সম্প্রতি ভারত শাসিত কাশ্মীরের পেহেলগামে পর্যটকদের ওপর সন্ত্রাসী হামলায় ২৬ জন নিহত হওয়ার পর পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে চরম উত্তেজনার সৃষ্টি হয়েছে। এ হামলায় পাকিস্তানের মদদ রয়েছে বলে অভিযোগ তুলেছে ভারত। যদিও এ দাবির পক্ষে তারা গ্রহণযোগ্য কোন তথ্য-প্রমাণ উপস্থাপন করতে পারেনি। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বিষয়টিতে নিয়ে নানাবিধ বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে। এমনকি বিষয়টি নিয়ে খোদ ভারতেও ভিন্নমত দেখা দিয়েছে। বিভিন্ন সূত্রে দাবি করা হচ্ছে, মুসলিম বিদ্বেষ উস্কে দেওয়ার জন্যই পরিকল্পিতভাবে এমন ঘটনা ঘটিয়েছে ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা। পাকিস্তান এ নৃশংস ঘটনার জন্য দায়ীদের চিহ্নিত করতে আন্তর্জাতিক তদন্তের আহ্বান জানিয়েছে। যদিও ভারত এ আহ্বানে এখন পর্যন্ত সাড়া দেয়নি।

এদিকে ভারত ঘটনার জন্য প্রতিবেশী পাকিস্তানকে দায়ী করে গত ২৩ এপ্রিল প্রতিবেশী দেশটির নাগরিকদের ভিসা বাতিলসহ পাঁচটি পদক্ষেপ নিয়েছে ভারত। এর জবাবে গত ২৪ এপ্রিল ভারতের নাগরিকদের ভিসা বাতিল, দেশটির সাথে বাণিজ্য স্থগিত, আকাশসীমা বন্ধসহ বেশ কয়েকটি পাল্টা পদক্ষেপ নিয়েছে পাকিস্তানও। আগের দিন ভারত যেসব পদক্ষেপ নিয়েছে, সেগুলোর মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ ছিল সিন্ধু পানি চুক্তি স্থগিতের ঘোষণা। এর জবাবে পাকিস্তান হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছে, ওই চুক্তি অনুযায়ী পানি প্রবাহ থামানো বা অন্যদিকে নেয়ার যেকোনো চেষ্টা যুদ্ধ ঘোষণার শামিল হিসাবে বিবেচনা করা হবে। একই সাথে ভারতীয় পদক্ষেপের পাল্টা ব্যবস্থা হিসাবে ‘ঐতিহাসিক সিমলা চুক্তি’ বাতিল করার কথা বলেছে পাকিস্তান।

