শাহেদ শফিক
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে আধুনিক বিশ্বে বিভিন্ন শক্তিধর দেশকে নিজেদের শান্তির রক্ষক দাবি করতে দেখা গেছে; কিন্তু ‘শান্তির জন্য যুদ্ধ’ এক অদ্ভুত বিরোধে পরিণত হয়েছে। অথচ কাগজে শান্তি, মাঠে নিহত মানুষের রক্ত। ইতিহাস বলছে, যারা যুদ্ধকে শান্তির নাম দিয়েছে, তারা বাস্তবে ক্ষমতা বিস্তারের জন্যই লড়েছে। ভিয়েতনাম, কঙ্গো, ইরাক, আফগানিস্তানÑ এ দেশগুলোকে যখন আন্তর্জাতিক বিশ্ব ‘সমস্যাগ্রস্ত’ হিসেবে চিহ্নিত করে, তখন সে দেশগুলোতে যুদ্ধের নামে চলেছে ধ্বংসযজ্ঞ।
মানুষের অতি আশীর্বাদ, সভ্যতার প্রগতি এবং শান্তির আকাক্সক্ষা সবসময়ই যুদ্ধের আগ্রাসনে আচ্ছন্ন হয়েছে। যারা নিজেদের ‘শান্তির বাহক’ দাবি করে এসেছে, তারা প্রায়শই অস্ত্র দিয়ে বিনদেশের সার্বভৌম দখলের চেষ্টা করেছে। অথচ বলা হয়েছে, শান্তি প্রতিষ্ঠার কথা। কিন্তু বাস্তবে হাজার হাজার নিরীহ মানুষকে হত্যা, তাদের ঘরবাড়ি ধ্বংস এবং রাষ্ট্রীয় কাঠামোর স্থিতিশীলতা বিনষ্ট করা হয়েছে।
ভিয়েতনাম যুদ্ধের উদাহরণটি পৃথিবীর কাছে শিক্ষা। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র শান্তি এবং স্বাধীনতার রক্ষক বলে দাবি করেছিল। কিন্তু বাস্তবে, লাখ লাখ নিরীহ ভিয়েতনামী মানুষের মৃত্যু এবং দেশটির সম্পূর্ণ অবকাঠামোর ধ্বংস শুধু ক্ষমতার জন্যই হয়েছিল। সেলাম, স্বাধীনতার জন্য নয়। এ ধরনের যুদ্ধবাজ নীতি প্রমাণ করে যে, ‘শান্তি’ কথাটি শুধু একটি লালনীয় স্লোগান, যা ক্ষমতাসীনদের স্বার্থ রক্ষার জন্য ব্যবহার করা হয়।
আধুনিক যুগের আরেকটি প্রাসঙ্গিক উদাহরণ হলো আফগানিস্তান। আন্তর্জাতিক সমাজ, বিশেষত পশ্চিমা শক্তিরা শান্তি, মানবাধিকার ও নারীর অধিকার রক্ষার কথা বলে দেশটিতে হস্তক্ষেপ করেছে; কিন্তু আসলে আফগানের জনগণ ভয়াবহ পরিস্থিতির মধ্যে পড়েছে। প্রচণ্ড সংঘাত, মৃত্যু, পরিবার বিচ্ছিন্ন শিশুÑ সবই সে যুদ্ধবাজ নীতির ফল। শান্তির নামেই লাখ লাখ নিরীহ মানুষের জীবন ও স্বাধীনতা বিলীন হয়েছে দেশটিতে।
ইরাকও এর ব্যতিক্রম নয়। ২০০৩ সালে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা বলেছিল ইরাকের শান্তি রক্ষার জন্য, হুমকি প্রতিরোধ এবং গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য দেশটি আক্রমণ করতে হবে। কিন্তু বাস্তবতা অন্যরকম ছিল। শহর ধ্বংস, নিহত সাধারণ মানুষ, দারিদ্র্য ও অনিশ্চয়তার সৃষ্টিÑ সবকিছুই ছিল সেই যুদ্ধের ফলাফল। এরা যুদ্ধবাজদের উদাহরণ, যারা কেবল নিজেদের স্বার্থের জন্য শান্তি কথাকে ব্যবহার করেছে।
