মো: সাজ্জাদুল ইসলাম

স্থানীয় সমস্যা স্থানীয়ভাবে সমাধানের লক্ষ্যেই মূলত স্থানীয় সরকার কাজ করে থাকে। স্থানীয় পর্যায়ের সমস্যার সুষ্ঠু সমাধানের জন্য স্থানীয় পর্যায়ে এ ধরণের শাসন ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে। আমাদের দেশের গ্রামাঞ্চলে স্থানীয় সরকার বিধানকে ইউনিয়ন পরিষদ, উপজেলা পরিষদ ও জেলা পরিষদ, আর শহর অঞ্চলে পৌরসভা ও সিটি কর্পোরেশন বলা হয়। এসব নির্বাচিত প্রতিষ্ঠান ৫ আগষ্টে স্বৈরাচার হাসিনার পতন ও পলায়ণের সঙ্গে সঙ্গে অকার্যকর হয়ে পড়েছে। স্থানীয় সরকার না থাকায় জেলা ও উপজেলা প্রশাসনকে এসব প্রতিষ্ঠানের অনেক কাজ সম্পন্ন করতে হচ্ছে। এতে প্রশাসনিক কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে। তাই জনগণের কল্যাণে স্থানীয় সরকার নির্বাচন করা জরুরী মনে করছেন বিশ্লেষকরা।

এ নির্বাচন সংসদ নির্বাচনের আগেই হওয়া দরকার কিনা তা নিয়ে রাজনৈতিক মহলে বিভাজন রয়েছে। বিএনপি ও তার মিত্ররা আগে সংসদ নির্বাচন চায়। বিএনপি কেবল এর বিরোধীই নয়, এ নির্বাচন যারা চাচ্ছে তাদেরকে ‘স্বাধীনতা বিরোধী’ বলে স্বৈরাচার শেখ হাসিনার বহুল উচ্চারিত এই বক্তব্যের পুণরাবৃতিও করছে। কেবল তাই নয় বিএনপি নেতারা বলেছেন, ‘স্থানীয় সরকার নির্বাচন আগে হতে দেয়া হবে না।’

তবে জামায়াতে ইসলামিসহ দেশের অনেক রাজনৈতিক দল, বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারসহ অধিকাংশ মানুষ স্থানীয় সরকার নির্বাচন সংসদ নির্বাচনের আগে অনুষ্ঠানের পক্ষে। বিএনপি অন্তর্বর্তী সরকারের প্রায় সব কাজের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছে। তারা দ্রুত নির্বাচন চায়, সংস্কার চায় বলে বললেও সে জন্য প্রয়োজনীয় সময় দিতে নারাজ। পতিত স্বৈরাচারের বিচার চাইলেও নির্বাচনের আগে তা সম্পন্ন হোক এমনটি তারা দাবি করছে না। গণবিরোধী বাহাত্তরের সংবিধান বাতিল ও স্বৈরাচারের দোসর ও দূর্নীতিতে নিমজ্জিত রাষ্ট্রপতির পদত্যাগেরও বিপক্ষে দলটি। আসলে বিএনপি কী চায় সেইটাই তাদের কাছে স্পষ্ট কিনা তা নিয়ে সংশয় আছে। চাঁদাবাজি ও নিজেদের ও প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে হামলা সন্ত্রাসে জড়িয়ে পড়েছে দলটি।

জনগণের মৌলিক সেবাসহ দৈনন্দিন কাজ সুষ্ঠুভাবে করতে রাজনৈতিক বিশ্লেষক এবং দেশে বেশির ভাগ রাজনৈতিক দল স্থানীয় সরকার নির্বাচন আগে অনুষ্ঠানের দাবিটি জনদাবিও বটে। স্থানীয় সরকার সংস্কার কমিশনের চেয়ারম্যান অধ্যাপক তোফায়েল আহমেদ বলেছেন, বেশির ভাগ মানুষ চায় অন্তর্বর্র্তী সরকারের আমলেই জাতীয় সংসদের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন অনুষ্ঠিত হোক।

