নূরুন্নাহার নীরু

“নিঃসন্দেহে সফল হল সে; যে তাযকিয়া করলো নিজেকে এবং নিঃসন্দেহে ব্যর্থ হলো সে; যে দূষিত ও কলুষিত করে ধ্বসিয়ে দিল নিজকে।” মহান প্রতিপালক আল্লাহ সুবহানুতা’লা সুরা আসশামশ এর ৯ ও ১০ নং আয়াতে ঐ দুটি বিষয় তুলে ধরে মানব জাতিকে জানিয়ে দিতে চাচ্ছেন তাজকিয়া করলে তার সফলতা আর কলুষতা করলে তার বিফলতা। মূলত “তাজকিয়া” শব্দের অর্থ পরিশুদ্ধ, উন্নত বা বিকশিত। আর মহান রব মানব জাতির কাছে এ প্রথমটি অর্থাৎ তাজকিয়ার প্রতিফলনই চাচ্ছেন শেষেরটি নয়। এ জন্যই তার প্রিয় সৃষ্টি এ মানবজাতিকে বেহুদা সৃষ্টি করে ছেড়ে দেননি তিনি বরং তাজকিয়া সৃষ্টির মাধ্যমে আশরাফুল মাখলুকাত হয়ে থাকার জন্য দিয়েছেনঃ ১/ বিবেক -বুদ্ধি -জ্ঞান- প্রজ্ঞা, ২/ ইচ্ছার স্বাধীনতা ও গ্রহণ ক্ষমতা এবং ৩/ একটি সুনির্দিষ্ট চলার পাথেয় তথা জীবন বিধান।

যুগে যুগে নবীরাসূল পাঠিয়ে সে তাজকিয়ার বিধানটিই তিনি প্রতিষ্ঠা করার নির্দেশ দিয়ে গেছেন আদম (আ:) এর সৃষ্টির সময় থেকে। তারই ধারাবাহিকতায় আমাদের প্রিয় নবী-পৃথিবীর সংস্কারক-বিশ্বনেতা মোহাম্মদ (সা:) এর মাধ্যমে তার পূর্ণতা ঘটান। যার প্রমান পাই আমরা রাসূল (সা:) এর একটি হাদীস থেকে। আবু হুরায়রা (রা:) হতে বর্ণিত: রাসূল (সা:) বলেছেন, “আমার ও আমার পূর্ববর্তী নবীদের দৃষ্টান্ত হচ্ছে এরূপ; এক ব্যক্তি একটি সুন্দর অট্টালিকা নির্মাণ করলো কিন্তু এক কোনে একটি ইটের জায়গা খালি রেখে দিলো। অতঃপর লোকেরা এসে সুন্দর অট্টালিকাটি ঘুরে ফিরে দেখতে লাগলো এবং তারা বিস্মিত হয়ে বলতে থাকলো- ঐ ইটটি কেন লাগানো হয়নি! রাসূল (সা:) বললেন, আমিই সেই ইট, আমিই সর্বশেষ নবী।” (মুসলিম)

আল কুরআনে আছে, “মোহাম্মদ (সা:) তোমাদের পূর্ব পুরুষদের মধ্যে কারো পিতা নন। বরং তিনি হলেন আল্লাহর রাসূল এবং নবীদের ধারাবাহিকতা সমাপ্তকারী। (আহযাব-৪০)। সে সমাপ্তকারী বিধানটিই হচ্ছে ইসলাম। ইসলামের দৃষ্টিতে মানব জীবন হবে পরিশীলিত, পরিমিত, পরিশুদ্ধ। আর সেটির অনুশীলনই হচ্ছে তাজকিয়া তথা মানব জাতির সংস্কৃতি।

যুগে যুগে বহুমনীষী সংস্কৃতির সংজ্ঞা বিভিন্নভাবে দিয়েছেন আজো দিচ্ছেন—সব ক,টিকে মেনে নিয়েই আমি বলবো ইসলামের দৃষ্টিতে সংস্কৃতি হচ্ছে ওই “তাযকিয়া।” যা উপরের আয়াতটি থেকে জেনেছি। আর এর মূল ভিত্তিই হচ্ছে তৌহিদ-রেসালাত-আখেরাত। এবং এর উপরই ইসলামী সংস্কৃতি বিবর্তিত। এ সংস্কৃতি এক দিনের বা এক মাসের জন্য কিংবা এক বছরের জন্য নয় বরং প্রতিবছর, প্রতি মাস, প্রতিদিনের। এজন্যই দেখা যায় ইসলামের এ সংস্কৃতি চান্দ্রমাস তথা আরবী মাসের সাথে সম্পৃক্ত। যাকে মূলত: হিজরী বর্ষ পুঞ্জি হিসেবে গণনা করা হয়।

