আসিফ আরসালান

জনাব মাহফুজ আলম সম্ভবত ভুলে গেছেন যে, তিনি বর্তমান ইন্টারিম সরকারের একজন উপদেষ্টা। উপদেষ্টা অর্থ হলো, একজন পূর্ণাঙ্গ বা ক্যাবিনেট মন্ত্রী। ক্যাবিনেটের কোনো মন্ত্রী বা উপদেষ্টা যখন কোনো রাজনৈতিক দল, ব্যক্তিত্ব বা কোন রাজনৈতিক দলের মতাদর্শ সম্পর্কে মন্তব্য করেন তখন মানুষ ধরে নেয় যে, এটি সরকারের বক্তব্য। বিষয়টি সম্ভবত মাহফুজ আলম বিস্মৃত হয়েছেন। তিনি আরো বিস্মৃত হয়েছেন যে, এখন তিনি তথ্য এবং সম্প্রচার উপদেষ্টা। যেসব দেশে সরকারের কোনো অফিসিয়াল মুখপাত্র থাকে না সেসব দেশে অনেক সময় তথ্যমন্ত্রী বা উপদেষ্টাই সরকারের মুখপাত্র হন। তথ্য ও সম্প্রচার উপদেষ্টার পদে থেকেও তিনি বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী সম্পর্কে বিরূপ মন্তব্য করেছেন।

দেশে যদি কোনো রাজনৈতিক সরকার থাকে তাহলে সে সরকারের কোনো মন্ত্রী বা দলীয় কোনো নেতা অন্যদল সম্পর্কে যে কোনো রকম মন্তব্য করতেই পারেন। কারণ যিনি মন্তব্য করেন বা যিনি মন্ত্রী হন তিনি নির্বাচন তথা রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে নিচ থেকে ওপরে উঠে আসেন। মাহফুজ আলম যদি কোনো রাজনৈতিক দলের সদস্য হতেন তাহলে কারো বলার কিছু থাকত না। কারণ একটি সাচ্চা গণতান্ত্রিক সমাজে একটি দল বা একজন নেতা আরেকটি দল বা আরেক জন নেতার সমালোচনা করবেন সেটিই স্বভাবিক।

প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস স্বয়ং বলেছেন যে, তার সরকার একটি সম্পূর্ণ নির্দলীয় ও নিরপেক্ষ সরকার। ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা যখন দেশ থেকে পালিয়ে যান তখন ড. ইউনূস ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসে ছিলেন। বাংলাদেশের সরকার পতনের পর গণঅভ্যুত্থানের কেউ একজন তাকে ফোন করেন এবং বাংলাদেশের দায়িত্ব গ্রহণের অনুরোধ করেন। প্রথম দিন তিনি রাজি হননি। পরদিন সকালে পুনরায় টেলিফোন গেলে তিনি রাজি হন। ঐ সময় তিনি প্যারিসের একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন। তিনি চিকৎসকদের অনুরোধ করেন যে, তাকে যত দ্রুত সম্ভব সারিয়ে তুলতে, যাতে করে তিনি দ্রুততম সময়ে বিমানে উঠে বাংলাদেশে আসতে পারেন। বাংলাদেশে সরকার গঠনের পর থেকে তিনি বলে আসছেন যে, তিনি কোনো দল করেন না এবং তার সরকারও নিরপেক্ষ এবং নির্দলীয়। যাদেরকে তিনি উপদেষ্টা করেন তাদেরও তেমন কোনো রাজনৈতিক চরিত্র খুঁজে পাওয়া যায় না।

এসব কথা আপনারা সকলেই জানেন। তবুও বলতে হলো এজন্য যে, একটি নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের নির্দলীয় নিরপেক্ষ একজন উপদেষ্টা হয়ে তিনি কিভাবে জামায়াতে ইসলামীকে আওয়ামী লীগের ভাষায় আক্রমণ করতে পারেন? তিনি অবশ্যই পারেন, যদি তিনি উপদেষ্টার পদ থেকে ইস্তাফা দেন। অতঃপর তিনি একজন সাধারণ নাগরিক হবেন অথবা কোনো রাজনৈতিক দলে যোগদান করবেন। এব্যাপারে এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম একটি অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। বিএনপি দাবি করেছিল যে, ছাত্রদের কোটা থেকে যে তিনজনকে উপদেষ্টা করা হয়েছে তারা যদি রাজনৈতিক কথাবার্তা বলতে চান বা রাজনীতি করতে চান তাহলে উপদেষ্টার পদ ছাড়ুন। নাহিদ ইসলাম প্রথমে উপদেষ্টার পদ থেকে ইস্তাফা দিয়েছেন এবং তারপর জাতীয় নাগরিক পার্টি গঠন করেছেন।

