কলাম
ভারতের আগ্রাসী তৎপরতা কি থামবে
জুলাই-আগস্টের গণ-অভ্যুত্থানে ফ্যাসিস্ট হাসিনা সরকারের পদত্যাগ ও পলায়নের পর ভারতে একশ্রেণীর উগ্রবাদীমহল পরিকল্পিতভাবে বাংলাদেশ সরকার ও জনগণের প্রতি ঘৃণা ও বিদ্বেষ ছড়াচ্ছে। সৎ প্রতিবেশীসুলভ আচরণের পরিবর্তে ভারতের গণমাধ্যমে বাংলাদেশী
Printed Edition
॥ মুনাওয়ার হাসান ॥
জুলাই-আগস্টের গণ-অভ্যুত্থানে ফ্যাসিস্ট হাসিনা সরকারের পদত্যাগ ও পলায়নের পর ভারতে একশ্রেণীর উগ্রবাদীমহল পরিকল্পিতভাবে বাংলাদেশ সরকার ও জনগণের প্রতি ঘৃণা ও বিদ্বেষ ছড়াচ্ছে। সৎ প্রতিবেশীসুলভ আচরণের পরিবর্তে ভারতের গণমাধ্যমে বাংলাদেশী হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর জুলুম, নির্যাতন, নিপীড়ন বিষয়ে প্রকৃত তথ্যের পরিবর্তে উদ্দেশ্যমূলকভাবে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে সাম্প্রদায়িক উস্কানিমূলক প্রচার চালিয়ে দুদেশের মধ্যে পরিস্থিতি উত্তপ্ত করে তুলেছে অথচ বাংলাদেশ একটি সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশ। এ দেশের মানুষ শান্তিপ্রিয়। ভারতে সব মসজিদ যদি উগ্রবাদী হিন্দু ভেঙে ফেলে তবুও বাংলাদেশে হিন্দুদের একটি মন্দিরেও আঘাত করা হবে না। কারণ এ দেশের মুসলমানেরা প্রতিশোধপরায়ণ নয়। ভারত আমাদের বৃহৎ প্রতিবেশী রাষ্ট্র হওয়ার পরও এদেশের বিরুদ্ধে তথ্য সন্ত্রাস, খাদ্যপণ্য বন্ধ, বাংলাদেশীদের চিকিৎসাসেবা বন্ধ, হোটেল রেস্তোরাঁ থেকে বাংলাদেশীদের বের করে দেওয়া এমনকি গত ২৭ জানুয়ারি ভারতের বিজেপি নেতা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিতশাহ বলেছেন, আগামী নির্বাচনে বিজেপি নির্বাচিত হলে সকল বাংলাদেশীকে ভারত থেকে বের করে দেয়া হবে। বিভিন্ন প্রকার হুমকি অব্যাহতভাবে চালিয়ে যাচ্ছে। তারা ভারতের হাইকমিশনে হামলা, বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা পুড়িয়ে দেওয়া, বাংলাদেশ ভারত সীমান্তে বাংলাদেশীদের নির্বিচারে হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে যাচ্ছে।
১৯৭১ সাল থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত যত নাগরিক প্রাণ হারিয়েছে তার চেয়ে বেশি প্রাণ হারিয়েছে গত ১৫ বছরে। মানবাধিকার সংগঠনগুলোর দেয়া তথ্যমতে, গত পনের বছরে ৫৮৮ জন বাংলাদেশীকে হত্যা করেছে ভারতীয় বিএসএফ এবং আহত হয়েছে ৭৭৩ জন। সাম্প্রতিক সময়ে ভারতের রাজনীতি উত্তাল হয়ে উঠেছে বাংলাদেশকে নিয়ে। প্রথমত, বালাদেশ একটি স্বাধীন-সার্বভৌম দেশ। সরকার যদি কাউকে দেশদ্রোহিতার অপরাধে ও যথাযথ অভিযোগের ভিত্তিতে গ্রেফতার করে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে চায়, সেটিকে ধর্মীয় অবয়ব দিয়ে সংখ্যালঘু নির্যাতনের অভিযোগ কেবল ভারতের পক্ষে সম্ভব। এটা নিয়ে অযাচিত ও মাত্রারিক্ত প্রতিক্রিয়া বাংলাদেশ রাষ্ট্রের ওপর হস্তক্ষেপ স্বরূপ। বাংলাদেশ নিয়ে ভারত যতখানি সরব, তা কিঞ্চিৎও নিজদেশের সংখ্যালঘুদের নিয়ে হলে এত সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ও মৃত্যুর গ্লানি ভারতকে বয়ে বেড়াতে হত না। উপমহাদেশের রাজনীতিতে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা একটি ট্রাম কার্ড। এটা কাজে লাগানোর চেষ্টা করা হচ্ছে হাসিনা সরকারের পতনের পর থেকে। উদ্দেশ্য বিশ্ববাসীকে দেখানো বাংলাদেশে সংখ্যালঘুরা নির্যাতিত হচ্ছে। এটা দিল্লি থেকে নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে এখন পরিষ্কার। যারা বাংলদেশকে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছেন তারা ভারতের সংবাদমাধ্যমে নির্লজ্জ মিথ্যাচার সহজেই ধরতে পারবেন। পতিত আওয়ামী লীগ সরকার অনেক চেষ্টা করতে থাকেন সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতন করে বিএনপি-জামায়াতের ওপর কিভাবে দোষ চাপানো যায়। কিন্তু ড. ইউনূস সে আগুনে পানি ঢেলে দিলেন। এরপর শুরু হলো ভারতীয় মিডিয়ায় মিথ্যাচার। কিন্তু ভারতীয় মিডিয়া এখান থেকে ক্ষতিগ্রস্ত হিন্দুদের নিয়ে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার উসকানি দিতে থাকল।
সর্বশেষ তারা উত্তাল হয়েছেন ইসকনের একজন ধর্মগুরুকে নিয়ে। যাকে কিনা বাংলাদেশ বহিষ্কার করেছে গুরুতর অভিযোগে। তাকে গ্রেফতার করা নিয়ে ইসকন ও কিছু উগ্রবাদী হিন্দু একজন মুসলিম আইনজীবীকে আদালতে প্রাঙ্গণে কুপিয়ে হত্যা করে। এর প্রতিক্রিয়ায় কোন হিন্দুকে মরতে হয়নি এ দেশে। এ অবস্থায় বাংলাদেশের মুসলিম ধর্মগুরুরা শান্ত থাকার নির্দেশ দিলেন। তারা যে ধর্মীয় ইস্যুতে কতটা দাঙ্গাবাজ তার প্রমাণ রাখলেন বাংলাদেশের হাইকমিশনে হামলা করে, পতাকা পুড়িয়ে। তারা ভারতে যে কত মুসলমান হত্যা করেছে তার কোন হিসাব নেই। এখন ভারতের সব মসজিদের নীচে মন্দির খুঁজে পাচ্ছেন তারা। ছাত্রলীগের কর্মীরা বিশ্বজিৎকে শিবিরকর্মী বলে হত্যা করেছিল তখন ভারতের বিবেক জেগে উঠেনি। এ দেশে ধর্মীয় কারণে কোন হিন্দু এদেশে নির্যাতিত হয়েছে এমন কোন রেকর্ড নেই। বরং মুসলিমরা বিগত সরকারের আমলেই বিভিন্নভাবে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। ফেসবুকে ভারত সর্ম্পকে কিছু লেখা পোস্ট করায় আবরার ফাহাদকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে। উগ্র হিন্দুত্ববাদ ক্রমেই সমগ্র ভারতবর্ষকে গ্রাস করেছে। তৃণমূলে ছড়িয়ে পড়েছে উগ্রবাদ, জন্ম নিয়েছে ভয়ংকর মুসলিম বিদ্বেষ। বাংলাদেশীদের বিরুদ্ধে অপবাদ দেওয়া হচ্ছে এরা নাকি টাকা পয়সা ছাড়াই স্যুটকেস ভর্তি করে ভারত থেকে জিনিস নিয়ে আসেন। এ কথার কোন ভিত্তি নেই। এগুলো একটা অবাস্তব অভিযোগ।
অথচ বাংলাদেশ থেকে ভারতে যায় মূল্যবান জিনিস যেমন, কাসা, পিতল, দস্তা, মূল্যবান ধাতব পদার্থ আর ভারত থেকে আসে পচা জিনিস যার স্থায়িত্ব কম। যেমন বিভিন্ন প্রকারের ফল, অত্যন্ত নিম্নমানের বস্তু যেমন শাড়িলুঙ্গি, গামছা, সিট কাপড় ইত্যাদি। এগুলো দেখতে খুবই চমৎকার অথচ এত নিম্নমানের, যা তিনমাসের বেশি ব্যবহার করা যায় না। এসব সুতি বস্ত্র ক্রয় করে এ দেশের জনগণ প্রতারিত হচ্ছে। ভারত যে বাংলাদেশীদের চিকিৎসা দিবে না বলে হুমকি দিয়েছে। এমতবস্থায় আমাদের হাত গুটিয়ে বসে থাকলে চলবে না। আমাদের বিকল্প চিকিৎসাব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। প্রতিবছর আমাদের দেশ থেকে দেশীয় চিকিৎসার প্রতি আস্থা হারিয়ে হাজার হাজার লোক ভারতে চিকিৎসার জন্য যাচ্ছে, তাদেরকে