কলাম
ফ্যাসিবাদের স্বরূপ
বর্তমান সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থায় নাগরিকের মধ্যে ধনীগরীব শব্দের ব্যবহার রয়েছে। কর্তৃত্ববাদী সমাজ এবং রাষ্ট্র বিশাল জনসমষ্টিকে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সাংস্কৃতিকভাবে অবহেলিত ও বঞ্চিত করে শাসন করে থাকে। রাষ্ট্র কল্যাণমূলক হলে জনসমষ্টি সাম্য,সামাজিক ন্যায় বিচার, মানবিক মর্যাদা, আইনের শাসন এবং গণতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা হয়।
॥ এম এ কবীর ॥
বর্তমান সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থায় নাগরিকের মধ্যে ধনীগরীব শব্দের ব্যবহার রয়েছে। কর্তৃত্ববাদী সমাজ এবং রাষ্ট্র বিশাল জনসমষ্টিকে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সাংস্কৃতিকভাবে অবহেলিত ও বঞ্চিত করে শাসন করে থাকে। রাষ্ট্র কল্যাণমূলক হলে জনসমষ্টি সাম্য,সামাজিক ন্যায় বিচার, মানবিক মর্যাদা, আইনের শাসন এবং গণতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা হয়। সমাজে আদব, রীতি, নীতি এবং ঐতিহ্য অনুযায়ী প্রতিষ্ঠা হলে সমাজের সাথে সমাজবদ্ধ জনগণের একটি চুক্তি তৈরী হয় যাকে সমাজের ‘অথরিটি’ বলা হয়। অর্থাৎ সমাজে রীতি-নীতি বিরুদ্ধ কোন কাজ করলে তা সমাজ গ্রহণ করে না। ঠিক তেমনি, রাষ্ট্রক্ষমতায় যাওয়ার যে বৈধতা তা হল রাষ্ট্রের সঙ্গে জনগণের চুক্তি। যে চুক্তি অনুযায়ী জনগণ রাষ্ট্রের মালিক। ভোটাধিকার প্রয়োগের মাধ্যমে যে প্রতিনিধি নির্বাচন করা হয় তাই হল জনগণের রায়ের বৈধতা। গণতন্ত্রের প্রাতিষ্ঠানিকরূপ নিয়ে রাষ্ট্রচিন্তাবিদদের মধ্যে মতপার্থক্য থাকলেও বর্তমান শতাব্দীর সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য,জনপ্রিয় এবং স্বীকৃত শাসন ব্যবস্থা হল গণতন্ত্র।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর নিজেদের অস্তিত্ব এবং আধুনিক জীবন চেতনার বিকাশ প্রতিষ্ঠায় বৃটেনে জনগণের সাধারণ ইচ্ছার ‘এবহবৎধষ ডরষষ’ প্রতিফলন প্রতিষ্ঠায় উদার নৈতিক গণতন্ত্রের সূচনা হয়। নির্বাচনের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্রক্ষমতায় সাধারণ জনগণের রাজনৈতিক অংশগ্রহণ ভোট প্রদানের অধিকারকেই উদার নৈতিক ‘গণতন্ত্র’ নামে আখ্যায়িত করা হয়। সার্বজনীন প্রাপ্তবয়স্কদের ভোটাধিকারের ভিত্তিতে নিদিষ্ট সময় অন্তর অনুষ্ঠেয় ‘নিরপেক্ষ’ নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার গঠন ও সরকারের পরিবর্তনই আধুনিক উদার নৈতিক গণতন্ত্রের প্রধান প্রাতিষ্ঠানিক শর্ত যা প্রতিনিধিত্বমূলক প্রতিষ্ঠান আইনসভার মাধ্যমে রূপ লাভ করে।
গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার প্রধান শর্ত হলো জনপ্রতিনিধি নির্বাচনে ভোট প্রদানের মাধ্যমে তাদের পছন্দনীয় প্রার্থীকে নির্বাচিত করা। সংসদীয় সরকার ব্যবস্থায় ‘জাতীয় সংসদ’ বা আইনসভা হলো সার্বভৌম। সেখানে ‘ছায়া মন্ত্রিসভা’ বা স্যাডো কেবিনেটের উপস্থিতি থাকে। সংসদে বিরোধী দলের ভূমিকা থাকে ডধঃপয উড়ম এর মত।
স্বাধীনতাপূর্ব বাংলাদেশে সংসদীয় গণতন্ত্র সম্পর্কে সাধারণ ঐক্যমতের ভিত্তিতেই ১৯৭২ সালে বাংলাদেশে সংসদীয় সরকার পদ্ধতি প্রবর্তিত হয়। তবে প্রশাসনিক অব্যবস্থাপনা, সীমাহীন দূর্নীতি লুটপাট এবং নানাকারণে ১৯৭৫ সালে গণতন্ত্রকে হত্যা করে একদলীয় শাসন ‘বাকশাল’ প্রতিষ্ঠা করা হয়। ১৯৭৫ সালে ৭ নবেম্বর সিপাহী জনতার বিল্পবের মধ্যে দিয়ে শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান রাষ্ট্রের প্রয়োজনে রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তিনি দায়িত্ব গ্রহণের পর পরই অবরুদ্ধ গণতন্ত্রকে অবমুক্ত করেন, প্রতিষ্ঠা করেন বহুদলীয় গণতন্ত্র, ফিরিয়ে দেন জনগণের মৌলিক এবং রাজনৈতিক অধিকার।