হযরত আবু বকর (রা:) হতে বর্ণিত আছে যে, নবী (সা:) তার বিদায় হজের ভাষণে বলেন, জামানা ঘুরে ঘুরে নিজের মূল অবস্থায় এসে গেছে। বছরের বারটি মাস হয়ে থাকে। এগুলোর মধ্যে চারটি সম্মানিত ও মর্যাদা সম্পন্ন মাস। ক্রমিক ভাবে রয়েছে তিনটি।”

আরো দেখুন : সুরা তওবার ৩৬নং আয়াতে আল্লাহ মহান বলছেন: “আল্লাহর কাছে আসমান ও জমিন সৃষ্টির দিক থেকে গণনার মাস ১২টি। এর মধ্যে ০৪টি পবিত্র মাস। যা হারাম বলে গণ্য। এটাই প্রতিষ্ঠিত বিধান।” হারাম বলতে নিষিদ্ধ ও পবিত্র দুটোই বুঝায়। হাদীসের আলোকে এ হারাম মাসগুলো হলো: যুলক্কাদা, যুলহাজ্জা, মহাররম ও জমাদিউসসানি ও শাবানের মাঝে “রজ্জব”(রজব)। আরবীতে এ ১২টি মাসেরই পৃথক পৃথক পূর্ণ অর্থ রয়েছে। এবং রয়েছে কিছু তাৎপর্যও। যেমন বর্ষপঞ্জির প্রথম মাস হিসেবে “মহররম”।

“মুহররম” শব্দের অর্থ পবিত্র বা সম্মানিত। প্রাচীনকাল থেকেই এ মাসটি পবিত্র হিসেবে গণ্য হয়ে আসছে। মহররম মাস ইসলামের ইতিহাসে অত্যন্ত তাৎপর্য ও ফজিলতপূর্ণ। যেহেতু এর সাথে জড়িত আছে “আশুরা।” আশুরা অর্থ দশম। এ মাসের ১০ তারিখই হচ্ছে বিশেষভাবে মর্যাদাসম্পন্ন সেই আশুরা। সৃষ্টির শুরু থেকে এ দিনে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ও স্মরণীয় ঘটনা সংঘটিত হয়েছে বলে মুফাস্সিরিনদের ধারণা। যথা :

* হযরত আদম (আ.)-এর সৃষ্টি ও পৃথিবীতে অবতরণ এবং ক্ষমাপ্রাপ্তি। * হযরত নূহ (আ.)-এর সময় মহাপ্লাবন এবং তার নৌকা রক্ষা পাওয়া। * হযরত ইব্রাহিম (আ.)-এর জন্ম ও নমরুদের অগ্নিকুণ্ড থেকে রক্ষা পাওয়া। * হযরত ইউনুস আলাইহিস সালাম মাছের পেট থেকে এই দিনে মুক্তি পেয়েছিলেন। * হযরত মূসা (আ.) ও তাঁর সাথীদের ফেরাউনের কবল থেকে উদ্ধার এবং নীল দরিয়ায় ফেরাউন ও তার বাহিনীর ডুবে মরা। (আল কুরআন: সূরা আত তোহা ৭৭-৭৯) * হযরত আইয়ুব (আ.)-এর ১৮ বছর অসুস্থতার পর রোগমুক্তি। * হযরত ঈসা (আ.)-কে আসমানে তুলে নেওয়াএ * হাদিসে আছে কেয়ামত বা মহাপ্রলয় আশুরার দিনেই সংঘটিত হবে।

