দু’বছর ধরে চলার পর গাজায় যুদ্ধ অবসানে বিশ্বব্যাপী তো বটেই বাংলাদেশসহ মুসলিম বিশ্বে একটি স্বস্তির ভাব এসেছিল। যুদ্ধ বলা হলেও তা ছিল কার্যত ইসরাইলীদের হাতে নির্বিচারে মানুষ হত্যা, বিশেষত গাজবাসী ও নারী শিশুকে নির্বিচারে হত্যা। আধুনিক ইতিহাসে যার কোন নজির নেই। বিশ্বের বড় মোড়ল দাবিদার আমেরিকার প্রেসিডেন্ট অবশেষে বিশ্ব জনমতের চাপে ২০ দফা শান্তি চুক্তির মাধ্যমে গত ১০ অক্টোবর এ যুদ্ধের আপাত অবসান ঘটাতে সক্ষম হন। এ জন্য তিনি নোবেল শান্তি পুরস্কারেও দাবিদার ছিলেন। যাহোক যুদ্ধ বা হামলা যা বলি না কেন তা থামার ফলে কিছুটা শান্তির বাতাস বয়ে আসছিল। গাজা চুক্তির সময় কিন্তু কোন কোন বিশ্লেষক বলেছিলেন ঘটনার এখানেই শেষ ভাবা মোটেই বুদ্ধিমানের কাজ নয়। এ বিষয়ে আরো পরিস্কার করে বললে যুদ্ধ বিরতির বিষয়ে ইসরাইলের ট্র্যাক রেকর্ড মোটেই ভাল নয়।

গত মার্চেও তারা যুদ্ধ বিরতি থেকে ফিরে আসে। হা, যা আশংকা করা হয়েছিল এবারও তাই হয়েছে। গাজায় ইসরাইলী হামলা এখনো চলমান। ক্ষুধার্ত গাজাবাসীর জন্য ত্রাণ সাহায্যও অপ্রতুল। শান্তি চুক্তি হলো, ইসরাইলী জিম্মিরা মুক্তি পেল কিন্তু গাজাবাসী ধ্বংসের হাত থেকে মুক্তি পেল না। সর্বশেষ খবরে জানা যাচ্ছে, ফিলিস্তিনের অবরুদ্ধ গাজায় বিমান হামলা ও গুলিবর্ষণ অব্যাহত রেখেছে ইসরাইল। ফলে হামাসের সাথে ভঙ্গুর যুদ্ধবিরতি চুক্তির ভবিষ্যৎ নিয়ে আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।

কমছে না ইসরাইলী হানা : গাজার কর্মকর্তাদের মতে, ১০ অক্টোবর যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় একটি ভঙ্গুর যুদ্ধবিরতি শুরু হওয়ার পর থেকে বেশ কয়েকটি হামলার ঘটনা ঘটেছে। এতে কমপক্ষে ৯৭ জন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। শান্তি চুক্তির পরও ৯৭ জন লোকের মৃত্যু মানতে পারছেন না অনেকেই। শুধু হামলা নয় ধরপাকড় চলমান, নিজেদের জমিতে চাষ করতে পারছে না গাজাবাসী। “যা আশংকা করা হয়েছিল তাই হয়েছে। গাজায় ইসরাইলী হামলা চলমান। ক্ষুধার্ত গাজাবাসীর জন্য ত্রাণ সাহায্যও অপ্রতুল। শান্তি চুক্তি হলো, ইসরাইলী জিম্মিরা মুক্তি পেল, গাজাবাসী ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা পেল না। ”

এদিকে, ইসরাইল ও হামাস ১০ অক্টোবর থেকে কার্যকর হওয়া যুদ্ধবিরতি চুক্তি ভঙ্গের জন্য একে অপরের দিকে আঙুল তুলেছে। স্থানীয় স্বাস্থ্য কর্মকর্তাদের মতে, রোববার ইসরাইলী বিমান হামলায় শিশুসহ ৪২ জন নিহত হয়েছে। ইসরাইল জানিয়েছে, হামাস যোদ্ধাদের যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘনের প্রতিশোধ হিসেবে এ হামলা চালানো হয়েছে। স্পষ্টত এটা হামলার অজুহাত মাত্র, বাস্তবতা মোটেই নয় বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা।

