মুহাম্মদ ওয়াছিয়ার রহমান

অতীতে শেখ হাসিনা সরকারসহ বিভিন্ন সরকারের কুকর্মের ফলে দেশবাসীর কাছে রাষ্ট্র মেরামতের প্রয়োজনীয়তা অনুভুত হতে থাকে। বিএনপি রাষ্ট্র মেরামতের নানা ফর্মুলাসহ ৩১ দফা দেয়। তবে ৩১ দফা খানিকটা অস্পষ্টতা লক্ষ্য করে নানা মহল থেকে সমালোচনা হতে দেখা যায়। এরমধ্যে ৫ আগস্ট ২০২৪ শেখ হাসিনা সরকারের পতন হয়। সরকার পতনের পর এ মেরামতের কথা জোর দিয়ে উচ্চারণ হতে থাকে। ৮ আগস্ট ২০২৪ প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস অর্ন্তবর্তীকালীন সরকার গঠন করে। ইউনূস সরকার আসার পর থেকে এই সংস্কার বা রাষ্ট্র মেরামতের কথা জোর দিয়ে আসতে থাকে। অবশেষে ১১ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ইউনূস সরকার বেশ কয়েকটা সংস্কার কমিটি ও ১২ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ ঐকমত্য কমিশন গঠন করেন। রাষ্ট্র মেরামতের কথা আসতেই বিএনপির সাথে অধিকাংশ দল বিবাদে জড়িয়ে পড়ছে। যেহেতু বিএনপি আগামীতে ক্ষমতায় যাচ্ছে বলে সকলের ধারণা। তাই তারা মেরামতের কাজটা নির্বাচনের পর পরবর্তী সংসদকে দিতে চায়। তা’ছাড়া হাসিনা সরকারের পতনের পর অধিকাংশ দল এবং দেশবাসী সকল দল নিয়ে এককভাবে নির্বাচন করার কথা সামনে আসে কিন্তু বিএনপিকে তাতে সায় দিতে দেখা যায় না। এক সময় বিএনপি নেতা তারেক রহমান বলেছিলেন তারা সরকার গঠনের সুযোগ পেলে সর্বদলীয় সরকার গঠন করবেন। সে বয়ান আজ উপেক্ষিত হতে চলছে।

যেহেতু তারা ক্ষমতায় চলে যাচ্ছেন বলে মনে করা হয়। তাই তারা অন্য দলগুলোকে খানিকটা খাটো করে দেখছেন বলে অভিজ্ঞ মহলের ধারণা। কখনও কখনও তারা দু’একটা দল সম্পর্কে আপত্তিকর নেতিবাচক মন্তব্য করছে। রাজনৈতিক অভিজ্ঞ মহল এমন অবজ্ঞাকে ভবিষ্যতে অন্য দলগুলো আগামী নির্বাচন বর্জনের মত ঘটনা ঘটাতে পারে বলে আশংকা করে। সংস্কার সস্পর্কে অতীত ্ইতিহাস হলো আওয়ামী লীগ-বিএনপি-জাপা বিশেষ ক্ষমতা আইন বাতিল করেনি। আদালতের রায় হাওয়ার পরও বিচার বিভাগ বিএনপি স্বাধীন করেনি। তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠার ব্যবস্থা কায়েমের লক্ষ্যে ১৯৯০ সালে এরশাদকে হটিয়ে বিএনপি ক্ষমতায় গিয়ে বেগম খালেদা জিয়া তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ২৫ মার্চ ১৯৯৬-এর আগ পর্যন্ত মেনে নেয়নি। এজন্য অনেক রক্ত ও জীবনহানি ঘটেছে। সুতরাং রাজনৈতিক ঐকমত্য ছাড়া কোন রাজনৈতিক দল ও জোটের পক্ষে কোন কাঙ্খিত সংস্কার আশা করা দুরহ।

