অধ্যক্ষ ডা. মিজানুর রহমান

দেশ সমাজ রাষ্ট্র ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে যে কোন আপদে-বিপদে, দুর্যোগে-দুর্ভোগে আদর্শিক জনমত গঠনে ইলেকট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়া ও মিডিয়া ব্যক্তিবৃন্দ কর্তৃক জনমত গঠন এবং দিকনির্দেশায় অবদানের গুরুত্ব অসাধারণ ও অপরিসীম। একটি দেশের মানুষ যখন তার চলার পথ হারিয়ে ফেলে, অভিভাবকহীন হয়ে পড়ে, তখন সে দেশ বিপদ থেকে মুক্তির পথ খুঁজতে থাকে। অন্ধকার সাগরে ধ্রুবতারা দেখে যেমন নাবিকরা পথ চেনে, তেমনি একজন নেতার বা একটি দলের প্রত্যাশায় প্রহর গুনতে থাকে। এমন দুঃসময়ে সর্ব প্রথম ভরসা হলো মিডিয়া বা মিডিয়ার ব্যক্তিত্বরা। অতীতে পথহারা জাতি-দেশ-বিশ্ব তাদের বিপদ-আপদ থেকে মুক্তির জন্য সবশেষে মিডিয়াকেই বেছে নিয়েছে।

মিডিয়া হলো জাতির ভালমন্দ চেনার আয়না। যে কোন জাতির উন্নয়ন ও অধপতনের নেপথ্যে অগ্রপথিক হিসেবে নিরবে কাজ করে মিডিয়া ও মিডিয়া ব্যক্তিত্বরা। পুর্বকার আমলে বেতার , ওয়ারলেস, রেডিও ও সংবাদপত্র ছিল প্রচার মাধ্যম, আর এখন বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উৎকর্ষ সাধনের ফলে টেলিভিশনসহ ইন্টারনেট আবিষ্কারের ফলে মিডিয়ার ব্যবহারের মাধ্যমে মুহুর্তের মধ্যেই দেশ ও বিদেশে অতিসহজেই সব কিছু জানা ও দৃশ্য দেখার সুযোগ হয়েছে। ফলে একথা জোর দিয়েই বলা যায় মিডিয়া যেদিকে বিশ্বকে ধাবিত করে বিশ্ব সভ্যতাও সেদিকে ধাবিত হয়। বিশ্ব পরিচালনার সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য হাতিয়ার হলো মিডিয়া বা মিডিয়া ব্যক্তিত্বরা। সুতরাং মিডিয়ার মাধ্যমেই জাতির উত্থান-পতন অনেকাংশে নির্ভর করে। তবে এটাও সত্য যে, প্রচার ও অপপ্রচার দুটোই মিডিয়ার মাধ্যমেই হয়ে থাকে।সুতরাং এটাও বলা যায় যে, সভ্যতা ও অসভ্যতার চাবিকাঠি এখন মিডিয়ার কব্জায়। এক ধরণের মিডিয়া বা মিডিয়া ব্যক্তিত্বরা স্বৈরাচার ও মানবাধিকারের বিপক্ষে চাটুকারিতার ছলে গুণকীর্তন মূলক ভূমিকা রাখে, আবার এক ধরণের মিডিয়া বা মিডিয়ার ব্যক্তিরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মানবতা, মানবাধিকার তথা সত্য প্রকাশে , আলোর পথে ,শান্তির পক্ষে ভূমিকা রাখে। আম জনতা যেটাকে বেশি গুরুত্ব দেয় দেশ -জাতি সে পথেই এগুতে থাকে।

আধুনিক বিশ্বে স্বৈরাচার বা অপশক্তির বিরুদ্ধে জনমত গঠনে যে সব চ্যানেল বা ব্যক্তিরা অগ্রণী ভূমিকা রেখেছেন সেসব চ্যানেল বা মিডিয়া ব্যক্তিরা কোন সাধারণ মিডিয়া বা সাধারণ মিডিয়া ব্যক্তিত্ব নয়। । বিগতদিনে কর্তৃত্ববাদী সরকারের বিরুদ্ধে জনমত তৈরিতে যারা ভূমিকা রেখেছে তাদের ওপর চালানো হয়েছে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনসহ জেল জুলুম মামলা হামলা। হাজার হাজার মিডিয়া ব্যক্তিদের মূল্যবান জীবন উৎসর্গ করতে হয়েছে জাতির কল্যাণে। অনেকে দেশান্তরী হয়ে জীবন বাঁচিয়েছেন। অনেককেই গুমের শিকার হতে হয়েছে। এ প্রকৃতির মিডিয়া বা মিডিয়া ব্যক্তিরা তাদের কাঙ্খিত স্বীকৃতি কতটুকু পেয়ে থাকেন তা এখনও অজানাই রয়ে গেছে।

