আহমদ মতিউর রহমান
গাজায় যুদ্ধবিরতির অবসান ঘটিয়েছে ইসরাইল। মঙ্গলবার ভোরে গাজা উপত্যকাজুড়ে ব্যাপক বিমান হামলা চালিয়েছে ইসরাইলি বাহিনী। এতে নিহত হয়েছেন কমপক্ষে ৪১৭ জন। ইসরাইল এমনটাই করতে পারে এ ইঙ্গিত রেখেছিলেন বিশ্লেষকরা, গত সপ্তাহে লিখেছিলামও। কার্যত সেটাই ঘটল। বার্তা মাধ্যম বলছে, ইসরাইল গাজায় যুদ্ধবিরতির অবসান ঘটিয়ে উত্তর গাজা, গাজা সিটি ও মধ্য ও দক্ষিণ গাজা উপত্যকার দেইর আল-বালাহ, খান ইউনিস, রাফাহসহ একাধিক স্থানে হামলা চালিয়েছে। ইসরাইলি সেনাবাহিনী বলেছে, তারা কয়েক ডজন লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত করেছে এবং যতক্ষণ প্রয়োজন ততক্ষণ পর্যন্ত হামলা অব্যাহত থাকবে। বিমান হামলার বাইরেও তাদের অভিযান প্রসারিত হবে। এটাকে ঔদ্ধত্ব ছাড়া কি বলা যাবে তা ভাববার বিষয় বটে।
হামলার চিত্র তুলে ধরে আল জাজিরা বলছে, যুদ্ধবিধ্বস্ত গাজার বাসিন্দাদের অনেকে তখন গভীর ঘুমে। কেউ কেউ সাহ্রির প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছেন। এমন সময় শুরু হয় একের পর এক বোমা হামলা। ইসরাইলি বাহিনীর সে হামলায় হতাহত হতে থাকেন নারী-শিশুসহ সব বয়সী ফিলিস্তিনী। রাতের অন্ধকারে চলতে থাকে আহত রক্তাক্ত মানুষের আর্তচিৎকার আর আতঙ্কিত মানুষের দিগ্বিদিক ছোটাছুটি। যুদ্ধবিরতির মধ্যে আবার দুঃস্বপ্নের রাত ফিরে এল ফিলিস্তিনের অবরুদ্ধ এ উপত্যকায়। ১৫ মাস ধরে ইসরাইলের নির্বিচার হামলায় ৪৮ হাজারের বেশি মানুষ নিহত হওয়ার পর গাজাবাসীর মধ্যে কিছুটা স্বস্তি এনে দিয়েছিল যুদ্ধবিরতি। ধ্বংসস্তূপ থেকে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা শুরু করেছিলেন তাঁরা। কিন্তু যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘন করে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে পরামর্শ করে নতুন করে গাজায় হত্যাযজ্ঞ শুরু করেছে বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর সরকার। এ হামলা পৈশাচিক ও নিন্দনীয়।
গত ১৯ জানুয়ারি স্বাক্ষরিত যুদ্ধবিরতি বর্ধিত করার জন্য কয়েক সপ্তাহের ব্যর্থ প্রচেষ্টার পর ইসরাইলি সেনাবাহিনী গাজায় নিয়মিত ড্রোন হামলা চালিয়েছে বলে দাবি করে আসছে। তবে এবারের হামলার মাত্রা অনেক বেশি। এদিকে হামাস জানিয়েছে, ইসরাইল যুদ্ধবিরতি চুক্তি বাতিল করেছে। ফলে গাজায় আটক ৫৯ জন পণবন্দীর ভাগ্য এখনো অনিশ্চিত। যুদ্ধবিরতি চুক্তি লঙ্ঘন করে নিরস্ত্র ফিলিস্তিনীদের ওপর ইসরাইলের বর্বরতম এ হামলার তীব্র নিন্দা জানিয়েছে গাজার সশস্ত্র প্রতিরোধ সংগঠন হামাস। সংগঠনটি বলেছে, এ হামলার মধ্য দিয়ে ‘বিশ্বাসঘাতকতা’ করেছে ইসরাইল।