৩৬ জুলাই বিপ্লব ২০২৪-এর পর থেকে রাজনৈতিক দলগুলো ক্রমাগত বিএনপির দাদাগিরি বরদাস্ত করতে নারাজ। বিএনপি বড় দল বলে সকল দল বা দু’একটা খুচরা দল নিয়ে নির্বাচন করতে পারবে, এটা মনে করার কোন কারণ আছে বলে মনে হয় না। বিশেষ করে গত ২৮ জুন ও ১৯ জুলাই শনিবার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ ও বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর বিশাল মহাসমাবেশে অধিকাংশ দল অংশ গ্রহণ করায় নতুন রাজনৈতিক সমীকরণ দৃশ্যমান হয়েছে। এদিন থেকে বিএনপি একক পথে হাটবে বলে প্রতিয়মান হচ্ছে না। তারা সঙ্গী খুঁজছে। কিছু বাম সংগঠন এ কাজে এগিয়ে আসছে বিএনপির পাশে। বামপন্থী দলগুলো ইসলাম ভীতির কারণে বিএনপির সাথে যুক্ত হতে পারে। তাতে ফল বয়ে আনবে না। বাম পন্থীদের পাশে নেয়ায় অতীতে বিপদের কাণ্ডারী বন্ধু জামায়াত বিএনপি থেকে দুরে সরে যাচ্ছে।

বিএনপি ভুলে গেছে জিয়াউর রহমানের অনুপস্থিতিতে ১৯৯১ ও ২০০১ সালে জামায়াতের সমর্থনই ক্ষমতায় যাওয়ার পথ সুগম করে। ১৯৯১ থেকে ১৯৯৬ পর্যন্ত বিএনপির সন্ত্রাসী আচরণের কারণে জামায়াতের সাথে সম্পর্কে ফাটল ধরে। বিএনপি সরকারে থাকা কালে ১৯৯৪ সালে শেষ পর্যন্ত জামায়াত সাবেক আমীর ও সাবেক ডাকসু জি.এস অধ্যাপক গোলাম আযম আদালতের মাধ্যমে নাগরিকত্ব ফেরৎ পান। ফলে জামায়াত ১৯৯৬ সালের ১২ জুন নির্বাচনে বিএনপির ওপর নাখোশ হয়ে ৩০০ সিটে নির্বাচন করে। সঙ্গত কারণে আনাসায়ে আওয়ামী লীগ জিতে যায়। বিএনপি তখন জামায়াতের সাথে দুরত্বের ফল হাড়ে হাড়ে টের পেয়ে যায়। আওয়ামী লীগের সাথে জামায়াতের আদর্শিক দূরত্বের কারণে বিএনপি সময়-অসময়ে বোনাস সুযোগ পেয়ে থাকে। কিন্তু সুযোগটা কাজে লাগানোর পর জামায়াতের কথা ভুলে যায়। বিএনপি নেতা তারেক রহমান ক্ষমতায় গেলে সর্বদলীয় সরকার গঠন করবেন এমন বক্তব্য দিলেও আজ তার প্রতিচ্ছবি কোথায়? তা’হলে ৩৬ জুলাই বিপ্লবের পর দেশে যে আবহাওয়া বিরাজ করছিল তাতে সব দল মিলে আগামী নির্বাচনে অন্তত একটা বারের মত সম্মিলিত ভাবে নির্বচন করে এ প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন করতে সুযোগ হাত ছাড়া হচ্ছে। তাতে আমাদের প্রতিবেশীসহ বিশ্বকে ভিন্ন ভাবে বাংলাদেশকে মূল্যায়ন করার সুযোগ হাত ছাড়া হতে যাচ্ছে। যেহেতু বিএনপি আন্দোলন করে হাসিনা সরকারকে পতন ঘটাতে পারেনি। তাই বিএনপি যতবড় দলই হোক না কেন তারা ক্ষমতায় গেলে একা একা বেশি কিছু করতে পারবে না। সেজন্য দেশ পরিচালনায় সকল দলের সহযোগিতা গ্রহণের সুযোগ হাত ছাড়া করা কোন ভাবেই সুচিন্তিত বলে ধরে নেয়ার সুযোগ নেই।

