এডভোকেট সাবিকুন্নাহার মুন্নী

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ বা ডাকসুর ৩৮ তম নির্বাচন হতে যাচ্ছে এবার। এ পর্যন্ত ডাকসু নির্বাচন হয়েছে ৩৭ বার। তবে সবচেয়ে বেদনার বিষয় হচ্ছেÑস্বাধীনতার ৫৪ বছরে মাত্র ৭ বার ডাকসু নির্বাচন হয়েছে। ১৯৯০ সালের পর ফ্যাসিবাদের আমলে সর্বশেষে ২০১৯ সালে বিতর্কিত একটি নির্বাচন হয়। ফ্যাসিস্ট সরকারের পতনের পর মুক্ত পরিবেশে ৯ সেপ্টেম্বর ২০২৫ ডাকসু নির্বাচন হতে যাচ্ছে। জনগণের মাঝেও এ নির্বাচন এতটাই উৎসাহের যে, এটা যেন অনেকটা জাতীয় নির্বাচনের রূপ পরিগ্রহ করেছে।

ডাকসু নির্বাচন নিয়ে পুরো দেশে চলছে আলোচনা। গণমাধ্যমেও ফলাও করে এ নির্বাচনের খবরাখবর প্রচারিত হচ্ছে। ডাকসুকে শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ হিসেবে বিবেচনা করলে এর গুরুত্ব বোঝা যাবে না। ডাকসু এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশের ভাষা আন্দোলন, ‘৬৯ এর গণআন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ, ’৯০ এর স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন এবং সর্বশেষ ২৪-এর ফ্যাসিবাদ বিরোধী আন্দোলনসহ সকল গণতান্ত্রিক আন্দোলনের সূতিকাগার হিসেবে কাজ করেছে। এসব আন্দোলনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ই মূলত নেতৃত্ব দিয়েছে।

অতীতে এখান থেকেই জাতীয় রাজনীতির যোগ্য নেতৃত্ব গড়ে উঠেছে এবং তারা দেশ ও জাতিকে নেতৃত্ব দিয়েছেন। যোগ্য নেতৃত্ব তৈরির একটা কারখানা বলা চলে ডাকসু। শুধু রাজনীতি নয়, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিবর্তন এবং উন্নয়নের ধারায় ডাকসু সবসময়ই সক্রিয় ছিল। যারা ছাত্রদের অধিকার নিয়ে কথা বলেছে সব সময়। কথা বলেছে শিক্ষা এবং শিক্ষার অধিকার নিয়ে। আর এসব কারণেই ডাকসু এত গুরুত্বপূর্ণ, ডাকসু নির্বাচন নিয়ে এত আলোচনা। ২৪ এর গণঅভ্যুত্থানের পর ডাকসু নির্বাচন হওয়ায় আলোচনাটা যেন আরো একটু বেশি মানুষের আক-ক্সক্ষাটাও বেশী। সবার একটাই কৌতুহল। কে বা কারা আসছে আগামী ছাত্র নেতৃত্বে ? তারা সততা ও দক্ষতা-যোগ্যতার সাথে এ অঙ্গনের জঞ্জাল পরিষ্কার করতে পারবে তো? চাঁদাবাজি টেন্ডারবাজি মুক্ত হয়ে ছাত্র সমাজের নৈতিক মান তথা শিক্ষার মান ফিরিয়ে এনে শিক্ষাবান্ধব, নারীবান্ধব স্বাস্থ্যকর পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে পারবে তো?

দীর্ঘদিন ডাকসু নির্বাচন না হওয়ায় জাতীয় রাজনীতিতে এক ধরনের নেতৃত্বশূণ্যতা তৈরি হয়েছে। তরুণ নেতৃত্ব বেরিয়ে আসছে না। আর ডাকসু নির্বাচন না হওয়ায় অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয় এবং কলেজ ছাত্র সংসদগুলোতেও কোনো নির্বাচন হয়নি। ফলে আঞ্চলিক এবং স্থানীয় পর্যায়েও কাক্সিক্ষত তরুণ নেতৃত্বের বিকাশ হয়নি।

ডাকসু একটি সার্বজনীন গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান। এখানে গণতন্ত্র, বাকস্বাধীনতা ও স্বাধীন মত প্রকাশের চর্চা হয়। এখানকার নির্বাচনে সবাই স্বাধীনভাবে ভোটাধিকার প্রয়োগ করেন। আমাদের দেশে নির্বাচনী ব্যবস্থা বলতে গেলে ভেঙে পড়েছে। বিগত জাতীয় সংসদ নির্বাচনগুলোতে মানুষ ভোট দিতে পারেনি। ‘ডামি-আমি’র’ নির্বাচন, ‘দিনের ভোট রাতে’ হয়ে গেছে। তাই ডাকসু নির্বাচনের দিকে গোটা দেশ তাকিয়ে আছে। এখানে যদি শিক্ষার্থীরা স্বাধীনভাবে ভোট দিতে পারে তাহলে জাতীয় রাজনীতিতে বড় ধরনের প্রভাব পড়বে।

এবারের ডাকসু নির্বাচন খবরেও অনেকটা বাড়তি গুরুত্ব পাচ্ছে কারণ ২৪-এর বিপ্লবের নায়কদের নিয়ে এ নির্বাচন। দীর্ঘ ফ্যাসিবাদের পতনের পর মুক্ত স্বাধীন পরিবেশে তারুণ্যের উচ্ছ্বাস ‘জেন-জি জেনারেশন’ তাদের নেতৃত্বের জন্য কাদের বাঁছাই করে নিচ্ছে। এ কারণেও এবারের নির্বাচনটি আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। দেশের শিক্ষিত চৌকস, বাছাইকৃত সেরা ছাত্রসমাজ কাদেরকে দেশ ও জাতিয় স্বার্থ রক্ষায়, রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্ব রক্ষায়, শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীবান্ধব ও ছাত্রীদের স্বার্থ এবং নিরাপত্তা রক্ষায় নিরাপদ ও যোগ্য মনে করছে সেটাই এখন দেখার বিষয়। আশা করছি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্র-ছাত্রী সততা, যোগ্যতা, দক্ষতা ও নৈতিকতার বিচারে ভালো একাডেমেশিয়ান যোগ্য প্রার্থীকে চিনে নিতে ভুল করবে না।

সুদূর অতীত থেকে দেখা গেছে দেশের মানুষ যে কোনো ধরনের অন্যায় আর অবিচারের প্রতিবাদ দেখতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং ডাকসুর ঐতিহাসিক ভূমিকার দিকে তাকিয়ে থেকেছে সবসময়। আর এ কারণেই ডাকসুকে বলা হয় সেকেন্ড পার্লামেন্ট। ফ্যাসিবাদ মুক্ত নতুন বাংলাদেশ গড়তে এবারের ডাকসু নির্বাচন জাতীয় নির্বাচনকেও দারুণভাবে প্রভাবিত করবে। আশা করা যায়, ডাকসুতে যে বা যারা নির্বাচিত হয়ে আসবে আগামীতে দেশের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায়ও সে দলের প্রাধান্য থাকবে।

‘হে ইমানদারগণ তোমরা স্থায়ীভাবে সত্যের উপর প্রতিষ্ঠিত থাকো এবং ন্যায় ও ইনসাফের সাক্ষ্যদাতা হয়ে যাও। কোন দলের শত্রুতা যেন তোমাদের কে এতটা উত্তেজিত করে না তোলে, যাতে করে তোমরা ইনসাফ থেকে বিচ্যুত হও। তোমরা ইনসাফ করো’। [সূরা মায়েদার : ৮] ‘এবং তোমরা সত্যকে মিথ্যার সাথে মিশ্রিত কর না এবং জেনেশুনে সত্য গোপন কর না।’ [সূরা বাক্বারা : ৪২]

অত্যন্ত চমৎকার সময় উপযোগী আল কুরআনের এসব আয়াত। সত্যকে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে ভোটের মাধ্যমে, ব্যালটের মাধ্যমে। ভোট হচ্ছে স্বাক্ষ্য দেয়া। কোন প্রার্থীকে ভোট দিচ্ছি অর্থাৎ তার ব্যাপারে চারিত্রিক সততা ও ন্যায় পরায়নতার সর্বোচ্চ স্বাক্ষ্য দিচ্ছি। তাই ভোট কোন হাল্কা বিষয় নয়। আমাদের সততাকে প্রতিষ্ঠিত করা এবং ইনসাফের সাক্ষ্যদাতা হতে সঠিক ব্যক্তিকে নির্বাচিত করতে হবে। সে প্রত্যাশা নিয়ে ৯ সেপ্টেম্বরে ডাকসুর ব্যালট বিপ্লবের দিকে তাকিয়ে গোটা দেশ।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের প্রতি আহ্বান থাকবে অতীত থেকে শিক্ষা নিয়েÑআগামীর কাক্সিক্ষত স্বপ্নের দেশ গড়তে বিশ্ববিদ্যালয়ের পবিত্র অঙ্গনে, মানুষ গড়ার আঙ্গিনায় সন্ত্রাস মাদক ও চাঁদাবাজ মুক্ত, শিক্ষাবান্ধব, শিক্ষার্থী বান্ধব, নারী বান্ধব পরিবেশ নিশ্চিত করতে, ডাকসুতে সৎ যোগ্য ও দায়িত্ববান মানবিক প্রার্থীকে নির্বাচিত করি।

লেখক : প্রাবন্ধিক ও আইনজীবী।