কেন এমনটা ঘটল? যুদ্ধবিরতি দ্বিতীয় পর্যায় কেন শুরু করা গেল না এসব প্রশ্ন করছেন বিশ্লেষকরা।
ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর কার্যালয় হামাসকে ‘পণবন্দীদের মুক্তি দিতে বারবার অস্বীকৃতি জানানোয়’ এবং মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের মধ্যপ্রাচ্য দূত স্টিভ উইটকফের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করার জন্য অভিযুক্ত করেছে। সেটা তাদের দিক থেকে একটা কারন। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। বাস্তবতা হচ্ছে যুদ্ধ বিরতির মধ্যেই ইসরাইল গাজা ও পশ্চিম তীরে হামলা অব্যাহত রেখেছিল।
ইসরাইল দাবি করেছে, হামাস জিম্মিদের মুক্তি না দেওয়ায় এ হামলা চালানো হয়েছে। মঙ্গলবার ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুর কার্যালয় জানিয়েছে, ইসরাইল এখন থেকে আরও বেশি সামরিক শক্তি নিয়ে হামাসের ওপর হামলা চালাবে। হোয়াইট হাউস জানিয়েছে, গাজায় এ হামলার আগে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে আলোচনা করে ইসরাইল। যুদ্ধবিরতির মধ্যে গাজায় হামলার তীব্র নিন্দা জানিয়েছে জাতিসংঘসহ বিভিন্ন দেশ ও সংস্থা।
গত ১৯ জানুয়ারি গাজায় প্রথম ধাপে ছয় সপ্তাহের যুদ্ধবিরতি কার্যকর হয়। এর মেয়াদ শেষ হয় ২ মার্চ। যুদ্ধবিরতির মূল চুক্তিতে বলা ছিল, প্রথম ধাপের যুদ্ধবিরতি চলাকালে দ্বিতীয় ধাপের আলোচনা হবে। যদি এর মধ্যেও দ্বিতীয় ধাপের যুদ্ধবিরতির শর্ত নিয়ে সমঝোতা না হয়, তাহলে প্রথম ধাপের যুদ্ধবিরতি চলবে। এ ছাড়া প্রথম ধাপ শেষ হওয়ার পর ২ মার্চ যুদ্ধবিরতির মেয়াদ সাময়িকভাবে বাড়ানোর বিষয়ে অনুমোদন দেয় ইসরাইলের সরকার। পবিত্র রমজান ও ইহুদিদের পাসওভার উৎসব এই মেয়াদকালের আওতায় পড়েছে। সে সিদ্ধান্ত অনুযায়ী আগামী ২০ এপ্রিল পর্যন্ত যুদ্ধবিরতির মেয়াদ বাড়ে। কিন্তু যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘন করে সোমবার রাতে আবারও গাজায় নির্বিচার হামলা চালাল ইসরাইল। গাজার আরেক সশস্ত্র প্রতিরোধ সংগঠন ইসলামিক জিহাদ বলেছে, যুদ্ধবিরতির সব প্রচেষ্টা ভূলুণ্ঠিত করার অপচেষ্টার অংশ হিসেবে এ হামলা করেছে দখলদার ইসরাইল।
গাজায় চলমান যুদ্ধবিরতিতে মধ্যস্থতাকারী দেশ মিসর বলেছে, ইসরাইলের এই হামলা যুদ্ধবিরতি চুক্তির স্পষ্ট লঙ্ঘন। ইসরাইলের হামলায় চীন গভীরভাবে উদ্বিগ্ন বলে জানিয়েছেন দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র মাও নিং। সংঘাত ছড়িয়ে পড়ে এমন পদক্ষেপ না নিতে দুই পক্ষকে আহ্বান জানিয়েছে বেইজিং। রুশ সরকারের মুখপাত্র দিমিত্রি পেসকভ বলেছেন, ‘আমরা পরিস্থিতি নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছি।’ কয়েক মাসের আলোচনার পর মিসর, কাতার ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় ১৯ জানুয়ারি গাজায় যুদ্ধবিরতি কার্যকর হয়। এ চুক্তির আওতায় ৩৮ জিম্মিকে মুক্তি দেয় হামাস। বিনিময়ে ইসরাইলি কারাগার থেকে প্রায় ২ হাজার বন্দীকে মুক্তি দেওয়া হয়।
