মো. শামীম মিয়া
বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চল, বিশেষ করে রংপুর, লালমনিরহাট, কুড়িগ্রাম, নীলফামারী এবং গাইবান্ধা-অঞ্চল শুধু দেশের ভৌগোলিক মানচিত্রে নয়, সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক দিক থেকেও গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে। নদী, চর এবং জলাধারের অগণিত স্রোত দ্বারা সমৃদ্ধ এ অঞ্চল প্রাচীনকাল থেকেই মানুষের জীবন, অর্থনীতি এবং পরিবেশের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে যুক্ত। এখানকার কৃষি, মৎস্যচাষ, নৌপরিবহন এবং অর্থনীতিÑসবই নদীর স্রোতের ওপর নির্ভরশীল। কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে এ অঞ্চল কেন্দ্রীয় সরকারের নীরবতা, প্রশাসনিক উদাসীনতা এবং অবহেলার শিকার হয়েছে। নদী ভাঙন, চর উত্থান, জলাবদ্ধতা এবং অবকাঠামোগত দুর্বলতার ফলে মানুষের জীবন, অর্থনীতি এবং পরিবেশ ক্রমশ বিপন্ন হয়ে উঠেছে।
উত্তরবঙ্গের এ সংকটের শিকড় কেবল প্রাকৃতিক নয়; বরং এটি রাজনৈতিক, প্রশাসনিক ও অর্থনৈতিক উদাসীনতার ফল। নদী রক্ষা, অবকাঠামো উন্নয়ন এবং স্থানীয় অধিকার বাস্তবায়নে দীর্ঘমেয়াদি বিলম্ব, কেন্দ্রীয় সরকারের নীরবতা এবং স্থানীয় প্রশাসনের কার্যকারিতা না থাকাÑসব মিলিয়ে এটি একটি বহুমাত্রিক সংকট তৈরি করেছে। বিশেষ করে তিস্তা নদী, যা রংপুর, লালমনিরহাট এবং কুড়িগ্রাম জেলায় প্রবাহিত, এ অঞ্চলের কৃষি ও মানুষের জীবিকার সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। তিস্তার জলবাহী শক্তি এবং চরভূমি স্থানীয় কৃষি উৎপাদন ও বাস্তুসংস্থানকে সমৃদ্ধ করে, তবে নিয়মিত নদী ভাঙন এবং চর উত্থান এ অঞ্চলের অর্থনীতি এবং সামাজিক স্থিতিশীলতাকে ক্রমশ ধ্বংস করছে।
২০২৫ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে শুরু হওয়া ‘তিস্তা বাঁচাও’ আন্দোলন দীর্ঘদিনের অবহেলার বিরুদ্ধে জনগণের সুসংগঠিত প্রতিরোধের বহিঃপ্রকাশ। নদীর ভাঙন, চর উত্থান এবং জলাবদ্ধতা লক্ষাধিক মানুষকে সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। কৃষিজমি বিলীন, বাড়িঘর ধ্বংস এবং পরিবেশগত ক্ষতির কারণে মানুষ রাস্তায় নামছে। বিশেষ করে মশাল প্রজ্জ্বলন কর্মসূচি, গণমিছিল ও পদযাত্রাÑযা রংপুর বিভাগের পাঁচটি জেলায় একযোগে ১১টি স্থানে অনুষ্ঠিত হয়েছেÑএটি প্রমাণ করছে যে তিস্তা রক্ষা আন্দোলন কেবল পরিবেশগত বা অর্থনৈতিক সমস্যা নয়, বরং মানুষের জীবন, মর্যাদা এবং সামাজিক ন্যায়বিচারের প্রশ্ন।
