আর্শিনা ফেরদৌস

মানব মন এক বিস্ময়কর রহস্য। মূলত, শরীরের প্রতিটি অঙ্গের সীমাবদ্ধতা রয়েছে। হাত, পা, চোখ কিংবা কান যতই শক্তিশালী হোক না কেন, তাদের কর্মক্ষমতা নির্দিষ্ট একটি সীমানার ভেতরে সীমাবদ্ধ। চোখ হয়তো দূর আকাশ দেখতে পারে, কিন্তু অদৃশ্য জগৎ নয়; কান শুনতে পারে নির্দিষ্ট তরঙ্গমাত্রার ভেতর। অথচ মন এমন এক স্বতন্ত্র শক্তি, যা কোনো অঙ্গ নয়, অথচ অঙ্গের সীমাবদ্ধতার বাইরে এক অদ্ভুত জগতের অধিপতি। মনকে কেউ স্পর্শ করতে পারে না, ধ্বংস করতে পারে না। কিন্তু মনই পারে মানুষকে নির্মাণ কিংবা ধ্বংসের পথে নিয়ে যেতে। তাই মনকে ইতিবাচক বৃত্তে সক্রিয় রাখতে আত্মশুদ্ধি ও আত্মসমালোচনার আবশ্যকতার বিষয়টি অনস্বীকার্য।

মনকে যদি এক কল্পনার রাজ্যের বাহন ধরা যায়, তবে তার গন্তব্য অনির্দিষ্ট। কখনো আলোর রাজ্যে ছুটে যায়, কখনো অন্ধকার অতল গহ্বরে নিমজ্জিত হয়। মনকে নিয়ন্ত্রণ করা যেমন কঠিন, তেমনি মনের স্রোতে ভেসে যাওয়া সহজ। এ মনই মানুষকে করে তোলে মানবিক, আবার কখনো অমানবিক। তাই প্রত্যের উচিত মনের ওপর কঠোর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা।

‘মন’ নিয়ে দার্শনিক, পণ্ডিত, সাহিত্যিক ও বিজ্ঞানীরা যুগে যুগে কথা বলেছেন। দানিয়েল ডিফো বলেছেন, ‘একটা সুন্দর মন অন্ধকারে আলোর মতো; যার মাধ্যমে কলুষতার মাঝেও নিজের অস্তিত্বকে মর্যাদাসম্পন্ন রাখা যায়।’ এখানে তিনি মনের পবিত্রতার গুরুত্ব তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন। কলুষিত পরিবেশেও যে মন সুন্দর ও সাবলীল, সে মন নিজের আলোয় জ্বলতে জানে; ছড়াতে পারে আলোকবর্তিকাও। গবেষণায়ও দেখা যায়, সুস্থ মন চাপ, প্রতিকূলতা কিংবা দুর্দশার মাঝেও ইতিবাচক চিন্তা তৈরি করতে সক্ষম। অন্যদিকে জন রে বলেছেন, ‘মনের দিক থেকে যে দুর্বল কর্মক্ষেত্রেও সে দুর্বল।’ তাই একজন সফল ও স্বার্থক মানুষকে মানসিকভাবে বলিষ্ঠ হতে হবে। তাহলেই তিনি জীবনের সকল ক্ষেত্রে সফল ও স্বার্থক হতে পারবেন।

বস্তুত, দুর্বল মন অনিশ্চয়তায় ভোগে, সিদ্ধান্তহীন হয় এবং বারবার ভুল করে। আর সে বৃত্ত থেকে কোন ভাবেই বেড়িয়ে আসা সম্ভব হয় না। মনোবিজ্ঞানের ভাষায় বলা যায়, দুর্বল মন মানসিক স্থিতিস্থাপকতা (resilience) হারিয়ে ফেলে। মন যদি দৃঢ় ও মজবুত হয়, তবে দেহ ও কর্মও শক্তিশালী হয়। আর এটিই বাস্তবতা।

দার্শনিক ও মনীষীরা মনের উপর অসংখ্য বাণী উচ্চারণ করে গেছেন। তারা লিখেছেন, ‘একটা মন আর একটা মনকে খুঁজিতেছে নিজের ভাবনার ভার নামাইয়া দিবার জন্য।’ এ উক্তি মানুষে মানুষে সম্পর্কের মূল দর্শন প্রকাশ করে। মন তার অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে চায় আরেকটি মনের সহায়তায়। বিশ্বাস, আস্থা ও পারস্পরিক বোঝাপড়া মানবজীবনের সম্পর্ককে দৃঢ় করে তোলে। অনত্র বলা হয়েছে, ‘মন দিয়ে মন বোঝা যায়, গভীর বিশ্বাস শুধু নীরব প্রাণের কথা টেনে নিয়ে আসে।’ বিশ্বাস ও মনের সংযোগ ছাড়া কোনো সম্পর্ক স্থায়ী হয় না। বিশ্বাস ভেঙে গেলে জীবনের ভিত্তি নড়বড়ে হয়ে যায়, যেমন আকাশ থেকে চাঁদের আলো হারিয়ে গেলে রাত অন্ধকারে ঢেকে যায়।

