মমতাজ উদ্দিন আহমদ
একসময় যে বান্দরবানের আলীকদম উপজেলা প্রাকৃতিক সম্পদ ও উর্বর কৃষি জমির জন্য পরিচিত ছিল, সেখানে গত আশির দশক থেকে বাসা বেঁধেছে এক নীরব ঘাতক তামাক চাষ। প্রাথমিকভাবে লাভজনক মনে হলেও, সুদূরপ্রসারী অর্থনৈতিক ও পরিবেশগত বিবেচনায় এটি এক বিষচক্র, যা ধীরে ধীরে আলীকদমের মাটির জীবনীশক্তি হরণ করছে। সাম্প্রতিক সময়ে নদীর তীরবর্তী সরকারি জমিতে তামাক চাষ বন্ধে উপজেলা প্রশাসনের কঠোর অবস্থান ও নজরদারি নিঃসন্দেহে এক ইতিবাচক পদক্ষেপ, কিন্তু এ লড়াইয়ে জয়ী হতে হলে তামাক চাষের ক্ষতিকর দিকগুলি আরও গভীরভাবে বিশ্লেষণ করা অপরিহার্য।
কৃষি জমির উর্বরতা হ্রাসের ভয়াবহ চিত্র
তামাক চাষকে বৈজ্ঞানিক পরিভাষায় হেভি ফিডার’ (Heavy Feeder) ফসল বলা হয়। অর্থাৎ, এটি মাটি থেকে বিপুল পরিমাণে পুষ্টি উপাদান শোষণ করে নেয়। আলীকদমের কৃষি জমিতে তামাক চাষের সবচেয়ে বড় বিপর্যয় হলো এর মাটি ধ্বংসের প্রবণতা:
১. পুষ্টি উপাদানের দ্রুত নিঃশেষণ : তামাক গাছ তার দ্রুত বৃদ্ধি এবং বৃহৎ পাতার কারণে নাইট্রোজেন (N), ফসফরাস (P), পটাশিয়াম (K)-এর মতো ম্যাক্রো-নিউট্রিয়েন্টগুলো অতিমাত্রায় শোষণ করে। কৃষকরা যখন একই জমিতে বছরের পর বছর তামাক চাষ করেন, তখন মাটির উর্বরতা দ্রুত হ্রাস পেতে থাকে। ফলস্বরূপ, পরবর্তীকালে এ জমিতে ধান বা অন্যান্য রবিশস্যের ফলন মারাত্মকভাবে কমে যায়। যা কেবল কৃষকের ক্ষতি করে না, স্থানীয় খাদ্য নিরাপত্তাকেও বিপন্ন করে তোলে।
২. মাটির কাঠামো ও জলধারণ ক্ষমতা হ্রাস : তামাক চাষের জন্য মাটিকে বারবার আলগা করতে হয়, যা মাটির প্রাকৃতিক কাঠামো বা ‘টেক্সচার’ নষ্ট করে দেয়। এছাড়া, তামাকের ঘন চাষের কারণে মাটি পর্যাপ্ত বিশ্রাম পায় না এবং জৈব পদার্থের পরিমাণ কমতে থাকে। এর ফলে আলীকদমের পাহাড়ি অঞ্চলে মাটির জলধারণ ক্ষমতা হ্রাস পায়, অন্যদিকে শুকনো মৌসুমে মাটি ক্ষয় (Erosion) বৃদ্ধি পায়, যা পাহাড়ের কৃষি জমির জন্য অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ।
৩. পরিবেশ ও খাদ্যে বিষক্রিয়া : তামাক চাষে প্রচুর পরিমাণে কীটনাশক ও রাসায়নিক সার ব্যবহৃত হয়। এ রাসায়নিকগুলো মাটির নিচে প্রবেশ করে ভূগর্ভস্থ জলকে দূষিত করে। এছাড়া, নদীর তীরবর্তী এলাকায় চাষ হওয়ায় বৃষ্টির জল বা সেচের জল সরাসরি এ বিষাক্ত উপাদানগুলি নদীতে নিয়ে যায়। উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে নদীর তীর থেকে ৫০ ফুট দূরত্বে তামাক চাষ নিষিদ্ধ করার নির্দেশনাটি তাই পরিবেশ রক্ষার জন্য অত্যাবশ্যক।