গাজায় স্থানীয় কর্তৃপক্ষের হিসাবে, ১০ অক্টোবর যুদ্ধবিরতি শুরুর পর থেকে ১১ দিনে উপত্যকাটিতে অন্তত ৯৭ জনকে হত্যা করেছে ইসরাইল। এরপরও মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেছেন, যুদ্ধবিরতি টিকে আছে। গাজায় গণমাধ্যম দপ্তর থেকে সোমবার প্রকাশিত বিবৃতিতে বলা হয়, যুদ্ধবিরতি চলাকালে এ হত্যাকাণ্ডসহ ৮০ বার যুদ্ধবিরতির চুক্তি লঙ্ঘন করেছে ইসরাইল। এ লঙ্ঘনের মধ্যে রয়েছে গাজাবাসীর ওপর সরাসরি গুলি, কামান ও ট্যাংক থেকে গোলাবর্ষণ এবং আকাশপথে হামলা। একই সময়ে গাজার অনেক বাসিন্দাকে গ্রেপ্তার করেছে ইসরাইলী বাহিনী। তারা নিজ বাড়ি ঘরে প্রবেশ করতে পারছে না। নাবলুসের দক্ষিণে খিরবেত ইয়ানুন-এ জলপাই চাষের জন্য ফিলিস্তিনি কৃষকদের তাদের জমিতে প্রবেশ করতে বাধা দিয়েছে ইসরায়েলি বাহিনী। বুধবার সকালে কমপক্ষে ২২ জন ফিলিস্তিনিকে আটক করেছে। ওয়াফা জানিয়েছে, হেবরন গভর্নরেটের ওপার থেকে তারা এক শিশুসহ ১৬ জনকে আটক করেছে, আর নাবলুস এবং নিকটবর্তী বালাতা ক্যাম্পে আরও পাঁচজনকে আটক করেছে। পূর্ব জেরুজালেমের ফিলিস্তিনি এলাকা বেইত হানিনায় ইসরায়েলি বাহিনী মোটরসাইকেল আরোহী দুই ব্যক্তিকে লাঞ্ছিত করেছে এবং তাদের একজনকে গ্রেপ্তার করেছে।

জানা যায়, রোববার গাজার রাফায় ফিলিস্তিনি যোদ্ধাদের হামলায় দু’ইসরাইলী সেনা নিহত হন। এর জেরে গাজায় হামাসের বিভিন্ন লক্ষ্যস্থলে ব্যাপক বিমান হামলা চালায় ইসরাইল। গাজায় ত্রাণ সরবরাহ বন্ধ রাখার ঘোষণা দেয় ইসরাইল। এসব সহিংসতা ও পদক্ষেপে গাজা যুদ্ধবিরতি ভেঙে পড়ার উপক্রম হয়। এসব ঘটনার প্রেক্ষিতে বিরাজমান যুদ্ধবিরতি ধরে রাখতে সক্রিয় হয় উদ্বিগ্ন ট্রাম্প প্রশাসন। তাদের চাপে ইসরাইল গাজায় ফের ত্রাণ সরবরাহ শুরু করার প্রস্তুতি নেয় বলে রয়টার্সকে জানিয়েছেন ইসরায়েলি নিরাপত্তা বাহিনীর নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা। রয়টার্স লিখেছে, যুদ্ধবিরতির প্রথম পর্ব বারবার সহিংসতার ঝলকানিতে নড়বড়ে হয়ে উঠছে। সোমবারও গাজায় সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে। এ অবস্থায় গাজা যুদ্ধ শেষ করার প্রক্রিয়া বজায় রাখার জন্য যুক্তরাষ্ট্র হামাস ও ইসরায়েলের ওপর চাপ ধরে রাখতে পারবে কি না, তা পরিষ্কার হয়নি।

