DailySangram-Logo-en-H90
ই-পেপার আজকের পত্রিকা

কলাম

বিজ্ঞানী হকিং যেন সময়ের দার্শনিক

বর্তমান বিশ্বব্যবস্থা মানুষকে অশ্ব বানিয়েছে। অশ্বের মতো সে দৌড়াচ্ছে এবং দৌড়াচ্ছে। কেন দৌড়াচ্ছে, কোথায় যাচ্ছে-সে অবগতি তার নেই। প্রভুর আদেশ তাই দৌড়াচ্ছে সে। মানুষ যে দাস হয়ে গেল, এ ব্যাপারে ব্যাখ্যা দেওয়ার দায়িত্ব ছিল সভ্যতার। কিন্তু সভ্যতা সে দায়িত্ব পালন করেনি। আসলে সভ্যতাকে সে দায়িত্ব পালন করতে দেয়নি সভ্যতার শাসকরা।

Printed Edition

বর্তমান বিশ্বব্যবস্থা মানুষকে অশ্ব বানিয়েছে। অশ্বের মতো সে দৌড়াচ্ছে এবং দৌড়াচ্ছে। কেন দৌড়াচ্ছে, কোথায় যাচ্ছে-সে অবগতি তার নেই। প্রভুর আদেশ তাই দৌড়াচ্ছে সে। মানুষ যে দাস হয়ে গেল, এ ব্যাপারে ব্যাখ্যা দেওয়ার দায়িত্ব ছিল সভ্যতার। কিন্তু সভ্যতা সে দায়িত্ব পালন করেনি। আসলে সভ্যতাকে সে দায়িত্ব পালন করতে দেয়নি সভ্যতার শাসকরা। এমন যুগন্ধর দার্শনিকের আবির্ভাবও লক্ষ্য করা যায়নি, যারা সত্য উচ্চারণ করবেন। কারণ দিন শেষে তারা উপলব্ধি করেছেন, দার্শনিকদের ঘাড়েও একটিই মাথা। অতএব আত্মসমর্পণ। সেক্যুলার তথা ইহলৌকিকবাদী দার্শনিকরা এর চাইতে বড় কিংবা মহীয়ান হবেন কেমন করে? নবী-রাসূলরা (সা:) যা পারেন, দার্শনিকরা তা পারেন না। পারার কথাও নয়। কারণ নবী-রাসূলরা স্বার্থান্ধ সীমিত বুদ্ধির মানবের কথায় চলেন না, তারা চলেন সৃষ্টি জগতের প্রভু মহান আল্লাহর আসমানী কিতাবের আলোকে। আর দ্বিতীয় বিষয়টি হলো, নবী-রাসূলরা কখনো সেক্যুলার বা ইহলৌকিকবাদী ছিলেন না। তাঁরা পরকালে শুধু বিশ্বাসীই ছিলেন না; জবাবদিহিতার ভয়েও ছিলেন কম্পমান। ফলে সত্য উচ্চারণে এবং সত্য প্রতিষ্ঠায় তাঁরা ছিলেন অকুতোভয়। ঘাড়ে মাথা কয়টি, সে ভাবনা প্রশ্রয় পায়নি তাঁদের অন্তরলোকে। যারা নবী-রাসূলদের সাথী বা সাহাবা ছিলেন, তাঁদের আচরণেও লক্ষ্য করা গেছে একই চিত্র। নবী-রাসূলরা (সা:) মানুষকে মানুষের দাসত্ব থেকে মুক্ত করতে এসেছিলেন। সূরা আল আরাফের ১৫৭ নং আয়াতে বলা হয়েছে... নবী তাদের ঘাড় থেকে গোলামীর বোঝা নামিয়ে দেয় ...।