পাক-ভারতের মধ্যে ঐতিহাসক সিমলা চুক্তি খুবই গুরুত্বপূর্ণ দ্বিপাক্ষিক চুক্তি। যা ১৯৭২ সালে উভয় দেশের মধ্যে সম্পাদিত হয়েছিলো। ১৯৭১ সালের যুদ্ধে ছিল তিনটি পক্ষ ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনী। ১৯৭১-এ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের শেষ প্রান্তে ডিসেম্বর মাসে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ শুরু হয়। পাকিস্তান সেনাবাহিনী ১৬ ডিসেম্বর আত্মসমর্পণ করে এবং যুদ্ধবন্দী হিসেবে তাদের নিরাপত্তা দেয়া হয়। বাংলাদেশ যুদ্ধাপরাধী হিসেবে এদের বিচার করতে চেয়েছিল। ভারতের হেফাজত থেকে এদের মুক্তি এবং যুদ্ধবন্দী হিসেবে তাদের বিচার রহিতকরণ ছিল পাকিস্তান সরকারের জন্য একটি জরুরি বিষয়। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টো ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী সিমলায় এক শীর্ষ বৈঠকে মিলিত হয়ে (২৮ জুন হতে ২ জুলাই ১৯৭২) দীর্ঘ আলোচনার পর একটি শান্তিচুক্তি স্বাক্ষর করেন। এ চুক্তিতে ভারত ও পাকিস্তান তাদের সকল বৈরিতার অবসান, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সকল ক্ষেত্রে বন্ধুত্ব ও সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা এবং জম্মু ও কাশ্মীরে বিরাজমান স্থিতাবস্থা পুনঃস্থাপনের অঙ্গীকার ব্যক্ত করে। এ চুক্তির অধীনে ভারত সকল যুদ্ধবন্দীকে বিনাবিচারে পাকিস্তানে ফেরত পাঠায়। ভারত পাকিস্তানের সঙ্গে আরও একটি ‘সার্বিক সমঝোতা’ করে, যা সন্ধির দলিলে উল্লিখিত হয় নি। এতে ছিল পাকিস্তান কর্তৃক বাংলাদেশকে কূটনৈতিক স্বীকৃতি প্রদান এবং বাংলাদেশ ও পাকিস্তান গমনেচ্ছু নাগরিকদের ফিরিয়ে নেওয়ার লক্ষ্যে সংলাপ শুরুর ব্যবস্থা। চুক্তির মধ্যে আগে ছিল ৭১-এর যুদ্ধের পর কাশ্মীরে দু’দেশের নিয়ন্ত্রণ রেখা উভয়পক্ষ মেনে নেবে। বলপ্রয়োগ থেকে বিরত থাকবে দু’দেশের সেনাবাহিনী। এ নিয়ন্ত্রণ রেখাকেই মেনে নেওয়া হয় আন্তর্জাতিক সীমান্ত হিসেবে। তা উভয় দেশের কাছেই ‘লাইন অব কন্ট্রোল’ হিসাবে স্বীকৃতি পায়। শিমলা চুক্তির মাধ্যমে পাকিস্তানী ৯৩ হাজার বন্দী সেনাদের ভারত ছেড়ে দেয় এ শর্তে যে, তাদের বিচার পাকিস্তান করবে। চুক্তির শর্ত মতে, পাকিস্তানের পশ্চিমাঞ্চলে ভারতীয় সৈনিক দ্বারা দখলকৃত সীমানা ভারত ছেড়ে দেয় বিনা শর্তে। ভবিষ্যতে ভারত পাকিস্তান কোন সমস্যা সমাধানে তৃতীয় পক্ষের হস্তক্ষেপ কামনা থেকে দু’দেশই বিরত থাকবে। দু’দেশের সেনারা কোনভাবেই এলওসি সীমানা অতিক্রম করবে না।

সম্প্রতি ভারতশাসিত কাশ্মীরের পেহেলগামে পর্যটকদের ওপর বন্দুকধারীদের হামলার ঘটনায় ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে উত্তেজনা রীতিমত তুঙ্গে উঠেছে। দু’পক্ষই প্রতিশোধমূলক পাল্টাপাল্টি পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। ২২ এপ্রিল সংঘটিত ঘটনার পর দ্রুত কতগুলো সিদ্ধান্ত জানায় দিল্লী। এ তালিকায় সিন্ধু পানি বণ্টন চুক্তি স্থগিত, প্রধান সীমান্ত ক্রসিং বন্ধ করে দেয়া, পাকিস্তানীদের জন্য ভিসা বন্ধ এবং কূটনীতিকদের বহিষ্কারের মতো সিদ্ধান্তও রয়েছে। জবাবে পাকিস্তানও ভারতের বিরুদ্ধে নানাবিধ পদক্ষেপ নিয়েছে। জানানো হয়েছে, ভারত আর পাকিস্তানের আকাশসীমা ব্যবহার করতে পারবে না। সব ধরনের বাণিজ্য বন্ধ থাকবে। এছাড়া ১৯৭২ সালের সিমলা চুক্তিও স্থগিতের হুমকি প্রধান করেছে পাকিস্তান। ভারতের দিক থেকে সিন্ধু চুক্তি স্থগিতের পরপরই অবশ্য পাকিস্তানের ভেতরে সিমলা চুক্তি স্থগিতের দাবি ওঠে।

