জাফর আহমাদ
হজ্ব হচ্ছে বিশ্ব মুসলিম সম্মেলন। এতে সারা বিশ্বের মুসলিম প্রতিনিধিরা অংশগ্রহণ করবে। বর্ণ, বংশ ও শ্রেষ্ঠত্বের পোশাক ছেড়ে সকলেই সেলাইবিহীন ইহরামের কাপড় পরে মুর্দার কাফনের মিছিলে শরীক হয়ে এমন এক সাক্ষ্য দিবে, যে সাক্ষ্য মক্কার আকাশ-বাতাস, অলিগলি ছাড়িয়ে পাহাড়ের চূড়ার ওপর দিয়ে পৃথিবীর প্রতিটি মুসলিম জনপদে প্রতিধ্বনিত হবে। যে ধ্বনি প্রতিটি মুসলিম দেশ, শাসক ও সদস্যকেও মুখরিত করে তুলবে। সে সাক্ষ্য হলো “হাজির প্রভু হে, আমি হাজির, তোমার কোন শরীক নেই, সকল প্রশংসা ও নিয়ামত তোমারই এবং সাম্রাজ্যের মালিক তুমি, তোমার কোন শরীক নেই।” অর্থাৎ দীন-দুনিয়ার কল্যাণের এ মহাসম্মেলনে আমি সশরীরে হাজির হয়ে বজ্র কন্ঠে ঘোষণা দিচ্ছি যে, তোমার কোন শরীক নেই, তুমি সাম্রাজ্যের মালিক সকল প্রশংসা একমাত্র তোমারই। ‘লাব্বায়িক’ বলে নিজের সার্বিক প্রস্তুতি ও আনুগত্যের ঘোষণা দিয়ে এ প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করছি যে, হে আল্লাহ, তুমি যে নির্দেশ দিবে আমি তা নিজ এলাকায় অবশ্যই তা পৌঁছে দেবো। বিশ্বব্যাপী ইসলামী সংগ্রামের বিপ্লবী দাওয়াতের দিক-নির্দেশনা প্রদানের প্রধান কেন্দ্র হলো এ মক্কা মোকাররমা। পৃথিবীর যারাই ইসলামী আদর্শের অনুসারী তারা যে জাতি গোষ্ঠীই হোক না কেন সকলকে এখানে সমবেত হয়ে সংগ্রামী দীক্ষা নিয়ে নিজ নিজ এলাকায় এসে তা বাস্তবায়নে সচেষ্ট হবো। এটিই হচ্ছে হজ¦।
আরাফাতের ময়দানে আল্লাহর রাসুল (স:) আল্লাহর পক্ষ থেকে লক্ষ লক্ষ সাহাবায়ে কেরামের উদ্দেশ্যে যে দিক নির্দেশনামূলক ভাষণ দিয়েছিলেন, সে একই জায়গায় দাঁড়িয়ে তাঁর অনুসরণে আল্লাহর প্রতিনিধি হিসাবে একজন নেতৃত্ব অবশ্যই বর্তমান বিশ্বের অবস্থার আলোকে দিক-নির্দেশনামূলক ও করণীয় কর্তব্য সম্পর্কে ভাষণ দিবেন। তাঁর ভাষণে ইসলামের সুনির্দিষ্ট স্থিরিকৃত কাজের পাশাপাশি বর্তমান বিশ্বের আলোড়িত বিষয়ে দিক-নির্দেশনামূলক ভাষণ দিবেন। সমগ্র ভাষণের মধ্যে এ অংশটুকু মোটা অক্ষরে লিখিত একটি সুনির্দিষ্ট বক্তব্য অবশ্যই সংযোজন করতে হবে এবং এটিই হবে এবারের হজ্বের মূল প্রতিপাদ্য বিষয়।
উদাহরণস্বরূপ আমি এখানে বিশেষভাবে উল্লেখ করতে চাই যে, বর্তমান মানবসভ্যতা বিরোধী অভিশপ্ত ইসরাঈল জাতি কর্তৃক মুসলিম নিধন। এদেরকে প্রতিহত করার কৌশল ও মুসলমানদের করণীয় বিষয়ে দিকনির্দেশনামূলক বক্তব্য দিবেন ইমামুল হজ¦। খুৎবাতের শিরোনাম হবে ‘গাজা ট্রাজেডি’। ইসলামের চীর শত্রু, অভিশপ্ত ইহুদী রাষ্ট্র ইসরাঈল কর্তৃক মুসলিম অধ্যুষিত