পাক-ভারত তিক্ততা ও সংঘাত নতুন কিছু নয় বরং তা চলছে দশকের পর দশক ধরে। বস্তুত, এ সংঘাতের মূল প্রতিপাদ্যই হচ্ছে কাশ্মীর নিয়ে বিরোধ। তবে গত ২২ এপ্রিল ভারত নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের পেহেলগামে এক সন্ত্রাসী হামলায় ২৬ জন নিহত হওয়ার ঘটনাকে কেন্দ্র করে তা নতুন মাত্রা পেয়েছে। নয়াদিল্লি এ হামলার জন্য চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী পাকিস্তানকে দায়ী করে প্রতিশোধের ঘোষণা দেয়। ৭ মে ভারতীয় বাহিনী পাকিস্তানের অভ্যন্তরে ‘অপারেশন সিঁদুর’ পরিচালনা করে এবং দেশটির পক্ষে এ অভিযানের ব্যাপক সাফল্য দাবি করা হয়। পাকিস্তান এ হামলার জবাব দেয় ১০ মে অপারেশন ‘বুনিয়ানুম মারসুস’ তথা দুর্ভেদ্য প্রাচীরের মাধ্যমে। ইসলামাবাদ কর্তৃপক্ষও এ অভিযানের ব্যাপক সাফল্য দাবি করে। এরপরই মূলত ভারত নড়েচড়ে বসে এবং দেশটি এ প্রাণঘাতী যুদ্ধ বন্ধের জন্য প্রভাবশালী মুসলিম দেশসহ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দারস্থ হয় এবং শেষ পর্যন্ত উভয় পক্ষই যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হয়। যদিও বিষয়টি নিয়ে নয়াদিল্লি ভিন্নমত পোষণ করছে।
পাক-ভারত সীমান্ত সংঘর্ষ বা যুদ্ধ নতুন কিছু নয় বরং ১৯৪৭-এ ভারত বিভাজনের পর থেকে বারবার যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছে। মূলত, মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ কাশ্মীর নিয়ে জন্মলগ্ন থেকেই উত্তেজনা চলে আসছে দেশ দু’টির মধ্যে। কাশ্মীরকে কেন্দ্র করে বড় দু’টি যুদ্ধ লড়েছে তারা। কাশ্মীরের বিতর্কিত ভূখণ্ড বরাবরই রয়েছে বিশ্বের উত্তেজনার কেন্দ্রবিন্দুতে। পারমাণবিক শক্তিধর উভয় আঞ্চলিক শক্তিই এ ভূখণ্ডের মালিকানা দাবি করে আসছে। ফলে যুদ্ধ ছিলো দু’নিকট প্রতিবেশীর নিত্যসঙ্গী। নিম্নে গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি যুদ্ধের কথা উল্লেখ করা হলো।
প্রথম কাশ্মীর যুদ্ধ (১৯৪৭) : ঔপনিবেশিক শাসন থেকে স্বাধীনতা লাভের পরপরই কাশ্মীর নিয়ে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধ শুরু হয়। দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে পৃথক দু’টি রাষ্ট্র গঠন হলেও মুসলিম অধ্যুষিত কাশ্মীরের মহারাজা ভারতের সঙ্গে যোগ দেয়ার সিদ্ধান্ত নেন। জম্মু অঞ্চলে মুসলমান প্রজাদের বিরুদ্ধে এক গণহত্যা চালায় ডোগরা রাজা হরি সিংয়ের সেনা ও উগ্র হিন্দুত্ববাদীরা। আল জাজিরার দেয়া তথ্যমতে, এসময় প্রায় আড়াই লাখের মতো মানুষকে হত্যা করা হয়। সর্বস্ব হারিয়ে প্রায় পাঁচ লাখ মানুষ পালিয়ে যায় সীমান্তের ওপার পাকিস্তানে।
অবশ্য ১৯৪৭ সালের শেষদিকে সম্পূর্ণ কাশ্মীরের নিয়ন্ত্রণ নেয়ার সিদ্ধান্ত নেয় পাকিস্তান। শুরু হয় রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ। এ যুদ্ধে কাশ্মীরের অনেক এলাকা নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিতে পেরেছিল ইসলামাবাদ। এরপর জাতিসংঘের সমর্থনে ১৯৪৯ সালের জানুয়ারিতে ৭৭০ কিলোমিটার দীর্ঘ একটি যুদ্ধবিরতি রেখা টানা হয়, যা কার্যত কাশ্মীরকে বিভক্ত করে দেয়। এ সীমারেখা ‘লাইন অব কন্ট্রোল’ (এলওসি) নামে পরিচিত। উল্লেখ্য, বর্তমানে কাশ্মীরের প্রায় ৩৭ শতাংশ পাকিস্তানে ও ৬৩ শতাংশ ভারতের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। তবে উভয় দেশই পুরো অঞ্চলটির মালিকানা দাবি করে আসছে। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে কাশ্মীরে শুরু হয় স্বাধীনতা সংগ্রাম। ভারতে এ আন্দোলনে উস্কানি দেয়ার অভিযোগ করে আসছে চিরবৈরি পাকিস্তানের বিরুদ্ধে। কাশ্মীরে স্বাধীনতা আন্দোলন দমনে অঞ্চলটিতে বিপুল সামরিক-আধা সামরিক বাহিনী মোতায়েন রেখেছে দিল্লি। সেখানে মানবাধিকার লঙ্ঘনের গুরুতর সব অভিযোগ রয়েছে ভারতীয় কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে।
