নুসরাত জাহান (স্মরনীকা)
যখন কোন জাতি দাসত্বকে স্বাভাবিক মনে করা শুরু করে তখন তাদের স্বাধীনতা দেয়া আর না দেয়া সমান কথা। কেননা তারা স্বাধীনতার মর্ম বোঝে না। তারা মনে করে দাসত্ব করার মধ্যে কোন ভুল নেই। আরো সহজভাবে বলতে গেলে তারা আসলে স্বাধীনতা আর দাসত্বের মধ্যকার পার্থক্য বোঝার সক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। বর্তমান সময়ে আমরা গণতন্ত্রের মুখোশে বন্দী এক জাতি। আমাদের গণতন্ত্র কেবল নামমাত্র। এর অভ্যন্তরে রয়েছে শর্তসাপেক্ষ বাকস্বাধীনতা, ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের বাহাদুরি, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি তার অভাব ইত্যাদি।
আমি যদি বলি, আমাদের দেশের আজকের এ অবস্থার জন্য কেবল সাধারণ জনগণ দায়ী। তাহলে এ দায় কেউ অস্বীকার করতে পারবে না। কথায় আছে, বাঙালি আবেগপ্রবণ জাতি। হয়তো কথাটার অনেকাংশই সত্য। যদি বাঙালি জাতির ইতিহাসে লক্ষ্য করা হয়, তাহলে আমরা দেখতে পাই শুধু আজকে থেকে নয় বরং শত শত বছর আগে থেকেই বাঙালিরা এক প্রকার দাসত্বের অভ্যন্তরে রয়েছে। প্রথমে ব্রিটিশ শাসন, পাকিস্তানি আমলের শাসন, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের দখল করা সিংহাসন এবং দীর্ঘ ১৭ বছরের স্বৈরাচারী সরকার। আমরা আসলে চোখের সামনে শান্তিটা দেখে অভ্যস্ত। আমরা প্রকৃত শান্তির চেয়ে আপাত শান্তিটাকেই বড় মনে করি। অথচ চোখের সামনের শান্তির পেছনে লুকিয়ে রয়েছে হাজার রহস্য। যা আমরা কখনোই দেখতে চাই না।
দীর্ঘ ১৭ বছরের স্বৈরাচারী সরকারের পতনের পর অন্তর্বর্তী সরকার এক নতুন আসার আলো নিয়ে ক্ষমতায় বসে। অভ্যন্তরীণ সরকারের প্রতি আমাদের আশা-আকাঙ্ক্ষা ছিল আকাশচুম্বি তবে সহযোগিতার নামে আমরা শুধু করেছি আন্দোলন। আমাদের বুঝতে হবে সরকারের সমালোচনা এবং সরকারের কাজে বাধা দিয়ে আন্দোলন করার মাঝে তফাৎ।
এ কয়েকমাসে পুরানো কিংবা নতুন রাজনৈতিক দলগুলা যা করলো, এতে আবারও প্রমাণ হয় এ দেশ আমরা এখনো গণতন্ত্রের জন্য যোগ্য নই। যেখানে শোষণ মাত্রা এত্ত বেড়ে যাবে যে খেয়ে পড়ে বাঁচাটাই আমাদের কাছে স্বাভাবিক আর শান্তির মনে হবে। তবে আমাদের দেশের ডিক্টেটররা আবার আডলফ হিটলারের মতো দেশপ্রেমিক ডিক্টেটর হন না, তারা সবাই স্ব-প্রেমিক/প্রেমিকা। এদেশের ইতিহাস ৭১ এর পর থেকে একই গতিতে বারবার পুনরাবৃত্তি ঘটাচ্ছে। কিন্তু ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেয়া মানুষ যেন ভুলেই গিয়েছে।
অন্যদেশের বিশ্ববিদ্যালয় যেখানে টেকনোলজি, রিসার্চে এগিয়ে যায়, আমরা এগিয়ে যাই নানা প্রকারের সংগঠন ও দল গঠনে। যাদের নীতিবাক্য আলাদা হলেও মূল লক্ষ্য এক। নিজস্ব স্বার্থোপলব্ধি। অথচ দুঃখজনক হলেও সত্য জনগণ তাদের সাহায্য করছে। যখন কোন রাজনৈতিক দল ক্ষমতা গ্রহণ করে, তখন তাদের নিয়ে শুরু হয় নানান সমালোচনা। কিছুদিন আগে যে দলটির স্লোগান দিতে দিতে গলা বসিয়ে ফেলেছিল এক যুবক আজ বদনাম গাইতে গাইতে তার মুখ বন্ধ হচ্ছে না। অথচ এ দলটি যে ক্ষমতায় আরোহণের পর এ ধরনের আচরণ করবে এটা আগে থেকেই জানা ছিল। তবুও সাময়িক শান্তির জন্য তারা সে দলকে নির্বাচনে জয়ী করে। প্রথম দু থেকে তিন মাস দলটি জনগণের হয়ে কাজ করলেও এরপর থেকেই শুরু হয় স্বার্থ হাসিল করা। এটি নতুন কোন ঘটনা নয় বরং রাজনৈতিক ইতিহাসের একটি চলমান ধারা।
