॥ মনসুর আহমদ ॥
হাজেরা (Hajar) একজন স্থির সংকল্প, শক্তি ও ঈমানের প্রতীক । ইসলামের ইতিহাসে তিনি এক গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র এবং আল্লাহর অনুগ্রহ ও সহানুভূতির স্মারক। ইসলামের ইতিহাসে হাজেরা এক শ্রদ্ধার পাত্র। তিনি ছিলেন গোষ্ঠীপতি ও নবী হজরত ইবরাহীম (আ:)-এর স্ত্রী ও নবী ইসমাইল (আ:)-এর মা। পবিত্র কুরআনে তাঁর নাম সরাসরি উল্লেখ না করে তাঁর প্রসঙ্গে আলোচনা করা হয়েছে। সারা বা হাজেরার কারও কথা কুরআনে নামসহ উল্লেখ করা হয়নি, কিন্তু ঐতিহ্যগতভাবে বোঝা যায়, যা উল্লেখ হয়েছে সূরা ইবরাহীমে। ইরশাদ হয়েছে, ‘আমাদের পালনকর্তা! আমি নিজের এক সন্তানকে তোমার পবিত্র গৃহের সন্নিকটে চাষাবাদহীন উপত্যকায় আবাদ করেছি।’ (সূরা ইবরাহীম-৩৭) এখানে হজরত হাজেরার নাম না থাকলেও পাঠক হাজেরার অবস্থান পরোক্ষভাবে ইবরাহীমের চোখে দেখতে পায়। তবে তাঁর ঘটনা রাসুলুুল্লাহ (স.)-এর হাদিসে বারবার আলোচিত হয়েছে। আল তাবারী (নবম শতাব্দী) এবং ইবনে কাসীর ( চৌদ্দশত শতাব্দী) বর্ণনা করেন যে, তিনি (হাজেরা) হজরত ইবরীমের স্ত্রী ছিলেন এবং তাঁর গর্ভে ইবরাহীমের প্রথম পুত্রসন্তান ইসমাইলের জন্ম হয়। এসব ঐতিহাসিকদের মতে, আল্লাহর ইচ্ছা পূরণে হজরত ইবরাহীম প্রায় সবকিছু কুরবানি করেছিলেন।
ইসালামের ইতিহাস ও ঐতিহ্যমতে হজরত হাজেরা ছিলেন হজরত ইবরাহীমের প্রথমা স্ত্রী সারা’র (সারাহ) মিশীরীয় দাসী। সারাহ সন্তান জন্মদানে অক্ষম ছিলেন, তাই তিনি একটি সন্তান লাভের আশায় হাজেরাকে হজরত ইবরাহীমের সাথে বিবাহ প্রদান করেন। এর ফলে হাজেরার গর্ভে শিশু হজরত ইসমাইল (আ:) জন্ম গ্রহণ করেন। তিনি তাঁর ঈমান, ধৈর্য, একাগ্রতা দিয়ে মুসলমান জাতির জন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেছেন কীভাবে একজন ঈমানদারকে বিপদ হাঙ্গামাকালে আল্লাহ তায়ালার উপর নির্ভর করে ধৈর্যধারণ করতে হয়।
হজরত হাজেরা এবং তাঁর সন্তান ইসমাইল (আ:) ইসলামের ইতিহাসে আলোকবর্তিকা রূপে ভূমিকা পালন করেছেন। ইসলামের ইতিহাস ও ঐতিহ্যমতে তাঁর সন্তান ইসমাইলসহ তাঁকে আল্লাহ তায়ালা মিনা উপত্যকায় সেখানকার জনবসতি রক্ষার জন্য রহমত রূপে পাঠিয়েছিলেন।
তাফসিরে তাবারী, আল বিদায়া ওয়া-অল-নিহায়াসহ বিভিন্ন সূত্র থেকে জান যায় যে, যখন হাজেরাকে নির্জন মরুভূমি এলাকায় পাঠান হয় তখন ইসমাইল ছিলেন কোলের শিশু। হজরত ইবরাহীম তাঁর স্ত্রী ও শিশুসহ ভ্রমণ শেষে একটি অনুর্বর এলাকায় পৌঁছলেন এবং তাদেরকে সেখানে রেখে যাওয়ার জন্য মনস্থির করলেন। তখন ভীতু হাজেরা বার বার স্বামীকে জিজ্ঞাসা করলেন : হে ইবরাহীম ! তুমি আমাদেরকে এ নির্জন স্থানে রেখে কোথায় যাচ্ছ?’ কোন জওয়াব না দিয়ে ইবরাহীম প্রতিবার তার থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছিলেন। অবশেষে হাজেরা প্রশ্ন করলেন, ‘এ কাজ কি তুমি আল্লাহর নির্দেশ মোতাবেক করছ?’ ইবরাহীম জওয়াব দিলেন, ‘হ্যাঁ’। এ কথা শুনে হাজেরা বললেন, ‘ঠিক আছে, আল্লাহ আমাদেরকে পরিত্যাগ করবেন না।’ ইবরাহীম যখন তাঁদেরকে পিছনে ফেলে তাঁদের চোখের আড়ালে আসলেন তখন তিনি আল্লাহর কাছে হাত তুলে দোয়া করলেন,‘ হে আমাদের প্রতিপালক! আমি আমার বংশধরদের কতককে বসবাস করালাম অনুর্ভর উপত্যকায় তোমার ঘরের কাছে, হে আমাদের রব! এ জন্য যে, এরা যেন সালাত কায়েম করে। অতএব তুমি কিছ ুলোকের অন্তর এদের প্রতি অনুরাগী করে দাও এবং ফলাদি দ্বারা এদের রিযিকের ব্যবস্থা কর, যাতে এরা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে।’ (সূরা ইবরাহীম-৩৭)
সে সময় মীনা উপত্যকায় পানির প্রচ- অভাব ছিল। এ পানিশূন্য এলাকায় হজরত হাজেরা যখন পানির অনুসন্ধানে ক্লান্ত, পিপাসার্ত ও আশাহত হয়ে পড়েন তখন মহান রাব্বুল আলামীন হজরত জিব্রাইল (আ:)কে পানির ঝর্নাধারা পেতে হাজেরার উপদেষ্টা হিসেবে পাঠান। এ পানির উৎস জমজম লাভ করে মা -ছেলেসহ এলাকার অধিবাসীরা তা পান করে তৃষ্ণা মেটায় ও জীবন রক্ষা করে। এ ঘটনাটি ছিল ঈমান পোষণকারীদের জন্য বিপদকালীন সময় আল্লাহর উপরে কেমনভাবে নির্ভর করতে হয়, ধৈর্য ও ঐকান্তিকতা পোষণ করতে হয় তার এক উজ্জ্বল নমুনা এবং আল্লাহ কীভাবে তাঁর ভক্ত বান্দার প্রয়োজনকালে তাদের পাশে এসে দাঁড়ান তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ।
আল্লাহ হজরত ইবরাহীমকে (আ:) আদেশ করেছিলেন স্ত্রী হাজেরা ও পুত্রসন্তান ইসমাইলকে (আ:) জনশূন্য মক্কা নামক স্থানে রেখে আসতে। আল্লাহর নির্দেশ অনুযায়ী হজরত ইবরাহীম (আ:) হজরত হাজেরা ও শিশু ইসমাইলকে (আ:) সামান্য পরিমাণ খাদ্য ও পানিসহ সেই মরুভূমি এলাকায় রেখে আসলেন।
হজরত হাজেরা ও ইসমাইলকে (আ:) আত্মনির্ভরশীল হয়ে ওঠার জন্য সেখানে রেখে আসা হয়। মা ও ছেলে যখন উভয়ই ভীষণভাবে তৃষ্ণার্ত হয়ে পড়েন তখন মা হাজেরা সাফা ও মারওয়া দু’পাহাড়ের মধ্যবর্তীস্থানে দৌড়াদৌড়ি করতে থাকেন। তিনি সাত বার এ পাহাড় থেকে সে পাহাড়ে দৌঁড়িয়ে ছিলেন। অবশেষে আল্লাহ করুণা করে হজরত জিবরাইল (আ:) কে পাঠিয়ে হাজেরাকে জমজম কুপের সন্ধান দিলেন যা আজও সেখানে বর্তমান আছে।
হজরত হাজেরা ও হজরত ইসমাইল (আ:) অনেক বছর মক্কায় বাস করেছিলেন। হজরত ইসমাইল সেখানে এক ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব রূপে বড় হন এবং পরবর্তীতে জুরহুম গোত্রে বিবাহ করেন। তাঁর বেশ কয়েকজন সন্তান ছিল। হজরত ইসমাইলের বংশে রেসালতী ধারার শেষ রাসুল হজরত মুহাম্মদ (স.) জন্মগ্রহণ করেন।