দ্বিতীয় কাশ্মীর যুদ্ধ (১৯৬৫) : কাশ্মীর নিয়ে দ্বিতীয়বারের মতো ১৯৬৫ সালে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে ভারত-পাকিস্তান। বিবিসির এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ওই বছরের আগস্টে অপারেশন জিব্রালটারের অধীনে ভারত-অধিকৃত কাশ্মীরে প্রবেশ করে পাকিস্তানী সেনারা। জবাবে পাকিস্তানের সীমান্ত সংলগ্ন এলাকায় পাল্টা হামলা করে ভারত। এ যুদ্ধে ভারত ও পাকিস্তান উভয়পক্ষেই ব্যাপক প্রাণহানি হয়। যুদ্ধ শুরুর সাত সপ্তাহ পর সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যস্থতায় একটি যুদ্ধবিরতি এবং তাসখন্দ চুক্তির মাধ্যমে যুদ্ধের আনুষ্ঠানিক পরিসমাপ্তি ঘটে। তবে এ যুদ্ধে উভয়পক্ষই নিজেদেরকে বিজয়ী ঘোষণা করে। বড় দু’যুদ্ধের বাইরেও বিভিন্ন সময় কাশ্মীর নিয়ে যুদ্ধ পরিস্থিতি তৈরি হয়। এরমধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে কারগিলের সংঘাত।
কারগিল যুদ্ধ (১৯৯৯) : ১৯৮৯ সালে ভারত শাসনের বিরুদ্ধে ভারত-নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরে এক সশস্ত্র স্বাধীনতা আন্দোলন শুরু হয়। পরবর্তী কয়েক বছরে নিরাপত্তা বাহিনী ও কাশ্মীরি বিদ্রোহীদের মধ্যে সংঘাতে হাজার হাজার যোদ্ধা ও সাধারণ নাগরিক প্রাণ হারান। ১৯৯৯ সালে স্বাধীনতাকামীরা কাশ্মীর সীমান্ত অতিক্রম করে কারগিলের বরফে ঢাকা পাহাড়ি অঞ্চল দখল করে নেয়। ১০ সপ্তাহ পর এ সংঘাতের অবসান ঘটলেও উভয় পক্ষের প্রায় ১ হাজার সেনা ও যোদ্ধা এতে প্রাণ হারায়। যুক্তরাষ্ট্রের চাপেই শেষ পর্যন্ত এ যুদ্ধ বন্ধ হয়। তবে ২০০১ ও ২০০২ সালে ভারতে একাধিক হামলা হয়, যার জন্য পাকিস্তানভিত্তিক সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোকেই দায়ী করে নয়াদিল্লি। এর জেরে দু’দেশের সীমান্তে আবারও বিপুল সংখ্যক সেনা মোতায়েন করা হয়। ২০০৩ সালে সীমান্তজুড়ে যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করা হয়। পরের বছর একটি শান্তি চুক্তির প্রক্রিয়া শুরু হলেও তা কোনো সুস্পষ্ট ফলাফল ছাড়াই শেষ হয়।
মূলত, ঔপনিবেশিক শাসন থেকে স্বাধীনতা লাভের পর দু’প্রতিবেশি বারবার রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছে। ’৪৭-এর ভারত বিভাজনের মানদণ্ড অনুযায়ী মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চল হিসাবে পুরো কাশ্মীরই পাকিস্তানের অংশ হওয়ার কথা। কিন্তু কাশ্মীরি রাজার বিশ্বাসঘাতকতার কারণেই কাশ্মীর ভারতভুক্ত হয়েছিলো। সঙ্গত কারণেই সেখানে দশকের পর দশক ধরে স্বাধীনতা সংগ্রাম দানাবেঁধে উঠেছে। একই সাথে দু’নিকট প্রতিবেশীর মধ্যে প্রায় শতাব্দীব্যাপী বৈরিতা ও তিক্ততা স্থায়ী রূপ নিয়েছে। সে ধারাবাহিকতার অংশই ছিলো ২২ এপ্রিল কাশ্মীরের পেহেলগামে সন্ত্রাসী হামলা।
এ হামলার জন্য ভারত স্বভাবসুলবভাবে পাকিস্তানকে দায়ী করলে পাকিস্তান তা প্রত্যাখ্যান করে আন্তর্জাতিক তদন্তের আহ্বান জানায়। যদিও পাকিস্তানসহ কতিপয় আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম এ নিন্দনীয় ঘটনার জন্য ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থাকে দায়ী করেছে। কিন্তু ভারত স্বাভাবিক পথে অগ্রসর না হয়ে পাকিস্তানের সাথে গায়ে পড়ে সংঘাত সৃষ্টির জন্য দেশটির অভ্যন্তরে ‘অপারেশন সিঁদুর’ পরিচালনা করে অনেক বেসামরিক লোককে হতাহত করে। জবাবে পাকিস্তান ‘অপারেশন বুনিয়ানুম মারসুস’-এর মাধ্যমে এর জবাব দিলে সার্বিক পরিস্থিতি পুরোপুরি ভারতের প্রতিকূলে চলে যায় এবং দেশটি এ সংঘাতে বড় ধরনের পরাজয়ের মুখোমুখি হয়।
মূলত, হামলা-পাল্টা হামলা এবং পরষ্পর দোষ চাপানোর খেলা চলে কয়েক দিন। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছিল পারমাণবিক শক্তিধর প্রতিবেশী দু’দেশ সর্বাত্মক যুদ্ধে নেমেই যাবে! কিন্তু ত্রাতার ভূমিকায় অবতীর্ণ হয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। ফলে হঠাৎ করেই প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প যুদ্ধবিরতির ঘোষণা দিয়ে বসেন। ১০ মে ট্রুথ সোশ্যালে ট্রাম্প পোস্ট করলেন, ‘ভারত আর পাকিস্তান সম্পূর্ণ আর তাৎক্ষণিক যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হয়েছে।’
মূলত, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পাক-ভারত সংঘাতে কোনো ভূমিকা রাখবে কি না, তা নিয়ে সৃষ্টি হয়েছিলো রীতিমত ধোঁয়াশা। ১০ মে ভারত ও পাকিস্তানে যখন স্বস্তির আবহ চলছিল, তখন যুক্তরাষ্ট্র তৃপ্ত ছিল আত্মতুষ্টি নিয়ে। কিন্তু কাশ্মীর আরও এক সহিংসতার রাত কাটিয়েছে। দু’দেশই যুদ্ধবিরতির পরপরই যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘনের অভিযোগ তুলেছে। আসলে এটাই বাস্তবতা। এ যুদ্ধবিরতি ছিলো বোধহয় এক সাময়িক স্বস্তি। এমন ধারণাই করছেন আন্তর্জাতিক বোদ্ধামহল। কারণ, উভয় দেশের মধ্যে এ ধরনের যুদ্ধ বিরতি একেবারে নতুন কিছু নয় বরং ইতিহাসের ধারাবাহিকতা মাত্র।
