গত ৫ আগস্ট প্রধান উপদেষ্টা ড. মোহাম্মদ ইউনূস জাতির উদ্দেশে এক ভাষণে আগামী ফেব্রুয়ারি মাসে সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের ঘোষণা দিয়েছেন এবং এ ব্যাপারে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য নির্বাচন কমিশনকে প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা দিয়েছেন।
বাংলাদেশের কিছু কিছু রাজনৈতিক দল বেশ কিছুদিন ধরে সংসদ নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবি করে আসছিলেন। এ দাবির যথার্থতা অস্বীকার করা যায় না। এ অবস্থায় বাংলাদেশে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানসমূহের বিবর্তন ও কার্যাবলী নিয়ে কিছুটা আলোকপাত করা জরুরি বলে মনে হয়। ইউনিয়ন পরিষদ দিয়েই শুরু করা যাক, স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান হিসেবে ইউনিয়ন পরিষদ গঠনের ইতিহাস পর্যালোচনা করতে গেলে দেখা যায় যে, বৃটিশ ভারতে ১৮৭০ সালের চৌকিদারী পঞ্চায়েত আইন সর্বপ্রথম এর গোড়া পত্তন করে। এরপর ১৮৮৫ সালের লোকাল সেল্প গবর্নমেন্ট অ্যাক্ট অনুযায়ী ১৮৮৬ সালে গড়ে ১২ বর্গকিলোমিটার নিয়ে একটি ইউনিয়ন কমিটি গঠিত হয়। এ কমিটির দায়িত্ব ছিল :
১. ছোটখাটো কাঁচা রাস্তা তৈরি,
২. প্রাথমিক স্কুল প্রতিষ্ঠা ও পরিচালনা,
৩. জনসাধারণের স্বাস্থ্য রক্ষা বিশেষ করে দক্ষ মল নিষ্কাশনের ব্যবস্থা করা ও খাদ্যে ভেজাল প্রতিরোধ,
৪. পুকুর ও দীঘি খনন,
৫. জন্মমৃত্যুর নিবন্ধন।
পরবর্তীকালে ১৯১৯ সালের ভিলেজ সেলফ গবর্নমেন্ট অ্যাক্টের অধীনৈ চৌকিদারি পঞ্চায়েত ও ইউনিয়ন কমিটিসমূহকে ভেঙ্গে দিয়ে তাদের স্থলে ইউনিয়ন বোর্ড প্রতিস্থাপন করা হয়। ইউনিয়ন বোর্ডের দায়িত্বসমূহ ছিল : (১) চৌকিদারদের কাজকর্ম তদারক, (২) স্বাস্থ্য সুরক্ষা ও স্বাস্থ্য পদ্ধতির সংরক্ষণ, (৩) ইউনিয়ন বোর্ডের এলাকাভুক্ত জলপথ, রাস্তাঘাট, পুল, কালভার্টসমূহের সংরক্ষণ, (৪) স্কুল ও দাতব্য চিকিৎসালয় প্রতিষ্ঠা এবং সেগুলো মেরামত-সংরক্ষণ (৫) জেলা বোর্ডের চাহিদা অনুযায়ী সময়ে সময়ে তাদের বিভিন্ন তথ্য সরবরাহ করা।
উপরোক্ত দায়িত্বাবলী ছাড়াও ইউনিয়নবাসী ভূমি ও জমির মালিক পরিবারসমূহের উপর ট্যাক্স (চৌকিদারী ট্যাক্স) আরোপের ক্ষমতা ইউনিয়ন বোর্ডের উপর অর্পণ করা হয়। আবার প্রাদেশিক সরকার ছোটখাট অপরাধের বিচার করার জন্য ইউনিয়ন বোর্ডের দুই বা ততোধিক সদস্যের সমন্বয়ে একটি আদালত গঠন করতে পারতেন। ১৯৫৮ সালের অক্টোবর মাসে জেনারেল আইয়ূব খান কর্তৃক সামরিক শাসন জারির পর ১৯৫৯ সালের মৌলিক গণতন্ত্র আইনের বলে সারা দেশে ইউনিয়ন কাউন্সিল গঠন করা হয়। নবগঠিত ইউনিয়ন কাউন্সিলের দায়িত্ব ছিল নিম্নরূপ : এ আইন অনুযায়ী ইউনিয়ন বোর্ডকে প্রদত্ত পূর্ববর্তী দায়িত্বসমূহ বহাল থাকার পাশাপাশি চৌকিদার দফাদারদের সমন্বয়ে ইউনিনের আইনশৃঙ্খলা রক্ষার জন্য গ্রাম পুলিশ গঠনের ক্ষমতা দেয়া হয়। আবার ১৯৬০ সালের মুসলিম পারিবারিক আইন অনুযায়ী ইউনিয়ন পর্যায়ে পারিবারিক আদালত প্রতিষ্ঠারও ক্ষমতা তারা পায়।
