‘রাজনীতিতে শেষ কথা বলে কিছু নেই’- এ কথাটাই বোধহয় আমাদের দেশের রাজনীতিকে অনেকটাই বিপথগামী ও প্রান্তিকতার মুখে ঠেলে দিয়েছে। মূলত, একথার আড়ালেই রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন, ঘৃণার রাজনীতি ও এক শ্রেণির রাজনীতিককে বল্গাহীন হওয়ার সুযোগ করে দিয়েছে। ফলে রাজনীতিকরা যখন যা ইচ্ছা তা-ই বলতে পারেন; করতেও পারেন মর্জি মাফিক সবকিছু। ‘রাজনীতিতে শেষ কথা নেই’ মূলত এটি এক আজব ও অভিনব মন্ত্র। যে মন্ত্রের মাধ্যমে একশ্রেণির রাজনীতিকের সকল গর্হিত ও অনাকাক্সিক্ষত কর্মকে স্বেতশুভ্র করার সুযোগ থাকে। এজন্য তাদের কখনো প্রশ্নের সম্মুখীন করা যায় না।
স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের রাজনীতিতে স্বাধীনতার পক্ষ-বিপক্ষ নামক একটি রাজনৈতিক ‘ক্ষত’ সযতনে লালন করে এসেছে দেশের প্রায় সকল রাজনৈতিক দল। যদিও এ ‘ক্ষত’ সব সময় নিরাময়যোগ্যই ছিল; কিন্তু রাজনীতিতে অসৎ উদ্দেশ্য চরিতার্থ করতেই এ ‘ক্ষত’ রক্ষণাবেক্ষণ, সংরক্ষণ ও পরিচর্যা করেছে দেশের ক্ষমতার স্পর্শ পাওয়া সকল রাজনৈতিক দল। উদ্দেশ্য নেতিবাচক রাজনীতিকে অবারিত রাখা।
স্বাধীনতার পর রাজনীতিতে অনেক নাটকীয় পরিবর্তনের পর মনে করা হয়েছিল যে, এ ব্যাধির স্বয়ংক্রিয়ভাবে নিরাময় ঘটেছে; কিন্তু আমাদের চরম দুর্ভাগ্য যে, এক পক্ষ যখন এ ‘ক্ষত’ সারানোর জন্য প্রতিষেধক প্রয়োগ করেছে, তখন অপর পক্ষ সে ক্ষত টিকিয়ে রাখার জন্য গ্রহণ করেছে বিপরীতমুখী পদক্ষেপ। বিষয়টি ঘুরপাক খেয়েছে চক্রাকারে। কখনো নিজেরা ক্ষমতার মসনদে আরোহন, আবার কখনো কাউকে অবতরণ করার জন্যও এ ক্ষতের স্বার্থক ব্যবহার করেছে। সে এক লম্বা আলোচনা। আপাতত সেদিকে যাচ্ছি না।
স্বাধীনতার পর রাষ্ট্রকে পুনর্গঠনের জন্য যখন জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করা প্রয়োজন ছিল, তখন স্বাধীনতার পক্ষ-বিপক্ষ প্রশ্ন তুলে জাতিকে বহুধা বিভক্ত করা হয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়ার অজুহাতে ইসলামী আদর্শের রাজনৈতিক দলগুলোকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছিল গণহারে ও নির্বিচারে। স্বাধীনতার পর সিরাজ শিকদার সহ ৩০ হাজার বিরোধী দলীয় নেতাকর্মীকে হত্যা করা হয়েছিল। এমনকি সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে দেশের সকল রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ ঘোষণা করে একদলীয় বাকশালী শাসন কায়েম করা হয়েছিল।