প্রাপ্ত তথ্যে জানা যায়, ৯ মে মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভ্যান্স ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে ফোন করেন। ভ্যান্স মোদিকে একটি সম্ভাব্য ‘প্রস্থান পথ’ প্রস্তাব করেন বলে জানা যায়। যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকর্তারা আশা করছিলেন যে, পাকিস্তানিরাও এমন ঝামেলা থেকে বের হয়ে আসতে সম্মত হবে। পরবর্তী ১২ থেকে ১৮ ঘণ্টার মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তারা উভয় দেশের সমকক্ষ ব্যক্তিদের সঙ্গে টেলিফোনে যোগাযোগ চালিয়ে যান। যদিও এর ব্যতিক্রমী খবরও গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। প্রকাশিত খবরে দাবি করা হয়েছে যে, যুদ্ধবিরতির জন্য ভারতীয় কর্তৃপক্ষই মার্কিন কর্তৃপক্ষের সাথে প্রথমে যোগাযোগ করেছে।
যাহোক পররাষ্ট্রসচিব মার্কো রুবিও ৯ মে রাতের বেশির ভাগ সময় ভারত ও পাকিস্তানের উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে একটানা যোগাযোগ রেখে চুক্তিটি চূড়ান্ত করেছেন বলে জানা গেছে। ১০ মে এক্সে এক পোস্টে রুবিও লেখেন, ‘আমরা প্রধানমন্ত্রী মোদি এবং প্রধানমন্ত্রী শরিফের প্রজ্ঞা, বিচক্ষণতা ও রাষ্ট্রনায়কোচিত সিদ্ধান্তের প্রশংসা করি, কারণ তাঁরা শান্তির পথ বেছে নিয়েছেন।’ তবে ভাইস প্রেসিডেন্ট ভ্যান্সের ভূমিকা ছিল বিস্ময়কর। এর ঠিক আগের দিনই যুক্তরাষ্ট্রের কূটনৈতিক হস্তক্ষেপের সম্ভাবনা একপ্রকার নাকচ করে দিয়েছিলেন তিনি। ফক্স নিউজকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ভ্যান্স বলেছিলেন, ‘আমরা এমন এক যুদ্ধে জড়িয়ে পড়তে যাচ্ছি না, যা মূলত আমাদের ব্যাপারই নয় এবং যার ওপর আমেরিকার কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই।’ তিনি সে সঙ্গে আরও বলেছিলেন, ‘আমরা এসব দেশের ওপর নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারি না।’ তবে দু’দেশ যখন পরস্পরের দিকে হামলা চালিয়ে যাচ্ছিল, তখন রুবিও পাকিস্তানের সেনাপ্রধান জেনারেল আসিম মুনিরের সঙ্গে কথা বলেন। ১০ মে ইসলামাবাদ দ্রুতই যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকার স্বীকৃতি দেয়।
এ বিষয়ে পাকিস্তানের সাবেক জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা মঈদ ডব্লিউ ইউসুফ এক্সে লিখেছেন, ‘উত্তেজনা প্রশমন শেষ পর্যন্ত পুরোনো ছক অনুযায়ীই হয়েছে তৃতীয় পক্ষের মধ্যস্থতায়, যার নেতৃত্বে ছিল যুক্তরাষ্ট্র।’ নয়াদিল্লির কয়েকজন বিশ্লেষক প্রকাশ্যে রুবিওর বক্তব্য নিয়ে আপত্তি জানান। রুবিও বলেছিলেন, ভারত পাকিস্তানের সঙ্গে ‘খুঁটিনাটি বিষয়ে আলোচনা’তে রাজি হয়েছে। তবে যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ এশিয়ার দু’পরমাণু শক্তিধর দেশের মধ্যে উত্তেজনা প্রশমনে সহায়তা এ প্রথম নয়। এর আগে ১৯৯৯ সালের জুলাইয়ে কারগিল যুদ্ধের চূড়ান্ত মুহূর্তে প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন পাকিস্তানের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফকে ওয়াশিংটনে আমন্ত্রণ জানান এবং ভারত নিয়ন্ত্রিত অঞ্চল থেকে সেনা প্রত্যাহারের জন্য চাপ প্রয়োগ করেন। ফলে কারগিলের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ বন্ধ হয়েছিলো। এতে প্রমাণ হয় কারগিল যুদ্ধেও ভারতীয় পক্ষ গো-হারা হেরেছিলো।
উভয় পক্ষের মধ্যে যখন হামলা-পাল্টা হামলা তীব্রতা লাভ করেছিলো, রুবিও তখন পাকিস্তানের সেনাপ্রধান জেনারেল আসিম মুনিরের সঙ্গে কথা বলেছিলেন বলে জানা যায়। রুবিওর সঙ্গে মুনিরের এ কথোপকথন এ সময় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকাটা রেখেছে। সেদিনই রুবিও পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসহাক দারের সঙ্গে কথা বলেন। দার পরে জিও নিউজকে বলেন, রুবিও তাঁকে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ভূমিকা রাখতে বলেন, কারণ দু’দেশই পরমাণু শক্তিধর। তবে শেষ পর্যন্ত একথা স্পষ্টভাবেই প্রমাণিত হয়েছে যে, পাকিস্তানী হামলার তীব্র্রতায় ভারতই মুসলিম বিশ্বের প্রভাবশালী দেশসহ মার্কিন যুদ্ধরাষ্ট্রকে যুদ্ধ বিরতির জন্য প্রথম প্রস্তাব দিয়েছিলো। আর সে প্রস্তাবের সূত্র ধরেই শর্ত সাপেক্ষে যুদ্ধবিরতিতে পাকিস্তানকে রাজী করানো হয়।