‘মন’ শুধু দার্শনিকতার বিষয় নয়; এটি চিকিৎসাশাস্ত্রেও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। দার্শনিক ফিলিপস এক সময় বলেছিলেন, ‘চিকিৎসকেরা যে ভুল করেন, তা হল তারা মনের চিকিৎসা না করে শরীর সারাতে চান।’ তাই চিকিৎসা বিজ্ঞানে স্বীকৃত শরীর ও মনের স্বাস্থ্য অবিচ্ছেদ্য। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) মানসিক সুস্থতাকে সামগ্রিক স্বাস্থ্যের অপরিহার্য অংশ হিসেবে ঘোষণা করেছে। গবেষণায় দেখা যায়, সুস্থ মন দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাও বাড়িয়ে তোলে। তাই প্রত্যেককেই মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ে সচেতন থাকা জরুরি।

মন নিয়ে বিভিন্ন গবেষক ও বিশ্লেষক নানা ব্যাখ্যাই উপস্থাপন করেছেন। এ বিষয়ে লটমাস নুন বলেছেন, ‘কুৎসিত মন একটি সুন্দর মুখের সমস্ত সৌন্দর্য কেড়ে নেয়।’ এ উক্তি মানব চরিত্রের প্রকৃত পরিচয় প্রকাশ করে। মন যদি কলুষিত হয়, তবে বাহ্যিক সৌন্দর্য অর্থহীন হয়ে যায়। সমাজে অন্যায়, দুর্নীতি ও অপরাধের মূলে থাকে কলুষিত মন। মনকে সুস্থ রাখার জন্য প্রয়োজন শিক্ষা, মূল্যবোধ ও মানবিকতা। অন্যদিকে ম্যাকডোনাল্ড লিখেছেন, ‘মনের উপর কারও হাত নেই। মনের উপর জোর খাটানোর চেষ্টা করা বৃথা।’ তবে একথা ঠিক যে, চেষ্টা করলে নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা খুবই সম্ভব। একথা অনস্বীকার্য যে, মন হলো স্বাধীনতা ও স্বাতন্ত্রের অনন্য প্রতীক। জোরজবরদস্তি দিয়ে মনকে বশ করা যায় না। এ কারণেই স্বাধীন চিন্তা, মুক্ত মন ও গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি মানব সভ্যতার বিকাশে অপরিহার্য অনুষঙ্গ। মূলত, মূল্যবোধ ও মানবতার ভিত্তি হলো দয়া। দয়াহীন মন পৃথিবীকে স্বার্থপর করে তোলে। দয়ালু মনই পারে অন্যকে সাহায্য করতে, সহমর্মিতা গড়ে তুলতে। গবেষণায় দেখা গেছে, সহানুভূতি ও দয়ার অনুভূতি মানুষের মস্তিষ্কে অক্সিটোসিন হরমোন বৃদ্ধি করে, যা সুখ ও শান্তির অনুভূতি জাগায়।

মানব সভ্যতার উৎকর্ষতায় প্রযুক্তি ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (অও) মানুষের জীবনকে ব্যাপকভাবে নিয়ন্ত্রণ করছে। তবে মন এমন এক শক্তি, যা কোনো যন্ত্র দ্বারা পুরোপুরি আয়ত্ত করা সম্ভব নয়। যন্ত্র হয়তো তথ্য বিশ্লেষণ করতে পারে, কিন্তু মন সৃষ্টি করে কল্পনা, অনুভূতি ও মানবিকতা। এ মনই মানুষকে করে তোলে অনন্য।

মানব মন এক অদ্ভুত সত্তা, যা দৃশ্যমান নয়, অথচ সর্বত্র বিদ্যমান এবং সর্বোতভাবে ক্রীয়াশীল। এটি পারে মানুষকে মহৎ করে তুলতে, আবার পারে অন্ধকারে নিমজ্জিত করতে। তাই মনকে পবিত্র রাখা, দয়া ও মানবিকতায় পূর্ণ করা আমাদের সবচেয়ে বড় দায়িত্ব ও কর্তব্য। মূলত মনকে ক্রিয়াশীল ও কর্মতৎপর রাখাও জরুরি। আর এজন্য চাই আত্মশুদ্ধি ও আত্মসমালোচনার মানসিকতা। মূলত, মানুষের সুন্দর মনই পারে এ সুন্দর পৃথিবীকে আরো সর্বাঙ্গ সুন্দর ও অধিকতর বাসযোগ্য করতে। এর অন্যথা হলে মানবসভ্যাতার বিকাশ সংকোচিত ও বাধাগ্রস্থ হবে।

লেখক : কবি ও প্রাবন্ধিক।