পাকিস্তানী সাংবাদিক হামিদ মীর এক্স-এ পোস্টে বলেন, ‘ভারত যদি বিশ্বব্যাংকের অধীন সিন্ধু পানি চুক্তিকে বিদায় জানাতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয়, তবে পাকিস্তানেরও সিমলা চুক্তি থেকে সরে আসা উচিত, যার মধ্যস্থতায় কোনো আন্তর্জাতিক সংস্থা অন্তর্ভুক্ত নেই।’ পাকিস্তান-শাসিত কাশ্মীরের সাবেক ‘প্রধানমন্ত্রী’ রাজা মহম্মদ ফারুক হায়দার খান সামাজিক মাধ্যম এক্স হ্যান্ডেলে লিখেন, ‘ভারত একতরফাভাবে সিন্ধু পানি চুক্তি স্থগিত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এর জবাবে সিমলা চুক্তি থেকে বেরিয়ে আসা উচিত। বিশেষত, কাশ্মীর সংক্রান্ত বিষয়ে।’ তার যুক্তি, সিমলা চুক্তি পাকিস্তানকে কাশ্মীর ইস্যুর আন্তর্জাতিকীকরণ থেকে বিরত রেখেছে। ওই চুক্তি স্থগিত হলে পাকিস্তান কোনো রকম কূটনৈতিক বাধ্যবাধকতা ছাড়াই আন্তর্জাতিক ফোরামে কাশ্মীর ইস্যু উত্থাপন করতে পারবে। তবে সিমলা চুক্তির অধীনে থাকা অবস্থাতেও অবশ্য পাকিস্তান তা করেছে। কিন্তু পাকিস্তানী বিশ্লেষকদের মতে, সিমলা চুক্তি থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পর আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে কাশ্মীর ইস্যু ‘আরো জোর গলায়’ তুলে ধরতে পারবে পাকিস্তান। মূলত, সিমলা চুক্তি এমন একটা আনুষ্ঠানিক চুক্তি যেটিকে দু’দেশের মধ্যে ‘শত্রুতা’ অবসানের জন্য গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করা হয়েছিল। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে কেন্দ্র করে ভারত-পাকিস্তান লড়াইয়ের পর ১৯৭২ সালের জুলাইতে স্বাক্ষরিত হয়েছিল এ চুক্তি।

এর ছয়মাস আগেই পাকিস্তানের সেনাবাহিনী তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে ভারতীয় সেনাবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করে। পাকিস্তানের সরকারি পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ৪৫ হাজার সৈন্য এবং আধাসামরিক বাহিনীসহ ৭৩ হাজার যুদ্ধবন্দী ভারতের কারাগারে ছিল। পশ্চিম পাকিস্তানের প্রায় পাঁচ হাজার বর্গমাইল এলাকাও ভারতের দখলে ছিল। এ পটভূমিতেই ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী এবং পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টো ভারতের হিমাচল প্রদেশের সিমলায় বৈঠক করেছিলেন। সেখানে যে সমঝোতা হয় সেটিই ‘সিমলা চুক্তি’।

মূলত, সিমলা চুক্তির অধীনে দু’দেশের মধ্যে নিয়ন্ত্রণ রেখা তথা এলওসি গঠিত হয়। তারা এ বিষয়েও একমত হয়েছিল যে, দু’পক্ষই কোনোরকম একতরফা সিদ্ধান্ত নেবে না। নিয়ন্ত্রণ রেখাকে স্কেল হিসেবে বিবেচনা করে একে অপরের ভূখণ্ড থেকে সেনা প্রত্যাহারে সম্মত হয়েছিল ভারত ও পাকিস্তান। কিন্তু দু’দেশই একে ওপরের বিরুদ্ধে নিয়ন্ত্রণ রেখাকে ‘না মানার’ অভিযোগ তুলে এসেছে।