গাজায় দীর্ঘ প্রতীক্ষিত যুদ্ধবিরতি সত্ত্বেও সাম্প্রতিক সহিংসতার ঘটনাগুলো ইঙ্গিত দিচ্ছে সেখানে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠা সহজ হবে না। গাজায় এক সপ্তাহ ধরে চলা যুদ্ধবিরতি সহিংসতার কারণে নড়বড়ে হয়ে পড়ার পর প্রেসিডেন্ট ডুনাল্ড ট্রাম্পের শান্তি পরিকল্পনার বাস্তবায়ন জারি রাখতে কূটনৈতিক পদক্ষেপ নিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। জানা যাচ্ছে, ইসরাইল ও হামাসকে যুদ্ধবিরতিতে ধরে রাখার লক্ষ্যে জোর তৎপরতা চালাচ্ছেন মার্কিন কূটনীতিকরা। এ লক্ষ্যে সোমবার ইসরাইলী প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর সঙ্গে দেখা করেছেন মার্কিন দূত স্টিভ উইটকফ ও ট্রাম্পের জামাতা জ্যারেড কুশনার। মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভ্যান্স বলেছেন যে ইসরায়েলের যুদ্ধবিরতি ‘প্রত্যাশার চেয়েও ভালোভাবে চলছে’। জেডি ভ্যান্স বিশেষ দূত স্টিভ উইটকফ এবং জ্যেষ্ঠ উপদেষ্টা জ্যারেড কুশনারের সাথে ইসরাইল সফরে আছেন। ডেডি ভান্সের সফরে কি কি পরিবর্তন আসে তা এখন দেখার পালা। তিনি বলেছেন হোয়াইট হাউস গাজা যুদ্ধবিরতি চুক্তিকে দৃঢ় করতে আগ্রহী, যা এই মাসের শুরুতে ডোনাল্ড ট্রাম্পের মধ্যস্থতায় হয়েছিল।

ইসরাইলকে বিশ্বাস করে না অনেক দেশ। তাদের মধ্যে আছে ইউরোপীয় ্ইউি নয়নভুক্ত দেশগুলো। জানা যাচ্ছে, সে কারণে গাজা যুদ্ধবিরতির পরও ইসরাইলের ওপর নিষেধাজ্ঞার কথা ভাবছে ইইউ। ইসরাইল আশা করছে, গাজা যুদ্ধবিরতিতে রাজি হওয়ায় এর পুরস্কার হিসেবে দেশটির ওপর বিদ্যমান আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞগুলো তুলে নেওয়া হোক। গাজায় ইসরাইল যে গণহত্যা চালিয়েছে এর কোনো বিচার করা যাবে না। কিন্তু, ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) পররাষ্ট্রনীতি বিষয়ক বিভাগের প্রধান কাজা কালাস চান ইসরাইল যাতে গাজা যুদ্ধবিরতি পুরোপুরি মেনে চলে তা নিশ্চিত করতে গণহত্যাকারী দেশটির বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা চালিয়ে যাওয়া দরকার। সোমবার বার্তা সংস্থা এএফপির প্রতিবেদনে বলা হয়, ইসরাইলের ওপর নিষেধাজ্ঞা চালিয়ে যাওয়ার বিষয়টি ইইউ বিবেচনায় রাখতে চায়। ব্রাসেলসে ইইউ পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের বৈঠকে কাজা কালাস বলেন, ‘যুদ্ধবিরতির ফলে পরিস্থিতি বদলেছে। এটা সবার কাছে পরিষ্কার। তবে গাজায় পর্যাপ্ত ত্রাণ পাঠানোসহ বাস্তবিক পরিবর্তন যতক্ষণ না আসছে ততক্ষণ পর্যন্ত নিষেধাজ্ঞার বিষয়টি আলোচনায় থাকবে।’

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের নির্দেশে ইসরাইল গাজা যুদ্ধবিরতিতে রাজি হওয়ার আগে ইইউ ইসরাইলী মন্ত্রীদের কালো তালিকাভুক্ত ও দেশটির সঙ্গে বাণিজ্য কমানোর প্রস্তাব দিয়েছিল। কাজা কালাসের ভাষ্য, ‘আমরা এখনো এগুলো কার্যকর করিনি। সেগুলোকে আলোচনার টেবিল থেকে সরিয়েও দিইনি। কেননা, পরিস্থিতি এখনো নাজুক।’ তিনি আরও বলেন, ইইউ চায় গাজায় মানবিক ত্রাণ সরবরাহ ব্যবস্থার উন্নতি হোক। ফিলিস্তিনিদের হাতে কর-শুল্কের অর্থ তুলে দেওয়া হোক। গাজায় সাংবাদিকদের ঢুকতে দেওয়া হোক।

