মুহাম্মদ আনোয়ার শাহাদাত
জুলাই ’২৪ ছাত্র-জনতার ঐতিহাসিক গণঅভ্যুত্থানে আওয়ামী দুঃশাসনের যবনিকাপাত বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের মনে একটি বৈষম্যহীন ও ন্যায়বিচারভিত্তিক রাষ্ট্রব্যবস্থা গড়ে তোলার স্বপ্ন জাগিয়ে তুলেছে। ষোল বছরের পুঞ্জীভূত জুলুম-নির্যাতন, লাঞ্ছনা-বঞ্চনার অবসান ঘটিয়ে অত্যাচারী, জুলুমবাজ সরকারকে হটিয়ে শঙ্কাহীন ও নিরাপদ একটি সুন্দর দেশের স্বপ্নকে বাস্তবে রূপদানের লক্ষ্যে গঠিত হয় অন্তর্বর্তী সরকার। অভ্যুত্থানের পর নতুন দিনের যাত্রা শুরু হলেও গন্তব্য কোথায় বা কীভাবে পৌঁছানো যাবে তার দিকনির্দেশনা কিন্তু এতটা পরিষ্কার নয়। শোষণ-বঞ্চনা আর বৈষম্যহীন একটি বাংলাদেশ গড়ে তোলার স্বপ্ন কতটুকু সফলতা পাবে তা নির্ভর করবে আমাদের রাজনৈতিক নেতৃত্বের নৈতিকতা কতটুকু পরিবর্তন হয়েছে তার উপর। কারণ সরকার পরিবর্তনের পাশাপাশি যারা যখন সরকার চালাবে সে মানুষগুলো যদি ব্যক্তিগতভাবে সৎ, নিষ্ঠাবান আর দেশদরদী না হয় তাহলে যে লাউ সে কদু থেকে যাবে! মানুষ ভেবেছিল বাংলাদেশের আকাশ থেকে ’আওয়ামীমেঘ’ কেটে গেছে এবার ভোরের আলো আসবেই। কিন্তু ভোর হলেও প্রত্যাশিত আলো এখনও অনেক দূর। এতদিন যারা ক্ষমতার বাইরে ছিল তারা এখন ক্ষমতায় আসার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে। সময়ের অপেক্ষা কখন ক্ষমতার স্বাদ আস্বাদন করবে! নিজেদের নেতা-কর্মীদের যথাযথ নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারছে না। ফলে শুরু হয়েছে বিশৃঙ্খলা এবং চাঁদাবাজি। হাট-বাজার, গ্রাম-শহর, সড়ক-মহাসড়কে চলছে চাঁদাবাজি আর দখলদারিত্ব। চারদিকে এক নৈরাজ্যজনক পরিস্থিতিতে সাধারণ মানুষ অতিষ্ঠ।
জুলাই গণঅভ্যুত্থানের মূল লক্ষ্য ছিল বৈষম্যহীন একটি সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা এবং ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ। কিন্তু সরকার পতনের পর সৃষ্ট শূন্যতা পূরণে অন্তর্বর্তী সরকারের অনভিজ্ঞতা, সঠিক দিক নির্দেশনার অভাব, প্রাশাসনিক চেইন অব কমান্ড ভেঙ্গে পড়া এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষার ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলগুলোর অসহযোগিতার ফলে অপরাধ দমন ও জনগণের উপযুক্ত নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারছে না। বড় বড় রাজনৈতিক দলগুলোর নেতা-কর্মীরা ক্ষমতায় আসার আগেই নিজেদের ক্ষমতার অংশীদার মনে করে স্ব-স্ব এলাকায় প্রভাব বিস্তার করছে এবং বিভিন্ন ধরনের অপরাধমূলক কর্মকান্ড করে যাচ্ছে। পরাজিত সৈরশাসকদের মতো চাঁদাবাজি ও দখল বাণিজ্যে মেতে উঠেছে প্রধান প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো। যা সত্যিকার অর্থে দেশের মানুষকে আশাহত করছে এবং আগামীর বাংলাদেশ নিয়ে আশঙ্কায় ভুগছে। দেশের নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলগুলোর এ এক বছরের কার্যক্রমে সাধারণ মানুষ খুবই হতাশ। বড় রাজনৈতিক নেতাদের কাছ থেকে কোন ধরনের সুশীল আচরণ কিংবা দেশপ্রেমের ছিটেফোঁটা দেখা যাচ্ছে না। সবাই ভোগের রাজনীতিতে মত্ত। দেশ ও জাতির সেবায় আত্মোৎসর্গ করার মতো মানসিকতা সম্পন্ন রাজনীতিক দেশে তেমন নেই বললেই চলে। আগামী ফেব্রুয়ারি’২০২৬ নির্বাচনের ঘোষণা দিয়েছে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার। এ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে কীনা বা হলেও কোন পদ্ধতিতে হবে এবং একটি নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন হবে কীনা তা নিয়ে মানুষ যথেষ্ট সন্দিহান।
