ করা হয়েছিলো নির্মমভাবে। রেহাই দেওয়া হয়নি তার পরিবার-পরিজনকেও। একই কারণে প্রাণ দিতে হয়েছিলো শহীদ টিপু সুলতানকে। ভারতকে স্বাধীন করার জন্য সিপাহী বিদ্রোহে নেতৃত্ব দেয়ায় কথিত অপরাধে চরম ভাগ্যবিড়ম্বনার শিকার হতে হয়েছিলো শেষ মোঘল সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফর ও সম্রাজ্ঞী জিনাত মহল সহ তার পুরো পরিবারকে। ইয়ংগুনের একটি সংকীর্ণ কারা প্রকোষ্টে অসম্মানজনকভাবে প্রাণ বিসর্জন দিতে হয়েছে জহির উদ্দীন মোহাম্মদ বাবুরের শেষ মোঘল সম্রাটকে। স্বাধীনচেতা মনোভাবের কারণেই বৃটিশদের সাথে যুদ্ধে জীবন দিয়ে প্রায়শ্চিত্য করতে হয়ে বীরকন্যা ঝাঁসির রাণী লক্ষ্মীবাঈকে।

জামায়াতে ইসলামীর প্রতিষ্ঠাতা আমীর সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদুদী (রাহি.)-এর মত কালজয়ী দাঈকে তার প্রতিপক্ষ ফাঁসির মঞ্চ পর্যন্ত নিয়ে গিয়েছিলো। মিশরের ইখওয়ান নেতা সাইয়্যেদ কুতুবকে ফাঁসির মঞ্চেই শহীদ করা হয়েছিলো। আরেক ইখওয়ান নেতা শহীদ হাসানুল বান্না শহীদ হয়েছিলেন আততায়ীর গুলীতে। জনপ্রিয়তাই কাল হয়ে দাঁড়িয়েছিলো মিশরের নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট এবং ইখওয়ান নেতা মোহাম্মদ মুরসীর জন্য। তাকেও নির্মমভাবে কারাগারে শাহাদাত বরণ করতে হয়েছে। অতিজনপ্রিয়তার কারণেই পাকিস্তানের সাবেক প্রেসিডেন্ট জেনারেল জিয়াউল হককে প্লেন ক্রাসের মাধ্যমে হত্যা করা হয়েছিলো। শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট রানাসিংহে প্রেমাদাসাকেও একই ভাগ্য বরণ করতে হয়। তিনি স্বাধীনতা দিবসের সোভাযাত্রায় বোমা হামলায় প্রাণ হারিয়েছিলেন। অহিংস ও অসাম্প্রদায়িক আন্দোলনের কারণে মহাত্মা গান্ধী (মোহন দাস করম চাঁদ গান্ধী) আততায়ীর গুলীতে প্রাণ দিতে হয়েছে। নাথুরাম গডসে ছিলো তার আততায়ী। ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর মত রাষ্ট্র নায়কও তা থেকে আলাদা ছিলেন না। বাদ যাননি তার পুত্র সঞ্জয় ও রাজীব গান্ধীও।

শুধু যে তৃতীয় বিশ্বের রাষ্ট্রগুলোতে এ ধরনের ঘটনার অবতারণা হয়েছে তা কিন্তু নয় বরং পশ্চিমা বিশ্বেও এ ধরনের নজীর রয়েছে। এমনকি ৪ জন মার্কিন প্রেসিডেন্টকে অতিজনপ্রিয়তার জন্যই হত্যাকাণ্ডের শিকার হতে হয়েছে। একথা কারো অজানা নয় যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টদের নিরাপত্তায় রয়েছে আলাদা বিশেষ বাহিনী। সিক্রেট সার্ভিস নামে গঠিত বিশেষ বাহিনীর মাধ্যমে তাদের নিরাপত্তা দেওয়া হয়। এমনকি প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর থেকে আজীবন তাদের এই বাহিনী নিরাপত্তা দেয়। বিশেষায়িত এ বাহিনীর নিরাপত্তা সত্ত্বেও হত্যাচেষ্টা করা হয়েছে বিভিন্ন মার্কিন প্রেসিডেন্টকে। মার্কিন সংবাদমাধ্যম সিএনএন-এর দেয়া তথ্যমতে, যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক চার জন প্রেসিডেন্ট হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছিলেন। তারা প্রত্যেকেই ছিলেন অতিজনপ্রিয় ও সফল প্রেসিডেন্ট। সে ধারাবাহিকতায় ১৮৬৫ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে প্রথম গুপ্তহত্যার শিকার হয়েছিলেন প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিঙ্কন। ১৮৮১ সালে ওয়াশিংটন ডিসির একটি ট্রেন স্টেশনে আততায়ীর হাতে গুলিবিদ্ধ হন প্রেসিডেন্ট জেমস গারফিল্ড। পরে তিনি মারা যান। ১৯০১ সালের সেপ্টেম্বরে নিউ ইয়র্কের বাফেলোতে আততায়ীর হাতে নিহত হন প্রেসিডেন্ট উইলিয়াম ম্যাককিনলে। ১৯৬৩ সালের নভেম্বরে ডালাসে স্নাইপারের গুলিতে প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনডি নিহত হন।