মনে করা হয়েছিল যে, আওয়ামী লীগের অপরাজনীতির অংশ অন্যরা হয়তো বিষয়টিতে নিয়ে জাতিকে বিভক্ত করবে না। তেমনই ইতিবাচক রাজনীতির শুভসূচনা করেছিলেন শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান। কিন্তু তিনি খুববেশি সময় পাননি বরং দুর্ভাগ্যজনকভাবে অকালেই শাহাদাত বরণ করতে হয়েছে। ১৯৮২ সালে বন্দুকের নলের মুখে বিএনপি সরকারের পতনের পর দৃশ্যপট পাল্টে যায়। সামরিক স্বৈরাচার জেনারেল এরশাদও এ ক্ষতের স্থায়িত্ব দিতে কসুর করেননি। যখন প্রয়োজন মনে করেছেন, তখনই এ ‘ঘা’ নিয়ে নাড়াচাড়া খুব কম করেননি। কিন্তু এরশাদের পতনের আন্দোলনে সে দৃশ্যপট পুরোপুরি পাল্টে গিয়েছিল। স্বাধীনতার পক্ষ-বিপক্ষ শক্তি যুগপৎ ভাবেই এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে অংশ নিয়েছিলেন।
সে আন্দোলনে ৮ দল, ৭ দল ও ৫ দলসহ জামায়াতে ইসলামী যুপপৎ আন্দোলনের মাধ্যম ১৯৯০ সালে এরশাদ সরকারের পতন হয়। এমনকি ১৯৯১ সালে বিএনপির সরকার গঠনে জামায়াতের সমর্থন স্বাধীনতার বিরোধিতার গন্ধও পরিলক্ষিত হয়নি। রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী বদরুল হায়দার চৌধুরীর পক্ষে জামায়াতের সমর্থন চাওয়াও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সাথে মোটেই সাংঘর্ষিক ছিল না। এমনকি ১৯৯৬ সালে নির্বাচনকালীন কেয়ারটেকার সরকার পদ্ধতি প্রতিষ্ঠার দাবিতে আওয়ামী লীগ-জামায়াত যুগপৎ আন্দোলনে কোন সমস্যা সৃষ্টি হয়নি। সমস্যা হয়েছে ৪ দলীয় জোট গঠন এবং যুগপৎ নির্বাচন ও সরকার গঠন নিয়ে। তখনই আওয়ামী লীগের কাছে জামায়াত স্বাধীনতা বিরোধী আখ্যা পেয়েছে বরং জামায়াতকে তারা জান-প্রাণের শত্রু বলে মনে করেছে। এক সাথে সরকার গঠন করতেও বিএনপির কোন সমস্যা হয়নি। শুধু তাই নয় বিএনপি মহাসচিব এখন মাঝে মধ্যেই জামায়াত বিরোধী বক্তব্য রাখছেন। দেশে কখনো মৌলবাদ বা দক্ষিণপন্থিদের উত্থানের কথা বলে উদ্বেগ প্রকাশ করতেও তাকে দেখা যাচ্ছে তাকে। কিন্তু তিনি বেমালুম ভুলে যান যে, তিনি নিজেও জামায়াতের শহীদ আমীর মাওলানা মতিউর রহমান নিজামীর মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছেন। এখন তারা যখন বিএনপির প্রভাব বলয় থেকে বেড়িয়ে এসে স্বতন্ত্রভাবে নির্বাচনের প্রস্তুতি গ্রহণ করছেন এবং ক্ষমতায় যাওয়ার সমূহ সম্ভবনা দেখা দিয়েছে, তখন তারা নতুন করে পুরাতন বিমারের পরিচর্চা শুরু করেছেন। যা তাদের পরিমিতবোধ নিয়ে রীতিমত প্রশ্নের সৃষ্টি করেছে।
পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের সাথে প্রায় ১৬ বছর জামায়াত-বিএনপির সম্পর্ক সুখকর ছিল না। যদিও ২০১৮ সালের নির্বাচন জোটবদ্ধভাবে একই প্রতীকে করা হয়েছিল। নৈশভোটের কারণে ফলাফল যা হবার তাই হয়েছে। কিন্তু উভয় দলের সম্পর্কটা একেবারে তিক্ততা পর্যন্ত পৌঁছায় নি। কিন্তু গত বছরের ৫ আগস্ট আওয়ামী-বাকশালীদের দুর্ভাগ্যজনক পতনের পর সে অবস্থার বড় ধরনের অবনোমন ঘটেছে। বিএনপির নেতাদের মুখে এখন জামায়াত বিরোধিতা খুবই স্পষ্ট। এমনকি বিএনপির কোন কোন নেতা কথিত