যা হোক, শেষ পর্যন্ত উভয়পক্ষই সেদিন বিকেল ৫টা থেকে যুদ্ধবিরতিতে রাজি হয়। তবে ক্ষণিকের এ সুযোগটি দীর্ঘস্থায়ী শান্তির সম্ভাবনার জন্ম দেওয়ার আশা দ্রুতই ভেঙে পড়ে। ১০ মে সন্ধ্যায় ভারতীয় গণমাধ্যমে এক সরকারি বিবৃতি ছড়িয়ে পড়ে। ভারত ঘোষণা করে যে, ভবিষ্যতে যেকোনো সন্ত্রাসী হামলাকে সরাসরি যুদ্ধ ঘোষণা হিসেবে বিবেচনা করা হবে।’ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র অরিন্দম বাগচি জানান, ভারত তার ‘যুদ্ধনীতি পুনঃসংজ্ঞায়িত করছে’ এবং যদি আরেকটি সন্ত্রাসী হামলা হয়, তাহলে ভারত ‘আরও সামরিক পদক্ষেপ গ্রহণের পথ খোলা রাখছে। বিষয়টিকে যুদ্ধবিরতি লংঘনের ক্ষেত্রে ভারতীয় কর্তৃপক্ষের বড় ধরনের উস্কানি বলেই মনে করছেন আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষক মহল।
কারণ, এ ঘোষণার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই ভারত ও পাকিস্তান-নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের নিয়ন্ত্রণ রেখার আশপাশে বিস্ফোরণের শব্দ ও ড্রোনের গুঞ্জন শোনা যায় বলে প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান। নয়াদিল্লি অভিযোগ তোলে, পাকিস্তান যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘন করেছে। ওয়াশিংটনের স্টিমসন সেন্টারের দক্ষিণ এশিয়াবিষয়ক প্রোগ্রামের ননরেসিডেন্ট ফেলো ক্রিস্টোফার ক্ল্যারির মতে, ‘আমরা হয়তো এমন এক বাস্তবতায় প্রবেশ করছি। এর সঙ্গে গত তিন দশকে মধ্যপ্রাচ্যে ইসরাইল যে অবস্থায় আছে তার মিল আছে।’ ক্ল্যারির কথা যদি ঠিক হয়, তাহলে এর মানে, ভবিষ্যতেও ভারত ও পাকিস্তানের মাঝে অনবরত হামলা ও পাল্টা হামলা চলতেই থাকবে। আর কাশ্মীর বিরোধ নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত এটাই প্রকৃত বাস্তবতা।
মূলত, জম্মু-কাশ্মীরের পেহেলগামে ২২ এপ্রিল সন্ত্রাসী হামলায় ব্যাপক হতাহতের পর ৭ মে গভীর রাতে ভারত পাকিস্তানের অভ্যন্তরে ব্যাপক হামলা চালায়। তবে পাকিস্তানের তিনটি বিমানঘাঁটি লক্ষ্য করে ভারত ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালানোর পর দেশটির বিরুদ্ধে ‘অপারেশন বুনিয়ানুম মারসুস’ নামের অভিযান শুরু করে ইসলামাবাদ। তবে দু’দেশই দাবি করে যে, তারা বেশির ভাগ হামলা প্রতিহত করেছে। কিন্তু কিছু হামলায় ক্ষয়ক্ষতির কথাও স্বীকার করেছে উভয় পক্ষই। জানা গেছে, ভারত ‘অপারেশন সিঁদুর’ শুরু করার পর ৬০ জনের বেশি নিহত হওয়ার খবর বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। ভারতের দাবি, পাকিস্তান ও পাকিস্তাননিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরে অবস্থিত ‘সন্ত্রাসী ঘাঁটি’ লক্ষ্য করে এসব ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালানো হয়েছে। তবে নিয়ন্ত্রণরেখার ওপারে পাকিস্তানের অংশে হামলায় ১৩ জন নিহত হয়েছে বলে নিশ্চিত করেছে ইসলামাবাদ। পাল্টাপাল্টি হামলাকে কেন্দ্র করে দু’পারমাণবিক শক্তিধর প্রতিবেশীর মধ্যে পূর্ণমাত্রার যুদ্ধের আশঙ্কা দেখা দেয়। অতীতেও আন্তর্জাতিক মধ্যস্থতায় ভারত-পাকিস্তান সংকটের সমাধান হয়েছে ঠিকই, কিন্তু এবার এ যুদ্ধবিরতি স্থায়ী হবে কি না ও সাধারণ মানুষের মধ্যে স্বস্তি ফিরবে কি না, তা এখনো অনিশ্চিত।
অবশ্য যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় একটি সফল ও প্রত্যাশিত আলোচনার পর ভারত ও পাকিস্তান যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হয়েছে বলে ঘোষণা দেন ট্রাম্প। তিনি তাঁর মালিকানাধীন সামাজিক মাধ্যম ট্রুথ সোশ্যালে দেওয়া পোস্টে লেখেন, ‘আমি আনন্দের সঙ্গে ঘোষণা করছি, যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় রাতভর আলোচনার পর ভারত ও পাকিস্তান একটি পূর্ণাঙ্গ ও তাৎক্ষণিক যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হয়েছে।’ ট্রাম্প আরও লেখেন, ‘সাধারণ বুদ্ধিমত্তা ও অসাধারণ কূটনৈতিক প্রজ্ঞা ব্যবহার করার জন্য দু’দেশকেই অভিনন্দন। এ গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে মনোযোগ দেয়ার জন্য ধন্যবাদ!’