ভাবতে অবাক লাগে কীভাবে হজরত হাজেরা (আ:) আল্লাহর উপর এত নির্ভরশীল ও বিশ্বাসী ছিলেন। ইসলামের ঐতিহ্য মতে যখন ইবরাহীম (আ:) আল্লাহর নির্দেশ মোতাবেক স্ত্রী ও শিশুপুত্রকে জনশূন্য মক্কার মরুভুমিতে রেখে যেতে বললেন, তা জানতে পেরে নির্ভীক নারী হাজেরা আল্লাহর উপর তাঁর স্থির বিশ্বাস নানা উপায়ে স্পষ্টভাবে প্রদর্শন করে ছিলেন।
এ মহিয়সী নারী দ্বিধাহীন চিত্তে আল্লাহর নির্দেশ মেনে নিলেন। যখন হজরত ইবরাহীম আল্লার নির্দেশ হাজেরাকে অবগত করালেন, তখন তিনি কোন ধরনের ইতঃস্ততা না করেই মেনে নিলেন। তিনি আল্লাহর হুকুমকে স্বীকার করে নিলেন এবং বিশ্বাস করলেন যে,আল্লাহ-ই তাঁর ও তাঁর সন্তানের দায়ভার গ্রহণ করবেন। তিনি পরিপূর্ণভাবে মহান আল্লাহর উপরে তাওয়াক্কুল বা নির্ভর করলেন। তাঁর দৃঢ় বিশ্বাস ছিল যে, আল্লাহই তাঁকে ও তাঁর সন্তানকে প্রতিপালনের ব্যবস্থা করবেন। তিনি বিশ্বাস করতেন যে, মরুভূমির অসহনীয় পরিবেশে তাঁকে রক্ষার জন্য আল্লাহই যথেষ্ট।
যখন হজরত হাজেরা ও তার সন্তান পানির অভাবে পতিত হলেন, তখন তিনি নিরাশ না হয়ে আল্লাহর রহমতের আশায় অধিকতরভাবে উন্মুখ হলেন এবং দোয়া করতে লাগলেন। আল্লাহর উপরে তাঁর নির্ভরতা ও বিশ্বাস এত গভীর ছিল যে, আল্লাহ তাঁর সাহয্যে হজরত জিবরাইল (আ:)কে পাঠালেন এবং জমজম কুপের সৃষ্টি হলো; যা থেকে অলৌকিকভাবে স্বয়ংক্রিয়ভাবে পানির ধারা প্রবাহিত হতে লাগল।
হজরত ইবরাহীমের পক্ষ থেকে নয় বরং আল্লাহর পক্ষ থেকে শুনে হজরত হাজেরা তা মেনে নিয়ে আল্লাহর উপর বিশ্বাস ও নির্ভরতার প্রমাণ দিলেন। বিপদে আল্লাহই তাঁকে রক্ষা করবেন, আল্লাহর দয়ার উপর নির্ভরতা, আল্লাহর কাছে অনুগ্রহ প্রার্থনা করার শিক্ষা হাজেরার জীবন মুসলমানদেরকে অনুসরণ করতে অনুপ্রেরণা যোগায়।
সাফা ও মারওয়া দু’পাহাড়ের মধ্যবর্তী স্থানে সায়ী করা (দৌঁড়ান) হজ্জের অংশ হিসেবে বিবেচিত হয়ে থাকে। এটি শুধু শারীরিক কসরত নয়। বরং এটি স্মরণ করিয়ে দেয় পিপাসার্ত মা মরুভূমিতে পানির খোঁজে কেমন প্রচেষ্টা ও প্রতিদ্বন্দ্বীতায় অবতীর্ণ হয়েছিলেন সেই ইতিহাস। এ সা’য়ী আমাদেরকে স্মরণ করিয়ে দেয় আমাদেরকে মহান আল্লাহর পথে অবিচল থাকতে কেমনভাবে নানা ধরনের বাধাবিপত্তির মোকাবেলা করতে হবে তা। সা’য়ী একটি প্রতীকী আচার যা মুসলমানদেরকে জীবনে অধ্যাবসায়ী, আনন্দ ও আশাবাদী চিত্তের অধিকারী হতে শিক্ষা দেয় যেমনটি ছিলেন হজরত হাজেরা পানির অনুসন্ধানে। হজ্জ যেমন সমস্ত মুসলমানরা একত্রে সম্পন্ন করে তেমনি সকল মুসলমানকে অটুট ঐক্য বন্ধনে আবদ্ধ হতে উৎসাহিত করে।