আমার সামান্য এ লেখায় ভূমিকাটি একটু দীর্ঘ হয়ে গেল নাকি? মোটেও না। কারণ, মানবসভ্যতার মূল দ্বন্দ্বটাই হলো স্বাধীনতা ও গোলামীর দ্বন্দ্ব। কায়েমী স্বার্থের প্রতিভূরা সবসময় মানুষকে দাস বা গোলাম বানিয়ে রাখতে চেয়েছেন। কখনো গোত্র বা বর্ণের নামে, কখনো ধর্ম বা টোটেম বিশ্বাসের নামে, আর আধুনিক বিশ্বে তা লক্ষ্য করা যাচ্ছে নানা তত্ত্ব বিজ্ঞান-প্রযুক্তি ও রাজনৈতিক ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে। নাম বা তত্ত্বের রঙ ও সাজশয্যা যা-ই হোক না কেন, মানুষকে গোলাম বানানোর প্রবণতা এখনো প্রবল। এ জন্য বোধহয় বিজ্ঞানী স্টিফেন হকিং বলেছেন, ‘বিপজ্জনক সময়ে আমাদের পৃথিবী।’ সাম্প্রতিক বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ এ বিজ্ঞানীকে নতুন করে তুলে ধরার বোধহয় প্রয়োজন নেই। তাত্ত্বিক পদার্থবিদ প্রফেসর স্টিফেন হকিং-এর জীবনের বিশাল অংশজুড়ে আছে কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় এবং এর পারিবেশ। জীবনের শেষ প্রান্তে এসে তিনি তার জ্ঞান এবং অভিজ্ঞানের কথা যেভাবে প্রকাশ করেছেন, তাতে ফুটে উঠেছে বর্তমান পৃথিবীর রাজনীতি, অর্থনীতি, কূটনীতি, অভিবাসী, বস্তিবাসী এবং বিজ্ঞান-প্রযুক্তির রকমফেরের কথা। সব মিলিয়ে কিছু মানুষ বর্তমান সভ্যতায় দানব হয়ে উঠছে, আর প্রায় সবার অবস্থান সর্বহারার অঙ্গনে অর্থাৎ গোলামীর তত্ত্বেও বিকাশ ঘটছে বর্তমান সভ্যতায়। স্টিফেন হকিং তার মতো করে বিষয়টির ব্যাখ্যা করেছেন। মানুষের ভোট প্রদান প্রসঙ্গেও তিনি কথা বলেছেন।

মার্কিন জনগণ প্রথমবার যখন ডোনাল্ড ট্রাম্পকে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন করলেন এবং সে সময় বৃটিশ জনগণ যখন ইউরোপীয় ইউনিয়ন ত্যাগ করলো, তখনকার পরিস্থিতি কেমন ছিল? স্টিফেন হকিং বলেন, মানুষ রাজনীতিক, এলিট, বিজ্ঞানী, ব্যবসায়ী, সেলিব্রিটিদের কথা শোনেননি, আমার কথাও শোনেননি। দুটি ঘটনাতেই ছিল ‘মানুষের ক্রোধের প্রতিফলন।’ মানুষের ক্রোধের সাথে যুক্ত হয়েছিল ভোট, আর এর পেছনে ছিল বিশ্বয়ন ও প্রযুক্তিক বিকাশজনিত উদ্বেগ। কারখানা স্বয়ংক্রিয় হয়ে যাওয়ায় কাজ হারিয়েছেন বহু মানুষ। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (অও)। এখন মধ্যবিত্তের চাকরি হারানোর আশঙ্কা আরও বাড়বে। ফলে বর্তমান সভ্যতায় বৈষম্যের বিপদ বাড়তেই থাকবে। ইন্টারনেটের বিভিন্ন প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে স্বল্পসংখ্যক মানুষকে নিয়োজিত করে প্রচুর মুনাফা অর্জন সম্ভব হবে। যার সিংহভাগ ভোগ করবে অতি অল্পসংখ্যক মানুষ। বৈষম্য ও ব্যবধানটা এত বেশি হবে যে, মনস্তাত্ত্বিকভাবেই প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাবে ‘প্রভু-গোলাম’ তত্ত্ব। হয়তো সুশীলরা বলবেন, এটাও এক ধরনের অগ্রগতি বটে।

তবে স্টিফেন হকিং বলছেন, ভিন্ন কথা। তার মতে, সমাজের জন্য এটা হবে ধ্বংসাত্মক। ব্যাখ্যায় তিনি বলেছেন, আমরা এখন এমন এক পৃথিবীতে বাস করছি, যেখানে মানুষের মধ্যে বৈষম্যের মাত্রা বাড়ছে, যেখানে বিপুল মানুষের শুধু যাপিত জীবনের মান নয়; জীবিকা অর্জনের সক্ষমতাও নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। ফলে তারা নতুন সামাজিক চুক্তির সন্ধান করছেন। প্রশ্ন জাগে, আমাদের প্রিয় এ গ্রহে কাক্সিক্ষত তেমন কোনো চুক্তির অনুশীলন চলছে কি? তেমন কোনো বার্তা কিন্তু মানুষ পায়নি। বরং রয়েছে ভিন্ন বার্তা। ইন্টারনেট ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের একটি অনাকাক্সিক্ষত ফলাফল হচ্ছে, বৈষম্য তথা অসমতার রূঢ় রূপটা একদম খোলাসা হয়ে গেছে। অতীতে ব্যাপারটা এরকম ছিল না। তথ্য-প্রযুক্তির এ জামানায় গরীব মানুষটার হাতে ফোন থাকলে সে ধনীতম মানুষের জীবন যাপন ও আচরণ দেখতে পাচ্ছে। সাব-সাহারা আফ্রিকা অঞ্চলের মানুষও হয়তো ফোন ব্যবহার করতে পারছে, কিন্তু তারা খাওয়ার মতো বিশুদ্ধ পানি পাচ্ছে না। বিজ্ঞান-প্রযুক্তির প্রসার হয়তো বাড়ছে, ধনীদের ব্যবসারও শ্রীবৃদ্ধি হচ্ছে, সাথে বাড়ছে বৈষম্যও। এর ফলাফল কেমন হচ্ছে? গ্রামের দরিদ্র মানুষ শহরে ভিড় করছে, বস্তিতে বাঁচার চেষ্টা করছে। কিন্তু বিশ^ব্যবস্থাটাই এমন যে, সেখানেও বাঁচতে পারছে না। ফলে আশার ভেলায় ভর করে পাড়ি জমায় বিদেশে। এমন অভিযাত্রার গল্প আরো মর্মন্তুদ। প্রতারণা, নির্যাতন এবং মৃত্যু। এসব ডিঙ্গিয়ে যারা ভিন দেশে পৌঁছতে পারেন, তাদের অভিজ্ঞতাও ভালো নয়।