অর্থনৈতিক ও পরিবেশগত বিপর্যয়
তামাক চাষের কারণে আলীকদম জুড়ে এক অর্থনৈতিক ও পরিবেশগত বিপর্যয়ের চেইন তৈরি হয়েছে:
* খাদ্য ফসলের সংকট: রবিশস্যের ফলন কমে যাওয়ায় এবং কৃষকরা নগদ অর্থের লোভে খাদ্যশস্যের জমি তামাকের জন্য ব্যবহার করায় বাজারে খাদ্যপণ্য ও সব্জির দাম সারা বছর ধরেই বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা স্থানীয় সাধারণ জনগোষ্ঠীর জীবনযাত্রায় নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।
* বনাঞ্চল উজাড় : তামাক প্রক্রিয়াজাতকরণ বা ‘কিউরিং’-এর জন্য বিপুল পরিমাণে জ্বালানি কাঠ প্রয়োজন হয়। স্থানীয়ভাবে এ জ্বালানি কাঠ সংগ্রহ করতে গিয়ে বনাঞ্চল উজাড় হচ্ছে। কৃষি বিভাগের মতে, তামাক চাষের এ নেতিবাচক প্রভাবেই এ অঞ্চলে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব আরও প্রকট হচ্ছে।
বহুজাতিক কোম্পানির দৌরাত্ম্য ও সার-ব্যবস্থাপনায় দুর্নীতি
আলীকদমের মতো প্রত্যন্ত অঞ্চলে তামাক চাষের বিস্তার ঘটিয়েছে বেশ কয়েকটি দেশি-বিদেশি তামাক কোম্পানি। এর মধ্যে ব্রিটিশ আমেরিকান টোবাকো (BAT), জাপান টোবাকো (JTI), আবুল খায়ের ট্যোবাকো, গ্লোবাল ট্যোবাকো, আজিজ উদ্দিন ট্যোবাকো এবং আকিজ উদ্দিন ট্যোবাকো অন্যতম। এ কোম্পানিগুলো চুক্তিভিত্তিক চাষের মাধ্যমে তামাক উৎপাদন বৃদ্ধি করে চলেছে।
তবে উদ্বেগের বিষয় হলো, এ কোম্পানিগুলো তামাক চাষের অন্যতম প্রধান উপাদান ইউরিয়া সার সরবরাহ করে না। বরং তাদের চুক্তিবদ্ধ তামাক চাষীরা উপজেলা পর্যায়ে সরকারি বরাদ্দের ইউরিয়া সারে ভাগ বসায়। সরকারি ভর্তুকিপ্রাপ্ত এই সার মূলত খাদ্যশস্য উৎপাদনের জন্য বরাদ্দ থাকে। তামাক চাষীরা সে সারের একটি বড় অংশ ব্যবহার করায় খাদ্য উৎপাদনকারী সাধারণ কৃষকরা ন্যায্য মূল্যে সার পেতে ব্যর্থ হন। এটি একদিকে যেমন সরকারের ভর্তুকি অপব্যবহার করে, তেমনি খাদ্যশস্যের উৎপাদনকে সরাসরি বাধাগ্রস্ত করে খাদ্য নিরাপত্তার জন্য চরম হুমকি সৃষ্টি করে।
মাতামুহুরী নদীর ক্রন্দন; তামাক চাষের বিষে বিপন্ন জলজ প্রাণবৈচিত্র্য
