মোহাম্মদ মাহবুব হোসাইন
৯০ দশকের শুরুতে বাংলাদেশের স্বকীয়তার বিরুদ্ধে তথাকথিত গণআদালতের নামে যে নৈরাজ্য সৃষ্টি করেছিল দেশের সংবিধান পরিপন্থি সংগঠন একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি বা ঘাদানিক; তার বিরুদ্ধে সেদিন দেশের যে ক’জন যুবক সাহস নিয়ে রাস্তায় নেমে এসেছিল তাদের মিছিলে আমিও ছিলাম। একদিকে লেখাপড়া অন্যদিকে দৈনিক মিল্লাত পত্রিকায় খণ্ডকালিন কাজ এবং এর পাশাপাশি মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় লালিত সংগঠন জাতীয় যুব কমান্ডের ব্যানারে দেশব্যাপী নৈরাজ্যবাদী ঘাদানিকের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার প্রেক্ষাপটের সময় জাতীয় পর্যায়ে যে সকল রাজনৈতিক নেতাদের সাথে আমাদের পরিচয় হয়েছিল তাদের মধ্যে তৎকালিন বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর নেতা পরবর্তীতে সেক্রেটারি জেনারেল এবং সমাজকল্যাণ মন্ত্রী শহীদ আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ অন্যতম।
যতটুকু মনে পরে ১৯৯৩ এপ্রিলের কোন একদিন বিকেলে ঢাকার মীরবাগে তারঁ বাসায় আমি ও যুব কমান্ডের কয়েকজন সদস্য সৌজন্য সাক্ষাৎকারের জন্য গিয়েছিলাম। কথা বলার শুরুতেই আমাদের লেখাপড়ার খোঁজ নিলেন। জীবনের এ প্রথম কোন রাজনৈতিক নেতার কাছ থেকে এমন ব্যতিক্রম কথা শুনে অবাকই হলাম। এর আগে যত রাজনৈতিক নেতাদের সাথে কথা হয়েছে তারা কোন দিনই লেখাপড়ার কথা তো জানা দুরের কথা বরং কাকে কয়টা ঘা দিতে হবে এসবই বাংলাদেশের রাজনৈতিক নেতাদের মূল আদর্শ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সাক্ষাৎকার শেষে তিনি আমাদের রাস্তা পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে যান। যে কথাটা বলতে ভুলেই গিয়েছিলাম, তা হলো একজন জাতীয় নেতার জীবন-যাপন এতোটা সাধারণ হতে পারে তা সত্যি অবাক করার মতো।
তাঁর সাথে এ সাক্ষাতের দীর্ঘ ১৫ বছর পর টিপাইমুখ বাঁধ সংক্রান্ত একটি গোলটেবিল বৈঠকে তাকে দাওয়াত দেবার জন্য ফোন করে আমার পরিচয় দিতেই তিনি আমাকে চিনে ফেললেন। সেদিন আমি যেনো আকাশ থেকে পড়লাম। কতটা সচেতন হলে আমার মতো একজন সাধারণ মানুষের কথা দীর্ঘ দিন মনে রাখতে পারেন। আমাদের অনুষ্ঠানের দিন জাতীয় প্রেসক্লাবের ভিআইপি লাউঞ্জে আমি ও নাগরিক ফোরামের চেয়ারম্যান আব্দুল্লাহিল মাসুদ সহ অন্যান্যরা যখন হলে অনুষ্ঠানের ব্যানার লাগাচ্ছিলাম; তখনও অনুষ্ঠান শুরু হতে ২০ মিনিট সময় বাকি। ঘুরে তাকিয়ে দেখি অনুষ্ঠানের অন্যতম বিশেষ মেহমান শহীদ আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ সবার আগেই সভাস্থলে হাজির। দেশের প্রশ্নে অসংখ্য সভা সেমিনার কিংবা নানা কর্মসূচি পালন করেছি। সময়ের প্রতি প্রায় সকলেরই কোন খেয়াল থাকতোনা। কিন্তু শহীদ আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদকে সেদিন পেলাম সময়ের প্রতি কিভাবে মূল্য দিতে হয় ।
এ অনুষ্ঠানে তিনি বেশ চমৎকারভাবে টিপাইমুখ বাঁধ-এর নানা দিক নিয়ে আলোচনা করলেন। সভা শেষে আমি তাকে এগিয়ে দিতে নিয়ে নিচে যেতে চাইলাম। তিনি আমাকে বললেন আসতে হবেনা। অন্য মেহমান কে সময় দিন। আমি সেদিনও কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে গিয়েছিলাম তাঁর এমন অসাধারণ মানবিক ব্যবহারে।
বিডিআর হত্যা নিয়ে গোলটেবিল বৈঠকে করতে যেয়ে সরকারের রোষানলে পরে ২০০৯ এ প্রিয় মাতৃভুমি বাংলাদেশ ত্যাগের পর তিনি প্রায়ই টেলিফোনে আমার খোঁজ-খবর নিতেন। তাঁর সাথে আরও অনেক স্মৃতি আমার আছে; যা চলার পথে আমাদের অনেক কাজে আসবে। সময় হলে লিখবো।
এমন একজন সাদা মনের আদর্শীক মানুষকে রাজনৈতিক প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার জন্য সেদিন ফ্যাসিবাদী শেখ হাসিনা’র সরকার তথাকথিত ট্রাইব্যুনালের মাধ্যমে হত্যা করেছিলো।
২০১৫ সালের আজকের দিনে ২২ নভেম্বর আওয়ামীলীগ সরকার অন্যায়ভাবে জুডিশিয়াল কিলিংয়ের মাধ্যমে আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদকে ফাঁসির নামে হত্যা করেছিল। মহান আল্লাহ আমাদের প্রিয়জন শহীদ আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদের উপর রহম দান করুন।
লেখক : সাংবাদিক ও মানবাধিকার কর্মী।