জাফর আহমাদ
উপহার নিবেন উপহার দিবেন। এমন আদান-প্রদানের মাধ্যমে সামাজিক সৌহার্দ ও সম্প্রীতি স্থাপিত হয়। উপহার প্রদানের মাধ্যমে পারস্পরিক ভালোবাসা, ভালো সম্পর্ক ও সম্প্রীতি গড়ে উঠে। আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব, পাড়া-প্রতিবেশী ও দ্বীনি ভাই-বোনদের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ এবং তাদের জন্য উপহার সামগ্রী নিয়ে যাওয়া ইসলামী আদবের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। আবু হুরাইরা (রা.) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন: সে সত্তার শপথ যার হাতে আমার প্রাণ! তোমরা জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না, যে পর্যন্ত না ঈমানদার হবে, আর ঈমানদার হতে পারবে না, যে পর্যন্ত না পরস্পর ভালোবাসা স্থাপন করবে। আমি কি এমন একটি কাজের কথা তোমাদেরকে বলে দিব না, যখন তোমরা তা করবে, পরস্পর ভালোবাসা স্থাপিত হবে। তোমরা একে অপরের মধ্যে সালামের প্রসার ঘটাও। (তিরমিযি: ২৬৮৮, কিতাবুল ইসতিযানে ওয়াল আদাবে আন রাসুলিল্লাহ, বাবু মা জাআ ফি ইফসায়িস সালাম, ইবনে মাযাহ: ৩৬৯২ ও মুসলিম) আবু ঈসা বলেন, এ হাদীসটি হাসান সহীহ। জাবির ইবনে আবদুল্লাহ (রা.) সূত্রে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন: কাউকে কিছু দান করা হলে সে যেন সামর্থ্য থাকলে তার প্রতিদান দেয়। যদি সামর্থ্য না থাকে তবে সে যেন তার প্রশংসা করে। সে তার প্রশংসা করলে তার প্রতি কৃতজ্ঞতা আদায় করলো। আর যে ব্যক্তি তা গোপন রাখলো সে অকৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলো। (সুনানে আবু দাউদ: ৪৮১৩, কিতাবুল আদাব, বাবু ফি শুকরিল মা’রূফ, তিরমিযি, হাদীসটি হাসান)
কিন্তু এমন উপহার ও হাদিয়া হতে হবে সম্পূর্ণভাবে নিঃস্বার্থ। এর পেছনে পার্থিব কোনো উদ্দেশ্য লুকায়িত থাকবে না। যদি এ ধরনের কোন উদ্দেশ্য বা স্বার্থ হাছিলের উদ্দেশ্য থাকে তবে তা ঘুষের পর্যায়ে পড়ে যাবে। আবু হুমাইদ সাঈদী (রা.) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, নবী (সা.) আসাদ গোত্রের এক ব্যক্তিকে কর্মচারী নিযুক্ত করলেন, যাকে ইবনুল লুতবিয়্যাহ নামে অভিহিত করা হতো। রাবী আমর ও ইবনু আবু উমার বলেন, যাকাত আদায়ের জন্য। যখন (যাকাতের উসুলকৃত) মালামাল নিয়ে ফিরে এলো, তখন সে বললো, এগুলো হচ্ছে আপনাদের, আর ওটা আমাকে উপঢৌকন স্বরূপ দেয়া হয়েছে। রাবী বলেন, তখন রাসুলুল্লাহ (সা.) মিম্বরের উপড়ে দাঁড়ালেন এবং আল্লাহর প্রশংসা করার পর বললেন, সে কর্মচারীর কি হলো, যাকে আমি (আদায়কারীরূপে) প্রেরণ করলাম, আর সে বলে! ওটা আপনাদের আর এটি আমাকে উপঢৌকন দেয়া হয়েছে?
সে তার পিতার বা মাতার ঘরে বসে থেকে দেখে না কেন যে তাকে উপঢৌকন দেয়া হয় কি না? মুহাম্মাদের প্রাণ যে পবিত্র সত্তার হাতে তার কসম! যে কেউ এরূপ সম্পদের কিছুমাত্র কুক্ষিগত করবে, কিয়ামতের দিন তাই সে তার ঘাড়ে বহন করে নিয়ে আসবে-তার ঘাড়ের উপর চিৎকাররত উট হবে অথবা হাম্বা-হাম্বারত গাভী হবে অথবা চিৎকাররত বকরী হবে। তারপর তিনি দু’হাত উপরের দিকে উঠিয়ে ধরলেন, এমনকি তার বগলের শুভ্রতা আমাদের দৃষ্টিগোচর হলো। তিনি বললেন, “হে আল্লাহ! আমি কি তোমার নির্দেশ পৌঁছিয়ে দিয়েছি!” এ কথা তিনি দু’বার বললেন। (মুসলিম: ৪৬৩২, আন্ত: নাম্বার: ১৮৩২, কিতাবুল ইমারাত, বাবু তাহরিমিল হাদায়াল উম্মালি অর্থাৎ সরকারি কর্মচারীদের উপহার গ্রহণ নিষিদ্ধ, বুখারী: ৬৬৩৬, ইফা: ৪৫৮৬, ই.সে. ৪৫৮৯)
আবু হুমাইদ সাঈদী (রা.) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, নবী (সা.) আযদ গোত্রের ইবনুল লুতবিয়্যাহ নামক এক ব্যক্তিকে যাকাত উসূলের উদ্দেশ্যে কর্মচারী নিয়োগ করেন। সে যখন (যাকাতের উসুলকৃত) মালামাল নিয়ে এসে নবী (সা.) এর নিকট অর্পণ করলে, তখন সে বলল, এগুলো হচ্ছে আপনাদের, আর ওটা আমাকে উপঢৌকন স্বরূপ দেয়া হয়েছে। তখন নবী (সা.) বললেন, তুমি তোমার পিতা-মাতার ঘরে বসে থেকে দেখলে না কেন, তোমার জন্য উপঢৌকনাদি প্রেরিত হয় কি না? তারপর নবী (সা.) খুৎবাহ দিতে দাঁড়ালেন। (মুসলিম: ৪৬৩৩, আন্ত. নাম্বার: ১৮৩২, কিতাবুল ইমারাত, বাবু তাহরিমিল হাদায়াল উম্মালি অর্থাৎ সরকারি কর্মচারীদের উপহার গ্রহণ নিষিদ্ধ, ইফা: ৪৫৮৭, ই. সে. ৪৫৯০) এই হাদীসগুলোর আলোকে সরকারি-বেসরকারি অফিসের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের জন্য হাদিয়া গ্রহণ নিষিদ্ধ।
বর্তমানে এটি আমাদের সমাজ ব্যবস্থায় অত্যন্ত মামুলী বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এর ভালো-মন্দ কেউ যাচাই বাছাই করেন না। ফলে এটি ইসলামের দৃষ্টিতে বিশাল অনাচারের রূপ পরিগ্রহ করেছে। অর্থাৎ এই উপহারের ফলে সমাজের সর্বস্তরে ঘুষ প্রথা চালু হয়ে যায়। যারা ঘুষ খায় এবং যারা ঘুষ প্রদান করে উভয়ের প্রাথমিক ট্রায়াল হলো, উপঢৌকন। এ সামান্য উপঢৌকনের মাধ্যমে সে বিশাল পরিসরে প্রবেশ করে। এ জন্য রাসুলুল্লাহ (সা.) যে পথে শয়তান মানুষের মধ্যে প্রবেশ করতে পারে, সে রাস্তা আগেই বা প্রাথমিক পর্যায়েই বন্ধ করে দিতেন। যেমন: আল্লাহ তা’আলা বলেন, “যিনার কাছেও যেয়ো না, ওটা অত্যন্ত খারাপ কাজ এবং খুবই জঘন্য পথ।” (সুরা বনী ইসরাইল: ৩২) এ হুকুম ব্যক্তির জন্য এবং সামগ্রীকভাবে সমগ্র সমাজের জন্যও। ব্যক্তির জন্য এ হুকুমের মানে হচ্ছে, সে নিছক যিনার কাজ থেকে দূরে থেকেই ক্ষান্ত হবে না বরং এ পথের দিকে টেনে নিয়ে যায় যিনার এমন সব সূচনাকারী এবং প্রাথমিক উদ্যেগ ও আকর্ষণ সৃষ্টিকারী বিষয় থেকেও দূরে থাকবে। আর সমাজের জন্য ফরয হলো, এ হুকুমের প্রেক্ষিতে সমাজ জীবনে যিনা, যিনার উদ্যেগ আকর্ষণ এবং তার কারণসমূহের পথ বন্ধ করে দেয়া। এ উদ্দেশ্যে আইন প্রণয়ন, শিক্ষা ও অনুশীলন দান, সামাজিক পরিবেশের সংস্কার সাধন, সমাজ জীবনের যথাযোগ্য বিন্যাস এবং অন্যান্য প্রভাবশালী ব্যবস্থা অবলম্বন করবে।
এ হুকুমের প্রেক্ষিতে আল্লাহর রাসুল (সা.) ইসলামী জীবনব্যবস্থার একটি বৃহত্তর অধ্যায়ের বুনিয়াদ রচনা করেন। এ অভিপ্রায় অনুযায়ী যিনা ও যিনার অপবাদকে ফৌজদারী অপরাধ গণ্য করা হয়। পর্দার বিধান জারী করা হয়। অশ্লীলতা ও নিলর্জ্জতার প্রচার কঠোরভাবে বন্ধ করে দেয়া হয়। মদ্যপান, নাচ, গান ও ছবির (যা যিনার নিকটতম আত্মীয়) ওপর কড়া নিষেধাজ্ঞা জারী করা হয়। আর এ সংগে এমন একটি দাম্পত্য আইন প্রণয়ন করা হয় যার ফলে বিবাহ সহজ হয়ে যায় এবং এ যিনার সামাজিক কারণসমূহের শিকড় কেটে যায়। অর্থাৎ যে পথে মানুষ যিনার দিকে আকৃষ্ট হয় সে পথের এমন জায়গায় বাঁধ দেয়া হয়েছে যেখান থেকে যিনার ছিঁটে ফুটা দেখা যায় না। ইসলামের প্রতিটি মারাত্মক অপরাধের ব্যাপারে একই কথা প্রযোজ্য যে, এমন জায়গায় বেঁরি বাঁধ তৈয়ার করা যাতে শয়তান মানুষকে অপরাধের দ্বারে কাছে নিয়ে যেতে না পারে।
আমাদের সমাজে যিনা ব্যভিচার, অশ্লীলতা, বেহায়াপনা,উলঙ্গপনা, ঘুষ, দুর্নীর্তি, দুরাচার ও লুটপাট এতটাই মামুলী বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে যে, সমাজের কেউ একে এখন আর ঘৃণার চোখে দেখে না। সুশীল সমাজ দু-একটি শব্দ উচ্চারণ করলেও তা কিছুক্ষণের মধ্যে হাওয়ায় মিলিয়ে যায়। এ নিয়ে কাউকে উচ্চ বাচ্য করতে দেখা যায় না। এ গুলো আমাদের সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঢুকে পড়েছে। সময়, শ্রম ও মেধা খরচ করে টাকা উপার্জন করার চেয়ে এটি খুবই সহজ-সরল পথ হিসাবে গণ্য করা হয়। সমাজ থেকে এগুলো দূর করার জন্য ফৌজদারী আইন প্রণয়ন করে বাস্তব প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে।
উপঢৌকন গ্রহণেও একই কথা প্রযোজ্য। এটি যদি সামাজিক সমৃদ্ধি বৃদ্ধির জন্য হয় তাতে এটি যেমন উৎসাহব্যঞ্জক, তেমনি এটি যদি বিশেষ সুবিধা লাভের উদ্দেশ্যে হয়ে থাকে তবে তা অবশ্যই পরিত্যজ্য। যেমন সরকারি বা বেসরকারি অফিসার এ ধরনের উপহার ও উপঢৌকন গ্রহণ উল্লেখিত হাদীসের আলোকে অবশ্যই পরিত্যজ্য। মনে রাখতে হবে এ ধরনের উপহার সংশ্লিষ্ট অফিসের ক্ষতি ও ধ্বংস ডেকে আনতে পারে। তাই যে কোন অফিসে কর্মরত কোন অফিসার কোন গ্রাহকের কাছ থেকে কোন প্রকার উপহার-উপঢৌকন গ্রহণ করতে পারবেন না। যদি তিনি এমনটি করেন, তাহলে উল্লেখিত হাদীসের আলোকে তিনি চাকরি থেকে বহিস্কৃত হবেন। তার থেকেও দ্ব্যর্থবোধক ভাষা প্রয়োগ করেছেন মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ (সা.)। নিচের হাদীসটি এখানে বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য।
আদী ইবনে উমাইরাহ আল-কিন্দী (রা.) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি রাসুলুল্লাহ (সা.) কে বলতে শুনেছি: আমরা তোমাদের মধ্যে যাকে আদায়কারী নিযুক্ত করি, আর সে একটি সূচ পরিমাণ বা তার চাইতেও কম মাল আমাদের কাছে গোপন করে, তাই আত্মসাৎ বলে গণ্য হবে এবং তা নিয়েই কিয়ামতের দিন সে উপস্থিত হবে। রাবী বলেন, তখন একজন কৃষ্ণকায় আনসারী তাঁর দিকে অগ্রসর হলেন, আমি যেন তাকে দেখতে পাচ্ছি। তিনি আরয করলেন, হে আল্লাহর রাসুল! আপনার দায়িত্বভার আপনি বুঝে নিন। তখন রাসুলুল্লাহ (সা.) বললেন: তোমার কী হয়েছে? তিনি আরয করলেন, আমি আপনাকে এরূপ এরূপ বলতে শুনেছি। তখন তিনি বললেন, আমি এখনও বলছি, তোমাদের মধ্যকার যাকেই আমি কর্মচারী নিযুক্ত করি আর সে অল্প বিস্তর যা-ই আদায় করে এনে উপস্থিত করে, তারপর তাকে যা-ই দেয়া হয় তা-ই গ্রহণ করে এবং যা থেকে নিষেধ করা হয় তা থেকে বিরত থাকে (তার জন্য ভয়ের কারণ নেই) (মুসলিম: ৪৬৩৭, আন্ত. নাম্বার: ১৮৩৩, কিতাবুল ইমারাত, বাবু তাহরিমি হাদায়াল উম্মাল, ইফা: ৪৫৯১, ই.সে: ৪৫৯৪)। লেখক : ব্যাংকার