হারুন ইবনে শাহাদাত
আমরা এমনই দুর্ভাগা যে, নিজেরাই নিজ দেশে পরবাসী হওয়ার আয়োজন করছি। এ আয়োজনের মহাজনরা হলেন ৩৬ জুলাই বিপ্লবের শহীদদের রক্তের ঋণশোধের দায় নিয়ে গড়া সংষ্কার কমিশনেরই একটি অন্যতম কমিশন, ‘শ্রম সংস্কার কমিশন’। তারা সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন ‘শ্রমজগতের রূপান্তর-রূপরেখা’ নামে একটি সুপারিশ দাখিল করেছেন। এখানেই এমন একটি বিষয় লুুকিয়ে আছে, যা এখন পর্যন্ত মনে হচ্ছে আমাদের দেশের সচেতন নাগরিক, রাজনৈতিক দলের নেতৃত্ব ও সাংবাদিকদের দৃষ্টির আড়ালে আছে ‘শ্রমজগতের রূপান্তর-রূপরেখা’য় বর্ণিত ৬.১.৫ এ। অথচ আড়ালে-আবডালে থেকে পাস হয়ে গেলে অন্য দেশ থেকে অত্যাচারিত হয়ে এদেশে আশ্রয় নেয়া উপজাতি গোষ্ঠী, যাদেরকে এদেশের সংবিধান ক্ষুদ্র-নৃ-গোষ্ঠী হিসেবে স্বীকৃত দিয়েছে তারা হবেন আদিবাসী। এদেশের আদি জনগোষ্ঠী মুসলিম, হিন্দু ও খ্রিস্টান, বৌদ্ধরা যারা সমতলে বসবাস করেন তারা হবেন পরবাসী। যাকে বলে উড়ে এসে জুড়ে বসা উপজাতি জনগোষ্ঠী আদিবাসী স্বীকৃতির শক্তিবলে খুব সহজে দেশের মানচিত্র খামচে ধরবে। অথচ ঐতিহাসিকভাবে সত্য নুহ (আ.)-এর পুত্র হামের জ্যেষ্ঠ সন্তান হিন্দ হিন্দুস্তানে আসার দরুন এ অঞ্চলের নাম তাঁর নামানুসারে রাখা হয়। সিন্ধ জ্যেষ্ঠ ভ্রাতার সঙ্গে এসে সিন্ধু দেশে বসতি স্থাপন করায় এ অঞ্চলের নাম তাঁরই নামানুসারে সিন্ধু রাখা হয়। হিন্দের দ্বিতীয় পুত্র বংয়ের (বঙ্গ) সন্তানেরা বাংলায় উপনিবেশ স্থাপন করেন। আদিতে বাংলার নাম ছিল বঙ। [সূত্র : গোলাম হোসায়ন সলিম, বাংলার ইতিহাস (রিয়াজ-উস-সালাতিনের বঙ্গানুবাদ, আকবরউদ্দীন অনূদিত, অবসর প্রকাশন, ফেব্রুয়ারি ২০০৮, পৃষ্ঠা ২৪)] প্রত্যেক নবী ও রাসুূলই এসেছেন ইসলামের দাওয়াত নিয়ে। তাঁরা সবাই ছিলেন মুসলিম। তাই নূহ (আ.)-এর নাতিরাও ছিলেন মুসলমান। তারাই এদেশে প্রথম বসতি শুরু করেন। তাই এনিয়ে সন্দেহের কোন অবকাশ নেই মুসলমানরাই ভারতীয় উপমহাদশের আদিবাসী। অথচ সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন ‘শ্রমজগতের রূপান্তর-রূপরেখা’-এ যাদের আদিবাসী বলে সুপারিশ করে আইএলও কনভেনশন ১৬৯ বাস্তবায়নের সুপারিশ করা হয়েছে তারা সবাই উপজাতি, কেউ আদিবাসী নন। বিষয়টি তারাও স্বীকার করেন। যেমন: শশী চাকমা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে লিখেছেন, ‘‘আমরা যে আদিবাসী নই আমরা যে উপজাতি সেটা কথায় কথায় স্মরণ করিয়ে দেই। আমাদের পূর্বপুরুষরা তো সত্যিই বার্মা, চীন, ভারত, ত্রিপুরা থেকে আসছে। আমরা সবাই বহিরাগত। আমরা সংখ্যাতেও খুবই কম। আমাদের আদিবাসী দাবি করার কোন যুক্তিই নেই।’’ ( দৈনিক ইনকিলাব, ০৯ আগস্ট ২০২২)
আইএলও কনভেনশন ১৬৯ সুপারিশ বাস্তবায়ন হলে এ দেশে বসবাসকারী ৫০টি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীকে আদিবাসী স্বীকৃতি দিলে কম করে হলেও ৫০টি স্বায়ত্বশাসিত অঞ্চল দিতে বাধ্য থাকে সরকার। কারণ বাংলাদেশে বসবাস করে ৫০টির মতো ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর মানুষ। ২০২২ সালের জনশুমারি অনুযায়ী, বাংলাদেশে ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর জনসংখ্যা ১৬ লাখ ৫০ হাজার ১৫৯। এর মধ্যে নারীর সংখ্যা ৮ লাখ ২৫ হাজার ৪০৮ আর পুরুষের সংখ্যা ৮ লাখ ২৪ হাজার ৭৫১। মজার ব্যাপার হলো, মানবাধিকারকর্মীদের দাবি, এ সংখ্যা আরও বেশি এবং দুর্গম এলাকায় তথ্যসংগ্রাহকেরা না যাওয়ায় ওই সব এলাকায় বসবাসরত ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর প্রকৃত তথ্য জনশুমারিতে অন্তর্ভুক্ত হয়নি। জনশুমারি অনুযায়ী, চট্টগ্রাম বিভাগে ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর জনসংখ্যা ৯ লাখ ৯০ হাজার ৮৬০, ঢাকায় ৮২ হাজার ৩১১, খুলনায় ৩৮ হাজার ৯৯২, ময়মনসিংহে ৬১ হাজার ৫৫৯, রাজশাহীতে ২ লাখ ৪৪ হাজার ৫৯২, রংপুরে ৯১ হাজার ৭০, সিলেটে ১ লাখ ৩৬ হাজার ৫৯৪ জন ও বরিশালে ৪ হাজার ১৮১।
অঞ্চল নিরিখে পার্বত্য চট্টগ্রামে ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। এ অঞ্চলে বসবাস করে ১৩টি ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর মানুষ। তাদের মধ্যে চাকমা, ত্রিপুরা, ম্রো, খুমি, লুসাই, মারমা, রাখাইন, চাক, বম, খেয়াং, পাঙ্খোয়া জাতিগোষ্ঠী উল্লেখযোগ্য। বাকি ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর মানুষেরা বসবাস করেন বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে। এদের মধ্যে মণিপুরি, গারো, সাঁওতাল ও রাজবংশী উল্লেখযোগ্য। (সূত্র; দৈনিক প্রথম আলো নাগরিক সংবাদ, ১০ মে ২০২৪)।
মানচিত্র বদলে ফেলার শংকা যে অমূলক নয়, তা আইএলও কনভেনশন ১৬৯-তে কী আছে একটু দৃষ্টি দিলেই জলবত তরলং হয়ে যাবে। আইএলও কনভেনশন ১৬৯-এর মতে, আদি জনগোষ্ঠীর আত্মপরিচয় নিরূপণের ক্ষেত্রে, তারা মূল জাতিগোষ্ঠী থেকে ভিন্নতর, নিজস্ব সামাজিক, সাংস্কৃতিক এবং আর্থ-সামাজিক মানদণ্ডে বিবেচিত হবে। এ প্রসঙ্গে অধ্যাপক মাহফুজ আহমেদ মন্তব্য করেছেন, ‘আদিবাসী জনগোষ্ঠীর অধিকার বিষয়ক ঘোষণাপত্র অনুসারে আদিবাসী হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার পর তাদের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার, স্বতন্ত্র তথা স্বায়ত্তশাসন দিতে হবে। এমনকি বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে যদি তারা মনে করে যে, তারা বাংলাদেশ রাষ্ট্রে থাকবে না বা ভারতেও যোগ দেবে না; তবে তারা স্বাধীন রাষ্ট্র স্থাপন করতে পারবে। বাংলাদেশ রাষ্ট্রে থাকলেও তারা যে অঞ্চলে বাস করে সে অঞ্চলের ভূমির মালিকানা বাংলাদেশের হবে না এবং সে অঞ্চলে সরকারের নিরাপত্তা বাহিনী কোনো কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারবে না। তারা আত্মনিয়ন্ত্রণ, স্বায়ত্তশাসন, স্বশাসিত সরকার ও তাদের স্বতন্ত্র রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও আইনি কার্যক্রম এবং তা পরিচালনার জন্য স্বনিয়ন্ত্রিত অর্থনৈতিক ব্যবস্থা চালু করতে পারবে। উপর্যুক্ত বিষয়গুলো নিশ্চিত হলে প্রকারান্তরে তা এ অঞ্চলের ওপর বাংলাদেশের নিয়ন্ত্রণ খর্ব করবে।’ (পার্বত্য নিউজডটকম, ২৭ আগস্ট ২০১৫)।
আইএলও কনভেনশন ১৬৯ বাস্তবায়নের জন্য শ্রম কমিশন সুপারিশ করায় তাই এতে ভয়। যারা সুপারিশ করেছেন, তারা সবাই ওয়ান হান্ড্রেড-এর পর যে উল্টাপাল্টা দু্িট অংক আছে, সিক্স এন্ড নাইন, যা পাগলামীর প্রতীক রম্যদুনিয়ায়। সেই শনিদশায় পড়েছেন কি না কে জানে।
লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক ও কথাসাহিত্যিক।