১৯৮৩ সালে জারিকৃত স্থানীয় সরকার (ইউনিয়ন পরিষদ) অধ্যাদেশ অনুযায়ী ইউনিয়ন পরিষদের কার্যাবলী নিম্নোক্তভাবে পুনর্বিন্যাস করা হয় : ১. চৌকিদার/ দফাদারদের মাধ্যমে আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করা। ২. জনসেবামূলক কাজ তথা: রাস্তাঘাট, পুল কালভার্ট, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রভৃতি প্রতিষ্ঠা ও তাদের মেরামত সংরক্ষণ; নলকূপ সরবরাহ ও স্থাপন এবং পয়ঃব্যবস্থার উন্নয়ন, ৩. বিধিবদ্ধ ও নিয়ন্ত্রণধর্মী কাজ : ক) জন্ম মৃত্যুর নিবন্ধন, খ) ভবনাদির নির্মাণ নিয়ন্ত্রণ, গ) জনস্বার্থ বিরোধী কাজ প্রতিরোধ। ৪. বিচারবিভাগীয় কাজ : ক) সালিশ মীমাংসার মাধ্যমে বিরোধ নিষ্পত্তি, খ) ছোটখাট ফৌজদারী ও দেওয়ানী মামলার বিচার। ৫. থানা বা উপজেলা কর্তৃক প্রদত্ত অন্যান্য দায়িত্ব পালন। উল্লেখ্য, সারা দেশে এখন ৪৯৫টি উপজেলা পরিষদ আছে। এ পরিষদগুলো নির্বাচিত প্রতিনিধিদের দ্বারা পরিচালিত হবার কথা। এছাড়াও সারা দেশে এখন ৩৩০টি পৌরসভা ও ১২টি সিটি কর্পোরেশন রয়েছে। এর অধিকাংশ নির্বাচিত কর্মকর্তারা পলাতক।
১৯৪৭ সালে আমাদের প্রথম স্বাধীনতা লগ্ন থেকেই ইউনিয়ন বোর্ড/ইউনিয়ন পরিষদসমূহ তৃণমূল পর্যায়ে তথা গ্রামীণ জনগণের প্রতিনিধিত্বশীল প্রতিষ্ঠান হিসেবে কাজ করে আসছিল। এ প্রতিষ্ঠানটিতে দলীয়ভিত্তিতে দলীয় প্রতীকে নির্বাচন অনুষ্ঠানের নজির ছিল না। কিন্তু স্বৈরাচারী আওয়ামী লীগ আমলে এ প্রথাটি ভেঙ্গে দেয়া হয়। বিশেষ করে ২০০৯ সালের স্থানীয় সরকার (ইউনিয়ন পরিষদ) আইনে এ প্রতিষ্ঠানটিকে দলীয় রাজনীতির আখড়ায় পরিণত করা হয়।
২০২৪ সালের ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের মুখে তৎকালীন ফ্যাসিস্ট প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদত্যাগ ও ভারতে পলায়নের পর সারা বাংলাদেশের ৪৫৭৮টি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও ৫৪,৯৩৬ জন সদস্যের মধ্যে আওয়ামী রাজনীতির সাথে সরাসরি জড়িত প্রায় ৪৫% চেয়ারম্যান-মেম্বার পালিয়ে যান। বলাবাহুল্য, ইউনিয়ন পরিষদসমূহের নির্বাচনে বিপুল সংখ্যক জামায়াত, বিএনপি ও স্বতন্ত্র প্রার্থী বিজয়ী হয়েছিলেন। হাসিনা-সরকার তাদের সহ্য করতে পারেননি। নানা অজুহাত দেখিয়ে তাদের অনেককেই সরিয়ে দেয়া হয়েছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত নিজেরা পালিয়ে যেতে যেমন বাধ্য হয়েছিলেন তেমনি তাদের নিয়োজিত চেয়ারম্যান-মেম্বাররাও পালিয়ে গেছেন। সবগুলো স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান তথা ইউনিয়ন পরিষদ, উপজেলা পরিষদ, পৌরসভা, সিটি কর্পোরেশন সর্বত্রই একই অবস্থা। ইউনিয়ন পরিষদসমূহে কোথাও কোথাও প্যানেল চেয়ারম্যান দিয়ে কিছু কিছু কাজকর্ম চালিয়ে যাওয়া হচ্ছে; কিন্তু সর্বত্র মানুষের ভোগান্তি চরমে উঠেছে। ইউনিয়ন বলুন, উপজেলা বলুন অথবা পৌরসভা বা সিটি কর্পোরেশন, দু’ভাবে মানুষকে দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে, যে কাজ দু’এক ঘণ্টা বা দু’-একদিনের মধ্যে সম্পন্ন হতো তা করতে এখন এক সপ্তাহেরও বেশি সময় লাগছে। আবার ঘুষ-দুর্নীতিও কয়েকগুণ বেড়ে গেছে। উপজেলা পরিষদসমূহে নির্বাহী অফিসারসহ বিভিন্ন বিভাগীয় সরকারি কর্মকর্তারা তাদের ইচ্ছামতো কাজকর্ম চালিয়ে