গাজা আক্রমণ। তারা বেসামরিক নাগরিক বৃদ্ধ, শিশু ও নারীদেরকে হত্যা করে যাচ্ছে। অথচ বিশ্বমুসলিমের বিবেক একান্তভাবে ধরা হলে অনেকটা নিশ্চুপ ভূমিকাই পালন করে যাচ্ছে। বিশ্ব মুসলিমকে জাগিয়ে তোলার জন্য এবারকার হজে¦র মূল প্রতিপাদ্য বিষয় হওয়া উচিত, ‘বিশ্ব মুসলিম জাগো, গাজাকে রক্ষা করো”। গাজাকে আর্থিক, শারীরিক ও বুদ্ধি দিয়ে সাহায্য করো’। প্রত্যেকটি দেশ বাধ্যতামূলক ইসলামের এ দুশমন ও চিরশত্রুর দেশ ইসরাঈলের সাথে সকল প্রকার রাষ্ট্রীয় সম্পর্ক ছেদ করতে হবে। দেশে দেশে তাদের উৎপাদিত পণ্য অবশ্যই বর্জন করতে হবে।
আরাফাতের ময়দানে আল্লাহকে হাজির-নাজির জেনে তাঁকে সাক্ষী মেনে অত্যন্ত ভাব-গাম্ভীর্য পরিবেশে আল্লাহর প্রত্যেক মেহমানের কাছ থেকে হজে¦র মূল প্রতিপাদ্য বিষয়ে ওয়াদা আদায় করা নেতৃত্বের ওপর কর্তব্য হয়ে দাঁড়ায়। ইসলামী শরী’আহর দৃষ্টিভঙ্গিতে এ ওয়াদা পরিপালন করা প্রত্যেক মেহমানকে বাধ্যতামূলক দায়িত্ব গণ্য করতে হবে। প্রত্যেকে নিজ নিজ দেশে গিয়ে যারা এখানে আসতে পারেননি, তাদের কাছে এবারকার হজ্বের মূল প্রতিপাদ্য বিষয় তুলে ধরতে হবে এবং প্রত্যেককে এই দায়িত্ব পালনের জন্য দাওয়াত ও বিশেষভাবে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। হতে পারে পিছনে পড়ে থাকা লোকেরা উপস্থিত লোকদের চেয়ে আরো বেশি সুচারুরূপে এই দায়িত্ব পালন করবে।
ইসলামী চিন্তাবিদদের সমন্বয়ে প্রতিবছর বাস্তবতাকে সামনে রেখে হজে¦র একটি স্লোগান তৈরি করা হবে। যে স্লোগানটি ইসলাম ও ইসলামী ভাবধারাকে উজ্জীবিত করবে। যে স্লোগানটি কখনো ইসলামী শরী’আহর বিরূদ্ধে যাবে না, আল্লাহর রাসুল (স:) যে ভাষণ দিয়েছিলেন সেই ভাষণের সাথে অবশ্যই সামঞ্জস্যশীল হতে হবে বরং স্লোগানটি মুসলিমবিশ্ব ছাড়াও সার্বিকভাবে সকলের কল্যাণ বয়ে আনবে।
আমরা এখানে রাসুল (স:) এর মূল ভাষণটি তুলে ধরতে পারি।
হে জনমণ্ডলী! শুনে রাখ,“জাহেলী যুগের সমস্ত প্রথা ও বিধান আমার দু-পায়ের নীচে।”
“অনারবদের ওপর আরবদের এবং আরবদের ওপর অনারবদের কোনো শ্রেষ্ঠত্ব নেই। তেমনি সাদার ওপর কালোর কিংবা কালার ওপর সাদার কোনো শ্রেষ্ঠত্ব নেই। তোমরা সবাই আদমের সন্তান আর আদমকে সৃষ্টি করা হয়েছে মাটি থেকে। মর্যাদার ভিত্তি হচ্ছে তাক্বওয়া বা আল্লাহর ভয়।”
“মুসলমানরা পরস্পর ভাই ভাই। সাবধান! আমার পরে তোমরা একজন আরেকজনকে হত্যা করার মতো কুফরী কাজে লিপ্ত হয়ো না।”
“আমার পরে ইসলামী ভ্রাতৃত্ব পরিত্যাগ করে তোমরা কাফের সুলভ জীবন গ্রহণ করে একে অপরের গলা কাটতে শুরু করে দিওনা।”