প্রাক ইসলামী যুগেও আশুরার দিনে রোজা রাখার প্রচলন ছিল। মহানবী (সা:) মদিনায় হিজরত করার পর দেখেন যে ইহুদিরাও এ দিনে রোজা রাখে। তখন তিনি তার কারণ জানতে চাইলে জানতে পারেন যে, ওই দিনটি ইহুদীদের বিজয় দিবস। কারণ ওই দিনে বনি ইসরাইল সম্প্রদায় মুসা (আ:) সালামের নেতৃত্বে আল্লাহর হুকুমে নীল দরিয়া পার হয়ে ফেরাউন বাহিনীর হাত থেকে মুক্তি লাভ করেন তাই ইহুদিরা এ দিনটিতে আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা স্বরূপ রোজা পালন করছে। তখন তিনি নিজেও রোজা রাখেন এবং মুসলমানদেরও রোজা রাখার নির্দেশ দেন। রমযানের রোজা ফরজ হওয়ার পর আশুরার রোজা নফল বা ঐচ্ছিক এবাদত হিসাবে গণ্য হয়। এমন কি এটিকে ইসলামের সংস্কৃতিতে নিয়ে আসতে মহানবী (সা:) ইহুদিদের অনুসরণ না করে পৃথকভাবে মুসলিমদেরকে দুইদিনের রোজা রাখার নির্দেশ দিয়ে যান (আগের দিন অথবা পরের দিন মিলিয়ে নিয়ে )। ফলে, মহররম মাস তথা আশুরার ফজিলত ও অনেক গুন বেড়ে যায়।

মহানবী (সা:)-এর ইন্তিকালের পর আশুরার সবচেয়ে মর্মান্তিক ও ঐতিহাসিক ঘটনা হলো কারবালার বিয়োগান্তক ঘটনা। ৬১ হিজরির ১০ মহররম ইরাকের কারবালা প্রান্তরে মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর দৌহিত্র হযরত ইমাম হুসাইন (রা.) এবং তাঁর ৭৭ মতান্তরে ৭৩ জন ঘনিষ্ঠ সহচর ইয়াজিদের বাহিনীর হাতে নির্মমভাবে শাহাদাত বরণ করেন। এ ঘটনা মুসলিম উম্মাহর জন্য গভীর শোকের কারণ এবং অন্যায় ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়ার অনুপ্রেরণা দায়কও। শুধু তাই নয় এ ঘটনা মুসলিম উম্মাহর জন্য বিশেষ শিক্ষাও বহণ করছে। এজন্য মহররম মাসের তাৎপর্য ও শিক্ষাকে মূলত দুটি অংশে বিভক্ত করা যায়।

১. ঐতিহাসিক তাৎপর্য এবং ২. নৈতিক ও আধ্যাত্মিক শিক্ষা।

১/ ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট : বছরের প্রথম মাস : মহররম মাস হিজরি বর্ষপঞ্জির প্রথম মাস এবং এ মাসের ১০ তারিখ (আশুরা) মুসলিম বিশ্বে বিশেষভাবে তাৎপর্যপূর্ণ। কারবালার প্রান্তরে হজরত ইমাম হোসাইন (রা.) ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের শাহাদাত বরণের ঘটনা মহররম মাসের সাথে গভীরভাবে সম্পর্কিত হয়ে পড়েছে। যদিও এটি (সা:)-এর তিরোধান এর পরের ঘটনা তবু কাকতালীয়ভাবে মিলে গেলেও এর কিছু তাৎপর্য রয়েছে।

আল্লাহর মাস: মহররম মাসকে ‘শাহরুল্লাহ’ বা ‘আল্লাহর মাস’ বলা হয়, যা এ মাসের গুরুত্বকে নির্দেশ করে।

সম্মানিত মাস: মহররম মাস চারটি সম্মানিত মাসের মধ্যে একটি, যেখানে যুদ্ধ-বিগ্রহ নিষিদ্ধ।

আত্মত্যাগ ও শোকের মাস: মহররম মাস আত্মত্যাগের শিক্ষা দেয়। ইমাম হোসাইন (রা.) ও তাঁর সঙ্গীদের আত্মত্যাগের ঘটনা মুসলিমদের জন্য এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।

২/ নৈতিক ও আধ্যাত্মিক শিক্ষা : আত্মশুদ্ধির মাস : মহররম মাস মুসলিমদের জন্য আত্ম-সংশোধন ও নৈতিক উন্নতির মাস। কারবালার ঘটনা থেকে শিক্ষা নিয়ে মানুষ নিজেদের জীবনে হকের পথে অবিচল থাকার জন্য ভালো গুণাবলী অর্জন এবং খারাপ কাজ থেকে দূরে থাকার জন্য নিরলস প্রচেষ্টার শিক্ষা দেয়।

সংগ্রামী চেতনা: মহররম মাস মুসলিমদের মধ্যে সংগ্রামী চেতনা জাগ্রত করে। ইমাম হোসাইন (রা.)-এর আত্মত্যাগ মুসলিমদেরকে অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে এবং তাঁদের অধিকার আদায়ে সচেষ্ট হতে অনুপ্রাণিত করে।