অভ্যন্তরীণ সরকারের দায়িত্ব গ্রহণের পর আমাদের আশা-আকাক্সক্ষা ছিল দেশের সংস্কার নিয়ে। অথচ এখন আমরা চাই শুধু নির্বাচন। তবে নির্বাচনের পরে কী হবে? ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল আবারো গতানুগতিক ধারায় স্বার্থ হাসিল করা শুরু করবে নাকি জনগণের চাহিদা পূরণের চেষ্টা করবে? বাংলাদেশের রাজনীতির এমন বিকৃত রূপ আর কতদিন চলবে? মানুষ কবে ফিরে পাবে তাদের আসল গণতন্ত্র? যেখানে মানুষকে কথা বলার আগে ভয় পেতে হবে না, থাকবে না কোন শর্তসাপেক্ষ বাকস্বাধীনতা, না থাকবে দুর্নীতির বেড়াজাল কিংবা রাজনৈতিক দলের বাহাদুরি।
বাংলাদেশের রাজনীতির এমন বিপর্যস্ত অবস্থা হবার পেছনের কারণ রয়েছে অনেক। যার মধ্যে অন্যতম একটি কারণ হলো জনগণের রাজনীতির প্রতি অসচেতনতা। জনগণের মনে রাজনীতির প্রতি যে অবহেলার সৃষ্টি হয়েছে তা একটি আদর্শ সরকার এবং রাষ্ট্র গঠনে বাঁধা তৈরি করছে। সরকারের স্বচ্ছতা জবাবদিহিতার অভাব। সরকারের প্রতিটি কার্যক্রমের পেছনে নেই কোন স্বচ্ছতা বা জবাবদিহিতা। যে কারণে জনগণ সরকারের ওপর আস্থা হারিয়ে ফেলে। সরকার ও জনগণের মধ্যকার সেতু গণমাধ্যম যখন বিকৃত খবর ছড়ানো শুরু করে তখন সরকারের প্রতি জনগণের আস্থা লোপ পায়। শুধু তাই নয়, পরবর্তীতে সরকারের সংস্কারের কথাও যখন খবরের কাগজে ছাপে মানুষ তা নিয়ে সন্দেহ করে। সরকারের শিকড়ে জড়ানো দুর্নীতি রাষ্ট্রের উন্নতিতে বড় ধরনের বাধা সৃষ্টি করে। যে রাষ্ট্রের ভিত্তিতে দুর্নীতি মিশে রয়েছে সে রাষ্ট্রের উন্নতি কোনোদিনও সম্ভব নয়।
গণতন্ত্রের মুখোশ থেকে বেরিয়ে প্রকৃত গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য আমাদের কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। তার মধ্যে প্রথম হলো সরকারের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা। সরকারের প্রতিটি পদক্ষেপের জন্য জনগণের প্রতি জবাবদিহিতা করা উচিত। এতে করে জনগণের সরকারের প্রতি আস্থা বৃদ্ধি পায়। ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের স্বার্থ হাসিল বন্ধ করে রাষ্ট্র ও রাষ্ট্রের জনগণের উন্নতিতে সচেষ্ট থাকা। সরকারের শিকড়ে মিশে থাকা দুর্নীতিকে মন থেকে উচ্ছেদ করা। দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণ সম্পর্কিত আইন কঠোর করা। রাজনীতির প্রতি জনগণ বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মের সচেতনতা বৃদ্ধি করা। এ রাষ্ট্র আমাদের, এর উন্নতিতে যোগদান করার দায়িত্ব আমাদের।
অন্তর্বর্তী সরকারের উচিত কেবল নির্বাচন দিয়ে ক্ষমতা থেকে পদত্যাগ করা নয় বরং সুষ্ঠু নিশ্চিত করা এবং পরবর্তীতে কোন রাজনৈতিক দল যাতে স্বৈরাচারী না হয়ে উঠতে পারে সে ব্যবস্থা করা। বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে অন্তর্বর্তী সরকারের অবদান নেই বললেই চলে। তাই ড. মুহাম্মদ ইউনুস এর নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকারের জনগণের আস্থা অর্জনের প্রতি লক্ষ্য রাখা উচিত। তাদের যে দায়িত্ব রয়েছে সংস্কার, সুষ্ঠু নির্বাচন এবং জনগণের মাঝে রাজনৈতিক সচেতনতা বৃদ্ধি তা পূর্ণরূপে পালন করা। এতে করে বাংলাদেশ উন্নতির পথে পদযাত্রা শুরু করবে।
মানুষ তাই বিশ্বাস করে যা তার চোখের সামনে সংঘটিত হয় অথচ তার চোখের সামনে শান্তির আড়ালে যে কত রহস্য লুকানো রয়েছে তা নিয়ে তাদের কোন ভ্রুক্ষেপ নেই। যদি মানুষের সামনে একটি কুকুরকে লাথি মারা হয় তবে মানুষ তার প্রতিবাদ করবে, অথচ যদি চোখের আড়ালে মানুষ খুন করা হয় তবে তা নিয়ে তাদের মধ্যে কোন পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাবে না। সত্য সাধারণত চোখের আড়ালেই থাকে সত্যকে আমাদের খুঁজে বের করতে হয়। তাই চোখের সামনে থাকা মিথ্যাকে বিশ্বাস না করে আড়ালে থাকা সত্যকে উদঘাটন করে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা উচিত।
লেখক : জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা।