ড. মোজাফফর হোসেন

বিস্তারিত আলাপের আগে দেখে নিই নারীবিষয়ক কতিপয় প্রস্তাব কী কী; যা নিয়ে ইতোমধ্যেই আপত্তি ওঠেছে। প্রস্তাবগুলো হলো:

১. যৌনপেশাকে অপরাধ হিসাবে চিহ্নিত না করে শ্রম আইনে একে স্বীকৃতি দেওয়া ২। যৌনকর্মীদের আইনি সুরক্ষার নিশ্চয়তা দান, ৩। বৈবাহিক সম্পর্কের মধ্যে জোরপূর্বক যৌন সম্পর্ককে ধর্ষণ হিসাবে অন্তর্ভুক্ত করে আইন সংশোধন করা, ৪। উত্তাধিকার আইন সংস্কার করে সম্পত্তিতে নারী-পুরুষ সমান সমান অধিকার প্রতিষ্ঠা করা, ৫। বহু বিবাহ নিষিদ্ধ করা, ৬। সংসদীয় আসন দ্বিগুণ করা।

বিস্তারিত আলাপে যাওয়া যাক :

১. যৌনতা কোনো পেশার জিনিস নয়। এটি জৈব আকক্সক্ষা। জীবমাত্রই এ আকাক্সক্ষা পোষণ করে। যেমন শরীর খাদ্য চায়। খাওয়া কিন্তু পেশা নয় । নারী-পুরুষ উভয়েরই এ বিশেষ চাহিদা আছে। এমন নয়, যিনি যৌনতাকে পেশা হিসাবে নিয়েছেন তার যৌন আকাক্সক্ষা নেই। এ বিশেষ অনুভূতিকে অন্যান্য পেশার সাথে জেনারালাইজ করা যায় না। যদি করা হয়, তা হবে মূর্খতা। মূর্খতার আইনগত বৈধতা থাকে না। মনে রাখা দরকার, বৈবাহিক যৌনতার বাইরের যৌনতাকেই তো মানুষ মেনে নিতে পারে না। বিবাহিত নারী-পুরুষ কেউই মেনে নিতে পারে না। এমন অসহ্য অনুভূতি প্রাকৃতিক। যারা মেনে নিতে পারে তারা অসুস্থ। বৈবাহিক যৌনতা ব্যতীত অন্য যৌনতা মানবসমাজকে পশু সমাজে পরিণত করবে। মানুষ পশু হতে চাইলে এ প্রস্তাব বাস্তবায়ন করা যেতে পারে। মানুষ কী সেটা হতে চাইবে?

২. ধরা যাক বৈবাহিক সম্পর্কের মধ্যে জোরপূর্বক সম্পর্ককে ধর্ষণ হিসাবে গণ্য করা হলো। ধর্ষণ একটি শাস্তিযোগ্য অপরাধ। কিন্তু এ অপরাধ প্রমাণিত হবে কীভাবে? সাধারণ ধর্ষণের আলামত শনাক্ত হয় ডাক্তারি পরীক্ষায়। এখন স্ত্রী যদি নিজ সম্মতিতে মেলামেশা করে, তারপর অভিযোগ করে, তাকে এ কাজে জোরজবরদস্তি করা হয়েছে। এ অভিযোগের প্রমাণ তো ডাক্তারি পরীক্ষা হতে পারে না।

স্ত্রীর এ দাবির একমাত্র প্রমাণ হতে পারে সিসিটিভির ফুটেজ। অথবা স্ত্রীকে রাখতে হবে সার্বক্ষণিক দুজন প্রহরী; যারা গভীর রাতে স্বামী-স্ত্রীর কার্যকলাপ পর্যবেক্ষণ করবে। এসব কী সম্ভব? একটি স্বাভাবিক সম্পর্কের ভিতর এক অস্বাভাবিক সম্পর্কের জটিল রসায়ন তৈরির এ অপকৌশল নারীকমিশন কিভাবে আবিষ্কার করলো তা আমাদের মাথায় ঢোকে না। আমাদের মনে হয়েছে এ কমিশন সন্ধির নয়, দুরভিসন্ধির।