জাতিসংঘের বিগত সাধারণ অধিবেশনে যে টিম নিয়ে ড. ইউনূস নিউইয়র্ক যান সে টিমে মাহফুজ আলমও ছিলেন। সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিন্টন যে একটি প্রাইভেট অনুষ্ঠান করেন সে অনুষ্ঠানে ড. ইউনূস মাহফুজ আলমকে এ বলে পরিচয় দিয়েছিলেন যে, তিনি (মাহফুজ আলম) একটি সুপরিকল্পিত গণঅভ্যুত্থানের মাস্টারমাইন্ড (Mastermind of a well-designed mass uprising). দেশবাসী এখনো জানেন না যে, জুলাই আগস্টের গণবিপ্লবের মাস্টারমাইন্ড কি একজন ছিল, নাকি যৌথ নেতৃত্বের অধীনে Collective Leadership) ঐ বিপ্লব সংঘটিত হয়েছে? আমাদের জানার প্রয়োজনও নেই। তবে তিনি যদি সত্যিই মাস্টারমাইন্ড হয়ে থাকেন তাহলে জামায়াত সম্পর্কে তিনি যে উক্তি করেছেন সেটি একটি মাস্টারমাইন্ডের পক্ষে শোভা পায় না।

মাহফুজ আলম গত ১২ মার্চ বুধবার রাতে তার নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুক আইডিতে বলেন, “জামায়াত যুদ্ধাপরাধের সহযোগী ছিল। কিন্তু, নাহিদ ইসলাম যেভাবে বলেছেন এ অভ্যুত্থানের মাধ্যমে তারা কাফফারা দিয়েছেন। আমিও বলেছি, জামায়াতের যারা বাংলাদেশপন্থি, তারা এ দেশে রাজনীতি করার অধিকার রাখেন। জামায়াতের নতুন প্রজন্মের অল্প কিছু ব্যতিক্রম বাদে কেউই পাকিস্তানপন্থি নন। ফলে, স্বাধীনতাবিরোধী ট্যাগ দিয়ে জামায়াত-শিবিরের রাজনৈতিক অধিকার ক্ষুণ্ন করা যাবে না। রাজনৈতিক ও আদর্শিক লড়াই করেই তাদের বিরুদ্ধে জিততে হবে। তাদের প্রোপাগান্ডা ওয়ারের জবাব দিতে হবে সত্য দিয়ে। শাহবাগে ফ্যাসিবাদ ও শাহবাগীদের কাফফারা” শীর্ষক স্ট্যাটাসে তিনি লেখেন, “শাহবাগে যারা গিয়েছিল একটা বড় অংশ চেতনার অন্ধতায় পড়ে গিয়েছিল। অনেক ছাত্র-তরুণ ইসলামবিদ্বেষ থেকে না, বরং নিছক যুদ্ধাপরাধী বিচারের দাবিতে গিয়ে উপস্থিত ছিল।”

তিনি ঐ ফেসবুক স্ট্যাটাসে আরো লেখেন, “আমি শর্ষিণাপন্থি যে মাদরাসায় পড়েছি, সেখানে জামায়াত নেতাদের ভ্রান্ত আকিদার অনুসারী হিসেবে গণ্য করা হতো। আর জামায়াত নেতাদের ফাঁসিকে দেখা হতো তাদের আলেম ও সহি ‘ইসলাম’ বিরোধিতার ফসল হিসেবে। জামায়াতকে আমরা ছোটবেলা থেকে আলেম-ওলামাবিরোধী হিসেবেই জেনে এসেছি।”

উপদেষ্টা আরও লেখেন, “অনেকেই হয়তো খেয়াল করেন না, অধিকাংশ শাপলার কর্মীরাই আসলে জামায়াতের আকিদা (বিশ্বাস ও কর্মপন্থা) ও নেতৃত্ববিরোধী। শাপলার অনেক নেতৃত্বই জামায়াতের আলেম ও পীরপন্থা বিরোধিতার শিকার। এমনকি অনেকেই জামায়াত ও শিবির নেতাদের কর্তৃক নিগৃহীত ও নিপীড়িত হয়েছেন।

॥ দুই ॥

তিনি তার এ দীর্ঘ স্ট্যাটাসে অনেক কথাই বলেছেন যেগুলো আজকের এ লেখার জন্য অপ্রাসঙ্গিক। মাহফুজ আলমের এই বক্তব্যের তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ করে বিবৃতি দিয়েছেন জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল ও সাবেক এমপি মিয়া গোলাম পরওয়ার। গত বৃহস্পতিবার দেয়া বিবৃতিতে তিনি বলেন, গত ১২ মার্চ বুধবার অন্তর্বর্তী সরকারের তথ্য ও সম্প্রচার উপদেষ্টা মাহফুজ আলম তার দীর্ঘ এক ফেইসবুক স্ট্যাটাসে “জামায়াত যুদ্ধাপরাধের সহযোগী ছিল মর্মে যে মন্তব্য করেছেন আমি তার তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাচ্ছি। আমি তার এ ভিত্তিহীন ও মিথ্যা বক্তব্যে বিস্মিত। মাহফুজ আলমের বক্তব্যের জবাবে আমি স্পষ্ট ভাষায় জানাতে চাই যে, তিনি জামায়াত সম্পর্কে ভিত্তিহীন ও অসত্য বক্তব্য দিয়ে একটি প্রতিবেশী দেশের গুপ্তচর কারাবন্দী শাহরিয়ার কবিরদের ভাষাতেই কথা বলেছেন।

তিনি আরও বলেন, মাহফুজ আলমের স্মরণ রাখা উচিত যে, তিনি একটি অরাজনৈতিক অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টা। সে কারণে কোনো রাজনৈতিক দলকে টার্গেট করে সমালোচনা ও অসত্য বক্তব্য দেওয়ার কোনো নৈতিক ও বিধিগত অধিকার তিনি রাখেন না। রাজনৈতিক বক্তব্য দিতে হলে রাজনীতির ময়দানে এসে বক্তব্য দেয়া সমীচীন। তার এ বক্তব্য বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অরাজনৈতিক চরিত্রকেই প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।

তিনি বলেন, মাহফুজ আলমের জানা থাকার কথা যে, শেখ মুজিবের আমলে যুদ্ধাপরাধের জন্য যে তদন্ত কমিশন গঠন করা হয়েছিলো তাতে যুদ্ধাপরাধের সাথে জামায়াতের কারো সংশ্লিষ্টতার কোন প্রমাণ পাওয়া যায়নি। যে কারণে শেখ মুজিব নিজেই সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করে গ্রেফতারকৃতদের মুক্তি দিয়েছিলেন এবং আত্মসমর্পণকারী পাকিস্তানী সৈন্যদের পাকিস্তানে ফেরত পাঠিয়ে ঐ সমস্যার সমাধান করে গিয়েছেন। জামায়াতের সাবেক আমীর অধ্যাপক গোলাম আযম সুপ্রিম কোর্টে মামলা করে নির্দোষ প্রমাণিত হয়েই তিনি তার নাগরিকত্ব ফিরে পেয়েছেন। শেখ হাসিনা ক্যাঙ্গারু কোর্ট বসিয়ে জামায়াতের নেতাদের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দিয়েছিল এবং তাদের দলীয় লোকদের দিয়ে মিথ্যা সাক্ষী সাজিয়ে জামায়াত নেতাদের যে বিচার করেছিলো তা দেশে-বিদেশে কোথাও গ্রহণযোগ্যতা পায়নি। শাহবাগে গণজাগরণ মঞ্চ বানিয়ে বিচারপতিদের ভয় দেখিয়ে যে বিচার করা হয়েছে তা ছিলো বিচারের নামে একটি প্রহসন। তার প্রমাণ স্কাইপি কেলেঙ্কারি, সাবেক বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার বক্তব্য, মাওলানা সাঈদীর মামলার সাক্ষী সুখরঞ্জন বালীর বক্তব্য। এমনকি বৃটিশ সুপ্রিম কোর্ট-এ হাসিনা সরকারের ঐ বিচার গ্রহণযোগ্যতা পায়নি। এ থেকেই প্রমাণিত হয় যে, ১৯৭১ সালে জামায়াত নেতাদের যুদ্ধাপরাধের সহযোগী হওয়ার অভিযোগ সম্পূর্ণ মিথ্যা ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। মাহফুজ আলমের বক্তব্যটি সম্পূর্ণ অসত্য, ভিত্তিহীন ও অনুমাননির্ভর। তবে তার এ বক্তব্য কোনো রাজনৈতিক অসৎ অভিপ্রায় থেকে বা কোনো অপশক্তির ইন্ধনে তাদের এজেন্ডা বাস্তবায়নের অপরিণামদর্শী আকাক্সক্ষা থেকেও হতে পারে বলে দেশবাসী মনে করে।