নদী শুধুমাত্র পানি বহন করে না; এটি অর্থনীতি, সমাজ, পরিবেশ এবং রাজনীতির এক জটিল সমন্বয়। নদী ভাঙনের ফলে কৃষিজমি বিলীন হচ্ছে, বসতি এলাকা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে এবং মানুষের জীবন ঝুঁকির মধ্যে পড়ছে। এটি শুধুমাত্র স্থানীয় প্রশাসনের বা প্রকল্পের অভাবে ঘটে না, বরং দীর্ঘমেয়াদি রাজনৈতিক নীরবতা এবং কেন্দ্রীয় সরকারের অগ্রাধিকারহীনতার ফল। নদী রক্ষা এবং পরিবেশ সংরক্ষণে সরকারের ভূমিকা থাকলেও, দীর্ঘদিন ধরে তিস্তা মহাপরিকল্পনা কার্যকর হয়নি। সরকারের ধীরগতি, প্রকল্প বিলম্ব এবং রাজনৈতিক অনীহাÑসবই নদীর জীববৈচিত্র্য, কৃষি এবং মানুষের জীবনকে বিপন্ন করেছে।
উত্তরবঙ্গের রাজনৈতিক ইতিহাসও এ সংকটকে আরও গভীর করেছে। সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত বক্তব্য অনুযায়ী, “দীর্ঘ ১৬ বছর এক ধরনের ফ্যাসিবাদী শাসন রংপুরের মানুষের বুকের ভেতরে জগদ্দল পাথরের মতো বসিয়ে দিয়েছে।” এটি নির্দেশ করে যে রাজনৈতিক কারণে প্রকল্প বিলম্ব, স্থানীয় অধিকার অবহেলা এবং সরকারের উদাসীনতাÑসবই উত্তরবঙ্গের জনগণকে দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতির দিকে ঠেলে দিয়েছে। সরকারের এই ধীরগতি শুধু স্থানীয় আন্দোলনকে জোরদার করেছে না, বরং নদী সংরক্ষণে জনগণের সচেতনতা ও উদ্যোগকেও শক্তিশালী করেছে।
উত্তরবঙ্গের জনগণ এখন নদী রক্ষার দাবিকে কেবল পরিবেশগত দৃষ্টিকোণ থেকে নয়, বরং সামাজিক ও রাজনৈতিক অধিকার, ন্যায়বিচার এবং মর্যাদার প্রতিফলন হিসেবে দেখছে। আন্দোলনের মাধ্যমে দেখা গেছে, নদী রক্ষা আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী জনগণ রাজনৈতিক দলের বাইরে থেকে সক্রিয় হয়েছে। ছাত্র, যুব, সামাজিক সংগঠন এবং স্থানীয় নেতাÑসবাই একসঙ্গে এ আন্দোলনের অংশ হয়েছেন। মশাল প্রজ্জ্বলন, গণমিছিল, পদযাত্রা এবং স্মারকলিপি প্রদানÑসব মিলিয়ে এটি প্রমাণ করছে যে, নদী রক্ষা এখন মানুষের জীবন, অধিকার এবং ন্যায়বিচারের সঙ্গে সরাসরি জড়িত।
নদী ভাঙন ও চর উত্থান শুধু স্থানীয় মানুষের জীবনকে হুমকির মধ্যে ফেলে না; এটি অর্থনৈতিক ও সামাজিক ধ্বংসেরও কারণ। ১৩০ কিলোমিটার দীর্ঘ তিস্তা নদীর বিভিন্ন স্থানে চর উত্থানের কারণে শতাধিক কৃষিজমি বিলীন হয়েছে। কৃষকরা মৌসুমী ফসল হারাচ্ছেন, যা স্থানীয় খাদ্য নিরাপত্তাকে বিপন্ন করছে। ভাঙনের কারণে বাড়িঘর ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, এবং পরিবারগুলো অবিরাম উদ্বেগের মধ্যে দিন কাটাচ্ছে। স্থানীয় নদী তত্ত্বাবধান এবং প্রশাসনিক উদাসীনতা এ সংকটকে আরও তীব্র করেছে।
এই পরিস্থিতিতে নদী রক্ষা আন্দোলনের ভেতরে জনগণের সচেতনতা এবং সমন্বয় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। লালমনিরহাট, রংপুর, কুড়িগ্রাম, নীলফামারী ও গাইবান্ধা-এ পাঁচটি জেলায় একযোগে মশাল প্রজ্জ্বলন, গণমিছিল, পদযাত্রা এবং স্মারকলিপি প্রদান-সবই প্রমাণ করেছে যে জনগণ নদী রক্ষা, ন্যায়বিচার এবং অধিকার আদায়ের জন্য ঐক্যবদ্ধ। আন্দোলনের নেতৃত্বে থাকা অধ্যক্ষ আসাদুল হাবিব দুলু স্পষ্টভাবে জানিয়েছেন, যদি তিস্তা মহাপরিকল্পনা কার্যকরভাবে বাস্তবায়ন না করা হয়, তাহলে রংপুর বিভাগের মানুষ বৃহত্তর রাজনৈতিক ও সামাজিক আন্দোলনে নামতে বাধ্য হবে।