৩. সম্পত্তিতে সমান অধিকার পেতে হলে নারীকেও সংসারের জটিল, কঠিন, ভারি কাজ সমান ভাগাভাগি করতে হবে। দায়িত্ব কর্তব্য সমান হবে । এ ক্ষেত্রে নারীকে পড়তে হবে কঠিন পরিস্থিতিতে। অধিকার নিশ্চিত করতে গিয়ে ‘সুখে থাকলে ভূতে কিলায়’ এমন অবস্থার সৃষ্টি হবে। কথায় কথায় ঘটবে অপ্রীতিকর ঘটনা। ধীর ধীরে সৃষ্টি হবে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে দূরত্ব। এক সময় ভেঙে যাবে পরিবার। বরং এখনও মুসলিম স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে অর্থব্যবস্থায় রয়েছে স্ত্রীর অগ্রাধীকার। মুসলিম পরিবার আইনে আছে নারী সম্পদশালী হওয়া সত্ত্বেও স্বামী নিজের অর্থ খরচ করে স্ত্রীর ভরণপোষণের বন্ধু করবে। বিয়েতে দেনমোহর পরিশোধ করবে এবং স্ত্রীর চিকিৎসা ব্যায় মিটাবে। নারী-পুরুষের সমান অধিকার নিশ্চিত করতে গেলে বিয়েতে মোহরানার প্রশ্ন অবান্তর হবে এবং বিয়ে হবে ইচ্ছা অনিচ্ছার অধীন। নারী পুরুষের সমান অধিকার নিশ্চিত হলে মুসলিম নারীরা ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।

৪. পুরুষের বহুবিবাহ নারীর জন্য আশীর্বাদ। তবে মুসলিম পুরুষের জন্য একাধিক বিয়ের ব্যাপারে যে পরিসীমা রয়েছে তা ঠিক রেখে অতিরিক্ত সংখ্যা নিষিদ্ধ করা যেতে পারে। স্বাভাবিক ভাবেই নারী-পুরুষের তুলনায় শারীরিকভাবে দুর্বল। যৌনসক্ষমতাও স্বল্প সময়ে আবদ্ধ। সন্তান জন্মদানের পর্ব অনেক নারীর কাছে যৌনচাহিদা গৌণ হয়ে যায়। কিন্তু পুরুষ সক্রিয় থাকে দীর্ঘ সময়। এ সময়ে পুরুষ অন্য নারী তালাশ করতে পারে। কোনো নারীকে পুরুষ রক্ষীতা না রেখে স্ত্রীর মর্যাদা দিলে নারীর সম্মান বাড়ে; আর্থিক চাহিদাও মিটে। আমরা খেয়াল করেছি ধনাঢ্য বহু পুরুষ এক স্ত্রীর পাশাপাশি একাধিক বান্ধবি পোষে। বান্ধবির দায়দায়িত্ব পুরুষ নেয় না। ইচ্ছার উপর নির্ভর করে এসব সম্পর্কের স্থায়িত্ব। অধিকার এবং দায়িত্ববোধ যেখানে থাকে না সেখানে মর্যাদাও থাকে না। বরং আইন করা যেতে পারে কোনো পুরুষ-নারী, বন্ধু-বান্ধবী রাখতে পারবে না। হয় বিয়ে করো, না হয় একা থাকো। এরকম আইন হলে নারী-পুরুষ উভয়ের জন্য কল্যাণ হতে পারে।

৫. সংসদীয় আসন বাংলাদেশের চলমান আইনে উন্মুক্ত। সেখানে নারী-পুরুষ উভয়েই নির্বাচনের মাধ্যমে যেতে বাধা নেই। যখন নারী-পুরুষ সমান অধিকার চাইবেন তখন আর নারীর জন্য আলাদা করে সংরক্ষিত আসনের প্রয়োজন পড়ে না । এ দাবি নারী কমিশনের প্রস্তাবের স্ববিরোধী।

এছাড়া নারীসংস্কার কমিশনের অন্যান্য প্রস্তাবও নিরঙ্কুশ পরিশুদ্ধ নয়। স্ববিরোধী এবং অদূরদর্শি। সামাজে নারীর প্রতি অবজ্ঞা, অবহেলা, বৈষম্য, সহিংসতা যে নেই, তা বলা যাবে না। আছে। এসব সমস্যা অসমতার জন্য নয়; দৃষ্টিভঙ্গির। শুধু নারী নয়, বিত্তবৈভবের অধিকারী নারী-পুরুষ কর্তৃক বিত্তবৈভবহীন নারী-পুরুষ উভয়ই অবহেলা অবজ্ঞার শিকার হয়। এ সমস্যা মানুষের স্বভাবজাত সমস্যা। মানুষের দৃষ্টিভঙ্গিকে মানববান্ধব করতে চাইলে দরকার শিক্ষা ও সংস্কৃতির গুণগত পরিবর্তন। বদলাতে হবে অভ্যাস ও মূল্যবোধের ধারণা। নারীর সম্মান বৃদ্ধি করতে চাইলে কল্যাণমুখী সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠার বিকল্প নেই।

লেখক : গবেষক।