যাচ্ছেন। চেয়ারম্যান, ভাইস চেয়ারম্যান ও পরিষদের অন্যান্য নির্বাচিত সদস্যের অনুপস্থিতিতে গ্রামীণ উন্নয়ন ও প্রশাসন মারাত্মক সমস্যার কবলে পড়েছে। প্রতিষ্ঠানগুলো আইন অনুযায়ী তাদের বিধিবদ্ধ দায়িত্বসমূহ (Statutory Function) পালন করতে পারছে না। আবার আইনশৃঙ্খলা রক্ষা ও দুষ্টের দমন শিষ্টের পালন সংক্রান্ত তাদের যে খবরদারি তাও হচ্ছে না। ফলে এতবড় একটা বিপ্লবের পরও সারা দেশে চাঁদাবাজি, সন্ত্রাস, দুর্নীতি ও দস্যুবৃত্তি বৃদ্ধি পেয়েছে। এর একমাত্র প্রতিকার ছিল সংসদ নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচনের মাধ্যমে তৃণমূল পর্যায়ে রাষ্ট্রীয় শৃঙ্খলা পুনর্বহাল, প্রয়োজনীয় সংস্কার সাধন এবং জবাবদিহিতার পুনর্বহাল।
একটি গণতান্ত্রিক দেশে সংসদ নির্বাচন অপরিহার্য সন্দেহ নেই। সংসদের কাজ আইন প্রণয়ন ও দেশকে কাক্সিক্ষত মনজিলের দিকে এগিয়ে নেয়া। সংসদ নির্বাচন দল বিশেষ বা তাদের জোটকে ক্ষমতায় নিতে সাহায্য করে। প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী, উপমন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, স্পিকার, ডেপুটি, স্পিকার বা রাষ্ট্রপতিও হয়ত কেউ হবেন। কিন্তু স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলো পুনর্গঠনের আগে তারা ফলপ্রসূভাবে কোনো কাজ করতে পারবেন বলে বিশ্বাস করা যায় না। Participatory democracy তথা অংশীদারিত্বভিত্তিক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় যেকোনো ধরনের পরিকল্পনা প্রণয়ন, বাস্তবায়ন, পরিধারণ ও মূল্যায়নে তৃণমূল পর্যায়ের স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানসমূহের অংশীদারিত্ব অপরিহার্য। এর অনুপস্থিতি ফ্যাসিবাদকে টিকিয়ে রাখে এবং তাকে নতুন করে জন্ম দেয়। মানুষ ইনসাফ থেকে বঞ্চিত হয়। স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানসমূহের আগে সংসদ নির্বাচনের ঘোষণাকে আমি অনেকটা ঘোড়ার আগে গাড়ি জুড়ে দেয়ার মতো মনে করি। এতে যে বা যে সমস্ত দল আসন্ন নির্বাচনে জয়ী হয়ে ক্ষমতায় যাবার ব্যাপারে নিশ্চিত বলে মনে হয় তাদের জন্য একটা সুবিধা সৃষ্টি হবার সম্ভাবনা রয়েছে বলে মনে হয়। ক্ষমতায় গিয়ে নির্বাচন করার বা নির্বাচন নির্বাচন খেলার সুবিধা পলাতক আওয়ামী লীগও ভোগ করেছে। এক্ষেত্রে প্রভাব খাটিয়ে দলীয় লোকদের নির্বাচিত করার সুযোগ থাকে। এ আশায় অনেকেই সংসদ নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচনের বিরোধিতা করছেন। তাদের এ চিন্তা-ধারার মধ্যে পতিত ফ্যাসিবাদের প্রত্যাবর্তনের পদধ্বনি শোনা যায়। বাংলাদেশের ৫৪ বছরের ইতিহাসে এর অনেক পুনরাবৃত্তি দেখা যায়। এমনকি পাকিস্তান আমলে আইয়ুব খানের চল্লিশ হাজার মৌলিক গণতন্ত্রীর ইতিহাসও স্বয়ং ফিল্ড মার্শালের পরিণতিও আমরা দেখেছি। এ অবস্থায় জাতীয় স্বার্থে স্থানীয় সরকার নির্বাচনটি সংসদ নির্বাচনের আগে করা যায় কিনা তা ভেবে দেখার জন্য আমি সরকারের প্রতি অনুরোধ করছি।
আগামী সংখ্যায় পিআর তথা জাতীয় নির্বাচনে আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বমূলক পদ্ধতি নিয়ে আলোচনার আশা রাখি ইনশাআল্লাহ।