“তোমাদের গোলাম! তোমাদের ভৃত্য! তোমরা নিজেরা যা খাবে, তা-ই তাদের খাওয়াবে; নিজেরা যা পরবে, তাই তাদের পরতে দিবে।”
“জাহেলী যুগের সমস্ত রক্তের বদলা বাতিল করে দেয়া হলো। (এখন আর কেউ কারো কাছ থেকে পুরানো রক্তের বদলা নিতে পারবে না)। সর্বপ্রথম আমি নিজ খান্দানের রক্ত-রাবিয়া বিন হারিসের পুত্রের রক্ত বাতিল করে দিলাম।”
“জাহিলী যুগের সমস্ত সুদও বাতিল করে দেয়া হলো। (এখন আর কেউ কারো কাছে সুদ দাবি করতে পারবে না)। সর্বপ্রথম আমি নিজ খান্দানের সুদ-আব্বাস বিন আব্দুল মুত্তালিবের সুদ-বাতিল করে দিলাম।”
ইিসলাম প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাওয়ার পর শয়তান আর আশা করে না যে এ ভূখণ্ডে তার আনুগত্য করা হবে। কিন্তু তোমরা যে গুণাহগুলোকে হালকা মনে কর, তাতে যদি শয়তানের আনুগত্য কর, তবে তাতে সে খুশী হবে।
“মেয়েদের ব্যাপারে আল্লাহকে ভয় করো। জেনে রাখ, তাদের ওপর যেমন তোমাদের অধিকার রয়েছে, তেমনি রয়েছে তোমাদের ওপর তাদের অধিকার। তাদের কল্যাণের বিষয়ে আমার নসিহত গ্রহণ করো।”
“আজকের এ দিন, এ মাস এবং এ শহরটি যেমন সম্মানার্হ, তেমনি তোমাদের রক্ত, তোমাদের ইজ্জত, তোমাদের ধন-দৌলত পরস্পরের প্রতি কিয়ামত পর্যন্ত সম্মানার্হ।”
“আল্লাহ তা’আলা প্রত্যেক উত্তরাধিকারীর জন্য উত্তরাধিকারের স্থায়ী অংশ নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন। এক তৃতীয়াংশের অধিক সম্পত্তি ওসিয়ত করা জায়েজ নয়।”
“আমি তোমাদের মধ্যে একটি জিনিস রেখে যাচ্ছি, তোমরা যদি তা দৃঢ়ভাবে আঁকড়ে ধরো, তাহলে কখনো পথভ্রষ্ট হবে না, আর তা হচ্ছে আল্লাহর কিতাব তথা আল-কুরআন।”
অতপর জনতার কাছে জিজ্ঞাস করেন :
“আল্লাহর দরবারে আমার সম্পর্কে তোমাদেরকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে, তোমরা কী বলবে ? সাহাবীগণ উত্তর দিলেন, আমরা বলবো, আপনি আমাদের কাছে পয়গাম পৌঁছে দিয়েছেন এবং আপন কর্তব্য পালন করেছেন। তিনি আসমানের দিকে শাহাদাত অঙ্গুলি তুলে তিনবার বললেন : “হে আল্লাহ! তুমি সাক্ষী থেকো।”
এ সময় কুরআনের নিম্নোক্ত আয়াত নাযিল হয় : “আজকে আমি দ্বীনকে তোমাদের জন্য পরিপূর্ণ দিলাম এবং আমার নিয়ামতকে সম্পূর্ণ করে দিলাম আর দ্বীন হিসাবে ইসলামকে তোমাদের জন্য মনোনীত করলাম।”
এরপর তিনি সমস্ত মুসলমানদের লক্ষ্য করে বলেন:
“উপস্থিত ব্যক্তিগণ (এই সব কথা) অনুপস্থিত লোকদের কাছে পৌঁছে দিও। হয়তো বা কিছু উপস্থিত লোকের চেয়ে কিছু অনুপস্থিত লোক এ কথাগুলো অধিকতর ভালোভাবে মনে রাখতে পারবে এবং সংরক্ষণ করবে।”
লেখক : ব্যাংকার।