অবশ্য সত্যের পক্ষে, ন্যায়ের পক্ষে, জনতার পক্ষে শুধু ইলেকট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়া বা মিডিয়া ব্যক্তিত্বরাই যে ভূমিকা রাখেন তা পুরোপরি সত্য নয়, বরং এদুটি জগত ছাড়াও বিভিন্ন দেশে কলম সৈনিক কবি,সাহিত্যিক, সাংবাদিক, লেখক, কলাম লেখক, প্রবন্ধকার, উপসম্পাদকীয় লেখক, গবেষক, রাজনৈতিক ব্যক্তিদের-ভাষণ বিবৃতি, ধর্মীয় নেতার আলোচনা, শিক্ষক, কন্ঠশিল্পী, চিত্রশিল্পী, কার্টুনিষ্ট,অভিনেতা- অভিনেত্রী, কঠোর সমালোচক কমবেশি সকলেরই দুঃশাসনের বিরুদ্ধে এবং জাতির দুঃসময়ে সাহস ও শক্তি যোগাতে জনমত গঠনের একটা বিরাট ভূমিকা রয়েছে। এছাড়া মিডিয়ার আরও অনেক ভূমিকা রয়েছে যেমন, জলবায়ু অভিঘাত, মহামারী, যুদ্ধ- বিগ্রহ, আন্দোলন, সংগ্রাম ইত্যাদি বিষয়ে আগাম সতর্কবাণী ও চলমান ঘটনার বিবরণ পেশ করে থাকে মিডিয়সমূহ।

তথ্য ও প্রযুক্তির এ জামানায় দেশ বিদেশের অগণিত মিডিয়া ও মিডিয়া ব্যক্তিত্বরাসহ উল্লেখিত পদধারী ব্যক্তিত্বরা যে পরিমাণ ভূমিকা রাখেন , জীবন সায়াহ্নে এসে তাদের অনেকেই বিনা স্বীকৃতিতে, বিনা চিকিৎসায় মানবেতর জীবন যাপন করে মৃত্যুবরণ করার দৃশ্য বিশ্ববিকেকে হার মানায়। অন্যান্য পেশার মানুষগুলো হয়ত অবসর গ্রহণের সময় মোটা অংকের টাকা পান, অবসর ভাতাও পান, কিন্তু বেশি সংখ্যক মিডিয়ার ব্যক্তি বা উল্লেখিত ব্যক্তিদের কোন কিছু পাবার সুযোগ নেই। অনেকেই সত্যের পথে ভূমিকা রাখার অপরাধে স্বৈরারাচারের চক্ষুশূল হয়ে অবশেষে মারা পড়তে হয়। তাদের পরিবারের সদস্যরা কিভাবে বেচেঁ থাকেন কিভাবে বেঁচে আছেন কেউ তার খোঁজ খবর রাখেন না।

এবার বাংলাদেশ প্রসঙ্গে আসি। লাল সবুজের পতাকা যেদিন থেকে স্বাধীন বাংলাদেশে উড়তে শুরু করেছে তখন থেকেই মূলত গণতন্ত্রের ছদ্দাবরণে কখনও বাকশাল, কখনও স্বৈরতন্ত্র কখনও সামরিক শাসন আবার কখনও তত্বাবধঅয়ক সরকার এ দেশ শাসন করেছে। প্রাতিষ্ঠানিক মৌলিক গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য দেশে সৎ ও যোগ্য নেতৃত্ব এবং সভ্য জনতার প্রয়োজন আছে। আমরা আদতে এ দুটোর কোনটি কী পরিমাণ অর্জন করতে পেয়েছি ?

১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় এবং এর পরবর্তীতে দেশের গণতন্ত্র, জননিরাপত্তা ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় যারা জাতির দুর্দিনে অতন্দ্র প্রহরীর ন্যায় অবদান রেখেছেন সে সকল সৎ যোগ্য এবং উপরোল্লিখিত পদধারী যে সব ব্যক্তিরা ভূমিকা রেখেছেন তাদের অবদানের স্বীকৃতি দান করা দরকার। সবশেষে বিগত দিনে বিশেষ কওে গত ২০ বছরে যে সব ব্যক্তি স্বৈরাচার বিরোধী কর্মকান্ডে অর্থ সময় মেধা ও শ্রম বিনিয়োগ করেছেন তাদের নিরঙ্কুশ তালিকা তৈরি করে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি প্রদানের কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা দরকার।

বিশেষত: প্রিন্টমিডিয়ার উপসম্পাদকীয় ও কলাম লেখক, বস্তুনিষ্ট প্রখ্যাত সাংবাদিক ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ার জগতে যারা রাতদিন পরিশ্রম করে দুঃশাসনের বিরুদ্ধে জনমত তৈরি করে একটি স্বাধীণ গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠাকরা যায়, সে বিষয়ে আলোচনা, সমালোচনাসহ সমাজ ও রাষ্ট্রের সবক্ষেত্রে সকল মহলে সকল মাধ্যমে অনন্য ভূমিকা রেখেছেন, তাদেরকে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি ও সম্মাননা প্রদানের ব্যবস্থা গ্রহণ করা অপরিহার্য। লেখক : প্রাবন্ধিক।