১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ এইচ এম এরশাদ রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করেন। দীর্ঘ নয় বছর রাষ্ট্র ক্ষমতায় আসীন থাকাকালে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ, গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি এবং গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে ধ্বংস করে পুনঃবার গণতন্ত্রের কবর রচনা করেন। ১৯৯০ সালে ৬ ডিসেম্বর গণআন্দোলনের মধ্যে দিয়ে স্বৈরাচার এরশাদ সরকারের পতনের পর সকল রাজনৈতিক দলগুলোর ঐক্যমতের ভিত্তিতে দ্বাদশ সংশোধনীর মধ্যে দিয়ে পুণঃবার সংসদীয় সরকার পদ্ধতি প্রবর্তিত হয়। ১৯৯১ সালে নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অবাধ সুষ্ঠু নিরপেক্ষ এবং অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের মধ্যে দিয়ে গণতন্ত্রের শুভ সূচনা হয়। তারই ধারাবাহিকতায় ১৯৯৬ এবং ২০০১ সালে নিরপেক্ষ নির্বাচনের মধ্যে দিয়ে সরকার গঠন ও পরিবর্তনের ধারা প্রতিষ্ঠিত হয়। জনগণ তাদের পছন্দনীয় প্রার্থীকে ভোটের মাধ্যমে নির্বাচিত করার সুযোগ পায়।
২০১৪ সালে দলীয় সরকারের অধীনে গণতন্ত্রকামী সকল রাজনৈতিক দল নির্বাচন বর্জন করলেও ১৫৩ আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দি¦তায় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন যা বিশ্বের ইতিহাসে বিরল। নবম জাতীয় সংসদে আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনের দোহাই দিয়ে নিরপেক্ষ তত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন ব্যবস্থা বিলুপ্ত করে গণতান্ত্রিক অগযাত্রাকে হত্যা করে।
২০১৮ সালে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে শেখ হাসিনার অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী বিএনপিসহ সকল রাজনৈতিক দল নির্বাচনে অংশ গ্রহন করে। কিন্তু এ নির্বাচন ৩০ ডিসেম্বর ২০১৮ তারিখে অনুষ্ঠিত হওয়ার পূর্বেই সংঘটিত হয় বলে দেশে এবং বিদেশের গণমাধ্যমে খবর প্রকাশিত হয়। ফলে দশম জাতীয় সংসদের ধারাবাহিকতায় একাদশ জাতীয় সংসদে সরকারী দল এবং নামসর্বস্ব বিরোধী দল একাকার হয়ে সরকার ও রাষ্ট্রপরিচালনায় নিয়োজিত হয়।
স্বাধীনতার পর থেকে বাংলাদেশে গণতন্ত্রের যাত্রা মসৃন পথ ধরে অগ্রসর হয়েছে একথা বলা যায় না। আবার ১৯৯১, ১৯৯৬, এবং ২০০১ সালে নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচন নিয়েও রাজনৈতিক দলগুলো কারচুপির অভিযোগ তোলে। তবে বাংলাদেশের জনগণ ভোটের মাধ্যমে তাদের পছন্দনীয় প্রার্থীকে নির্বাচিত করার সুযোগ পায় ঐ সকল নির্বাচনে। কিন্তু ২০১৪ এবং ২০১৮ সালে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে জনগণ ভোট প্রদানের অধিকার এবং সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়। ফলে জনগণ ক্রমান্বয়ে ভোট,রাজনীতি, সরকার, এবং জাতীয় সংসদের প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলে যা একটি দেশের জন্য অশনি সংকেত। এরূপ পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে গত কয়েক বছর আগে সুপ্রীম কোর্ট থেকে বলা হয়েছিল “আমরা এমন একটা পঙ্গু সমাজে বসবাস করছি, যেখানে ভালো মানুষ স্বপ্ন দেখতে পারছে না, রাজনীতি বাণিজ্যে পরিণত হয়েছে...আমাদের পূর্বসূরিরা গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন, কোনো ক্ষমতাধর দৈত্য নয়”।