॥ তিন ॥

জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেলের ঐ বিবৃতির পর নতুন করে আর কিছু বলার আর প্রয়োজন আছে বলে মনে করি না। এসব হাইলি পলিটিক্যাল বক্তব্য দিয়ে নির্দলীয়-নিরপেক্ষ সরকারকে প্রশ্নবিদ্ধ বা সমালোচনার পাত্র করা মাহফুজের মতো অপরিপক্ব উপদেষ্টার উচিত নয়। তিনি সরকারের ভেতরে আছেন। তার নিশ্চয়ই জানার কথা যে, বাংলাদেশ এক গভীর সংকটের মধ্যদিয়ে পার হচ্ছে। দেশের অভ্যন্তরেও সংকট। প্রতিদিন এক বা একাধিক মিছিল মিটিং হচ্ছে। প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব বলেছেন যে, সরকার এ পর্যন্ত ২৫৭টি আন্দোলন মোকাবেলা করেছে। মাহফুজ আলম নিশ্চয়ই দিল্লির বিশিষ্ট সাংবাদিক গৌতম লাহিড়ীর এক সাক্ষাৎকার পড়েছেন। আল জাজিরার সাংবাদিক জুলকারনাইন সায়ের ঐ ইন্টারভিউয়ের উদ্ধৃতি দিয়ে বলেছেন যে, আওয়ামী লীগের প্রায় ৪৫ হাজার নেতাকর্মী এখন ভারতে অবস্থান করছেন। আরেকটি খবরে প্রকাশ, শেখ হাসিনা দিল্লির ঠিক কোন স্থানে অবস্থান করছেন সেটি কঠোরভাবে গোপনীয় রাখা হয়েছে। কিন্তু দিল্লির সাংবাদিকরা এ তথ্যটি ফাঁস করেছেন যে, মাঝে মাঝে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এবং তাদের নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত দোভাল শেখ হাসিনার সাথে সাক্ষাৎ করছেন। মাহফুজ আলম এটিও নিশ্চয়ই লক্ষ্য করেছেন যে, ভারতের সেনাপ্রধান জেনারেল উপেন্দ্র ত্রিবেদী সোজাসাপ্টা বলেছেন যে, এ সরকারের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক হবে না। বাংলাদেশের কোনো নির্বাচিত সরকারের সাথেই কেবলমাত্র সম্পর্ক স্বাভাবিক হতে পারে।

ঐদিকে ভারতের একাধিক নামিদামী পত্রিকা বাংলাদেশের সেনাবাহিনী নিয়ে উন্মাদ প্রচারণা চালাচ্ছে। তারা সেনাবাহিনীকে উস্কে দেয়ার মতো উস্কানিমূলক সংবাদ প্রচার করছে। অবশ্য রিউমার স্ক্যানার তাদের ফ্যাক্ট চেকে এসব সংবাদকে ফেক বা ভুয়া বলছে।

ফেক বা ভুয়া হলেও এসব প্ররোচনামূলক সংবাদ প্রচারের পেছনে ভারতের অবশ্যই একটি বদ মতলব রয়েছে। মাহফুজ আলমদের বলবো, ভারতের এখন অসৎ উদ্দেশ্য মোকাবেলায় আপনাদের এনার্জি ব্যয় করুন, জামায়াতের খুঁত ধরার পেছনে অযথা সময় নষ্ট করবেন না।

Email: [email protected]