সরকারের ধীরগতির কারণে নদীর জীববৈচিত্র্য ধ্বংসের আশঙ্কা বৃদ্ধি পাচ্ছে। কৃষি ও মৎস্যজীবী জনগণের ক্ষতি, বন্যা নিয়ন্ত্রণের অকার্যকর ব্যবস্থা এবং নদী ভাঙনের ফলে নিম্ন আয়ের মানুষের জীবনযাত্রা কঠিন হয়ে পড়েছে। নদী সংরক্ষণ ও মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন এখন আর দেরি করতে পারবে না; এটি জাতীয় নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার সঙ্গে যুক্ত। আন্দোলনের মাধ্যমে স্থানীয় জনগণ শুধু সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করছেন না, বরং তারা আন্তর্জাতিক নদী ব্যবস্থাপনা এবং পরিবেশ সংরক্ষণ নীতির সঙ্গে নিজেদের দাবিকে মিলিয়ে দেখাচ্ছেন। বাংলাদেশে নদী ব্যবস্থাপনার অভিজ্ঞতা এবং আন্তর্জাতিক নদী রক্ষা প্রক্রিয়ার তুলনা দেখায়, নদী সংরক্ষণে জনগণের সরাসরি অংশগ্রহণ অপরিহার্য। অন্য দেশগুলোর নদী সংরক্ষণ প্রকল্প যেমন নেপাল ও ভারতীয় রাজ্যগুলোর উদ্যোগ দেখায় যে, স্থানীয় জনগণকে অবহেলা করলে প্রকল্প ব্যর্থ হয় এবং পরিবেশগত ও সামাজিক ক্ষতি বাড়ে। উত্তরবঙ্গের নদী ভাঙন ও তিস্তা মহাপরিকল্পনার বিলম্বের কারণে খাদ্য নিরাপত্তা ও অর্থনীতিতে দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব পড়তে পারে। কৃষি উৎপাদন কমে যাবে, স্থানীয় মানুষের আয় হ্রাস পাবে এবং সামাজিক অস্থিরতা বৃদ্ধি পাবে। বন্যা ও চর উত্থান, নদীর স্রোত নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতা, এবং সরকারি উদ্যোগের অভাবÑসব মিলিয়ে এই অঞ্চলে একটি গভীর মানবিক ও অর্থনৈতিক সংকট তৈরি করছে।
সামাজিক দিক থেকেও দেখা যায়, নদী ও পরিবেশের অবনতি স্থানীয় সম্প্রদায়ের মধ্যে অনাস্থা সৃষ্টি করেছে। স্থানীয় মানুষ ও প্রশাসনের মধ্যে দূরত্ব বাড়ছে, রাজনৈতিক প্রতিহিংসা ও অগ্রাহ্যতার কারণে জনগণ আন্দোলনে নামছে। নদী রক্ষা আন্দোলন কেবল প্রকল্প বাস্তবায়নের দাবি নয়, এটি মানুষের অধিকার, ন্যায়বিচার এবং সামাজিক শান্তি বজায় রাখার চূড়ান্ত মাধ্যম।
উত্তরবঙ্গের আন্দোলন এবং তিস্তা নদীর সংরক্ষণ প্রমাণ করেছে যে, রাজনৈতিক নেতৃত্ব ও সরকারকে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। যদি নদী রক্ষা ও মহাপরিকল্পনা কার্যকরভাবে শুরু না করা হয়, তবে ভবিষ্যতে উত্তরবঙ্গের মানুষ খাদ্যের জন্য রাজধানী অভিমুখে লংমার্চ করতে বাধ্য হবে। এটি শুধু রাজনৈতিক হুমকি নয়, বরং সামাজিক ও মানবিক সংকটও বয়ে আনবে।