গণঅভ্যূত্থানে স্বৈরাচার শেখ হাসিনার পতনের পর ছয় মাস পার হয়ে গেছে। ড. মুহাম্মাদ ইউনুসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার দেশের উন্নয়ন ও সংস্কারে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। দেশে একটি মুক্ত-স্বাধীন পরিবেশ ফিরে এসেছে। মানুষ স্বাধীনভাবে কথা বলতে পারছে। গণমাধ্যম আজ অবাধ স্বাধীনতা ভোগ করছে। তবে দেশে আইনশৃঙখলা পরিস্থিতি ততটা উন্নতি হয়নি, কমেনি দ্রব্যমূল্য, চাদাবাজিও চলছে নানাভাবে এবং প্রশাসনিক কার্যক্রমে আশান্বিত গতি এখনো ফিরে আসেনি। স্বৈরাচার হাসিনা ও তার দলের বিরুদ্ধে দেশবাসী ঐক্যবদ্ধ থাকলেও দলগুলোর মধ্যে সংসদ ও স্থানীয় নির্বাচনের কোনটি আগে হবে তা নিয়ে মতপার্থক্য ক্রমশ বাড়ছে।

সংস্কার প্রশ্নে দলগুলোর মতপার্থক্যও দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতির ক্রমশ জটিল করে তুলছে। দেশের বড় দল বিএনপি দ্রুত জাতীয় সংসদ নির্বাচনের জোর দাবি জানাচ্ছে, অন্যসব দলও নির্বাচন চায়, তবে সংস্কার করার পর। বিএনপি বলছে, তারা ডিসেম্বর মাসের মধ্যে জাতীয় নির্বাচন অর্থাৎ সংসদ নির্বাচন চায়, এর আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন অনুষ্ঠানের পক্ষে নয় তারা। তবে একথা সবাই স্বীকার করছে যে, মৌলিক সংস্কার করা ছাড়া নির্বাচন হলে তা সুষ্টু হবে না এবং আরেকটি স্বৈরাচারের উত্থানও ঠেকানো কঠিন হবে। আর বৈষম্যমুক্ত সমাজ গঠনের গণঅভ্যূত্থানের গণআকাঙ্খাও পূরণ হবে না। অন্তর্বর্তী সরকারও নির্বাচন দিতে সম্মত আছে। তবে তারা বলছে, প্রয়োজনীয় ন্যূনতম সংস্কার সম্পন্ন হওয়ার পরই দ্রুত নির্বাচন দিতে চায় তারা। চলতি বছরের ডিসেম্বর বা আগামী বছরের জুনে এই নির্বাচন হতে পারে বলে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মাদ ইউনূস জানিয়েছেন।

প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসও জানিয়েছেন, জাতীয় নির্বাচনের পাশাপাশি স্থানীয় নির্বাচনের প্রস্ততি নিচ্ছে অন্তর্র্বতী সরকার। গত ৮ জানুয়ারি প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস ইউরোপীয় বিনিয়োগ ব্যাংকের (ইআইবি) ভাইস প্রেসিডেন্ট নিকোলা বিয়ারের সঙ্গে আলোচনার সময় বলেন, অস্তর্র্বতী সরকার জাতীয় নির্বাচনের সঙ্গে স্থানীয় সরকার নির্বাচনেরও প্রস্ততি নিচ্ছে, যেন স্থানীয় সরকার সত্যিই স্থানীয় সরকার থাকে এবং একটি সরকার নিশ্চিত করা যায়। স্থানীয় সরকার সংস্কার কমিশন বলছে, জাতীয় নির্বাচনের আগে তৃণমূলের ভোট দিতে জনদাবি রয়েছে।