দ্বিতীয় ধাপের আলোচনা কেন ব্যর্থ হলো? প্রাথমিক এ যুদ্ধবিরতির মেয়াদ শেষে দ্বিতীয় ধাপে স্থায়ী যুদ্ধবিরতির লক্ষ্যে কাতারের দোহায় বিবদমান পক্ষের সঙ্গে কাতার ও মিসরের আলোচনা চলছিল। গত সোমবার আলোচনা বন্ধ হয়ে গেছে। দেড় মাস ধরে আলোচনা চললেও যুদ্ধবিরতির দ্বিতীয় ধাপ অর্থাৎ স্থায়ী যুদ্ধবিরতি ও গাজা থেকে সব সেনা প্রত্যাহারের বিষয়ে ইসরাইল রাজি হচ্ছিল না। ইসরাইল ও তাদের মিত্র যুক্তরাষ্ট্র চাচ্ছিল, প্রথম ধাপের যুদ্ধবিরতির মেয়াদ বাড়িয়ে গাজায় থাকা অবশিষ্ট জিম্মিদের মুক্তি দেওয়া হোক। কিন্তু হামাস বলে আসছিল, মূল চুক্তি অনুযায়ী দ্বিতীয় ধাপের স্থায়ী যুদ্ধবিরতি চুক্তি কার্যকর করতে হবে। এর আওতায় ইসরাইলি সব সেনাকে গাজা থেকে প্রত্যাহার করতে হবে। এর পরই বাকি জিম্মিদের ছেড়ে দেবে তারা। হামাস এখনো মূল যুদ্ধবিরতি চুক্তি মেনে চলতে চায় বলে জানিয়েছেন সংগঠনটির মুখপাত্র আবদেল লতিফ। তিনি বলেন, মধ্যস্থতাকারীদের সঙ্গে এখনো তাঁদের যোগাযোগ রয়েছে। এখনো তাঁরা মূল চুক্তি পুরোপুরি কার্যকরের পক্ষে।
চুক্তি অনুযায়ী, দ্বিতীয় পর্যায়ে অবশিষ্ট পণবন্দীদের মুক্তি দেয়া হবে এবং ইসরাইল তার সামরিক বাহিনীকে গাজা থেকে সম্পূর্ণ প্রত্যাহার করবে এমনটাই আশা করা হচ্ছিল। এখন দেখা যাচ্ছে কাতারে সেই আলোচনা কার্যত ব্যর্থ হয়েছে। আর পরিস্থিতি আগের যুদ্ধকালীন অবস্থায় ফিরে গেছে। সেই মুহূর্তে ধারণা করা হচ্ছিল, হামাসের কাছে এখনো ২৪ জন পণবন্দী ও ৩৫ জনের লাশ রয়েছে। তাদের মুক্তি ও লাশ ফেরত পাওয়ার বিষয়টিও কার্যত ঝুলে গেল। ইসরাইলের দক্ষিণ অঞ্চলে ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর নজিরবিহীন হামলা চালায় হামাস। ওই সময় আড়াই শতাধিক মানুষকে জিম্মি করে গাজায় নিয়ে যায় তারা। এসব জিম্মিদের অনেকেই যুদ্ধবিরতি চুক্তির আওতায় মুক্তি পেয়েছেন।