চূড়ান্তভাবে বলা যায়, তিস্তা নদী এবং উত্তরবঙ্গের মানুষদের অধিকার রক্ষা এখন আর স্থানীয় বা আঞ্চলিক ইস্যু নয়। এটি একটি জাতীয় দায়িত্ব, যা দেশের অর্থনীতি, খাদ্য নিরাপত্তা, পরিবেশ এবং সামাজিক স্থিতিশীলতার সঙ্গে সরাসরি যুক্ত। নদী সংরক্ষণ, মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন, এবং সরকারের কার্যকর পদক্ষেপ ছাড়া এই অঞ্চল এবং দেশের বৃহত্তর ভবিষ্যৎ ঝুঁকিতে রয়েছে।
তিস্তা নদী রক্ষা আন্দোলনের ঐক্যবদ্ধ অবস্থান প্রমাণ করছে যে, জনগণ সচেতন, সক্রিয় এবং নিজের অধিকার আদায়ে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। এই আন্দোলন ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য শক্তিশালী ন্যায়বিচার, পরিবেশ সচেতনতা এবং সামাজিক ঐক্যের প্রতীক হয়ে থাকবে। সরকারের দায়িত্ব হলো জনগণের এই আন্দোলনকে সম্মান করা, কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা এবং নদী সংরক্ষণ ও মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নের মাধ্যমে উত্তরবঙ্গের মানুষের জীবন, অধিকার এবং মর্যাদা নিশ্চিত করা।
তিস্তা নদী রক্ষা আন্দোলন কেবল নদীর জন্য নয়; এটি উত্তরবঙ্গের মানুষের জীবন, অর্থনীতি, খাদ্য নিরাপত্তা, সামাজিক শান্তি এবং রাজনৈতিক ন্যায়বিচারের জন্য একটি অবিচ্ছেদ্য সংগ্রাম। এ আন্দোলনের মাধ্যমে স্পষ্ট হয়েছে যে, জনগণ আর নীরব থাকবে না। তারা সচেতন, একজোট এবং নিজের অধিকার রক্ষায় দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। সরকারকে এখনই কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে, নাহলে নদী, কৃষি, জীবন এবং সামাজিক স্থিতিশীলতা বিপন্ন হবে।
উত্তরবঙ্গের ভাঙনপ্রবণ নদী, চর, কৃষি ক্ষতি, রাজনৈতিক প্রতিহিংসা, সরকারের ধীরগতি এবং জনগণের আন্দোলনÑসব মিলিয়ে একটি স্পষ্ট চিত্র তৈরি করেছে। তিস্তা নদী সংরক্ষণ এবং মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন না হলে, শুধু নদী নয়, মানবজীবন, খাদ্য নিরাপত্তা, অর্থনীতি এবং সামাজিক স্থিতিশীলতাও বিপন্ন হবে। জনগণের ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন প্রমাণ করেছে যে, নদী রক্ষা এখন আর স্থানীয় সমস্যা নয়; এটি জাতীয় দায়িত্ব এবং ন্যায়বিচারের ইস্যু।
উত্তরবঙ্গের মানুষ আর নীরব থাকবে না। তারা সচেতন, সক্রিয় এবং নিজের অধিকার আদায়ে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। এ আন্দোলন ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি শক্তিশালী ন্যায়বিচার, পরিবেশ সচেতনতা এবং সামাজিক ঐক্যের প্রতীক হয়ে থাকবে। সরকারের দায়িত্ব হলো এই আন্দোলনকে সম্মান করা এবং কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা, যাতে নদী, কৃষি, মানুষের জীবন ও মর্যাদা সুরক্ষিত থাকে।
লেখক : শিক্ষার্থী, ফুলছড়ি সরকারি কলেজ সাঘাটা, গাইবান্ধা।