সাইয়েদ রাফে সামনান
পরিচয়টা পিতার সূত্র ধরে। অধ্যাপক খুরশীদ আহমদের পিতা নাজির আহমদ কোরায়েশী ছিলেন মাওলানা সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী রহ.-এর ঘনিষ্ঠ বন্ধু। উভয়েই ছিলেন দিল্লীর অধিবাসী। বিষয়টি প্রফেসর খুরশীদ নিজেই উল্লেখ করেছেন এভাবে যে, পারিবারিকভাবে আমার বাবা তার একজন ঘনিষ্ঠ বন্ধুবর ছিলেন। বিষয়টি মাওলানা স্বয়ং আমাকে বলেছেন, কিন্তু বাবার ইন্তিকালে মাওলানা মওদূদী রহ. শোকগাঁথা লিখে যে চিঠি পাঠিয়েছিলেন তা দেখে আমার উপলব্ধি আরও পরিষ্কার হয়।
প্রফেসর খুরশীদ আরও লিখেন, মাওলানা মওদূদী যখন ভূপাল থেকে দিল্লীতে স্থানান্তরিত হন তখন থেকেই মূলত তাদের বন্ধুত্ব বেশি গাঢ় হয়। ১৯৩৮-৩৯ সালে মাওলানা মওদূদীকে আমি প্রথম দেখি। তিনি তখন আমাদের বাসায় বেড়াতে এসেছিলেন। বৈঠকখানায় বসে তাকে শোনানো কবিতাটি আজও আমার হৃদয়পটে মুদ্রিত আছে। আমার বয়স তখন ছয় বছর। তার সাথে দ্বিতীয় সাক্ষাৎ ১৯৪৮ সালে। সে বছর ফেব্রুয়ারি মাসের ১২ তারিখে আমরা দিল্লী ছেড়ে লাহোর চলে আসি। মডেল টাউনের একটি ছোট কুঠুরি ভাড়া নিয়ে আমাদের লাহোরের জীবন শুরু হয়। হঠাৎ একদিন মাগরিবের নামাযের পূর্বে মাওলানা আমাদের বাসায় তাশরীফ আনেন। আমাদের বাসার লনে তার ইমামতিতে আমরা মাগরিব আদায় করলাম। আমি সেদিন ইক্বামাত দিয়েছিলাম। (তরজামুল কুরআন বিশেষ সংখ্যা : অক্টোবর ২০০৩)।
১৯৩২ সালের ২৩ মার্চ হিমালিয়ান উপমহাদেশের রাজধানী দিল্লীতে জন্ম। ৫০০ বছরের মুসলিম শাসনের অবসান হবার পর দিল্লী তখন সবেমাত্র ব্রিটিশ ভারতের রাজধানী হয়েছে। ১৮৫৭ সালের প্রথম স্বাধীনতাযুদ্ধে ভারতবর্ষের মুসলমান আলেম সিপাহী-জনতার বিপ্লব ব্যর্থ হয়ে গেলে বেনিয়ার বেশে আসা ইংরেজরা দিল্লীর মসনদে আসীন হয়। শেষ মোঘল সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফর নির্বাসিত হন বার্মার রাজধানী রেঙ্গুনে। ইংরেজদের হাতে লাখ লাখ আলেম নিহত হন। হাজার হাজার দেশপ্রেমিক স্বাধীনতাকামী ভারতীয় মুসলিমকে নির্বাসিত করা হয় কালাপানি খ্যাত আন্দামান নিকোবর দ্বীপপুঞ্জে। যেন শতাব্দীর প্রাচীন গুয়ান্তানামো বে।
এমনি এক ঘনঘোর অন্ধকার অমানিশার তমাশাচ্ছন্ন যুগে দিল্লী শহরে খুরশীদ আহমদ জন্মলাভ করেন। পেশায় ব্যবসায়ী নাজির আহমদ কোরায়েশী ছিলেন মাওলানা মওদূদী রহ.-এর একজন ঘনিষ্ঠ বন্ধু এবং দিল্লীর একজন সম্ভ্রান্ত ব্যবসায়ী। ১৯৪৮ সালে নাজির আহমদ পেশাগত কারণে নিখিল পাকিস্তানের প্রথম রাজধানী করাচীতে চলে আসেন। খুরশীদ আহমদ কিছুদিন লাহোরে থেকে যান। কিন্তু দেরী হয়ে যাবার কারণে লাহোরের কোনো কলেজে তিনি ভর্তির সুযোগ পেলেন না।