হজরত হাজেরার গর্ভে জন্ম লাভ করেন হজরত ইসমাইল (আ:)। হজরত ইসমাইল ব্যতীত হজরত হাজেরার আর কোন দ্বিতীয় সন্তান ছিল না এবং ইসমাইল (আ:) ছিলেন হজরত ইবরাহীমের জ্যেষ্ঠ সন্তান। নবী ইসমাইল (আ:)মক্কা উপত্যকায় বাস করতেন। সকলে তাঁকে আরববাসীদের আদিপুরুষ হিসেবে সম্মান করতেন। তিনি ছিলেন মুসলিম জাতির আধ্যাত্মিকতার মূল কেন্দ্র কাবার নির্মাণকারী পিতা হজরত ইবরাহীম (আ:)-এর কাবা ঘর নির্মাণ কাজের সহযোগী।
হজরত হাজেরার জীবনী শুধু একটি দুঃসাহসিকতাপূর্ণ কাহিনী মাত্র নয়। একটি উত্তম আদর্শ জাতি বিনির্মাণ ও তার স্থায়িত্বের জন্য একটি জাতির কী সব বৈশিষ্ট্যের প্রয়োজন তা দেখিয়ে গেছেন হজরত হাজেরা। তাঁর জীবন কাহিনী সকলের জন্য উৎসাহের উৎস। আল্লাহ ও তাঁর পরিকল্পনার উপরে বিশ্বাসীজনেরা কীভাবে জীবনে আগত সমস্ত বাধা বিপত্তির চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করবে, তার স্মারক হজরত হাজেরা (আ:)।
তাঁর জীবন থেকে আমরা যে সব শিক্ষা গ্রহণ করতে পারি তার মধ্যের কিছু উল্লেখযোগ্য শিক্ষা হলোÑ
ক) ঐকান্তিকতা (perseverance). একজন রাজদূহিতা ও নবীপত্ন হওয়ার পরেও তাঁকে জীবনের বহুবিষয়ে চ্যালেঞ্জের মোকাবেলা করতে হয়েছে। কিন্তু তিনি কখনও হতোদ্যম হয়ে পড়েননি। তিনি ছিলেন দৃঢ় মনোবলের সাহসী নারী। তিনি কোন অবস্থায়ই আল্লাহর উপর থেকে বিশ্বাস হারাননি।
খ) আল্লাহর উপর নির্ভরশীলতা (Trust inAllah). হাজেরা তাঁর জীবনের সর্ব বিষয়ে আল্লাহর উপর নির্ভরশীল ও আশাবাদী ছিলেন। তাঁর বিশ্বাস ছিল যে, কোন কঠিন ও দুর্যোগময় মুহূর্তও আল্লাহ তাঁকে দূরে ঠেলে দেবেন না।
গ) আশাবাদ (Optimism). জীবনের কঠিনতম সময়ও তিনি ছিলেন আশাবাদী। তিনি সর্বদা আশা পোষণ করতেন যে, আল্লাহ তাঁকে ও তাঁর সন্তানকে সাহায্য করবেন।
ঘ) নিঃস্বার্থতা (Selflessness). হাজেরা ছিলেন একজন নিঃস্বার্থ পরায়না নারী যিনি নিজের জীবনের চেয়ে অপরের প্রয়োজনকে অধিকতর গুরুত্ব দিতেন। তিনি সন্তানের সুখ ও জীবনের নিরাপত্তার জন্য নিজের সুখ বিসর্জন দিতে ইচ্ছুক ছিলেন।
ঙ) নিষ্ঠাবান (Devotion). হজরত হাজেরা ছিলেন নিষ্ঠাবতী রমণী। তিনি সর্বদা আল্লাহর ইবাদতে নিষ্ঠাবতী ছিলেন। তিনি আল্লাহর কাছে হেদায়াত ও শক্তিলাভের জন্য দোয়া করতেন এবং সর্বদা আল্লাহর নির্দেশ মেনে চলতেন। এসব গুণাবলী ছাড়াও তিনি ছিলেন সহিষ্ণু, উদার, আনন্দময়ী ও চরম ধৈর্যধারণকারিনী নারী। হাজেরার এ কাহিনীতে বর্তমান রয়েছে আমাদেরকে শক্তিশালী বা দৃঢ় মনোবল, আনন্দময় চিত্তের অধিকারী ও সহানুভূতিশীল হৃদয়ের অধিকারী হওয়ার শিক্ষা।
লেখক : প্রাবন্ধিক।