রাজনৈতিক নেতারা সভা-সেমিনারে দেশপ্রেম আর জনকল্যাণের বুলি উড়ালেও প্রকৃতপক্ষে ক্ষমতার জন্য তারা মরিয়া। অথচ রাজনীতিবিদদের অন্তরে পবিত্রতার মহাভাব জাগ্রত করে দেশ ও জনগণের সেবার মহান ব্রত নিয়ে এগিয়ে আসা উচিত ছিল। বাংলাদেশের রাজনীতি এমনিতেই প্রচারসর্বস্ব দলীয় রাজনীতি। তাই সাধারণ মানুষের বোধগম্য হয়ও কম। সে কারণে জনগণও নির্বাচনের সময় সিদ্ধান্তহীনতায় ভোগে। জুলাই গণঅভ্যুত্থানের চেতনাকে যদি আমাদের রাজনীতিবিদরা হৃদয়ে ধারণ না করে যেনতেনভাবে রাষ্ট্র পরিচালনা করা বা যে কোনভাবে ক্ষমতার অংশীদারিত্বকে প্রাধান্য দেয় তাহলে ভবিষ্যতে এই সমস্ত রাজনৈতিক দল ও নেতাদের অবস্থা তেমন ভালো হবে না। দেশের সাধারণ মানুষ এবং তরুণ প্রজন্মের ভাষা বুঝতে হবে রাজনীতিবিদদের। সময় এসেছে দেশকে গড়ে তোলার। এ সুযোগ যদি কোন কারণে ব্যাহত হয় তাহলে চরম রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংকটে নিপতিত হতে পারে প্রিয় বাংলাদেশ। ইতিহাস আমাদেরকে জানিয়ে দেয়-আন্দোলন-সংগ্রামের সুফল মীরজাফর চরিত্রের রাজনীতিকরা জনগণকে ভোগ করতে দেয় না।
প্রায় প্রতিটি গণআন্দোলনের ফসল ব্যক্তি, গোষ্ঠী কিংবা দলগত স্বার্থে ব্যবহার করা হয়েছে। গণতন্ত্রের নামে সেচ্ছাচারিতা আর দমন-নিপীড়নের মাধ্যমে ভোগ বিলাসের রাজনীতিতে মত্ত ছিল বেশির ভাগ রাজনীতিক। জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পর দেশের সকল রাজনৈতিক দল মিলে যেখানে দেশ গঠনের কাজে আত্মনিয়োগ করার কথা সেখানে কাঁদা ছুড়াছুড়ি আর ক্ষমতাকে কে কীভাবে করায়ত্ত করতে পারে তার কূটকৌশল নিয়ে ব্যস্ত প্রায় সকল রাজনৈতিক দল এবং দলের নেতারা। অথচ এ সুবর্ণ সুযোগে আমরা চাইলে বিগত ১৬ বছরের নয়, ৫৩ বছরের জঞ্জাল দূর করে একটি পরিচ্ছন্ন রাষ্ট্র উপহার দিতে পারি। অথচ আমরা এখনও পরে আছি দলপ্রেমের রাজনীতিক বলয়ে, দেশপ্রেমের রাজনীতিতে আমরা নিজেকে এখনও সমর্পণ করতে পারিনি। সুশাসন, ন্যায়বিচার, বাকস্বাধীনতা, মানবাধিকার ও অর্থনৈতিক মুক্তির লক্ষ্যে কাজ করে যেতে হবে রাজনৈতিক দলগুলোকে। দেশের স্বার্থে দলীয় স্বার্থকে পরিত্যাগ করে একই মঞ্চে আসতে হবে। রাষ্ট্রের এমন কিছু বিষয় আছে যেখানে সকল রাজনৈতিক দলকে দেশের স্বার্থে একীভূত হয়ে কাজ করতে হবে। বিরোধিতার স্বার্থে বিরোধিতার এই সংস্কৃতি যেন সকল পর্যায়ে না দেখায় সেটি আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতি হওয়া উচিত। দেশপ্রেমিক ও নৈতিকতাসম্পন্ন রাজনৈতিক নেতৃত্বের অভাবে একটি সফল অভ্যুত্থানের এক বছরের মাথায় অভ্যুত্থানে অংশ নেয়া রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বিভেদ আর কাঁদা ছুড়াছুড়ি চরম পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। গণঅভ্যুত্থানের সময় যে রাজনৈতিক ঐক্য গড়ে উঠেছিল তা আজ ফিকে হয়ে গেছে। আমাদের মধ্যে যদি ক্ষমতার লোভ আর ভোগবাদি চিন্তা না থাকতো তাহলে এই অবস্থা হতো না। রাজনৈতিক দলগুলোর পরস্পর বিরোধ-বৈরিতার প্রতিযোগিতায় দেশের অকল্যাণ ছাড়া কোন কল্যাণ বয়ে আনবে না।
জনগণ আশা করছে রাজনীতিবিদরা জনকল্যাণে কাজ করবে এবং সাধারণ মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার ব্যবস্থা করবে। আধিপত্যবাদ, পরিবারতন্ত্র এবং অবৈধ পথে ক্ষমতায় আসার পথকে স্থায়ীভাবে রুদ্ধ করে রাজনীতিতে আমূল পরিবর্তন নিয়ে আসা খুবই জরুরি। রাজনৈতিক দলগুলোর অভ্যন্তরে গণতন্ত্রের চর্চা, রাজনীতিবিদদের নীতি-আদর্শের পরিবর্তন এবং দেশপ্রেম ও জনকল্যাণে ব্রতী না হলে রাজনীতিক বা রাজনৈতিক দলগুলো কখনো সাধারণের কাছে আস্থাভাজন হয়ে উঠবে না।
লেখক : প্রবাসী প্রাবন্ধিক, সৌদি আরব।