যুদ্ধাপরাধের বিচার অব্যাহত রাখার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন। এখানেই শেষ নয় বরং বিএনপির বিরোধিতার কারণে জামায়াত নেতাকর্মীদের জিহ্বা কেটে নেওয়া এবং জামায়াতকে ভোট দিয়ে অক্ষত অবস্থায় ভোটারের বাড়ীতে না ফেরার ব্যাপারে হুশিয়ারি দেওয়া হচ্ছে বা এখনো হচ্ছে। কেউ কেউ আবার ৭১ এর ভূমিকার কারণে জামায়াতের ক্ষমা চাওয়ার দাবি নিয়েও মাঠে নেমেছেন। ‘জামায়াত ধর, শিবির ধর, ধইরা ধইরা জবাই কর’ ধরনের ফৌজদারী অপরাধমূলক কথাও এখন বিএনপির নেতাকর্মীদের প্রতিনিয়তই প্রতিধ্বনিত হচ্ছে।
অবস্থাদৃষ্টে দৃষ্টে মনে হচ্ছে, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ তথা জামায়াতে ইসলামীকে অনাদর্শিকভাবে মোকাবেলা করার জন্য পতিত আওয়ামী লীগ যেসব নেরেটিভ তৈরি করেছিল, বিএনপি এসব এখন উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়ে সে সবের সফল ও স্বার্থক ব্যবহার করছে। সম্প্রতি ভারতীয় একটি পত্রিকায় বিএনপি মহাসচিবের সাক্ষাৎকারের বিষয়টি আলোচনায় এসেছে। এতে জামায়াতে ইসলামী ও আগস্ট বিপ্লবে নেতৃত্ব দেওয়া এনসিপি সম্পর্কে বিএনপির শীর্ষনেতা বা দলীয়ভাবে বিএনপির মনোভাব স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। যদিও এ সাক্ষাৎকারের বক্তব্যের কিছু অংশ বিএনপি অস্বীকার করা হয়েছে। কিন্তু একথাও স্মরণ করা দরকার যে, কোন কোন রাজনৈতিক নেতা গণমাধ্যমে বক্তব্য দেওয়ার পর বেগতিক দেখে তা অস্বীকার করা, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে দোষারোপ ও গণমাধ্যম কর্মীদের যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা রীতিমত মুদ্রাদোষে পরিণত হয়েছে।
গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবর থেকে জ্ঞাত হওয়া গেছে যে, প্রকাশিত সাক্ষাৎকারে বিএনপি মহাসচিব দাবি করেছেন, জাতীয় নাগরিক পার্টিকে (এনসিপি) এখন আর কোনো শক্তি মনে করে না বিএনপি। জামায়াতে ইসলামীকে আর মাথায় উঠতে দেবে না। দলটির যত না শক্তি, বিএনপি অকারণে তার চেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়েছে। ভারতের কলকাতার বাংলা সংবাদপত্র ‘এই সময়’-এ প্রকাশিত এক সাক্ষাৎকারে বিএনপি মহাসচিবকে উদ্ধৃত করে এসব কথা বলা হয়েছে।
‘বিএনপি-জামায়াতকে ভারত কেন এক বন্ধনীতে রাখছে, প্রশ্ন মির্জার’ শিরোনামে প্রকাশিত সাক্ষাৎকারটি নিয়ে বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে আলোড়ন ও বিতর্কের সৃষ্টি করেছে। সাক্ষাৎকারের কিছু বক্তব্য নিয়ে জামায়াত তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছে। প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে এনসিপি নেতারাও। যদিও অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র সফরে থাকা বিএনপির মহাসচিবের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, ‘এই সময়’-এ সাক্ষাৎকারটি ভুলভাবে উপস্থাপিত হয়েছে, যা বিভ্রান্তিকর। বিএনপির মহাসচিব এ ধরনের বক্তব্য দেননি।