জাতিগত বৈরিতা ও বৈষম্যে অভিবাসীদের স্বপ্নভঙ্গ হয়। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো, যারা বর্তমান সভ্যতার শাসক এবং বৈষম্যের কারিগর, তাদের কারণেই যে মানুষ দরিদ্র হয়, বস্তিবাসী হয়, অভিবাসী হয়Ñসেই সত্যটি তারা মেনে নিতে চান না। দায় স্বীকার না করলে দায়িত্ব পালন করবেন কেমন করে? বিষয়টি উপলব্ধি করেছেন স্টিফেন হকিংও। তাইতো তিনি বলেছেন, জাতিতে জাতিতে যে বৈরিতা, বিভেদের যে দেওয়াল, তা ভেঙ্গে ফেলতে হবে। আর সেটা করতে গেলে বিশ্বনেতাদের স্বীকার করতে হবে, তারা ব্যর্থ হয়েছেন। তারা প্রতিনিয়ত নানাভাবে ব্যর্থ হচ্ছেন। তারা অন্য অনেক মানুষকে ব্যর্থ করেছেন। মানবজাতির সম্পদ ক্রমাগতভাবে অল্পকিছু মানুষের হাতে পুঞ্জিভূত হচ্ছে। এখানে দৃষ্টিভঙ্গি ও বন্টনের সমস্যা প্রকট। বিষয়টি আমাদের শিখতে হবে, আচরণে প্রতিফলিত করতে হবে। শুধু ভাব দিয়ে, কথামালার ফেনা দিয়ে এমন মৌলিক কাজ সম্ভব নয়। বরং বিগত সময়ে এমন অকার্যকর কৌশলে সমস্যার মাত্রা বেড়েছে, বেড়েছে ধনী-গরীবের ব্যবধান। আসলে প্রভু-দাসের তত্ত্বটাই পুরো সভ্যতাকে অক্টোপাসের মতো বেঁধে ফেলেছে।

এখন মুক্তির উপায় কী? মুক্তির উপায় হলো স্বাধীনতা। স্বাধীনতার জন্য, নতুন পৃথিবীর জন্য মানুষকে উপযুক্ত করে গড়ে তুলতে হবে। স্বাধীনতা প্রসঙ্গে রাজনৈতিক স্বাধীনতা, অর্থনৈতিক স্বাধীনতা, মত প্রকাশের স্বাধীনতার কথা বলা হয়ে থাকে। স্টিফেন হকিং আরও কিছু কথা বলেছেন। বলেছেন, লন্ডন থেকে হার্ভার্ড এবং কেমব্রিজ থেকে হলিউড পর্যন্ত-সব অভিজাতকে অতীত থেকে শিক্ষা নিতে হবে। তবে সবার ওপরে তাদের সংযম শিখতে হবে, নম্র হতে হবে। বিজ্ঞানী স্টিফেন হকিং এখানে যেন দার্শনিক হয়ে গেলেন। তার কণ্ঠে যেন নবী-রাসূলদের সে শাশ্বত সুর। নবী-রাসূলরাতো যুুগে যুগে বিভ্রান্ত মানবসমাজকে পথের দিশা দিয়েছেন। জীবন যাপনের পদ্ধতি উপহার দিয়েছেন। সংযম ও নম্রতার উদাহরণ পেশ করেছেন। বলেছেন, মানুষ মানুষের প্রভু নয়, বরং ভাই। সাম্যের চেতনায় একই সমতলে মানুষের জন্য গড়ে তুলতে হবে দরদী সমাজ। অভিজাত ও সর্বহারার সমাজ নয় মানব সম্মত সমাজ। তাইতো নবী-রাসূলদের কণ্ঠে আমরা শুনতে পেয়েছি শাশ্বত এক কলেমা-‘নেই কোনো প্রভু এক আল্লাহ ছাড়া।’