যাওয়া বন্ধ করতে হবে। দেশের কোটি কোটি টাকা পাচার হয়ে যাচ্ছে। আমাদের দেশের বহু অভিজ্ঞ ডাক্তার বিদেশে চিকিৎসা সেবা দিচ্ছে, তারা সুযোগ পেলে দেশে চিকিৎসা দিতে প্রস্তুত। তাদেরকে দেশে ফিরিয়ে এনে চিকিৎসা সেবায় নিয়োজিত করতে হবে। পরনির্ভরতা কমিয়ে স্বনির্ভশীল হয়ে গড়ে উঠতে হবে। ২০ বছর আগে দেশে যে চিকিৎসা সরঞ্জামাদির অভাব ছিল এখন কিন্তু নেই। উন্নত চিকিৎসা সরঞ্জামাদি দেশে আনা সম্ভব। তবে বেশ কিছু সমস্যা রয়েছে, ভাল চিকিৎসা কেন্দ্র নেই। কর্মরত ডাক্তার, নার্স অন্যন্য ব্যক্তিদের সংবেদনশীল ব্যবহারজনিত প্রশিক্ষণ বা প্রয়োগের অভাব, যা রোগীবান্ধব চিকিৎসা কেন্দ্র প্রতিষ্ঠার অন্যতম শর্ত। আমাদের দেশের চিকিৎসা খরচ স্বচ্ছতা অনুপস্থিত। চিকিৎসা খরচ, স্বচ্ছতা এনে চিকিৎসা বা স্বাস্থ্য ব্যবস্থার ওপর আস্থা ফিরিয়ে আনতে হবে। প্রফেসর ড. ইউনূস একজন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান। সারাবিশ্বে তার গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে। তিনি যেন তার বৈশ্বিক পরিচিতি দিয়ে নিকট প্রতিবেশী দেশ, যেমন মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড এমনকি জাপানে অবস্থিত প্রখ্যাত চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানের শাখা হাসপাতাল বাংলাদেশের স্থাপনের চেষ্টা চালালে আমরা সফল হব। এতে করে দেশে আন্তর্জাতিক মানের চিকিৎসা ব্যবস্থা গড়ে উঠতে পারে। ফলে দক্ষ ও অর্ধদক্ষ মানুষের কর্মসংস্থান হবে। বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা চিকিৎসার মত লাভজনক খাতে নিজেরা বিনিয়োগ এবং অন্যদেরকে অনুপ্রাণিত করে আধুনিক হাসপাতাল নির্মাণ করে চিকিৎসা ক্ষেত্রে নজীরবিহীন দৃটান্ত স্থাপন করতে পারে। হাসপাতাল ব্যবসাকে লাভজনক গণ্য করে বিভিন্ন ব্যাংক সরাসরি অর্থ বিনিয়োগ করতে পারে। বিদেশী উৎসাহী উদ্যোক্তাদের সঙ্গে জয়েন্ট ভেঞ্চারে হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করে চিকিৎসা ক্ষেত্রে এক যুগান্তকারী ভূমিকা রাখা যেতে পারে। ভারতীয়রা বাংলাদেশীদেরকে তাদের হোটেল থেকে বের করে দিবেন! এটা কেমন কথা। তারা কি বিনামূল্যে তাদেরকে খাওয়া পরার ব্যবস্থা করে থাকেন। বিনামূল্যে কি চিকিৎসা সেবা দিয়ে থাকেন। এদিকে ভারত যে খাদ্যপণ্য আসে তা বন্ধ করে এ দেশের ১৮ কোটি মানুষকে ক্ষুধার্ত না খাইয়ে মেরে ফেলার হুমকি দিয়েছে। এ ক্ষেত্রে আমাদের খাদ্যশস্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করতে হবে। আমাদের এখন করণীয় হলো, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও কৃষি মন্ত্রণালয় একযোগে কাজ করে বিভিন্ন কৃষি পণ্য আমদানি বিষয়ে দেশীয় উৎপাদন এবং চাহিদা পূর্বাভাস বিশ্লেষণে এক চৌকস শাখা গঠন করে আমদানিকারকদের কাছে প্রয়োজনীয় তথ্য সরবরাহ করা জরুরি। যাতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় এবং আমদানিকারকরা বিবিধ উৎপাদনকারী দেশের সঙ্গে অগ্রিম চুক্তি করতে পারে। এতে করে ভারত নির্ভরতা কাটিয়ে উঠা সম্ভব। একটি দেশের জন্য পারস্পরিক সম্পর্ক বিকাশ যেমন অপরিহার্য। তেমনি সম্পর্কের ক্ষেত্রে অতিনির্ভরতা বিপদজনক।
লেখক : কলামিস্ট