প্রকাশিত সাক্ষাৎকারের শুরুটা ছিল আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে। বিএনপির মহাসচিবের কাছে প্রশ্ন ছিল আগামী বছর ফেব্রুয়ারিতে বাংলাদেশে জাতীয় নির্বাচন কি আদৌ হবে? জামায়াতে ইসলামী ও এনসিপি যেভাবে একটার পরে একটা নতুন দাবি তুলছে এবং সেগুলো পূরণ না হলে নির্বাচন হতে দেবে না বলছে, অনেকেই সংশয়ে। মির্জা ফখরুলের জবাব ছিল, আগামী বছর ফেব্রুয়ারিতেই ভোট হবে। সংশয়ের কোনো জায়গা নেই। কোনো অশান্তি হবে না। মানুষ ভোটাধিকার ফেরত চাইছেন, নির্বাচন চাইছেন। উৎসবের মতো ভোট হবে ফেব্রুয়ারিতে।
জামায়াত যে বলছে পিআর (আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব) পদ্ধতি ছাড়া ভোট হবে না, এনসিপি প্রচলিত সংবিধান বাতিল করে আগে গণপরিষদের নির্বাচন চাইছে। না হলে ভোট হতে দেবে না বলছে এ প্রসঙ্গে মির্জা ফখরুলের যে বক্তব্য ছাপা হয়েছে, তাতে বলা হয়, ‘জামায়াত ভোটে আসবে। পিআর-টিআর নয়, মানুষ যে পদ্ধতিতে ভোট বোঝেন, সে প্রচলিত পদ্ধতিতেই হবে বাংলাদেশের ভোট। জামায়াতও দেখবেন অংশ নেবে। আর এনসিপিকে আমরা কোনো শক্তি বলেই আর মনে করি না। এটা ঠিক, এ ছাত্ররাই শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে বিক্ষোভের বারুদে আগুনটা দিয়েছিল। এখন আর তাদের কিছু নেই। ডাকলে লোকও আসে না।’
এনসিপির এখন একমাত্র লক্ষ্য বিএনপিকে সরকার গঠন করতে না দেওয়া এমন বক্তব্যও এসেছে এ সাক্ষাৎকারে। এ সময় সাক্ষাৎকারের এক প্রশ্নে মির্জা ফখরুলের জবাব হিসেবে লেখা হয়েছে, আগামী নির্বাচনে জামায়াত বিএনপির কাছে ৩০টা আসন চেয়েছে। বিএনপি উৎসাহ দেখায়নি। এ প্রশ্নের জবাবে আরও লেখা হয়েছে, ‘আপনাকে আশ্বাস দিচ্ছি, জামায়াতকে আর আমরা মাথায় উঠতে দেব না। তারা যত বড় না শক্তি, আমরা অকারণে তার চেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়েছি। পিআর-টিআর সবই বিএনপির ওপর চাপ সৃষ্টির কৌশল। জামায়াত কিন্তু নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছে। বিভিন্ন জায়গায় প্রার্থীর নাম ঘোষণা করছে। আসলে দেশে প্রবলভাবেই মানুষ নির্বাচন চাইছেন। সেনাবাহিনী চাইছে, অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসও চাইছেন।’
