মাহমুদুল হক আনসারী

বাংলাভাষী মুসলমানকে তাড়িয়ে দিচ্ছে ভারত সরকার। এ সংবাদ মানবাধিকার সংগঠন ্ও দেশ বিদেশের বিভিন্ন আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে প্রচার হচ্ছে। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন হিউমান রাইটস ওয়াচ বলছে, ভারত কর্তৃপক্ষ কোনো প্রক্রিয়া ছাড়াই দেশটি থেকে শত শত বাংলাভাষী মুসলমানকে এ অভিযোগ করে বাংলাদেশে তাড়িয়ে দিচ্ছে যে তারা ‘অবৈধ অনুপ্রবেশকারী’। এদের মধ্যে অনেকেই বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী রাজ্যগুলোর ভারতীয় নাগরিক। হিউমান রাইটস ওয়াচ এ নিয়ে এক বিস্তারিত প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মে মাসের সাত তারিখ থেকে জুনের ১৫ তারিখ পর্যন্ত ভারত দেড় হাজারেরও বেশি মুসলমান নারী-পুরুষ ও শিশুকে বাংলাদেশে বিতাড়িত করেছে। এ সংখ্যার মধ্যে আছেন মিয়ানমার থেকে আসা প্রায় একশো জন রোহিঙ্গা শরণার্থীও। তবে ভারত সরকার এ বিষয়ে আনুষ্ঠানিক কোনো তথ্য যে দেয় নি, সেকথাও লিখেছে হিউমান রাইটস ওয়াচ। এ সংখ্যা তারা পেয়েছে বর্ডার গার্ডস বাংলাদেশ বা বিজিবির দেওয়া তথ্য থেকে।

হিউমান রাইটস ওয়াচের এশিয়া বিভাগের পরিচালক ইলেইন পিয়ারসন বলেন, “ভারতীয় নাগরিক সহ বাঙালি মুসলমানদের দেশ থেকে যেনোতেনোভাবে বিতাড়িত করে দিয়ে ভারতের ক্ষমতাসীন বিজেপি বৈষম্য তৈরি করছে।” এ প্রতিবেদন তৈরি করার জন্য জুন মাসে ১৮ জন বিতাড়িত মানুষের সাক্ষাৎকার নিয়েছে হিউমান রাইটস ওয়াচ, যাদের মধ্যে এমন মানুষও ছিলেন যারা নিজেরাই এই প্রক্রিয়ার শিকার হয়েছেন। অন্য নয়টি এমন সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়েছে, যেখানে ভুক্তভোগীদের পরিবারের ব্যক্তিরা কথা বলেছেন হিউমান রাইটস ওয়াচের সঙ্গে। যাদের সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়েছে, তাদের মধ্যে এমন ভারতীয় নাগরিকও আছেন যারা বাংলাদেশে বিতাড়িত হওয়ার পরে আবারও ভারতে ফিরে গেছেন। আটক হওয়ার পরে এখনো নিখোঁজ রয়েছেন, এমন কয়েকজনের পরিবারের সঙ্গেও কথা বলেছে এই আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনটি।

ওইসব সাক্ষাৎকারের বিস্তারিতও হিউমান রাইটস ওয়াচ প্রকাশ করেছে তাদের প্রতিবেদনে। এ ধরনের অনেক সাক্ষাৎকার বিবিসি বাংলা ইতোমধ্যেই সম্প্রচার এবং প্রকাশ করেছে। যাদের ভারত থেকে বিতাড়িত করা হয়েছে, তাদের একটা বড় অংশই আসাম আর পশ্চিমবঙ্গের পরিযায়ী শ্রমিক এবং তারা বাংলাভাষী মুসলমান-এ মন্তব্য বারেবারেই করেছে হিউমান রাইটস ওয়াচ। জুলাই মাসের আট তারিখ হিউমান রাইটস ওয়াচ তাদের প্রাপ্ত তথ্যাবলী দিয়ে ভারতের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের কাছে চিঠি পাঠিয়েছিল, তবে কোনো জবাব আসে নি। সংগঠনটি জানিয়েছে “আসাম, উত্তর প্রদেশ, মহারাষ্ট্র, গুজরাত, ওড়িশ্যা আর রাজস্থানের বিজেপি শাসিত সরকার মুসলমানদের আটক করছে। এদের বেশিরভাগই গরীব, পরিযায়ী শ্রমিক। আটক করার পরে এদের ভারতীয় সীমান্ত রক্ষী বাহিনীর হাতে তুলে দেওয়া হচ্ছে।”কিছু ক্ষেত্রে সীমান্ত রক্ষীরা আটক হওয়া ব্যক্তিদের মারধর করেছে এবং যথাযথ ভাবে তাদের নাগরিকত্ব যাচাই না করেই জোর করে বাংলাদেশ সীমান্ত পার করতে বাধ্য করছে। সীমান্ত পার করে দেওয়ার পরে নিজেদের ভারতীয় নাগরিকত্ব প্রমাণ করতে পেরেছেন, এরকম ডজন-খানেক মানুষকে ভারত আবারও ফিরিয়ে নিতে বাধ্য হয়েছে” বলে জানিয়েছে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনটি।

ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ভারত শাসিত কাশ্মীরের পহেলগামে এপ্রিল মাসে “হিন্দু পর্যটকদের ওপরে প্রাণঘাতী হামলা” হওয়ার পরেই এ প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। মুসলমানদের হেনস্থা করা শুরু করে পুলিশ, ভারতীয় নাগরিকত্বের প্রমাণ অগ্রাহ্য করে, ফোন নথি এবং অন্যান্য ব্যক্তিগত সামগ্রী কেড়ে নেওয়া হয় যাতে আটক হওয়া ব্যক্তিরা তাদের পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগও না করতে পারে। মুসলমান-প্রধান বাংলাদেশ থেকে ভারতে অনুপ্রবেশ কয়েক দশক ধরে চলছে, কিন্তু এর কোনো সুনির্দিষ্ট তথ্য পাওয়া যায় না। আবার রাজনৈতিক কারণে কখনও ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে দেখানো হয় বলেও মন্তব্য করেছে হিউমান রাইটস ওয়াচ।

সাম্প্রতিক সময়ে ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে মুসলমানদের উপর অত্যাচার নিপীড়ন বৃদ্ধি পেয়েছে। তারা ভারতের প্রমাণিতভাবে নাগরিক হ্েলও ইচ্ছেপূর্বক ভারত সরকার আইনশৃঙ্খলা বাহিনী দিয়ে ভারতীয় মুসলমানদের ঘরবাড়ি, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ধ্বংস করছে। উচ্ছেদ করছে সব ধরনের নাগরিক পরিচিতি থাকার পরও। ভারত সরকারের এহেন আচরণ দীর্ঘ সময় থেকে চলমান রয়েছে। তবে আট দশ মাস পূর্বে এমনভাবে ভারতীয় মুসলমানদেরকে বিতাড়নে আগ্রাসী ছিল না।

বাংলাদেশে হাসিনা সরকারের পতনের পর ভারতের সাথে বাংলাদেশের কূটনৈতিক তৎপরতায় দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছে। নানান বিষয়ে ভারত ও বাংলাদেশ সরকারের বর্তমান আন্তর্জাতিক বিষয়ে ভুল বুঝাবুঝি চলছে। বাংলাদেশের রাজনৈতিক মাঠে ভারত বিরোধিতা আগের চেয়ে প্রকট আকার ধারণ করেছে। বিশেষ করে ইসলামি রাজনীতির নেতাদের বক্তব্যে ভারতের নানান ইস্যুতে সমালোচনা বক্তব্য বৃদ্ধি অব্যাহত আছে। বিগত দিনে বাংলাদেশ ভারতের মধ্যে দ্বীপাক্ষিক বহু চুক্তি কর্মসূচী বাস্তবায়ন চলমান ছিল। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দেশ পরিচালনার পর থেকে ভারতের সাথে বাংলাদেশের সবগুলো চুক্তি কর্মসূচি আলোচনা পর্যালোচনায় বহু চুক্তি কার্যকর বাস্তবায়ন থেকে সরে এনেছে। বলা যায় বর্তমান সময়ে বাংলাদেশ ভারত কূটনৈতিক সম্পর্ক স্বাধিণতার পর অত্যান্ত নাজুক পরিস্থিতিতে।

যার কারণে ভারত বাংলাদেশের বর্তমান সরকার ও রাজনৈতিক কতিপয় দলের বক্তব্যে এক ধরনের কূটনৈতিক চাপের শিকার হচ্ছে। ভারত বাংলাদেশের সাথে ব্যবসা বাণিজ্য আদান প্রদান বহুলাংশে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বাংলাদেশ ও ভারতের জনগণের মধ্যে দীর্ঘদিনের একটি যাতায়াত থাকল্ওে সাম্প্রতিক সময়ে সেটি হ্রাস পেয়েছে। অর্থনৈতিক, ব্যবসা বাণিজ্য দুই দেশের নাগরিকের মধ্যে দূরত্ব তৈরি হয়েছে। ফলে প্রতিবেশী এলাকার নাগরিকদের মধ্যে একটি চরম ভাবে হতাশাও দেখা যায়। অর্থনৈতিক প্রাণচাঞ্চল্য অনেকটা ভাটা পড়েছে।

বাংলাদেশ ও ভারতে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি কোনো কোনো সময় রাজনৈতিক কারণে বিনষ্ট হয়। কুচক্রি মহল সংখ্যালঘু মানুষগুলো নিয়ে রাজনৈতিক কূটকৌশল চক্রান্ত বাস্তবায়ন করে থাকে। শিকার হয় দু’দেশের সংখ্যালঘু জনগন। মনে হয় বর্তমানে ভারতের নিরীহ মুসলমান জনগন সেই দেশের উগ্রবাদী হিন্দু রাজনীতির ষড়যন্ত্রের শিকারের বলিতে পরিণত হয়েছে। ফলে কয়েক মাসের মধ্যে হাজার হাজার শান্তিকামি ভারতীয় মুসলমান নানান ভাবে নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। পার্শ্ববর্তী দু’দেশের মধ্যে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক সমজোতা দরকার সরকারের মধ্যে। তা নাহলে বাংলাদেশের মধ্যে রাজনৈতিক উত্তপ্ত বাগবিতন্ডার বলি হবে দু’দেশের আরো সংখ্যালঘু জনগণ।

লেখক : প্রাবন্ধিক।