১৯৪৯ সালে প্রফেসর খুরশীদ করাচীতে চলে আসেন। বড় ভাই যামীর আহমদ ততদিনে ইসলামী জমিয়তে তালাবার সাতে সংযুক্ত হয়েছেন। তার ভ্রাতা যামীর আহমদ পরবর্তী জীবনে পাকিস্তান নৌবাহিনীর উপ-প্রধান নিযুক্ত হয়েছিলেন। কনিষ্ঠ ভ্রাতা ড. আনিস আহমদ প্রখ্যাত ইসলামী চিন্তাবিদ।
করাচী আসার পর মাওলানার সাহিত্যভাণ্ডার থেকে ‘খুতবাত’ ও ‘তানকীহাত’ অধ্যয়ন করেন খুরশীদ আহমদ। সে সময় মোহাম্মদ আসাদ লিখিত Islam at the cross Roads অধ্যয়ন সম্পন্ন করেন। জমিয়তের রুকনিয়াত অর্জন করে ফিরে ১৯৫০ সালে বার্ষিক সম্মিলনে যোগদিতে লাহোর যাত্রা। এবার সফরসঙ্গী খুররম মুরাদ, যাফার ইসহাক আনসারী (রাজা ভাই), আব্দুল্লাহ জাফর, বড় ভাই যামীরসহ অনেকে। এবার মাওলানা সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদীর সাথে তার সাক্ষাৎ, পূর্ণ পরিচয় ও আলিঙ্গনকে অত্যন্ত হৃদ্যতাপূর্ণ বলে ব্যক্ত করেছেন প্রফেসর খুরশীদ।
কলেজ জীবন থেকে মাতৃভাষা উর্দুর চেয়ে ইংরেজিতে বেশি দক্ষ ছিলেন খুরশীদ আহমদ। খুরশীদ আহমদ ও রাজা ভাইÑ এই দুইজনের হাত ধরে জমিয়তের প্রকাশনা STUDENT VOICE প্রথম প্রকাশিত হয় সাইক্লোস্টাইল মেশিনে। সাংগঠনিক দায়িত্ব পালন তাকে নিয়ে যায় ছাত্রসংঘের নাযেমে আ’লার পদে।
ছাত্রজীবন শেষ করে প্রফেসর খুরশীদ জামায়াতে ইসলামীতে যোগদান করেন। ষাটের দশক হতেই তিনি জামায়াতে ইসলামী পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় মজলিসে শূরার সদস্য।
১৯৭৯ সালে ইসলামাবাদে প্রতিষ্ঠা করেন বর্তমান বিশ্বের অন্যতম থিঙ্কট্যাঙ্ক ওচঝ বা ইনস্টিটিউট অব পলিসি স্টাডিজ। ১৯৭৩ সালে যুক্তরাজ্যের লিস্টারে দি ইসলামিক ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠায় অন্যতম অবদান রাখেন।
১৯৭৮ সালে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় পরিকল্পনা ও উন্নয়ন বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলেন এবং পরিকল্পনা কমিশনের ডেপুটি চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেন। আশির দশক থেকেই তিনি পাকিস্তানের উচ্চকক্ষ সিনেটের সদস্য এবং অর্থ ও পরিকল্পনা বিষয়ক সিনেট কমিটির চেয়ারম্যান হিসেবে দীর্ঘদিন দায়িত্ব পালন করেন। ২০১২ সাল পর্যন্ত তিনি সিনেট সদস্য ছিলেন। মুসলিম বিশ্বে এই মহামনীষীর অবদান অসামান্য। এজন্যই মুসলিম দুনিয়ার নোবেল খ্যাত বাদশা ফয়সল পুরষ্কারে তাকে ভূষিত করে রাজকীয় সৌদী সরকার।