ঐক্যের শিক্ষা: মহররমের শিক্ষা মুসলিম উম্মাহর মধ্যে ঐক্য ও সংহতি বৃদ্ধি করে। কারবালার ঘটনা মুসলিমদেরকে জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সকলের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে এবং মানবতার জন্য কাজ করতে উৎসাহিত করে।

ফ্যাসীবাদ মোকাবিলায় আপসহীনতা: হযরত ইমাম হোসাইন কারবালার প্রান্তরে স্বপরিবারে আত্মাহূতি দিয়ে সে দৃষ্টান্তই রেখে গেছেন। এ আত্মাহূতি ছিল তাঁর তৎকালীন ইয়াজিদ সরকারের আল্লাহ ও রাসূলের দেখানো নীতি নিয়ম উপেক্ষা করে স্বেচ্ছাচারী নীতি প্রয়োগের তীব্র প্রতিবাদ স্বরূপ। তিনি রাষ্ট্রক্ষমতার জন্য লালায়িত হয়ে অন্যায়ের সাথে আপসকামীতা মেনে নেননি বরং জীবনের শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে তা প্রতিহতের প্রচেষ্টাই করে গেছেন-যা যুগ যুগ ধরে মুমিনের জন্য মাইল ফলক হয়ে আছে। বিগত ৩৬ জুলাই এর আন্দোলন আমাদের দেশেও সেই দৃষ্টান্তই রেখেছে। ২৪ সালের ১৬ জুলাই ছিল শহীদ আবু সাঈদের হত্যা দিবস। তারপর দিনই ১৭ জুলাই ছিল আশুরা। ঠিক সেই কিরবালার কাহিনীর মতই কাকতালীয় হলেও এটিও এখন বাঙালীর ইতিহাসে স্বর্নাক্ষরে লিপিবদ্ধ থাকবে।

মহররম মাসের করণীয় : মহররম মাসে কিছু বিশেষ আমল রয়েছে যা অত্যন্ত ফজিলতপূর্ণ :

নফল রোজা: রমজানের পর মহররম মাসের রোজা, বিশেষত আশুরার দিনের রোজা, সবচেয়ে উত্তম বলে গণ্য করা হয়েছে। নবীজি (সা.) বলেছেন, “রমজানের পর যদি তুমি রোজা রাখতে চাও, তবে মহররম মাসে রাখো। কারণ এটি আল্লাহর মাস।” (তিরমিজি) আশুরার দিনে রোজা রাখার পাশাপাশি তার আগের দিন (৯ মহররম) অথবা পরের দিন (১১ মহররম) রোজা রাখাও উত্তম, যাতে ইহুদিদের রোজার সাথে সাদৃশ্য না হয়।

তওবা ও ইস্তিগফার: এই মাস তওবা ও ক্ষমা প্রার্থনার জন্য বিশেষভাবে উৎসাহিত করা হয়েছে।

কুরআন তেলাওয়াত, জিকির-আজকার, তাসবিহ-তাহলিল ও দরুদ পাঠ: এ দিনে বেশি বেশি আল্লাহর জিকির অর্থাৎ কুরআন পাঠ, আলোচনা এবং নবীজির প্রতি দরুদ পাঠ করা যেতে পারে।

দান-সদকা: সামর্থ্য অনুযায়ী দান-খয়রাত করা এ মাসে অত্যন্ত সওয়াবের কাজ। তবে, মহররম মাসকে কেন্দ্র করে তাজিয়া মিছিল বের করা, মাতম করা, শরীর রক্তাক্ত করা, হালুয়া-রুটি বিতরণ করা কিংবা কুরবানীর গোশত জমিয়ে রেখে খাওয়ার কোন বিধান নেই বরং তা শরিয়তসম্মত নয়। ইসলাম এসব বাড়াবাড়িকে সমর্থন করে না। মূলত মহররম মাস মুসলিম উম্মাহর জন্য আত্মিক পরিশুদ্ধি, শোক, শিক্ষা এবং নতুন করে পথচলার একটি মাস। সুতরাং ইসলামী সংস্কৃতি চর্চায় এ মাসের গুরুত্ব যেমন অপরিহার্য। তেমনি এভাবেই বহমান থাকবে ইসলামী সংস্কৃতির মূলধারাও।

লেখক : কবি ও প্রাবন্ধিক।