ফিলিস্তিনে সবচেয়ে বেশি সহায়তা দেওয়া এ জোটটি যুদ্ধ-পরবর্তী গাজা পুনর্গঠনে কাজ করতে চায়। তবে ইসরাইল এখনো মিসরের সঙ্গে গাজার রাফা সীমান্ত বন্ধ করে রাখায় ইইউ মিশন কাজ শুরু করতে পারছে না বলেও সংবাদ প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।

আলজাজিরা বুধবার জানাচ্ছে, ইসরাইল এবং হামাস আরও বন্দীদের দেহাবশেষ বিনিময় করেছে, কিন্তু ফিলিস্তিনি গোষ্ঠীটি বলছে যে মিসরের সাথে গুরুত্বপূর্ণ রাফাহ সীমান্ত ক্রসিং পুনরায় চালু করতে অস্বীকৃতি জানিয়ে ইসরাইল গাজা যুদ্ধবিরতি চুক্তির শর্তাবলী মেনে চলতে ব্যর্থ হচ্ছে। মঙ্গলবার গভীর রাতে আরও দু’ইসরায়েলি বন্দীর মৃতদেহ ইসরায়েলে ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছে, একজন সৈন্য এবং একজন বেসামরিক নাগরিক, এবং বুধবার ভোরে তাদের মৃতদেহ আরিয়েহ জালমানোভিচ (৮৫) এবং সেনাবাহিনীর মাস্টার সার্জেন্ট তামির আদারের (৩৮) হিসেবে শনাক্ত করা হয়েছে। গাজার ফিলিস্তিনিরা আল জাজিরাকে জানিয়েছে যে যুদ্ধবিরতির পর থেকে তারা তাদের জীবনে কোনও বাস্তব পরিবর্তন দেখতে পায়নি, কারণ ইসরায়েল বিক্ষিপ্ত আক্রমণ চালিয়ে যাচ্ছে এবং সাহায্য আটকে রাখছে।

সংযুক্ত আরব আমিরাতের রাষ্ট্রপতির কূটনৈতিক উপদেষ্টা আনোয়ার গারগাশ আবুধাবিতে উপসাগরীয় শীর্ষ সম্মেলনে এক সাক্ষাৎকারে গাজার পরিস্থিতি নিয়ে কথা বলেছেন। তিনি বলেন, গাজায় মানবিক সাহায্যের প্রবাহ নিশ্চিত করার জন্য এখনও অনেক কাজ বাকি আছে, যা তিনি বলেছেন যে আরও বাড়ানো হবে। তিনি আরও বলেন, গাজায় স্থলভাগে নিরাপত্তা বাহিনী মোতায়েনের বিষয়ে আলোচনা চলছে, যা ট্রাম্পের ২০-দফা শান্তি পরিকল্পনার একটি মূলনীতি যা চলমান যুদ্ধবিরতির ভিত্তি।

গাজায় দীর্ঘ প্রতীক্ষিত যুদ্ধবিরতি সত্ত্বেও সাম্প্রতিক সহিংসতার ঘটনাগুলো ইঙ্গিত দিচ্ছে সেখানে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠা সহজ হবে না। বেশ কিছু বাধা এখনও রয়ে গেছে, এগুলো দু’বছর স্থায়ী একটি যুদ্ধের পর শান্তি প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টাকে বাধাগ্রস্ত করছে। এক্ষেত্রে প্রধান প্রশ্নগুলো হল হামাসের নিরস্ত্রীকরণ, ইসরাইলী সেনাদের সরিয়ে নেওয়া ও ফিলিস্তিনি ছিটমহলটির ভবিষ্যৎ শাসক কারা হবে। এসব প্রশ্ন এখনও অমীমাংসিত রয়ে গেছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, ট্রাম্প তার দ্বিতীয় মেয়াদের প্রথম বছরে বৈদেশিক নীতিতে অর্জিত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এ সাফল্য ধরে রাখতে হামাস ও ইসরাইল, উভয়ের উপর চাপ বজায় রেখেছেন। যদিও বিশ্লেষকরা এ নিয়ে সন্দিহান।

লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক।