আমাদের দেশে প্রায়ই গ্যাস লাইন লিকেজ থেকে বিস্ফোরণ ও অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটছে। ফলে সম্পদের ক্ষয়ক্ষতি ছাড়াও অনেকেই অগ্নিদগ্ধ হয়ে হতাহতের শিকার হচ্ছেন। বড় ধরনের ভূমিকম্পে গ্যাস লাইন বিস্ফোরণ জনিত দুর্ঘটনার ঝুঁকি ব্যাপকভাবে বাড়তে পারে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স থেকে জানা যায়- গ্যাস, বিদ্যুৎ ও পানির লাইনে বিস্ফোরণ ঘটলে পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ নিতে পারে। বেশিরভাগ গ্যাস লাইন বিস্ফোরণে, আগুনের শিখা শত শত ফুট উপরে উঠতে পারে, যার ফলে দ্রুত আগুন ছড়িয়ে পড়াসহ ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি ও হতাহতের ঘটনা ঘটতে পারে।
উল্লেখ্য, গত ২১ নভেম্বর বাংলাদেশে সকাল ১০টা ৩৮ মিনিটে রিখটার স্কেলে ৫.৭ মাত্রার ভূমিকম্প অনুভূত হয়। উৎপত্তিস্থল ছিল রাজধানীর খুব কাছেই- নরসিংদীর মাধবদীতে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দেশে উৎপত্তি হওয়া সবচেয়ে বড় ভূমিকম্প এটি। বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তরের ভূমিকম্প পর্যবেক্ষণ কেন্দ্র বলছে, ঢাকায় বিগত কয়েক দশকের মধ্যে আজকের ভূমিকম্পই সবচেয়ে শক্তিশালী। পূর্বের অধিকাংশ ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল ছিল দেশের বাইরে। তবে ভবিষ্যতে আরও বড় ভূমিকম্পের আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, তিনটি টেকটোনিক প্লেটÍভারতীয়, ইউরেশীয় ও বার্মিজ প্লেটের সংযোগস্থলে অবস্থান করায় বড় ধরনের ভূমিকম্পের ঝুঁকি দীর্ঘদিন ধরেই বাড়ছে। ভূতত্ত্ববিদ অধ্যাপক সৈয়দ হুমায়ুন আখতার বলেছেন, শুক্রবারের ভূমিকম্পটি ইন্দো-বার্মা প্লেটের সংযোগস্থলে হয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে জমে থাকা শক্তির আংশিক মুক্তি ঘটেছে। ফলে পরবর্তী সময়েও বড় ভূমিকম্প হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। তিনি জানান, ঢাকায় প্রায় ২১ লাখ ভবন রয়েছে। তাঁর আশঙ্কা, ঢাকার ১০০ কিলোমিটারের মধ্যে ৭ মাত্রার ভূমিকম্প হলে দুই থেকে তিন লাখ মানুষ হতাহত হতে পারে, এবং শহরের ৩৫ শতাংশ ভবন ভেঙে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। ২০০৯ সালে আইডিএমপি-জাইকা জরিপে জানা যায়, যদি রিখটার স্কেলে ৭ বা তার বেশি মাত্রার ভূমিকম্প ঢাকায় আঘাত হানে, তবে প্রায় ৭২ হাজার ভবন ধসে পড়তে পারে, ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে আরও ১ লাখ ৩৫ হাজার ভবন। এতে ৭ কোটি টন ধ্বংসস্তূপ সৃষ্টি হবে।