ট্রাম্প ট্রুথ সোশ্যালে পোস্ট দেয়ার কিছুক্ষণের মধ্যে পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসহাক দার ও ভারতের পররাষ্ট্রসচিব বিক্রম মিশ্রি আনুষ্ঠানিকভাবে যুদ্ধবিরতির বিষয়টি নিশ্চিত করেন। ‘যুদ্ধ’ শব্দটির কোনো আনুষ্ঠানিক, সর্বজনগ্রাহ্য সংজ্ঞা না থাকায় দেশগুলো চাইলে যুদ্ধ ঘোষণা না করেই দীর্ঘস্থায়ী সামরিক অভিযান চালাতে পারে। এ ধোঁয়াশার সুযোগে বিভিন্ন দেশের সরকার তাদের রাজনৈতিক বা কূটনৈতিক স্বার্থ অনুযায়ী সামরিক কর্মকাণ্ডের রূপরেখা তৈরি করতে পারে। ভারতের বিদেশ সচিব বিক্রম মিশ্রি এক সংক্ষিপ্ত বিবৃতিতে বলেন, ‘দু’দেশের মধ্যে এ সিদ্ধান্ত হয়েছে যে আজ (১০ মে) ভারতীয় সময় বিকেল পাঁচটা থেকে স্থল, আকাশ ও সমুদ্র-তিন ক্ষেত্রেই সব ধরনের লড়াই ও সামরিক কার্যক্রম বন্ধ থাকবে।’ বিবৃতিতে আরও বলা হয়, এ সমঝোতা কার্যকর করার জন্য দু’পক্ষকেই প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেয়া হয়েছে এবং দু’দেশের সামরিক কার্যক্রম পরিচালনাকারী মহাপরিচালকেরা আবারও ১২ মে কথা বলবেন। পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসহাক দার বলেছেন, এ সমঝোতার পর ভারত ও পাকিস্তান সামরিক যোগাযোগ চ্যানেল এবং হটলাইনগুলো সচল করেছে।
যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও জানান, ভারত ও পাকিস্তান একটি ‘নিরপেক্ষ স্থানে বিস্তৃত ইস্যুতে আলোচনা শুরু করতে’ সম্মত হয়েছে। ১৯৪৫ সালে জাতিসংঘ সনদ গৃহীত হওয়ার পর থেকে কোনো দেশই সাধারণত যুদ্ধ ঘোষণা করে না বা নিজেকে যুদ্ধরত বলে দাবি করে না। কারণ, আইনগতভাবে এটি অবৈধ শক্তি প্রয়োগ হিসেবে বিবেচিত হয়। তবে ভারতের তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয় সামাজিক মাধ্যমে দেয়া এক বিবৃতিতে এ দাবি আংশিকভাবে অস্বীকার করেছে। তারা বলেছে, ‘অন্য কোনো ইস্যুতে অন্য কোনো স্থানে আলোচনা করার কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি।’
এ বিষয়ে লন্ডনের এসওএএস বিশ্ববিদ্যালয়ের সাউথ এশিয়া ইনস্টিটিউটের পরিচালক সুবীর সিনহা আল-জাজিরাকে বলেন, ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে বিস্তৃত পরিসরে দ্বিপক্ষীয় আলোচনা শুরু করাটা অত্যন্ত চ্যালেঞ্জের। কারণ, ভারত আগেও এ ধরনের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছে। সুবীর সিনহা মনে করেন, পাকিস্তাননীতি নিয়ে মোদি সরকারের তথাকথিত ‘দৃঢ় অবস্থান’-এর অন্যতম একটি যুক্তি হলো-এখন আর আলোচনায় বসা এবং বিস্তৃত ও দীর্ঘমেয়াদি অঙ্গীকারের মাধ্যমে সমস্যা সমাধানের অঙ্গীকার করা সম্ভব নয়। এখন ভারত সরকার যদি এ অবস্থান থেকে সরে আসে। তবে দেশের ডানপন্থী গোষ্ঠী নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া দেখাতে পারে। এ গোষ্ঠী দীর্ঘদিন ধরে পাকিস্তানের ওপর সামরিক হামলা চালানোর আহ্বান জানিয়ে আসছে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, কোনো পরিস্থিতি যুদ্ধ বলে তখনই বিবেচ্য হবে, যখন লড়াই অত্যন্ত তীব্র আকার ধারণ করে এবং লড়াইয়ে ১ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়। কিন্তু সরকারের কাছে যুদ্ধ শুরু হয় তখন, যখন তারা তা ঘোষণা করে।
সিনহা মনে করেন, যুদ্ধ-পরবর্তী উত্তেজনা প্রশমনে দু’টি গুরুত্বপূর্ণ চুক্তি আবার সক্রিয় করতে হবে-একটি সিন্ধু পানিবণ্টন চুক্তি ও অপরটি সিমলা চুক্তি। সাম্প্রতিক উত্তেজনাকে কেন্দ্র করে ভারত পাকিস্তানের সঙ্গে হওয়া সিন্ধু পানিবণ্টন চুক্তি স্থগিত করে। আর সিমলা চুক্তি থেকে সরে আসার হুমকি দিয়েছে পাকিস্তান। সিনহার মতে, এ দু’টি চুক্তি পুরোপুরি সচল করা ও সেগুলো ভবিষ্যৎ আলোচনার ভিত্তি হিসেবে বিবেচনা করা দরকার।
অবশ্য উভয় দেশের মধ্যে ব্যাপক মাত্রায় সংঘাত, ক্ষেপণাস্ত্র হামলা, ড্রোন হামলা ও গোলাবিনিময়ের ঘটনা ঘটলেও কোনো পক্ষ আনুষ্ঠানিকভাবে যুদ্ধ ঘোষণা করেনি। ভারত ও পাকিস্তান তাদের সামরিক কর্মকাণ্ডকে সুনির্দিষ্ট ও সমন্বিত ‘সামরিক অভিযান’ হিসেবে উল্লেখ করেছে। পাকিস্তান ১০ মে ভারতের বিরুদ্ধে ‘বুনিয়ানুম মারসুস’ নামে অভিযান চালিয়েছিল। আরবি ভাষার শব্দগুচ্ছ বুনইয়ান-উন-মারসুস-এর অর্থ ‘সুদৃঢ় প্রাচীর’। কয়েক দিন আগে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ‘অপারেশন সিঁদুর’ শুরু করেছিল ভারত। পেহেলগামে হামলার ঘটনায় পাকিস্তানভিত্তিক সশস্ত্র গোষ্ঠীকে দায়ী করেছে ভারত। তবে ভারত ও পাকিস্তানের জন্য এ ধরনের পরিস্থিতি নতুন কিছু নয়। অতীতের সংঘাতগুলোর দিকে খেয়াল করলে দেখা যায়, বড় সংঘর্ষে বিপুলসংখ্যক সেনা ও নিরীহ বেসামরিক লোকজন নিহত হওয়ার পরও এ দু’দেশ আনুষ্ঠানিকভাবে যুদ্ধ ঘোষণা করেনি।
স্বাধীনতা লাভের পর উভয় দেশই কাশ্মীরসহ নানা ইস্যুতে সংঘাতের মুখোমুখি হয়েছে। ১৯৪৭ সালে দেশভাগ এবং ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে প্রথম যুদ্ধের পর থেকে তৃতীয় পক্ষের মধ্যস্থতায় একাধিকবার তাদের মধ্যকার বিরোধের সমাধান হয়েছে। কাশ্মীরের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে দু’দেশের মধ্যে যুদ্ধ সংঘটিত হওয়ার পর ১৯৪৮ সালে জাতিসংঘের মধ্যস্থতায় ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধবিরতি হয়। কার্যত তখন থেকে কাশ্মীর ভারতনিয়ন্ত্রিত ও পাকিস্তাননিয়ন্ত্রিত অংশে ভাগ হয়ে পড়ে। ১৯৬৫ সালে ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে শুরু হওয়া যুদ্ধ ১৯৬৬ সালের জানুয়ারিতে তাসখন্দ চুক্তির মাধ্যমে শেষ হয়। এতে মধ্যস্থতা করেছিল সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন।
এ চুক্তির কারণে তৎকালীন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী লাল বাহাদুর শাস্ত্রী ও পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান যুদ্ধপূর্ববর্তী অবস্থানে ফিরে যাওয়ার এবং কূটনৈতিক ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক পুনঃস্থাপন করার বিষয়ে একমত হয়েছিলেন। ১৯৯৯ সালে কারগিল যুদ্ধ চলাকালে পাকিস্তানী সৈন্যরা নিয়ন্ত্রণরেখা পার হয়ে ভারতীয় অংশে ঢুকে পড়েন। এ উত্তেজনাকর পরিস্থিতির মধ্যে তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফকে আন্তর্জাতিকভাবে একঘরে করে দেওয়ার হুমকি দিয়ে সেনা প্রত্যাহারে রাজি করান। ২০০২ সালে তৎকালীন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী কলিন পাওয়েল দাবি করেন, ২০০১ সালের ডিসেম্বরে ভারতের পার্লামেন্টে হামলার পর নিয়ন্ত্রণরেখা বরাবর তৈরি হওয়া উত্তেজনা অবসানে তিনি ও তাঁর দল মধ্যস্থতা করে। পরের বছরের জুনে কলিন পাওয়েল বলেন, তিনি আলোচনার মাধ্যমে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট পারভেজ মোশাররফের কাছ থেকে কিছু আশ্বাস পেয়েছিলেন। আশ্বাসগুলো হলো নিয়ন্ত্রণরেখায় অনুপ্রবেশমূলক কার্যকলাপ বন্ধ করা হবে এবং পাকিস্তানের ভূখণ্ডে অবস্থানরত সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোকে নির্মূল করা হবে।