পেহেলগামের দুঃখজনক ঘটনাকে কেন্দ্র করে মূলত উভয় দেশের মধ্যে একটা যুদ্ধাবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। যদিও তা এখন পর্যন্ত উভয় পক্ষের বাগাড়ম্বরের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রয়েছে। কারণ, উভয় পক্ষই হয়তো উপলব্ধি করতে পেরেছে, যুদ্ধ কারোর জন্যই সুফল বয়ে আনবে না। এতে উভয় দেশের মধ্যে সৃষ্ট উত্তেজনাকে কেন্দ্র করে সিন্ধু ও সিমলা চুক্তি স্থগিত বা বাতিল নিয়ে সৃষ্ট জটিলতার বিষয়টি আলোচনায় এসেছে। তবে ভারতীয় থিং ট্যাংকরা জানাচ্ছেন, সিমলা চুক্তি থেকে পাকিস্তানের বেরিয়ে যাওয়া মোটেও ভারতের জন্য কোনো ‘ধাক্কা’ হবে না। তারা বলেছেন, ‘কাশ্মীর ইস্যুতে বড় সিদ্ধান্ত নিতে বরং এটা ভারতকে সাহায্য করবে। তারা দাবি করছেন, ‘পাকিস্তান অনেক আগেই সিমলা চুক্তি থেকে সরে এসেছে। কারণ, পাকিস্তান যদি এ চুক্তি মেনে নিত, তাহলে তারা কার্গিলে যুদ্ধ করত না। এমন পরিস্থিতিতে পাকিস্তান যদি মৃত চুক্তির সৎকার করতে চায়, তাহলে তা করুক।’ কাশ্মীরী গবেষক ও আইনবিদ মির্জা সায়ব বেগ অবশ্য ভিন্নমত পোষণ করেন। তার মতে, ‘সিমলা চুক্তি শুধু কার্যকর নয়, দু’স্বাক্ষরকারী দেশও তা বাস্তবায়ন করতেও বাধ্য। সিমলা চুক্তি লঙ্ঘনের জন্য ভারতকে জবাবদিহি করাতে বা এ নিয়ে আন্তর্জাতিক কোনো দাবি না তুলতে পারাটা পাকিস্তানের অযোগ্যতা। সিমলা চুক্তিতে একতরফা সিদ্ধান্তের কোনো ধারণা নেই।’ তিনি জোর দিয়ে বলেন, পাকিস্তান তাদের অধিকারের অধীনে ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট অফ জাস্টিসে ভারতের বিরুদ্ধে ওই চুক্তিকে লঙ্ঘনের অভিযোগ জানিয়ে মামলা করতে চেয়েছিল। কিন্তু পাকিস্তান কেন এমনটা করেনি সেটা তারাই জানে।

এ বিষয়ে বিবিসিকে পাকিস্তানের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী খুরশিদ মাহমুদ কাসুরি বলেছেন, ‘এখন এ অঞ্চলের পরিস্থিতি সিমলা চুক্তির যুগ পার করে গেছে। গত দশকেও লাহোর চুক্তি, ইসলামাবাদ চুক্তির কথা মাথায় রেখে আলাপ আলোচনা এগোচ্ছিল। যে কারণে দু’দেশ আলাপ আলোচনা করছিল।’ ভারতের বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলে তিনি বলেছেন, ‘সিমলা চুক্তিতে দ্বিপক্ষীয় ও শান্তিপূর্ণভাবে বিতর্কিত বিষয়গুলো সমাধানের কথা বলা হলেও ভারত একতরফা পদক্ষেপের মাধ্যমে কাশ্মীরের সাংবিধানিক মর্যাদা পরিবর্তন করেছে, যা এ দ্বিপক্ষীয় চুক্তির সুস্পষ্ট লঙ্ঘন।’ দু’দেশ সম্মত হয়েছিল যে, তারা এলওসিকে সম্মান করবে।

