আর্শিনা ফেরদৌস
মানুষ মাত্রই সৌন্দর্য প্রিয়। তাই সুন্দরের প্রতি সকলেরই একটা দুর্বলতা লক্ষ্য করা যায়। কিন্তু একথা ঠিক যে, দৌহিক সৌন্দর্য আসল সৌন্দর্য নয়। কারণ, এটি বহিরাভরণ মাত্র। বস্তুত, ব্যক্তির প্রকৃত সৌন্দর্য হলো তার ব্যক্তিত্বে, আচার-আচরণে, চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যে, দায়িত্ব ও কর্তব্যনিষ্ঠায়; সর্বোপরি মনুষত্ববোধে। সৌন্দর্য একটি দায়িত্ব ও কর্তব্যের নাম। আর সৌন্দর্য চোখে বা দৃষ্টিতে নয় বরং আত্মায় থাকে। বিষয়টি অন্তরদৃষ্টি দিয়ে উপলব্ধি করতে হয়। আর এ কথাটি শুধু কোন কবিতার লাইন নয়, বরং মানবজীবনের গভীর সত্যের প্রতিফলন; নির্মোহ এক বাস্তবতা। সাম্প্রতিক বিশ্বে, বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে, সৌন্দর্যের ধারণা ক্রমেই এক জটিল সাংস্কৃতিক ও নৈতিক বাস্তবতায় রূপ নিয়েছে। সেখানে মেয়েদের ‘সুন্দর’ বলা অনেক সময় প্রশংসা নয়, বরং ব্যক্তিগত সীমা লঙ্ঘনের প্রতীক হিসাবে বিবেচনা করা হয়। এর পেছনে রয়েছে সমাজে লিঙ্গসমতা, পারস্পরিক সম্মান এবং ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা। যা বিবেকবান মানুষের জন্য অবশ্যই শিক্ষণীয়।
প্রাশ্চাত্যে কেউ কাউকে সুন্দর বললে সেটি বাহ্যিক রূপের মূল্যায়ন হিসেবে ধরা হয়। যা ব্যক্তি বা নারীর ব্যক্তিত্ব, বুদ্ধিমত্তা বা মানসিক শক্তিকে উপেক্ষা করে। এজন্য তারা ব্যবহার করে বিকল্প শব্দ-You look confident, You are inspiring কিংবা ‘You seem powerful’ বস্তুত, এসবের মধ্যে থাকে প্রেরণা; থাকে না দৃষ্টিনির্ভর বা বহিরাভরনের আকর্ষণ। এমন সাংস্কৃতিক পরিবর্তন মূলত নারীর মর্যাদাকে দৌহিক সৌন্দর্যের সীমা থেকে মুক্ত করার এক প্রচেষ্টা। তবে এখানেই এক দার্শনিক প্রশ্ন জাগে, সৌন্দর্য আসলে কী? দেখা যায়, না অনুভব করা যায়? বিষয়টি বেশ জটিল বলেই মনে করেন মনোবিজ্ঞানীরা।
প্রাচীন গ্রিক দার্শনিক প্লেটো বলেছিলেন, ‘Beauty is the splendor of truth’ সৌন্দর্য সত্যের দীপ্তি। কিন্তু আজকের ভোগবাদী সমাজে সে দীপ্তি ম্লান হয়ে গেছে রূপের বাহ্যিক ঝলকানিতে। সুন্দরীরা প্রায়ই একপেশে হয়ে পড়েন। কারণ, সমাজ তাদের কেবল বাহ্যিক আভায় মুগ্ধ থেকে ভিতরের গভীরতাকে উপেক্ষা করে। যেন সূর্যাস্তের রঙে সবাই থেমে যায়, কিন্তু সূর্য যে ক্লান্ত হয়ে হারিয়ে গেল সেটি কেউ দেখে না। আর সাম্প্রতিক সময়ে এটিই বাস্তবতা।
ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে সৌন্দর্যের ধারণা আরও গভীর ও বিস্তৃত। ইসলামের দৃষ্টিতে ‘আল্লাহ সুন্দর এবং তিনি সৌন্দর্য ভালোবাসেন।’ (সহীহ মুসলিম)। কিন্তু সে সৌন্দর্য কেবল বাহ্যিক নয়, বরং চরিত্র, নৈতিকতা ও আত্মিক বিশুদ্ধতায় নিহিত। পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে, ‘তোমাদের মধ্যে আল্লাহর নিকট সর্বাধিক মর্যাদাবান সে ব্যক্তি, যে সর্বাধিক পরহেজগার।’ (সূরা হুজুরাত, আয়াত ১৩) অর্থাৎ সৌন্দর্যের মানদণ্ড হলো হৃদয়ের পবিত্রতা ও নৈতিকতার গভীরতা, নয় বাহ্যিক রূপের ঝলক। খ্রিস্টধর্মেও একই শিক্ষা দেওয়া হয়েছে। বাইবেলে বলা হয়েছে, our beauty should not come from outward adornment, rather, it should be that of your inner self’ (১ পিটার ৩:৩-৪) অর্থাৎ সত্যিকারের সৌন্দর্য হলো অন্তরের নম্রতা ও সহানুভূতির প্রকাশ। এ দৃষ্টিভঙ্গি আমাদের মনে করিয়ে দেয় সৌন্দর্য কেবল দেখা যায় না; বরং হৃদয় দিয়ে অনুভব করতে হয়।
যেমন নদীর কলতানের সৌন্দর্য দেখে আমরা মুগ্ধ হই, কিন্তু তার গভীর স্রোতকে বুঝতে পারে কেবল সে নাবিক, যে ঢেউয়ের সঙ্গে লড়েছে। সুন্দর মানুষও তেমন তার মুখ উজ্জ্বল, কিন্তু তার হৃদয়ের আলো অদৃশ্য, নিঃশব্দ, সত্যিকারের। সামাজিক দৃষ্টিতে সুশ্রী নারীদের একপেশে হয়ে যাওয়ার বিষয়টি মানসিক চাপের সঙ্গেও যুক্ত। তারা প্রায়ই এমন এক প্রতিচ্ছবির মধ্যে আটকে যায়, যা সমাজ তৈরি করেছে একটি নিখুঁত মুখ, নিখুঁত হাসি, নিখুঁত আচরণ। কিন্তু এর ভেতরে থাকে এক অব্যক্ত একাকিত্ব। কারণ সবাই তাদের দেখে, কিন্তু খুব কম মানুষই তাদের বোঝে বা উপলব্ধি করে।
বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশীয় সমাজজীবনে সৌন্দর্যের ধারণা আবার ভিন্ন। এখানে মেয়েদের সৌন্দর্য এখনো সামাজিক মর্যাদা, বিবাহ বা পেশাগত স্বীকৃতির সঙ্গে গভীরভাবে জড়িত। অথচ ধর্ম, সাহিত্য ও দর্শন আমাদের শেখায় দৌহিক সৌন্দর্য ক্ষণস্থায়ী; চরিত্র অনন্তের। আত্মার সৌন্দর্যই প্রকৃত সৌন্দর্য। ত্বকের রঙ ফিকে হয়, চোখের দীপ্তি কমে যায়, কিন্তু নৈতিকতার আলো কখনো নিভে না বরং চিরস্থায়ী ভিত্তি প্রস্তুত করে।
চিত্রকল্পে ভাবলে একটি পদ্মফুলকে দেখলে মনে হয় সে কেবল সৌন্দর্যের প্রতীক। কিন্তু পদ্ম তো জন্মায় কাদা থেকে। তবুও এটিকে ছুঁতে পারে না মলিনতা। সৌন্দর্যও তেমনি; যদি তা আত্মার আলোয় আলোকিত হয়, তবে তা অনন্ত; কিন্তু যদি কেবল চোখের জন্য হয়, তবে তা ক্ষণিক। আজকের সমাজে তাই প্রশ্ন একটাই আমরা কি সত্যিই মানুষকে ভালোবাসি, নাকি তার মুখের প্রতিবিম্বকে; দৈহিক দেহাবরণকে? ধর্মীয় নির্দেশনা হচ্ছে, ভালোবাসো সে হৃদয়কে যেখানে স্রষ্টার ছায়া আছে। দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গী, জানো সে মানুষটিকে, যে বাহিরের নয়, ভেতরের আলোয় প্রজ্জলিত।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সহ পাশ্চাত্য বিশ্বে ‘সুন্দর’ বলা যেমন সামাজিকভাবে সীমিত, আমাদের সমাজেও ‘সুন্দর’ শব্দের অর্থ পুনরাবিষ্কার জরুরি। সৌন্দর্য যেন আর কেবল দেহে না, থাকে চিন্তায়, মননে, আচরণে ও অনুভূতির ভিতরে।
শেষ পর্যন্ত সৌন্দর্যের পাঠ একটাই, দৌহিক সৌন্দর্যের দীপ্তি ক্ষণস্থায়ী, কিন্তু আত্মার আলো অনন্ত। যে মানুষ এ আলো খুঁজে পায়, সে-ই সত্যিকারের সুন্দর, সে যেখানেই থাকুক না কেন। বস্তত, আত্মার সৌন্দর্যই প্রকৃত সৌন্দর্য।
লেখক : কবি ও প্রাবন্ধিক।