ফায়ার সার্ভিস জানিয়েছে, ঢাকার ৭৬ শতাংশ রাস্তা সরু হওয়ায় বড় ধরনের ভূমিকম্পে উদ্ধারকাজ বিঘ্নিত হবে। প্রায় ৬০ শতাংশ ভবন অনুমোদিত নকশা থেকে বিচ্যুত- ফলে ধসে পড়ার ঝুঁকি অত্যন্ত মারাত্মক। সুতরাং ভূমিকম্পের কারণে পুরাতন অবকাঠামো ধ্বংসের পাশাপাশি গ্যাস লাইনে ফাটল বা লিকেজের উচ্চতর ঝুঁকি তৈরি হয়। এর ফলে জরুরি পরিষেবাগুলো বিপর্যস্ত হতে পারে এবং গুরুতর ক্ষতি এবং হতাহতের কারণ হতে পারে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন। তাঁদের মতে এই ঝুঁকি হ্রাস করার জন্য যে ব্যবস্থাগুলো নেয়া যায় তার মধ্যে রয়েছে: গ্যাস লাইনের অখণ্ডতা নিশ্চিত করা, অবকাঠামোকে আরও ভূমিকম্প-প্রতিরোধী করে তোলা এবং স্বয়ংক্রিয় সুরক্ষা শাটডাউন ভালভ রাখা এবং নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ করা।
গ্যাস লাইন লিকেজ ও বিস্ফোরণ ঝুঁকি বৃদ্ধির কারণসমূহ:
ভূমিকম্প: ভূমিকম্পের ফলে গ্যাস লাইন ফেটে যেতে পারে, বিশেষ করে পুরনো, অসংযত, অথবা দুর্বলভাবে রক্ষণাবেক্ষণ করা লাইন।
অবকাঠামোগত দুর্বলতা: ভূমিকম্পের সময় পুরনো বা দুর্বলভাবে নির্মিত লাইনগুলোর ব্যর্থতার ঝুঁকি বেশি থাকে।
প্রজ্বলন উৎস: গ্যাস লিকেজ একটি উচ্চ-ঝুঁকিপূর্ণ পরিবেশ তৈরি করে যেখানে একটি স্পার্ক বা শিখা সহজেই বিস্ফোরণ ঘটাতে পারে।
সঠিক সুরক্ষা বৈশিষ্ট্যের অভাব: ভূমিকম্পের সময় গ্যাস প্রবাহ বন্ধ করার জন্য ডিজাইন করা কার্যকর সুরক্ষা শাটডাউন ভালভ না থাকা মারাত্মক ঝুঁকি তৈরি করে। ক্ষয়ক্ষয় এবং অন্যান্য ক্ষতি পাইপলাইনগুলোকে দুর্বল করে দিতে পারে, যা চাপের মধ্যে ভেঙে যাওয়ার ঝুঁকি বৃদ্ধি করে।
প্রতিকার কৌশল:
অবকাঠামো শক্তিশালীকরণ: ভূমিকম্পের সময় গ্যাস এবং জলের লাইনগুলির স্থিতিস্থাপকতা উন্নত করার জন্য তাদের শক্তিশালীকরণ এবং আপগ্রেড করুন।
স্বয়ংক্রিয় শাটঅফ ভালভ: ভূমিকম্পের সময় গ্যাস প্রবাহ বন্ধ করতে পারে এমন স্বয়ংক্রিয় সুরক্ষা শাটঅফ ভালভ ইনস্টল করা এবং তা সচল বা কার্যকর থাকা নিশ্চিত করা।
নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ এবং পরিদর্শন: দুর্ঘটনা রোধ করতে নিয়মিতভাবে পুরানো বা ক্ষয়প্রাপ্ত পাইপগুলো পরিদর্শন, রক্ষণাবেক্ষণ এবং প্রতিস্থাপন করা জরুরী।
নিষ্কাশন এবং বিচ্ছিন্নকরণ: জলবাহী পরীক্ষা বা রক্ষণাবেক্ষণের সময়, ফেটে যাওয়ার ক্ষেত্রে গ্যাস জমা রোধ করার জন্য এলাকার কাছাকাছি গ্যাস নেটওয়ার্কগুলোকে পদ্ধতিগতভাবে বিচ্ছিন্ন এবং নিষ্কাশন করা।
নমনীয় সংযোগ: ভূমিকম্পের সময় বৃহৎ ভূমি স্থানচ্যুতি সামঞ্জস্য করার জন্য গ্যাস পরিবহন নেটওয়ার্কগুলোতে আরও নমনীয় সংযোগ ব্যবহার করা। জরুরি প্রস্তুতি: গ্যাস লাইন ফেটে যাওয়ার ঘটনার প্রতিক্রিয়া জানাতে জনসাধারণ এবং জরুরি পরিষেবাগুলির জন্য মহড়া এবং সচেতনতামূলক কর্মসূচি পরিচালনা করা।
লেখক : সাংবাদিক।