জম্মু ও কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা বাতিল আন্তর্জাতিক মহলে নানাবিধ প্রশ্নের সৃষ্টি হয়েছে। এ বিষয়ে দিল্লির জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর সাউথ এশিয়া স্টাডিজের অধ্যাপক মহেন্দ্র পি লামা বিবিসিকে বলেছেন, ‘৩৭০ ধারা বিলোপের বিষয়টি সিমলা চুক্তির লঙ্ঘন ছিল না। ৩৭০ ধারা ভারতীয় সংবিধানের বিষয় ছিল এবং সংবিধান সংশোধন করার ক্ষমতা সংসদের রয়েছে।’ তার মতে, সিমলা চুক্তি স্থগিত হলে তার প্রভাব ভারতে পড়বে না। অধ্যাপক মহেন্দ্র লামা বলেন, ‘পাকিস্তান সিমলা চুক্তি থেকে বেরিয়ে গেলে ভারতের ওপর তার কোনো প্রভাব পড়বে না। এমনিতেও পাকিস্তানকে মোকাবেলা করা যাবে এবং সেটা শুধু বলপ্রয়োগের মাধ্যমে, সিমলা চুক্তির মাধ্যমে নয়।’ ‘সিমলা চুক্তির এখন কোনো অর্থ নেই। পাকিস্তান প্রতিদিনই তা লঙ্ঘন করছে। সুতরাং এটা ভালো বিষয় যে তারা এখন চুক্তি থেকে বেরিয়ে আসছে।’

উদ্ভূত পরিস্থিতিতে ভারতের পক্ষ থেকে সিন্ধু পানি চুক্তি এবং ‘তার জবাবে’ পাকিস্তানের পক্ষ থেকে সিমলা চুক্তি স্থগিত নিয়ে দু’ দেশেই ব্যাপক আলোচনা হচ্ছে। এখন প্রশ্ন হলো দু’দেশের আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপট ও আঞ্চলিক রাজনীতিতে এ দু’চুক্তির কতটা গুরুত্ব রয়েছে? পররাষ্ট্রনীতি বিশ্লেষক মাইকেল কুগেলম্যান এক্স হ্যান্ডেলে লিখেছেন, ‘সিন্ধু পানি চুক্তি এবং সিমলা চুক্তি পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে তীব্র উত্তেজনার সময়ে সহযোগিতা এবং যোগাযোগের একটা ভিত্তি নিশ্চিত করার জন্য নিরাপত্তা জাল হিসেবে কাজ করেছিল। তাদের সম্পর্কের ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চলে প্রবেশ করার আশঙ্কা রয়েছে।’ এখন প্রশ্ন হলো-সিন্ধু পানি চুক্তি স্থগিতের প্রতিক্রিয়ায় পাকিস্তানের সিমলা চুক্তি থেকে সরে আসা কতটা উপযুক্ত জবাব?

আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের এ প্রশ্নের উত্তরে অধ্যাপক মহেন্দ্র পি লামা বলছেন, ‘সিমলা চুক্তি ইতোমধ্যেই মৃত, অথচ সিন্ধু পানি চুক্তির প্রতিটা লাইন এখনো জীবিত। একটা মৃত চুক্তির সাথে একটা জীবন্ত এবং কার্যকর চুক্তির তুলনা হতে পারে না। পাকিস্তানের জনগণ সে চুক্তি স্থগিত করার কথা বলছেন, যা তারা নিজেরা অনেক আগেই হত্যা করেছে।’ এ বিষয়ে ভারতীয় পক্ষের বক্তব্য হলো, সিন্ধু পানি চুক্তি স্থগিতের ফলে পাকিস্তানের ওপর খুব খারাপ প্রভাব পড়বে। পাকিস্তানের জনসংখ্যার ৮০ শতাংশেরও বেশি প্রভাবিত হবে কারণ সিন্ধু নদের ৭০ শতাংশ পানি পাকিস্তানে যায়।’ ‘পাকিস্তানের কৃষিপণ্যের ৮০ শতাংশেরও বেশি সিন্ধু পানি চুক্তির পানির ওপর নির্ভর করে। এ পানি বন্ধ করা গেলে পাকিস্তানের মানুষকে বেশ সমস্যায় পড়তে হবে।’