বাংলাদেশের গত তিন দশকের রাজনৈতিক পথ-পরিক্রমা বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, যে প্রত্যাশা ও আকাক্সক্ষা নিয়ে ১৯৯১ সালে সংসদীয় গণতন্ত্রের যাত্রা সূচিত হয়েছিল তার যাত্রাপথ পরিবর্তন করা হয়েছে। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারী নির্বাচন ‘গণতান্ত্রিক একনায়কত্ব’ এবং ২০১৮ সালে ৩০ ডিসেম্বর বির্তকিত নির্বাচনের পর শেখ হাসিনা ‘কর্তৃত্ববাদী’ শাসক হিসেবে চিহ্নিত হন। ফলে ২০১৮ সালের নির্বাচনের পর বাংলাদেশ কার্যত একদলীয় রাষ্ট্র এবং বাংলাদেশের ক্ষয়িষ্ণু গণতন্ত্রের ধারা ‘হেজিমোনিক ইলেকটোরাল অথরিটারিয়ানিজম বা আধিপত্যশীল নির্বাচনী কর্তৃত্ববাদে পরিণত হয়।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে সাম্য, মানবিক মর্যাদা এবং সামাজিক ন্যায় বিচার প্রতিপাদ্য বিষয় থাকলেও গণতন্ত্রের জন্য তীব্র আকাক্সক্ষা ছিল এ বঙ্গের জনগণের। কারণ গণতন্ত্র শুধুমাত্র একটি সরকার ব্যবস্থা নয়, বরং গণতন্ত্র একটি দর্শন। যে দর্শনের মধ্যে সাম্য,মানবিক মর্যাদা, সামাজিক ন্যায় বিচার, আইনের শাসন, জনগণের প্রতিনিধি নির্বাচনের সুযোগসহ নানাবিধ বিষয় সমূহ বিদ্যমান, যার মধ্যে একটি সভ্য সমাজ বির্নিমান এবং উন্নত ও কল্যাণমূলক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার রয়েছে।
বাংলাদেশকে একটি আত্মনির্ভরশীল মর্যাদাপূর্ণ দেশ হিসেবে গড়ে তোলার লক্ষ্যে ১৯৭৭ সালে শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের ১৯ দফা এবং তৃতীয় বিশ্বে গণতান্ত্রিক সংগ্রামের প্রতিচ্ছবি বেগম খালেদা জিয়া’র ভিশন-২০৩০ যেমন ছিল একটি মাইল ফলক, ঠিক তেমনি তারেক রহমান কর্তৃক ঘোষিত রাষ্ট্র কাঠামো মেরামতের ৩১ দফা রূপরেখা বর্তমান বাংলাদেশের বাস্তবতায় অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। জাতীয় ঐক্যমতের সরকার,
জধরহনড়ি ঘধঃরড়হ, উচ্চ কক্ষ বিশিষ্ট আইন সভা, ন্যায়পাল নিয়োগ, জুডিশিয়াল কমিশন, সার্বজনীন মানবধিকার সনদ বাস্তবায়ন, রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের তালিকা প্রণয়ন, রাষ্ট্রপতি প্রধানমন্ত্রী এবং মন্ত্রীদের ক্ষমতার ভারসাম্য আনয়ন, প্রতিহিংসামূলক রাজনীতি পরিহার, সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ সংশোধন, ‘নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার’ ব্যবস্থা প্রবর্তন, যুগোপযোগী এবং জ্ঞানভিত্তিক শিক্ষাকে অধিক গুরুত্বারোপসহ নানাবিধ বিষয় স্থান পেয়েছে এই ৩১ দফায়।
বাংলাদেশের সিংহভাগ জনসমষ্টি তরুণ। শিক্ষিত তরুণদের বর্তমানে রাজনীতির প্রতি আগ্রহ নেই বললেই চলে। তাছাড়াও সুস্থ ধারার রাজনীতির চর্চা না থাকায় অনেক শিক্ষিতজনেরা রাজনীতিতে আসতে চান না। তবে সমাজের মৌলিক ইতিবাচক পরিবর্তনে শিক্ষিত এবং তরুণ সমাজের বিশাল ভূমিকা রয়েছে। এ কারণে রাজনীতি বিমূখ ব্যক্তিত্বের অংশগ্রহণের সুযোগ সৃষ্টি করা দরকার। শিক্ষিত তরুণদের রাজনীতির প্রতি আগ্রহ তৈরী করাতে না পারলে সমাজের মৌলিক পরিবর্তন করা সম্ভব নয়। তাই রাষ্ট্র কাঠামো মেরামতের পাশাপাশি সমাজ সংস্কারও জরুরী। সামাজিক মূল্যবোধ, অনাচার,অন্যায় এবং দূর্বৃত্তায়নের কবল থেকে সমাজ এবং সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে বের করে আনার প্রতি গুরুত্বারোপ করা দরকার। বর্তমান বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে জনগণের চাহিদা,আচার আচরণে এবং দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন ঘটেছে, তথাপিও আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতি চর্চার মধ্যে দিয়ে হারানো ঐতিহ্যকে ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ জরুরী। ফ্যাসিবাদ মানে শুধু স্বৈরশাসকের ক্ষমতা নয়। এটি এমন এক মানসিকতা, যা ধীরে ধীরে সংক্রমিত হয়। ফ্যাসিবাদী রেজিমের পতন ঘটলেও সমাজ কিন্তু এখনও মুক্ত হয়নি। এটা যেন এক ধরনের ফ্যাসিবাদ-পরবর্তী ফ্যাসিবাদ,যেখানে ক্ষমতার কেন্দ্র বদলালেও ক্ষমতার কাঠামো ও মনস্তত্ত্ব বদলায়নি।
লেখক : সাংবাদিক।