ফিলিস্তিন পরিস্থিতি শান্তির নামে যুদ্ধের অন্য এক দৃষ্টান্ত। দীর্ঘদিন ধরে ইসরাইল ফিলিস্তিনে আগ্রাসন চালিয়ে আসছে। যেখানে বলা হয় শান্তি প্রতিষ্ঠার কথা। কিন্তু বাস্তবে নিরীহ সাধারণ মানুষই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। শিশুরা বোমার শব্দে ঘুমায়, নারী ও বৃদ্ধেরা ঘরবাড়ি হারায়, এবং সম্পূর্ণ সমাজ অস্থিরতার মধ্যে ধাক্কা খায়। আন্তর্জাতিক মিডিয়া এবং শক্তিধর দেশগুলো মাঝে মাঝে ‘মধ্যস্থতার’ প্রস্তাব দেয়, কিন্তু মূলত তাদের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বার্থ বজায় রাখার জন্যই। এভাবে শান্তির নামের আড়ালে চলতে থাকা সংঘাত কেবল নিরীহ মানুষের জীবনকে বিপন্ন করে, সমাজকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দেয়।
ফিলিস্তিন প্রমাণ করে যে যুদ্ধবাজদের উদ্দেশ্য কখনোই মানবিক নয়। তারা শান্তির খোঁজে নয়, বরং নিজেদের শক্তি, প্রভাব এবং রাজনৈতিক দখল বৃদ্ধির জন্য লড়াই চালায়। মানুষের শান্তি কেবল কাগজে বা বক্তৃতায় নয়, বাস্তব জীবনে প্রতিষ্ঠিত হওয়া প্রয়োজন। আর তা সম্ভব কেবল সংলাপ, ন্যায়বিচার এবং মানবিক মূল্যবোধকে অগ্রাধিকার দিয়ে। ফিলিস্তিনের অসহায় জনগণ এই সত্যের জোরালো স্মারক যে, শান্তির আড়ালে যুদ্ধ কখনোই কোনো জাতির কল্যাণ আনতে পারে না।
এছাড়া ইউক্রেন ও রাশিয়ার সাম্প্রতিক সংঘাত বিশ্বকে আবার একবার স্মরণ করিয়েছে যে শান্তির নামে যুদ্ধ কতটা নিষ্ঠুর হতে পারে। রাশিয়া ইউক্রেন আক্রমণ করে বলেছে, তাদের উদ্দেশ্য নিরাপত্তা ও ‘শান্তি প্রতিষ্ঠা’। কিন্তু লক্ষ লক্ষ মানুষ নিরাশ্রয়, শিশু ও বৃদ্ধ নিহত এবং সমগ্র সমাজ ধ্বংসের মুখোমুখি রয়েছে। ফলে এটা এখন স্পষ্ট, শান্তির জন্য যুদ্ধ করা হয় না-মানুষের জীবনকে বিপন্ন করার জন্য যুদ্ধ করা হয়।
শান্তির আড়ালে যেসব দেশ বা রাষ্ট্র যুদ্ধ চালায়, তারা কখনোই বাস্তব শান্তির অভিপ্রায় রাখে না। তাদের কেবল নিজস্ব রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বার্থ থাকে। তারা বিশ্বকে বিভ্রান্ত করে-শান্তির কথা বলে, ক্ষমতার জন্য যুদ্ধ চালায়। ইতিহাস ও বাস্তবতা প্রমাণ করে, যারা যুদ্ধবাজ তাদের নেতিবাচক চরিত্রে চিহ্নিত করা যায়। তারা মানবিকতার নীতি অমান্য করে, হাজার হাজার নিরীহ মানুষকে হত্যা করে এবং সমাজকে অস্থিতিশীল করে তোলে।
শান্তি প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব একমাত্র তখনই, যখন রাষ্ট্রগুলো একে অপরের সঙ্গে সহমর্মিতা, সংলাপ এবং কূটনৈতিক মাধ্যম ব্যবহার করে সমস্যা সমাধান করে। অস্ত্রের মাধ্যমে শান্তি কখনো আসবে না। যুদ্ধবাজরা যে বিপর্যয় সৃষ্টি করে, তা অনেক বছর ধরে সমাজ ও অর্থনীতিকে ব্যাহত করে। যুদ্ধের রক্তাক্ত ইতিহাস ও তার ফলাফল প্রমাণ করে, শান্তি অর্জনের জন্য যুদ্ধ কোনো সমাধান নয়।
শান্তির জন্য যুদ্ধের কথা বলা হয় অনেক সময় রাজনৈতিক বা সামরিক নেতাদের মুখে; কিন্তু তারা যা চায় তা হলো ক্ষমতা, সম্পদ এবং প্রভাব বিস্তার। ইতিহাসে এটি বহুবার প্রমাণিত হয়েছে। ভিয়েতনাম, আফগানিস্তান, ইরাক, ইউক্রেন-Ñ সবকিছুর পরেও বিশ্ব শেখেনি, শান্তির জন্য অস্ত্র কখনো সমাধান হতে পারে না। যুদ্ধবাজদের নেতিবাচক দিক তুলে ধরে বলতে হয় যে, তারা শুধু মৃত্যু, ধ্বংস ও অনিশ্চয়তার কারণ। মানবাধিকার লঙ্ঘিত হয়, শিশু ও বৃদ্ধদের জীবন বিপন্ন হয়, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতের অবস্থা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। অথচ, শান্তি প্রতিষ্ঠার নামে তাদের কার্যক্রম বাস্তবে হিংসা ও বিদ্বেষের বীজ বুনে। এ বাস্তবতা থেকে শিক্ষা নিতে হবে। বিশ্বের সকল রাষ্ট্রকে শান্তি রক্ষার ক্ষেত্রে অস্ত্রনির্ভর কৌশল পরিহার করতে হবে। কূটনৈতিক সংলাপ, আন্তর্জাতিক সংস্থা, মানবিক সহায়তাÑ এসবই শান্তি প্রতিষ্ঠার পথ। যুদ্ধবাজদের বার্তা অনুধাবন করতে হবে : তারা শান্তি চায় না, তারা কেবল ক্ষমতা চায়। বিশ্ববাসীকে সচেতন হতে হবে। যুদ্ধবাজদের কৌশল ও উদ্দেশ্য চিহ্নিত করতে হবে। মানবিক ও ন্যায়সঙ্গত সিদ্ধান্ত গ্রহণের মাধ্যমে, আমাদের শিখতে হবে অস্ত্রের পরিবর্তে সংলাপের মাধ্যমে শান্তি প্রতিষ্ঠা করা যায়। যুদ্ধবাজরা কখনো শান্তি নিয়ে আসে না। তারা শুধু ধ্বংস, মৃত্যুর ছাপ ও সমাজের অস্থিতিশীলতা তৈরি করে।
শেষত, শান্তির জন্য যুদ্ধ নয়। এটি এক বিপজ্জনক বিভ্রান্তি। যেসব দেশ বা শক্তি নিজেদের ‘শান্তির রক্ষক’ বলে দাবি করে, তারা প্রায়ই ইতিহাসের কালো অধ্যায় তৈরি করে। আমাদের প্রয়োজন সচেতনতা, শিক্ষা এবং মানবিক মূল্যবোধ। শান্তি অর্জন সম্ভব সংলাপ, বোঝাপড়া এবং ন্যায়সঙ্গত নীতির মাধ্যমে। অস্ত্রের মাধ্যমে শান্তি কখনো স্থায়ী হতে পারে না। বিশ্ববাসীর উচিত যুদ্ধবাজদের প্রকৃত চেহারা বোঝা। তারা শান্তির খোঁজে নয়; তারা শুধু নিজের স্বার্থ হাসিল করতে যুদ্ধ চালায়। এই সত্য উপলব্ধি করে, আমাদের সবাইকে শান্তির স্থায়ী ভিত্তি তৈরি করতে হবে, যেখানে অস্ত্র নয়, সংলাপ ও মানবিক মূল্যবোধের জয় হবে। শান্তি চাওয়া বিশ্বে যুদ্ধের এ প্যারাডক্স আমাদের শিখিয়েছে, সত্যিকারের শান্তি কখনোই অস্ত্রের মাধ্যমে আসে না। যুদ্ধবাজদের নেতিবাচক দিক, তাদের কেলেঙ্কারি এবং মানবতার বিরুদ্ধে কার্যকলাপ আমাদের সতর্ক থাকতে শেখায়। শান্তি অর্জনের একমাত্র পথ হলো বোঝাপড়া, সংলাপ এবং ন্যায়সঙ্গত নীতি।
লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট