মো. কায়ছার আলী

একটি আত্মাহুতি বা দুর্ঘটনায় মর্মান্তিক মৃত্যু একটি জনপদকে আলোড়িত করতে পারে; কিন্তু একটি শাহাদাত প্রজন্মের পর প্রজন্ম খোদার রাহে প্রাণ বিলাতে অনুপ্রাণিত করে। সে অনুপ্রেরণার আভায় উদ্ভাসিত প্রতিভাধরের নাম শহীদ আবরার ফাহাদ। তিনি এদেশের স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে আপামর জনগণের চিরন্তন সংগ্রামের ইতিহাসে এক বিশাল অধ্যায়ের শিরোনাম। দেশপ্রেমের পক্ষে ক্ষুরধার লেখনীর জন্য তাকে শহীদ করা হয়েছে তিলে তিলে। তার আততায়ী কোনো ব্যক্তি ছিল না, ছিল একটি গোত্র। তার প্রোফাইলে ছিল ধর্মীয় নানা পেজ, কয়েকটি সাহসী ও সত্যবাদী খাঁটি দেশপ্রেমের পোস্ট। ওই পোস্টগুলো তৎকালীন ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক সরকারের ছাত্র সংগঠনের পছন্দ হয়নি। তার লেখা সমসাময়িক প্রেক্ষাপটের যুক্তিযুক্ত পোস্টগুলো ভাইরাল হয়েছিল। একের পর এক তিনি লেখেই যাচ্ছিলেন। ভারতের ত্রিপুরায় গ্যাস সরবরাহ প্রসঙ্গে তিনি লেখেন- কয়েক বছর আগে নিজেদের সম্পদ রক্ষার দোহাই দিয়ে উত্তর ভারত কয়লা-পাথর রপ্তানি বন্ধ করেছে, অথচ আমরা তাদের গ্যাস দেব। যেখানে গ্যাসের অভাবে নিজেদের কারখানা বন্ধ করা লাগে। সেখানে নিজের সম্পদ দিয়ে বন্ধুর বাতি জ্বালাব। হয়তো এ সুখের খোঁজেই কবি লিখেছেন ‘পরের কারণে স্বার্থ দিয়া বলি। এ জীবন মন সকলি দাও, তার মত সুখ কোথাও কি আছে, আপনার কথা ভুলিয়া যাও।’

ইলিশ মাছ প্রসংগে লেখেন ‘কে বলে হিন্দুস্থান আমাদের প্রতিদান দেয় না। এ যে ৫০০ টন ইলিশ পাওয়া মাত্র ফারাক্কা খুলে দিচ্ছে। অথচ আমরা মনের সুখে পানি খাবো আর বেশি বেশি ইলিশ পালবো। ইনশাআল্লাহ আগামী বছর এক্কেবারে ১০০১ টন ইলিশ পাঠাবো।’ পাকিস্তান ভাংগার কারণ হিসাবে লেখেন, ‘পাকিস্তান ভাংগার প্রকৃত কারণ মনে হয় ৪৬-৪৭ সালের এ ঘটনাগুলো। ৪৭ এর পর পাকিস্তান বেইমানি করেছে। এদেশের ৭ কোটি মানুষের সাথে। তার আগে করেছে পশ্চিম বাংলা আর আসামের ৬ কোটি মুসলমানের সাথে। খুব সহসাই হয়তোবা তা দৃশ্যমান হবে। কাশ্মীরে ভারতের নিপীড়নের বিরুদ্ধেও তিনি সরব ছিলেন অন্তর্জাল জগতে। সর্বশেষ পোস্ট ছিল ভারত-বাংলাদেশের পানি চুক্তি নিয়ে। তিনি লেখেন, ‘কাবেরী নদীর পানি ছাড়াছাড়ি নিয়ে কানাড়ি আর তামিলদের কামড়াকামড়া কয়েক বছর আগে শিরোনাম হয়েছিল।

যে দেশের এক রাজ্যই অন্যকে পানি দিতে চায় না। সেখানে আমরা বিনিময় ছাড়া দিনে দেড়লাখ কিউবিক মিটার পানি দিব। ৪৭ এ দেশভাগের পর দেশের পশ্চিমাদের কোন সমুদ্র বন্দর ছিল না। তৎকালীন সরকার ৬ মাসের জন্য কলকাতা বন্দর ব্যবহারের জন্য ভারতের কাছে অনুরোধ করেন; কিন্তু দাদারা নিজেদের রাস্তা নিজেদের মাপার পরামর্শ দিয়েছিল। বাধ্য হয়ে দুর্ভিক্ষ দমনে উদ্বোধনের আগে মোংলা বন্দর খুলে দেওয়া হয়েছিল। ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে আজ ইন্ডিয়াকে সে মোংলা বন্দর ব্যবহারের জন্য হাত পাততে হচ্ছে। এদেশের সর্বোচ্চ এবং আন্তর্জাতিক মানের বিদ্যাপীঠ বুয়েট। স্বাভাবিকভাবেই সেখানে মুক্তবুদ্ধি চর্চা হবে, তর্ক-বিতর্ক হবে। দৈহিক উত্তেজনা প্রকাশের প্রয়োজন নেই। হীরের টুকরো ছেলে আবরার ফাহাদ ছিলেন শতভাগ দেশপ্রেমিক। যদি দেশপ্রেমের বিষয়ে ১০০ নম্বরের পরীক্ষা নেওয়া হয়, তবে এর পাশ মার্ক হবে ১০০ নম্বরই। ১ মার্ক কম পেলেই আর দেশপ্রেমিক থাকবে না। আবরার ফাহাদ শুধু একটি নাম বা ব্যক্তি নন। তিনি এদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব, আগ্রাসন ও আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের বাতিঘর। তিনি তরুণ সমাজকে নতুন করে জাগিয়ে তুলেছেন, উজ্জীবিত করেছেন এবং জুলাই গণঅভ্যুত্থানের বীজ বপন করেছেন।

বুয়েটের সকল শিক্ষার্থীই অত্যন্ত মেধাবী, একথা বলার অপেক্ষা রাখে না। কুষ্টিয়ায় জন্ম নিলেও তিনি সারা দেশের কৃতী সন্তান। ছিলেন বুয়েটের ১৭ ব্যাচ এর দ্বিতীয় বর্ষে ইসলামের ইতিহাসের ছাত্র। গ্রামের বাড়িতে ঠিকমতো পরীক্ষার প্রস্তুতি না নিতে পারার কারণে ছুটি শেষ হওয়ার আগেই ২০১৯ সালের ৬ অক্টোবর রোববার শেরেবাংলা হলে ফিরে এসেছিল। কিন্তু ওই রাতেই ২০০৫ নম্বর কক্ষের নিখুঁত পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী হত্যার উদ্দেশ্যে ১০১১ কক্ষ থেকে ২০১১ কক্ষে ডেকে নিয়ে যায়। এমন নৃশংসভাবে তাকে সহপাঠী ও পরিচিত সিনিয়র ভাইদের হাতে জীবন দিতে হবে তা কেউ কল্পনাও করতে পারেনি। রুমে ডেকে নিয়ে যাওয়ার পরপরই তার ল্যাপটপ, মোবাইল, ফেসবুক ও মেসেঞ্জার সবগুলোই তারা ঘেঁটে দেখে। এরপর শুরু হয় বর্বরতা চড়-থাপ্পড়, কিল, ঘুষি ও এলোপাতাড়িভাবে মারধর। তিনটি ক্রিকেট স্ট্যাম্প দিয়ে ৫-৬ ঘণ্টা বেধড়ক লাঠিপেটা একের পর এক সবাই যেন ছোট্ট শরীরটার ওপর হামলে পড়ে। দুই হাত-পা সহ সারা শরীরটা কালছিটে রঙ ধারণ করে। জোর করে শিবিরে জড়িত থাকার স্বীকারোক্তি আদায়ের চেষ্টা করে। অজ্ঞান হয়ে পানি খেতে চাইলে ওরা বলে ‘ব্যাটা নাটক, করছে’।

সে সময় বমি করলে ওয়াশরুমে তাকে নিয়ে গিয়ে তারা ওয়াশ করার পর আবার রুমে নিয়ে গিয়ে পিটায়। পেটানোর খবর পুলিশ ও বুয়েট প্রশাসন জানতে পারলেও তারা সে সময় ছুটে আসেনি। বড় আফসোস ও পরিতাপের বিষয় তার হাত পা ঠান্ডা হয়ে শার্ট প্যান্ট ও তোষক ভিজে যায়। শিক্ষা আর সন্ত্রাস একসাথে চলতে পারে না। ভয়ানক সন্ত্রাসের বিষাক্ত ছোবলে আবরার ফাহাদ শাহাদাত বরণ করেন। চাদরে মুড়িয়ে ক্ষত-বিক্ষত পবিত্র দেহটি দোতলা আর নিচ তলার মাঝামাঝি সিঁড়িতে রেখে দেয়। খুনিরা তার লাশ গুম করার চেষ্টা করেছিল এবং ভেবেছিল এ হত্যার বিচার কখনোই হবে না; কিন্তু কথায় আছে ‘পাপ বাপকেও ছাড়ে না’। ভিডিও ফুটেজ, অসংখ্য আলামত দেশ-বিদেশ, জাতিসংঘসহ সবাই তোলপাড় করা এই হত্যাকাণ্ডের বিচারের দাবিতে ফুঁসে ওঠে। বুয়েটের ভিসি আবরার ফাহাদের নির্যাতনের সময় কোনো পদক্ষেপ নেননি। ভিসি ক্যাম্পাসে লাশ দেখতেও যাননি, জানাজাতেও যাননি। পরবর্তীতে পুলিশ ও ক্যাডারের পাহারায় গ্রামের বাড়িতে লাশ দাফনের জন্য ভিসি গেলে আত্মীয়-স্বজন ও গ্রামবাসীর তোপের মুখে পড়েন।

ছাত্র সংগঠনগুলো লেজুড়বৃত্তিক হওয়ায় আমাদের নোংরা সংস্কৃতি অনুযায়ী চলে দল থেকে খুনিদের বহিষ্কারের নাটক। এ খুনের বিচারের রায়ে ২০ জনের ফাঁসি এবং ৫ জনের যাবজ্জীবন কারাদণ্ডাদেশ হয়েছে। দেশ সেরা এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে প্রতিটি শিক্ষার্থী হউক আন্তর্জাতিক মানের প্রকৌশলী। এদেশের সম্মানিত অভিভাবকরা স্বপ্ন দেখেন তাদের প্রিয় সন্তান এখানে লেখাপড়া করে দেশ ও জাতির মুখ উজ্জ্বল করবে। নোংরা রাজনীতির ফাঁদে পড়ে আর কেউ কখনোও ফৌজদারি অপরাধী বা ক্রিমিনাল হয়ে উজ্জ্বল মুখগুলোকে কলংকের কালিমায় লিপ্ত করবে না। তাদের সন্তানদের ক্যারিয়ার গঠনে বা নেতৃত্বের বিকাশের জন্য আইনানুগভাবে বুয়েটের ২৯টি ক্লাব সচল থাকবে, নীতি ও নৈতিকতা বজায় রেখে প্রত্যেকে হয়ে উঠবে আবরার ফাহাদের মত দেশপ্রেমিক। বর্তমান সরকারকে অভিনন্দন ‘মরণোত্তর স্বাধীনতা পদক-২০২৫’ আবরার ফাহাদকে প্রদানের জন্য। এ দুনিয়ায় সম্মানের পাশাপাশি মহান রাব্বুল আলামিন আবরার ফাহাদকে শহীদের মর্যাদা দান করুন। এদেশের তরুণ প্রজন্ম মনেপ্রাণে হয়ে উঠুক আবরার ফাহাদের চেতনায় উজ্জীবিত ও উদ্ভাসিত।

লেখক : শিক্ষক ও প্রাবন্ধিক।