মূলত, পাকিস্তানের পাল্টা প্রত্যাঘাতের পর মার্কিন মধ্যস্থতায় উভয় দেশই সাময়িক যুদ্ধ বিরতিতে রাজি হয়েছে। ভারত ‘অপারেশন সিঁদুর’-এর মাধ্যমে পাকিস্তানের ভেতরে নয়টি বেসামরিক স্থানে হামলা চালিয়েছে বলে দাবি করা হয়েছে। রাফাল বিমান থেকে ছোঁড়া হয় দূরপাল্লার ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র ও নির্ভুল গ্লাউড বোমা। এরপর ৭ থেকে ১০ মে পর্যন্ত ভারত বিভিন্ন ড্রোন ব্যবহার করে। এগুলো শুধু লক্ষ্যবস্তুতে আঘাতই করেনি বরং রাডার এবং ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিক্রিয়াও বিশ্লেষণ করেছে। এ সময় পাকিস্তান পাল্টা সামরিক জবাব দিয়েছে। তাদের বিমান বাহিনী, সেনাবাহিনী ও ক্ষেপণাস্ত্র ইউনিট একযোগে কাজ করেছে। পাকিস্তান প্রধান যুদ্ধবিমান হিসেবে চীনের তৈরি জে-১০ বিমান ব্যবহার করেছে। দেশটি প্রথমবারের মতো তিনটি রাফাল যুদ্ধবিমান ধ্বংস করার দাবি করেছে। একইসাথে পাকিস্তান দাবি করে, তারা ৭৫টি ভারতীয় ড্রোন ভূপাতিত করেছে।
হামলা-পাল্টা হামলায় ভারত শুধু সামরিকভাবেই ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি বরং সংঘাতকালীন ৮৭ ঘণ্টায় ভারতের শেয়ারবাজারে বড় ধরনের ধস মেমেছে। উত্তর ভারতের আকাশসীমা বন্ধ থাকায় প্রতিদিন আট মিলিয়ন ডলারের ক্ষতি হয়েছে। ক্রিকেট লিগ বন্ধ হওয়ায় আরো পঞ্চাশ মিলিয়ন ডলার ক্ষতি হয়। যুদ্ধ পরিচালনায় খরচ হয় ১০০ মিলিয়ন ডলার। যুদ্ধবিমান হারিয়ে ক্ষতি হয় ৪০০ মিলিয়ন ডলার। কার্গো ও পণ্য পরিবহন ব্যাহত হয়ে ক্ষতি হয় দু’ বিলিয়ন ডলার। সব মিলিয়ে ভারতের ক্ষতি দাঁড়ায় ৮৩ বিলিয়ন ডলার। এ সময়ে পাকিস্তানের প্রধান শেয়ার সূচক ৪ দশমিক ১ শতাংশ কমে যায়। বাজার মূলধন কমে যায় দু’দশমিক পাঁচ বিলিয়ন ডলার। ক্রিকেট লিগ বন্ধ হয়ে ১০ মিলিয়ন ডলারের ক্ষতি হয়। আকাশসীমা বন্ধ থাকায় বিমান চলাচলে ক্ষতি হয় ২০ মিলিয়ন ডলার। সামরিক খরচ ছিল প্রতিদিন ২৫ মিলিয়ন ডলার। ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র অভিযানেই খরচ হয় ৩০ কোটি ডলার। বিনিয়োগকারীদের আস্থা কমে যায়। বিদেশী বিনিয়োগে প্রভাব পড়ে। পাকিস্তানের মোট ক্ষতি দাঁড়ায় প্রায় ৪ বিলিয়ন ডলার।
যুদ্ধবিরতি নিয়ে ভারত বিভ্রান্তিকর তথ্য প্রচার করলেও চুলচেরা বিশ্লেষণে এসবের সারবত্তা মেলেনি। কারণ, যুদ্ধবিরতি চুক্তি নিয়ে নতুন তথ্য সামনে এনেছে মার্কিন সংবাদমাধ্যম সিএনএন। ট্রাম্প প্রশাসনের একাধিক কর্মকর্তার সূত্রে সংবাদমাধ্যমটি তাদের প্রতিবেদনে জানিয়েছে, ভারত-পাকিস্তান সীমান্তে উত্তেজনা বৃদ্ধির প্রেক্ষাপটে উদ্বেগজনক গোয়েন্দা তথ্য পাওয়ার পরই ভ্যান্স ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে ফোন করে পাকিস্তানের সাথে যুদ্ধবিরতি আলোচনা শুরুর আহ্বান জানান। মার্কিন প্রশাসনের একটি কেন্দ্রীয় দল ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে চলমান সংঘাত ঘনিষ্ঠভাবে পর্যবেক্ষণ করছিল। ওই দলে ভ্যান্স, রুবিও ও হোয়াইট হাউসের চিফ অফ স্টাফ সুজি ওয়াইলসের মতো শীর্ষ মার্কিন কর্মকর্তারা ছিলেন।