মূলত, ৪ দলীয় জোট সরকারের জামায়াতের ২ জন মন্ত্রীর সততা, নিষ্ঠা, দেশপ্রেম, সাফল্য ও জনপ্রিয়তাই দলটির ভাগ্যবিড়ম্বনার কারণ হয়ে দেখা দেয়। এজন্য সাবেক মন্ত্রী সহ বেশকিছু সিনিয়র নেতাকে হারাতে হয়। এমনকি পতিত আওয়ামী লীগের প্রায় ১৬ বছরের অপশাসন-দুঃশাসনে জামায়াতের ওপর জুলুম-নির্যাতন চালানো হয়, তা বিশ্ব রাজনীতিতে এক নজীরবিহীন ঘটনা। পতিতরা এদেশের রাজনীতি থেকে জামায়াতকে পুরোপুরি নিশ্চিহ্ন করে দিতে চেয়েছিলো। কিন্তু ফল হয়েছে ঠিক তার উল্টো। জুলুম-নির্যাতন, হত্যা, সন্ত্রাস, গুপ্তহত্যা পথ ধরেই জামায়াত রাজনীতিতে এক উদীয়মান ও সম্ভবনাময় শক্তি। দলটি এখন অতীতের যেকোন সময়ের চেয়ে অধিক জনপ্রিয়। যার প্রমাণ মিলেছে সদ্য সমাপ্ত ডাকসু ও জাকসু নির্বাচনে। সঙ্গত কারণে দলটির অগ্রযাত্রা রোধ করার জন্য নতুন ষড়যন্ত্র ব্যতিক্রম কিছু নয়। যদিও তা বিরুদ্ধবাদীদরে অলীক কল্পনা বৈ কিছু নয়। কারণ, সময় বদলেছে। ইতোমধ্যেই পদ্মা, মেঘনা, যমুনায় অনেক পানি প্রবাহিত হয়েছে। তবে বিভীষণরা মোটেই থেমে নেই। সে ধারাবাকিতায় রাকসু, চাকসু সহ সকল ছাত্র সংসদ নির্বাচন নিয়ে নতুন করে ষড়যন্ত্র শুরু হয়ে গেছে। সে ষড়যন্ত্রের ধারাবাহিকতায় বিরুদ্ধবাদীদের দাবির মুখে রাকসু নির্বাচন পেছানো হয়েছে। জামায়াত সহ দলটির জনপ্রিয়তা এখন সকল সময়ের চেয়ে তুঙ্গে ওঠায় জাতীয় রাজনীতিতেও এর প্রভাব লক্ষ্য করা যাচ্ছে। জামায়াতকে ভোট দিলে ভবিষ্যতে কী হবে বা তারা ক্ষমতা পাবে কি না, তা নিয়ে বিরোধী পক্ষের কল্পকথার কোন সীমা-পরিসীমা নেই। এমনিতেই তো বিগত প্রায় ১৬ বছরের বিভিন্ন প্রতিকূলতা ও ষড়যন্ত্র মোকাবেলা করে বর্তমান অবস্থায় পৌঁছতে হয়েছে এবং একই সাথে সৃষ্টি হয়েছে আগামী দিনের এক অপার সম্ভবনা। আর এজন্য তাদেরকে আর কী মূল্য দিতে হয় তা-ই এখন দেখার বিষয়। বিষয়টি নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে উদ্বেগ-উৎকন্ঠারও অন্ত নেই।

‘আপনা মাঁসে হরিণা বৈরী’ খুবই পরিচিত একটি উক্তি। উক্তিটি এসেছে চর্যাপদের অন্যতম কবি ভুসুকুপা’র পদ থেকে। কারো সৌন্দর্য ও অর্জন যখন তার জন্য ক্ষতিকর কিছু হয়, তখন আমরা উক্তিটি ব্যবহার করি। যেমন, সুন্দরবনের হরিণের ক্ষেত্রে উক্তিটি বেশ যুক্তিযুক্ত। কারণ, হরিণের দৌহিক সৌন্দর্য ও সুস্বাদু মাংসই প্রাণীটির প্রধান শত্রু। বিষয়টি প্রাণীটির অসহায়ত্ব ও ভাগ্য বিড়ম্বনারও কারণ।