আশির দশক থেকে আলীকদমের কৃষিজমিতে শুরু হওয়া তামাক চাষ কেবল মাটির উর্বরতাকেই গ্রাস করেনি, এর বিষক্রিয়া পৌঁছে গেছে মাতামুহুরী নদীর একেবারে গভীরে। নদীর বিস্তীর্ণ চরাঞ্চলে, এমনকি শুষ্ক মৌসুমে জেগে ওঠা নদীগর্ভের চরেও যখন তামাকের সারি তৈরি হয়, তখন প্রতিটি সেচ এবং বর্ষার ঢলের সঙ্গে যুক্ত হয় এক ভয়াবহ বিপদ। তামাক চাষে ব্যবহৃত তীব্র কীটনাশক এবং বিপুল পরিমাণে প্রয়োগ করা অযাচিত ইউরিয়া সার সরাসরি গিয়ে মিশে যায় নদীর স্রোতে। এই রাসায়নিক দূষণ মাতামুহুরী নদীর জলজ প্রাণবৈচিত্র্যের ওপর ব্যাপক ক্ষতি সাধন করেছে। ইউরিয়া সারের আধিক্যে তৈরি হয় শৈবালের অস্বাভাবিক বৃদ্ধি (Algal Bloom), যা নদীর অক্সিজেনের মাত্রা কমিয়ে দেয়। ফলস্বরূপ, একসময় মাতামুহুরী নদীর যে সুস্বাদু মাছের জন্য খ্যাতি ছিল, সে মাছের বংশ ও খাদ্যচক্র মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। নদীর পরিবেশ যখন বিষাক্ত হয়ে ওঠে, তখন নদী শুধু জলপথ থাকে না; এটি হয়ে ওঠে এক ক্রন্দনশীল সত্তা, যার প্রাণ বিলুপ্তির পথে।
প্রশাসনের ইতিবাচক পদক্ষেপ ও প্রত্যাশিত সমাধান
এমন পরিস্থিতিতে আলীকদম উপজেলা প্রশাসন যে কঠোর ও ইতিবাচক নজরদারি শুরু করেছে, তা অত্যন্ত প্রশংসনীয়। উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) এবং উপজেলা কৃষি অফিসার (কৃষিবিদ)-এর যৌথ পরিদর্শন এবং ইউএনও-এর এ দৃঢ় ঘোষণা”- কৃষিজমিতে তামাক চাষ পরিবেশগত বিপর্যয় ডেকে আনছে। আমরা এ বিষয়ে কোনো ছাড় দেব না”- আগামী দিনের আশার সঞ্চার করে।
প্রশাসনের এ দৃঢ় পদক্ষেপ ও স্থানীয় সচেতন মহল কর্তৃক এর প্রতি সমর্থন প্রমাণ করে যে, আলীকদমের মানুষ এখন তাদের মাটির স্বাস্থ্য রক্ষায় ঐক্যবদ্ধ। তামাকের বিরুদ্ধে এ কঠোর নজরদারি আলীকদমের কৃষি ঐতিহ্য সুরক্ষার এক দৃঢ় পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
তবে কেবল নজরদারি যথেষ্ট নয়। সরকারিভাবে তামাক চাষ থেকে সরে এসে বিকল্প লাভজনক ফসল (যেমন: আদা, হলুদ, ফলমূল, উন্নত সবজি) চাষে কৃষকদের প্রযুক্তিগত ও আর্থিক সহায়তা প্রদান নিশ্চিত করতে হবে। সরকারি ভর্তুকির ইউরিয়া সারের ব্যবহার তামাক চাষে বন্ধ করতে হবে। এ বিষচক্র থেকে মুক্তি পেতে হলে সরকারের নীতিগত সহায়তা এবং স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের সম্মিলিত প্রচেষ্টা প্রয়োজন। তবেই আলীকদমের মাটি ফিরে পাবে তার হৃত উর্বরতা, এবং এই অঞ্চলের মানুষ মুক্ত হবে বহুজাতিক তামাক কোম্পানির শোষণ থেকে।
লেখক : সাংবাদিক ও প্রাবন্ধিক।