এদিকে ঐকমত্য কমিশনের সাথে রাজনৈতিক দলগুলোর রাষ্ট্র সংস্কার নিয়ে কথা উঠলেই কিছু মৌলিক বিষয়ে বিএনপির ভাষ্য এটা পরবর্তী নির্বাচিত সরকারের জন্য ছেড়ে দেয়া। বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতায় কোন রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় গেলে তাদের চাহিদামত কিছু সংস্কারের কথা বললেও ফল বয়ে আনে না। এ চিন্তার সাথে ঐক্যমত কমিশনও একমত। তাই কোনভাবেই ঐকমত্য কমিশন থেমে থাকতে চাচ্ছে না। কমিশনের আলোচনান্তে কিছু মৌলিক বিষয় নিয়ে ডানপন্থীদের সাথে বামপন্থীদের মত বিরোধ দেখা যাচ্ছে। এ মতবিরোধকে কাজে লাগিয়ে বিএনপির অধিকাংশ সংস্কার বিষয় সুকৌশলে পরবর্তী সংসদের হাতে রেখে দিতে চাচ্ছে। এটা বিশ্বাস করার কোন হেতু নেই আগামী ক্ষমতাসীন দল জনগণের আকাংখা অনুযায়ী রাজনৈতিক সংস্কার সম্ভব, তার নজীরও নেই এবং ভবিষ্যতে আশা করা দুরাশা। যদি ঐকমত্য কমিশনের সাথে মৌলিক রাজনৈতিক সংস্কারে ঐকমত্যে আসা সম্ভব না হয় তবে সেটা আগামী সংসদের জন্য না রেখে এখনই গণভোটের মাধ্যমে সমাধানে আসা। বিএনপি নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করার জন্য চাপ দিচ্ছে এবং বলছে নির্বাচনকে বানচাল করার চেষ্টা হচ্ছে। এটা স্পষ্ট যে কোন রাজনৈতিক কোন দলের সরকার দ্বারা জনআকাক্সক্ষা অনুসারে সংস্কার সম্ভব নয়। এজন্যই এটা জনগণের মতামতের শেষ সমাধান হওয়া উচিত নয়। ঐকমত্য কমিশনের সভায় বিএনপি নেতাদের ভাষা ও বডি ল্যাঙ্গুয়েজ অধিকাংশ দলগুলো ভাল ভাবে নিচ্ছে না। তাদের মধ্যে একটা বড় ভাই সুলোভ দৃষ্টি ভঙ্গি সকলকে চিন্তায় ফেলে দিচ্ছে।

তা’ছাড়া বৈষম্যবিরোধী ছাত্রদের কয়েকটি দল যে ভাবে আক্রান্ত করছে তা তাদের চরমভাবে অবহেলার শামিল। বিএনপি বহু ঈদ গিয়েছে কিন্তু হাসিনা সরকারকে পতন ঘটাতে পারেনি। ২০২৩ সালে বড় বড় সমাবেশ করেও রাজনৈতিক ফায়দা হাসিল করতে পারেনি। কিন্তু ছাত্ররা ২০১৮ সালে কোটা সংস্কার দাবী প্রাথমিক ভাবে দাবী আদায়ে সফল হয়। ২০২৪ সালেও তারাই নেতৃত্ব দিয়ে হাসিনা সরকারকে পতন ঘটিয়েছে। এখন তাদেরই যদি হেয় করা হয় ভবিষ্যতে এ ধরণের পদক্ষেপ গ্রহণ করতে কেউ আগ্রহী হবে না। এমনকি অন্তর্বর্তী সরকারও যেভাবে দায়িত্বশীল রাজনৈতিক দল দ্বারা অবমূল্যায়িত হচ্ছে তাতে ভবিষ্যতে কেউ এ ধরণের দায়িত্ব গ্রহনে আগ্রহী হবে না। রাষ্ট্র সংস্কারের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো পুলিশ ও জনপ্রশাসন সংস্কার। কিন্তু এ দুটিতে কমিশন গঠন হলেও অজ্ঞাত কারণে দৃশ্যমান কোন তৎপরতা দেখা যাচ্ছে না। এই দুটি বিভাগই রাষ্ট্র পরিচালনার সকল বিষয় বাস্তবায়ন করে থাকে।

বিএনপি নেতারা বলে থাকে-আবু সাঈদ-মুগ্ধরা স্থানীয় সরকার নির্বাচন করার জন্য জীবন দেননি। প্রশ্ন হচ্ছে আদৌ আবু সাঈদ-মুগ্ধরা নির্বাচনের জন্য জীবন দিয়েছে? না সংস্কার, বৈষম্য ও স্বৈরতন্ত্র নিরোধের জন্য জীবন দিয়েছে? তা’ছাড়া বিএনপির নেতা-কর্মীরা নানাবিধ অনৈতিক কাজে সম্পৃক্ত এ পর্যন্ত বিএনপি ও তাদের অঙ্গ সংগঠনের প্রায় সাড়ে সাত হাজার নেতা-কর্মীকে নানা অনৈতিক কাজে যুক্ত থাকার দায়ে বহিস্কার করেছে। এ অবস্থায় বিএনপির নেতা-কর্মীদের কি আবু সাঈদ-মুগ্ধদের নাম মুখে উচ্চারণ করার নৈতিক অধিকার রাখে?

লেখক : প্রাবন্ধিক।