জামায়াতে ইসলামীও আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচনের পক্ষে। অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেয়া ছাত্রদের সংগঠন জাতীয় নাগরিক কমিটি আগে স্থানীয় নির্বাচনের পক্ষে জোরালো অবস্থান নিয়েছে। নূরুল হক নূরের দল নাগরিক অধিকার পরিষদও আগে স্থানীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের পক্ষপাতি। বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলামের দাবি, জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন চাওয়া দেশকে আরও ভঙ্গুর অবস্থায় নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা ছাড়া আর কিছুই নয়। জাতীয় সংসদ নির্বাচনের বিষয়ে আবারও গুরুত্বারোপ করে তিনি বলেন, যত দ্রুত জাতীয় নির্বাচন হবে, ততই রাজনীতি সহজ হবে। বাংলাদেশের মানুষ স্থিতিশীল অবস্থার মধ্যে আসবে। সম্প্রতি গুলশানে বিএনপি চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে সাংবাদিকদের ব্রিফিংয়ে এক প্রশ্নের জবাবে মির্জা ফখরুল এসব কথা বলেন। নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে বৈঠকে জামায়াত নেতাদের পক্ষে স্থানীয় সরকার নির্বাচন আগে চাওয়ার বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে বিএনপি মহাসচিব বলেন, এটাতে আমরা একেবারেই একমত নই। কোনো দলের নাম উল্লেখ না করে বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবীর রিজভী বলেন, ‘একটি রাজনৈতিক দল নির্বাচন নিয়ে বিতর্ক করছে। তারা বলছে, স্থানীয় নির্বাচন আগে হতে হবে, তার পরে সংসদ নির্বাচন হবে। বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা জয়নুল আবদিন আরেক ধাপ এগিয়ে বলেছেন, তার দলকে টপকিয়ে জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় নির্বাচন বাংলার বুকে হতে দেয়া হবে না। জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে স্থানীয় নির্বাচনের আগে জাতীয় নির্বাচনের দাবিতে এক সমাবেশে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি একথা বলেন। গত ১০ ফেব্রুয়ারি স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া জানিয়েছেন, সংসদ নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচনের বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়নি। তবে এ নিয়ে নীতিগত সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। সব পক্ষের সঙ্গে আলোচনা করে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।

জামায়াতে ইসলামীর আমীর ডা. শফিকুর রহমান বলেছেন, জনদুর্ভোগ নিরসনের জন্য স্থানীয় সরকার নির্বাচন দিতে হবে। এরপরে অবশ্যই জাতীয় নির্বাচন দিতে হবে।তবে জাতীয় নির্বাচনের আগে জনগণ কিছু মৌলিক সংস্কার চায়। কয়েকদিন আগে চাঁদপুরের হাজী গঞ্জে কেলা জামায়াত আয়োজিত এক পথ সভায় তিনি একথা বলেন। গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি নূরুল হক নূর বলেছেন, নাজুক আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিতে এই মুহূর্তে জাতীয় নির্বাচন করা সম্ভব নয়। ডিসেম্বর পর্যন্তু সময়ে পরিস্থিতির কতটা উন্নতি হয় সেটা দেখার বিষয়। এ বিবেচনায় প্রশাসনের নিরপেক্ষতা ও সক্ষমতা দেখা এবং তৃণমূল পর্যায়ে নির্বাচন নিয়ে আবহ তৈরির জন্য পুরোপুরি না হলেও স্থানীয় সরকারের কিছু নির্বাচন করে দেখা যেতে পারে। সম্প্রতি নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে দলটির প্রতিনিধিদলের বৈঠক করে। বৈঠকের পর সাংবাদিকদের প্রশ্্েনর জবাবে তিনি এ মন্তব্য করেন। অন্যদিকে বিএনপির আন্তর্জাতিক বিষয়ক কমিটির সদস্য ইঞ্জিয়ার ইশরাক হোসেন তার ভেরি ফাইড ফেসবুক এক পোস্টে স্থানীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যাপারে কড়া হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেছেন, ঢাকা বা অন্যত্র স্থানীয় সরকার নির্বাচনকে একটি চক্রান্ত হিসেবে গণ্য করা হবে। জীবন থাকতে স্থানীয় নির্বাচন হতে দেয়া হবে না।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন দেশের গণতান্ত্রিক পরিবেশ বিকাশে এবং বৃহত্তর জনগোষ্ঠির মৌলিক সেবাদানে সংসদ নির্বাচনের আগেই স্থানীয় সরকার নির্বাচন হওয়া দরকার। আগে স্থানীয় নির্বাচন হলে তা জনগণের মধ্যে গণতান্ত্রিক জীবন ধারা ও মানসিকতার সৃষ্টিতে বেশ সহায়ক হবে যার একটা ইতিবাচক প্রভাব জাতীয় নির্বাচনে পড়বে। নির্বাচনব্যবস্থা ও স্থানীয় সরকার সংস্কার কমিশন জাতীয় নির্বাচনের আগেই স্থানীয় সরকারের পক্ষে। নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশন এর পক্ষে জনমত জরিপর ফল প্রকাশ করে বলেছে, ‘৬৪.৬৫ শতাংশ মানুষের মত হলো জাতীয় নির্বাচনের আগেই স্থানীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হোক।