২৫ বছর ধরে বিএনপির সঙ্গে জামায়াত একসঙ্গে ছিল, সে জন্য দল দু’টির নাম একসঙ্গে উচ্চারিত হয় কি না। এমন প্রশ্নের জবাবে বলা হয়, ‘ভুল। আওয়ামী লীগ এ অপপ্রচার ভারতকে বিশ্বাস করিয়েছে। তারা শুধুই নির্বাচনী শরিক। তারা ধর্মীয় রাজনীতি করে, আমরা করি না। আসলে আওয়ামী চশমা দিয়ে ভারত বাংলাদেশকে দেখেই ভুলটা করেছে। বাকিদের সঙ্গে যোগাযোগই রাখেনি। আজ আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে ক্ষোভের পাহাড় তীব্র ভারত-বিরোধিতায় পর্যবসিত হয়েছে।’
আওয়ামী লীগ, জাসদ বা ওয়ার্কার্স পার্টির মতো দলগুলো আগামী নির্বাচনে অংশ নিতে পারবে কি না? এ প্রশ্নের জবাবে মির্জা ফখরুলের যে বক্তব্য ছাপা হয়েছে, সেটা হলো ‘আমরা বলেছি আওয়ামী লীগ ও তাদের শরিকেরা সবাই, এমনকি জাতীয় পার্টিও নির্বাচনে অংশ নিক। একটা সুষ্ঠু ও অবাধ ভোট হোক। এ জন্য অনেকে আমাকে ভারতের এজেন্ট, আওয়ামী দালাল বলে গালাগাল দিচ্ছে। কিন্তু শেখ হাসিনার অপকর্ম আমরাও কেন করব? হাসিনা ১৫ বছর প্রতিপক্ষকে ভোটে দাঁড়াতেই দেননি, তার শাস্তি পেয়েছেন। একই কাজ করলে আমরাও তো প্রতিফল পাব।’
প্রকাশিত সাক্ষাৎকারে জামায়াতে ইসলামী সম্পর্কে দেওয়া বক্তব্য ও মন্তব্যের তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছেন দলটির সেক্রেটারি জেনারেল। তিনি বলেছেন, বিএনপির মহাসচিব জামায়াতে ইসলামীর রাজনীতি এবং সংগঠনের মর্যাদা সম্পর্কে তাচ্ছিল্যের ভাষায় কথা বলেছেন। এটা সম্পূর্ণ অসত্য, অমর্যাদাকর ও প্রতিহিংসাপরায়ণ বক্তব্য। এ বক্তব্যের সঙ্গে সত্য ও শিষ্টাচারের কোনো মিল নেই। বিবৃতিতে গোলাম পরওয়ার বলেন, ‘এ বক্তব্য তাঁর হয়ে থাকে, তবে বাধ্য হয়ে আমরা তার প্রতিবাদ ও নিন্দা জ্ঞাপন করছি। পাশাপাশি এ বক্তব্য যদি তাঁর হয়ে থাকে তাহলে জামায়াতে ইসলামী কার কাছে এ আসনগুলো দাবি করেছে, তার প্রমাণ জাতির কাছে উপস্থাপন করার জন্য দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে আহ্বান জানাচ্ছি।’ বিএনপির কাছে ৩০ আসন চাওয়ার দাবি প্রত্যাখ্যান জামায়াত সেক্রেটারি জেনারেল বিবৃতিতে বলেছেন, ‘কারও কাছে আসন চাওয়ার রাজনীতির সঙ্গে জামায়াতে ইসলামীর বর্তমান সময়ে দূরতম কোনো সম্পর্ক নেই।’ ভবিষ্যতে এ ধরনের অসত্য ও বিভ্রান্তিকর বক্তব্য প্রদান থেকে বিরত থাকার জন্য বিএনপির মহাসচিবের প্রতি আহ্বান জানানো হয় বিবৃতিতে। এদিকে এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম তাঁর দলের বিষয়ে সাক্ষাৎকারে দেওয়া বক্তব্যের বিষয়ে বলেছেন, এনসিপি কোনো শক্তি কি শক্তি নয়, এটা রাজপথে, ভোটের মাঠে জনগণই রায় দেবে। নিউইয়র্কের বিমানবন্দরে আখতার হোসেনকে হেনস্তা করার ঘটনায় মঙ্গলবার বিকেলে ঢাকায় এক সংবাদ সম্মেলনে এক প্রশ্নের জবাবে নাহিদ ইসলাম এ কথা বলেন।
আওয়ামী লীগকে নির্বাচনে আনার সুযোগ নেই উল্লেখ করে নাহিদ ইসলাম বলেন, ‘আমরা দেখতে পাচ্ছি, একদিকে আওয়ামী লীগ সন্ত্রাসী কার্যক্রম করছে, অন্যদিকে দেশের কোনো কোনো রাজনীতিবিদ আওয়ামী লীগকে নির্বাচনে আনার ষড়যন্ত্র করছে। আমরা স্পষ্টভাবে বলতে চাই, আওয়ামী লীগকে নির্বাচনে আনার অথবা আওয়ামী লীগকে রাজনীতিতে পুনর্বাসন করার কোনো সুযোগ নেই। যারা এটা করার চেষ্টা করবে, জনগণ তাদের বিরুদ্ধেই দাঁড়াবে। তাদের রাজনীতি বাংলাদেশ থেকে নাই হয়ে যাবে।’
বিএনপি মহাসচিবের বক্তব্য অনুযায়ী জামায়াত বিএনপির অনুগ্রহ নিয়ে রাজনীতি করছে এবং দলটি বিএনপির পক্ষ থেকে সুবিধাভোগী। এমনকি বিএনপির অপরাপর নেতারাও একই ধরনের বক্তব্য প্রতিনিয়তই দিয়ে যাচ্ছেন। অথচ বাস্তবতা হলো ১৯৯১ সালে জামায়াতই নিঃশর্তভাবে বিএনপিকে ক্ষমতায় যাওয়ার সুযোগ করে দিয়েছিল। ১৯৯৬ সালে জোট না থাকার কারণে তাদের পরাজয় অনিবার্য হয়ে উঠেছিল। কিন্তু ২০০১ সালে আবার জোটবদ্ধ হওয়ার ৪ দলীয় জোট ভূমিধস বিজয় পেয়েছিল। এতে প্রমাণ হয় না যে, বিএনপির অনুগ্রহ নিয়ে জামায়াত রাজনীতি করছে বরং একথাই প্রমাণ হয় যে, ১৯৯১ ও ২০০১ সালে বিএনপির ক্ষমতায় আসার নেপথ্যের শক্তি ছিল জামায়াতে ইসলামী। জামায়াত বিএনপির কাছে তো অতিমূল্যায়িত হয়-ইনি বরং তাদের বরাবরই অবমূল্যায়নই করা হয়েছে। আর বিএনপির কাছে জামায়াতের সিট চাওয়ার বিষয়টিও কোন মানদণ্ডেই উত্তীর্ণ নয়। কারণ, জুলাই বিপ্লবের আগেই বিএনপির সাথে জামায়াতের জোট ভেঙে গেছে এবং বিপ্লব পরবর্তী সময়ে তারা স্বতন্ত্রভাবেই নির্বাচনী প্রস্তুতি গ্রহণ করতে শুরু করেছেন। তাই আসন চাওয়ার বিষয়টিও বাস্তবসম্মত হওয়ার কোন কারণ নেই। আর চাওয়ার বিষয়টি নিয়ে জনমনে রীতিমত বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়েছে। তারা আশঙ্কা করছেন যে, আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচন কি প্রতিযোগিতামূলক না হয়ে ভাগাভাগির নির্বাচন হবে ? যা আমাদের জুলাই বিপ্লবের সাথে মোটেই সঙ্গতিপূর্ণ নয়।
কথিত সাক্ষাৎকারে বিএনপির মহাসচিবের বক্তব্যে জুলাই বিপ্লবে ছাত্র-জনতার নেতৃত্ব দানকারী দল এনসিপিকে রীতিমত অবমূল্যায়নই করা হয়েছে। তারা এখন দলটিকে রীতিমত অপাক্তেয় বা অচ্ছুৎ-অপয়া মনে করছেন তারা। অথচ এসব বিপ্লবী না হলে বিএনপির অনেক নেতাকেই এখনো জেলের ঘানি টানতে হতো।
এবার আশা যাক আওয়ামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগের অংশ গ্রহণের অধিকার নিয়ে। বিএনপি মহাসচিবের কথিত সাক্ষাৎকারেও সে অধিকারের বিষয়টি ওঠে এসেছে। তিনি আওয়ামী লীগ সহ তাদের সহযোগিদের নিয়ে নির্বাচন করার পক্ষপাতি। এজন্য অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন ও গণতান্ত্রিক অধিকারের কথা সামনে আনা হচ্ছে। কিন্তু সচেতন মহলের প্রশ্ন হলো, যারা গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধে বিশ্বাসী তারাই তো গণতান্ত্রিক অধিকার ভোগ করবেন। কিন্তু একথা কারো অজানা নয় যে, প্রায় ১৬ বছরে আওয়ামী লীগ শুধু দেশের গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক মূল্যবাধ ধ্বংস করে নি বরং রাষ্ট্রীয় কাঠামোগুলোকেই পুুরোপুরি ধ্বংস করে দিয়েছিল। এ জন্য অন্যরা পালন করেছিল সহযোগীর ভূমিকা। তাই তাদের নির্বাচনে অধিকার থাকার বিষয়টি অনেকটাই প্রশ্নবিদ্ধ।