সংবেদনশীলতার কারণে কি জাতীয় তথ্য পেয়েছিলেন তা জানাতে অস্বীকৃতি জানালেও সূত্রগুলো জানিয়েছে, তথ্যের প্রকৃতি এতোটাই গুরুত্বপূর্ণ ও ভয়াবহ ছিল যে, ওই তিন কর্মকর্তা যুক্তরাষ্ট্রের এ বিষয়ে সম্পৃক্ততা বাড়ানো উচিত বলে মনে করেন। ফলে নিজে থেকেই মোদিকে ফোন করেন ভ্যান্স। সিএনএন বলেছে, ওই তথ্যের ভিত্তিতে ভ্যান্স প্রথমে ট্রাম্পকে পুরো পরিকল্পনার ব্যাপারে অবহিত করেন। এরপরই যুক্তরাষ্ট্রের স্থানীয় সময় ৯ মে দুপুরে সরাসরি মোদিকে ফোন করেন। মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট মোদির কাছে স্পষ্ট করে বলেন, হোয়াইট হাউস মনে করে এ সংঘাত আরো ভয়াবহ রূপ নিতে পারে এবং সপ্তাহের শেষে বড় ধরনের সংঘর্ষ হতে পারে। যা ভারতের জন্য মোটেই স্বস্তিদায়ক হবে না। ভ্যান্স এ সময় মোদিকে উৎসাহ দেন যেন পাকিস্তানের সাথে সরাসরি যোগাযোগ করে ভারত এবং উত্তেজনা কমানোর বিভিন্ন পথ বিবেচনা করে। সূত্র জানায়, ভ্যান্স এ সময় মোদিকে এমন একটি শান্তিপূর্ণ বিকল্পের কথাও জানান, যেটি পাকিস্তান গ্রহণ করতে পারে বলে যুক্তরাষ্ট্রের ধারণা ছিল। তবে কূটনৈতিক পর্যবেক্ষক মহলের ধারণা ভারতই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছে প্রথম যুদ্ধবিরতির প্রস্তাবে পাকিস্তানকে রাজি করানোর প্রস্তাব দিয়েছিলো। যা ভারতীয়দের বক্তব্য থেকে অনেকটাই প্রমাণিত।
মূলত পেহেলগামে সন্ত্রাসী হামলার পর ভারত কোন প্রকার তথ্য-প্রমাণ বা তদন্ত ছাড়াই এজন্য পাকিস্তানকে দায়ী করেছিলো। কিন্তু পাকিস্তান এ দায় সরাসরি অস্বীকার করে এজন্য আন্তর্জাতিক তদন্তের দাবি করেছিলো। কিন্তু ভারত সে আইনসিদ্ধ ও স্বাভাবিক পথে অগ্রসর না হয়ে এজন্য অস্ত্রের ভাষায় শক্তি প্রদর্শন করে পাকিস্তানকে কোনঠাসা ও আসন্ন রাজ্যসভা নির্বাচনগুলোকে জনমত নিজেদের পক্ষে নেয়ার জন্য যুদ্ধ বাধানোর গর্হিত পথকে বেছে নিয়েছিলো। একই সাথে ছিলো সাম্প্রদায়িক উস্কানিও। কিন্তু মোদি এ জুয়া খেলায় রীতিমত পরাস্ত হয়েছেন বলেই মনে হচ্ছে। ভারত শক্তি দেখাতে গিয়ে নিজেদের সম্ভ্রমকেই উন্মুক্ত করে দিয়েছে। পাকিস্তানও নিজেদের শক্তি-সামর্থ্য পরখ করে নেয়ার সুযোগ পেয়েছে। চীনও তাদের নির্মিত সমরাস্ত্রের সফল পরীক্ষা চালাতে সক্ষম হয়েছে। গায়ে পড়ে যুদ্ধ বাধানো ও যুদ্ধে পরাজয়ের জন্য পুরো ভারতই এখন মোদি বিরোধী স্লোগানে উত্তাল। যা দেশটিতে মধ্যবর্তী নির্বাচনের জোরালো সম্ভবনা সৃষ্টি করেছে।
মূলত, রাজা হরিসিং-এর বিশ্বাসঘাতকতার কারণে ভূ-স্বর্গ কাশ্মীর ভারতভুক্ত হয়েছে। কিন্তু এ ভূমির মালিকানা নিয়ে পাক-ভারত বারবার যুদ্ধের মুখোমুখি হয়েছে। জড়িয়ে পড়েছে রক্ষক্ষয়ী যুদ্ধে। কাশ্মীরে স্বাধীনতা সংগ্রামও জোরদার হয়েছে। কিন্তু ভারতীয় বাহিনী পোড়ামাটিনীতি গ্রহণ করেছে। কাশ্মীরিদের স্বাধীনতা সংগ্রাম ঠেকানোর জন্য ভারতীয় কর্তৃপক্ষ ঠুনকো অজুহাতে ২০১৯ সালে কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা সম্বলিত ভারতীয় সংবিধানের ৩৭০ অনুচ্ছেদ বাতিল করে দিয়েছে। কিন্তু এতে পরিস্থিতির উন্নতি না হয়ে বরং বড় ধরনের অবনতিই হয়েছে। কাশ্মীরের বিরোধ, উভয় পক্ষ বার বার যুদ্ধে লিপ্ত এবং তাসখন্দ ও শিমলার মত বড় চুক্তি হওয়ার পরও সমস্যার কোন সমাধান হয়নি। এমতাবস্থায় ১৯৪৮ সালের ১৩ আগস্ট জাতিসংঘ গৃহীত ৪৭ নং প্রস্তাব অনুযায়ী কাশ্মীরিদের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকারের প্রশ্নে গণভোটই প্রকৃত সমাধান। বিশ্বের শান্তিপ্রিয় মানুষ আশা করে উভয় পক্ষই এ ক্ষেত্রে ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গী প্রদর্শন করবে এবং একটি শান্তিপূর্ণ সমাধানের পথে অগ্রসর হবে।