আর কয়েকদিনের মধ্যেই গাজায় যুদ্ধবিরতি চুক্তির দ্বিতীয় পর্যায় শুরু হওয়ার কথা ছিল। তবে দ্বিতীয় পর্যায়ে প্রবেশের জন্য ৪টি শর্ত রেখেছিল ইসরাইল। যদি এই চার শর্ত পূরণ না হয়, সেক্ষেত্রে চুক্তির প্রস্তাবিত দ্বিতীয় পর্যায় শুরুর ব্যাপারটি পুরোপুরি অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়বে বলে জানিয়েছিল দেশটির জ্বালানিমন্ত্রী এবং যুদ্ধকালীন মন্ত্রিসভার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সদস্য এলি কোহেন। মঙ্গলবার এক সাক্ষাৎকারে কোহেন বলেন, ‘যুদ্ধবিরতির দ্বিতীয় পর্যায়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে আমাদের ৪টি শর্ত রয়েছে ক) ৭ অক্টোবর এবং তার আগে যেসব ইসরাইলিকে গাজায় বন্দি করা হয়েছিল তাদের সবাইকে মুক্তি দিতে হবে, খ) গাজা উপত্যকা নিয়ন্ত্রণকারী গোষ্ঠী হামাসকে গাজা থেকে বিদায় নিতে হবে, গ) গাজা উপত্যকাকে অবশ্যই সম্পূর্ণ অস্ত্রমুক্ত করতে হবে এবং ঘ) পুরো গাজা এলাকায় ইসরাইলের নিরাপত্তা সংক্রান্ত নিয়ন্ত্রণ থাকবে। মঙ্গলবারের হামলার মধ্য দিয়ে ইসরাইল স্পষ্ট করলো যে তারা চুক্তি থেকে সরে গেছে।
এ চুক্তির প্রথম পর্বের মেয়াদ ছিল ৬ সপ্তাহ। কথা ছিল এ পর্বে ৩৩ জন জিম্মিকে মুক্তি দেবে হামাস, যেসব জিম্মিদের মুক্তি দেওয়া হবে এ পর্বে, তাদের মধ্যে বয়স্ক এবং নারীরা প্রাধান্য পাবেন। এর বিনিময়ে গাজার জনবসতিপূর্ণ সব এলাকা থেকে সেনা প্রত্যাহার করে নেবে ইসরাইল, কারাগারে বন্দী ফিলিস্তিনীদের মধ্যে শতাধিককে মুক্তি দেবে এবং এ ছয় সপ্তাহের প্রতিদিন গাজায় প্রবেশ করবে ত্রাণ পণ্যবাহী ৬০০টি ট্রাক। দ্বিতীয় পর্যায়ে স্থায়ীভাবে সংঘাত শেষ হবে গাজায়। চুক্তির শর্ত অনুসারে, এ পর্যায়ে অবশিষ্ট জিম্মিদের মুক্তি দেবে হামাস এবং বিনিময়ে বিভিন্ন কারাগারে বন্দি ফিলিস্তিনীদের মধ্যে ১ হাজার জনকে মুক্তি দেবে ইসরাইল এবং উপত্যকা থেকে ইসরাইলি সেনাদের সম্পূর্ণ প্রত্যাহার করে নেওয়া হবে। আর তৃতীয় পর্যায়ে যুদ্ধবিধ্বস্ত গাজা উপত্যকাকে পুনর্গঠনের কাজ শুরু হবে। হামাস জিম্মি মুক্তি দিয়ে কথা রেখেছে। দ্বিতীয় ধাপের যুদ্ধ বিরতি কার্যকর হলে বাকি জিম্মিদের মুক্তির উজ্জ্বল সম্ভাবনা ছিল। কার্যত তা বিনষ্ট হলো।
এখন কি হবে? গাজাবাসীর ভবিতব্যই বা কী? বিশ্লেষকরা মনে করেন, আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প তার পর্বসূরি জো ব্ইাডেনের পথে না হেঁটে অন্য পথ ধরতে চাইছেন। বাইডেনের আগ্রহে যুদ্ধ বিরতি হয়েছিল । কার্যত সেটা থেকে বের হয়ে কঠোর নীতি নিতে চাইছেন ট্রাম্প। তার সাথে আলোচনা করেই ইসরাইল নুতন দফা হামলা শুরু করেছে। এই পর্ব আরো রক্তস্নাত হতে পারে। গাজাকে আগেই দ্বংসস্তুপে পরিণত করেছে ইসরাইল। লাশের সংখ্যা বাড়িয়ে তা কোথায় নিয়ে যেতে চায় ইসরাইল ও যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসন সেটা এখন বিশ্লেষকদের ভাবিয়ে তুলেছে। ২০ লাখ গাজাবাসীর জন্য জাতিসংঘ ও চীন তুরস্কসহ বাকি বিশ্ব কি করে সেটাই এখন দেখার বিষয়।