একটি উদাহরণ দিলে বিষয়টি আরো দিবালোকের মতো স্পষ্ট হয়ে উঠবে। খেলার মাঠে প্রতিপক্ষের সাথে খেলতে হয় খেলার আইন-কানুন বা বিধি-বিধান মেনেই। কিন্তু খেলার আইন ভঙ্গ করার জন্য কোন খেলোয়ারকে লালকার্ড দেখানো হলে, তখন তার আর খেলার কোন অধিকার থাকে না। তাই খেলার মাঠের সমতা রক্ষা ও অধিকারের ধুঁয়া তুলে লালকার্ড প্রাপ্ত খেলোয়ারের খেলার সুযোগ সৃষ্টি করার দাবি কোনভাবেই যৌক্তিক হতে পারে না। মূলত, আওয়ামী লীগ এবং দলটির সহযোগীরা কোনোভাবেই গণতান্ত্রিক আদর্শের দল নয়। তাই তাদের গণতান্ত্রিক অধিকার থাকার কোনো সুযোগ নেই।
আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে রাজনৈতিক বিষয় নিয়ে বিস্তর মতপার্থক্য থাকলেও জামায়াতকে স্বাধীনতা বিরোধী বা রাজাকার আখ্যা দেওয়ার ব্যাপারে ঐক্যমত রয়েছে। সঙ্গত কারণেই, আওয়ামী লীগের অনুপস্থিতিতে এখন বিএনপির মুখেই তাদের কথার প্রতিধ্বনিত শোনা যাচ্ছে। পতিতরা যে সব কথার মাধ্যমে জামায়াতকে ঘায়েল করার অপচেষ্টা করেছিল, বিএনপি এখন তার স্থলাভিষিক্ত হয়েছে। এক সাথে নির্বাচন, সরকার গঠন করার পরও তারা নিজেদের রাজনৈতিক দর্শন ও আদর্শ পরিচ্ছন্ন করতে পারে নি। যেমন পারেনি আওয়ামী লীগ যুগপৎ আন্দোলন এবং রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে জামায়াতের সমর্থন ভিক্ষার পরও। এতে আওয়ামী লীগের কথার প্রতিধ্বনি করতে গিয়ে যে সংশ্লিষ্টদের সম্ভ্রমহানীর ঘটনা ঘটছে তা স্পষ্ট করার জন্য একটি গল্পের অবতারণা করছি।
একদিন রানী রাজার কাছে ভূষা দেখার আব্দার করলেন। তার দাবি, তিনি চাষা দেখলেও কখনো ভূষা দেখেন নি। রাজা তার সভাষদদের ভুষা অনুসন্ধানের দায়িত্ব দিলেন। নেংটি পরা এক সহজ-সরল ব্যক্তিকে রানীর সামনে ভূষা হিসাবে উপস্থাপন করা হলো। প্রায় উলঙ্গ নেংটি পরা কথিত ভূষাকে দেখে রানী মুখে আঁচল মুখে দিয়ে হাসতে শুরু করলেন। ভূষা ভাবলো, মুখে কাপড় দিয়ে হাসাহাসি করা রাজ দরবারের ঐতিহ্য। তাই সে নেংটি খুলে মুখে দিয়ে হাসতে শুরু করল। এতে সে বিবস্ত্র হলেও তার সম্ভ্রম জ্ঞানের বালাই ছিল না।
হয়তো পক্ষ বিশেষ মনে করছে বাংলাদেশের রাজনীতিতে ‘রাজাকার ইস্যু’-ই রাজনৈতিক ঐতিহ্য। তাই সে ঐতিহ্য অনুসরণ করতে গিয়ে কারো সম্ভ্রম গেল কি না তা অবশ্য আগামী নির্বাচনে ভোটাররাই বিচার করবেন। আমরা তা দেখার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষায় থাকলাম।