সিন্ধু পানি চুক্তি ভাঙলে ভারতের সমস্যা হবে কি না সে প্রসঙ্গেও মন্তব্য করেছেন তিনি। তার মতে, ‘এখন হয়তো সামাল দেয়া কঠিন হবে। কিন্তু এভাবেই একটা গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তে পৌঁছানো যায়। ভারত পানির কিছু অংশ পরিচালনা করার ব্যবস্থা করেছে, তবে আগামী বছরগুলোতে এ ব্যবস্থা আরো বিস্তৃত হবে।’ এ বিষয়ে পাকিস্তান শাসিত কাশ্মীর সরকারের সাবেক সচিব রাজা মোহাম্মদ আব্দুর রাজ্জাক এক্স হ্যান্ডেলে লিখেছেন, ‘সিন্ধু পানি চুক্তি নিয়ে ভারত কোনো একতরফা সিদ্ধান্ত নিতে পারে না।’ তার মতে, এ বিষয়ে ভারতের ব্রহ্মপুত্রের বিষয়টা মাথায় রাখা উচিত। ‘চীন থেকে উৎপত্তি হয়ে ব্রহ্মপুত্র দু’দেশের মধ্যে দিয়ে বয়ে গিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। উত্তর-পূর্ব ভারত ব্রহ্মপুত্র নদের ওপর ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল। ভারতের মতো সিদ্ধান্ত নিতে পারে চীনও।’

এ বিষয়ে অধ্যাপক লামা অবশ্য বলছেন, ‘চীন যদি এমনটা করে, তাহলে বাংলাদেশের ওপর এর খুব খারাপ প্রভাব পড়বে। পাকিস্তানকে খুশি করতে দু’দেশকে চীন হয়রান করবে বলে আমি মনে করি না। সিন্ধু তিব্বত থেকে উৎপন্ন হয়েছে এবং আমি মনে করি না চীন তিব্বতের পানির বিষয়ে সামাল দিতে পারবে। চীন ওই পানি যদি বন্ধ করে দেয় তাহলে সেটা পাকিস্তানে পৌঁছাবে না।’

মূলত, ভারত শাসিত জম্মু-কাশ্মীরের পেহেলগামে সন্ত্রাসবাদী হামলাকে কেন্দ্র করে দু’প্রতিবেশীর মধ্যে রীতিমত যুদ্ধাবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে স্ব স্ব পক্ষ নিজেদের মত ব্যাখ্যা করে পরস্পর বড় ধরনের বিরোধে জড়িয়ে পড়েছে এবং উভয় দেশকে যুদ্ধাবস্থার দিকে ঠেলে দিয়েছে। এখন উভয় পক্ষের এমন মুখোমুখি অবস্থান কতখানি যৌক্তিক, ঐতিহাসিক সিমলা চুক্তির প্রেক্ষাপটই বা কী ছিলো বা এখনো এ চুক্তির কোন প্রাসঙ্গিতকতা আছে কি না; তা নিয়ে আন্তর্জাতিক মহলে নানাবিধ আলোচনা-সমালোচনা শুরু হয়েছে। আর ভারত সিন্ধু নদীর পানি চুক্তি বাতিল করতে পারে কি না, আর করলে পাকিস্তানে এর কী ধরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়বে তাও আলোচনায় স্থান পেয়েছে।

সার্বিক দিক বিবেচনায় মনে হচ্ছে, কোন বিচ্ছিন্ন ঘটনাকে কেন্দ্র করে কোন প্রকার তদন্ত ছাড়াই কোন ভাবেই চরম পন্থা অবলম্বন করা সমীচীন নয়। সম্পাদিত সকল চুক্তিকে স্ব স্ব পক্ষের যথাযথ সম্মান প্রদর্শন করা উচিত। আর সকল সমস্যার সমাধান হওয়া উচিত আলোচনার টেবিলে। তবে ভারতীয় থিং ট্যাংকরা অভিযোগ করছেন যে, পাকিস্তান ইতোমধ্যেই সিমলা চুক্তি ভঙ্গ করেছে। এজন্য তারা কারগিল যুদ্ধকে উদাহরণ দিচ্ছেন। অপরপক্ষে পাকিস্তানীরা কাশ্মীরীদের জন্য বিশেষ মর্যাদা সংক্রান্ত ভারতীয় সংবিধানের ৩৭০ ধারা প্রত্যাহারকে সিমলা চুক্তির লঙ্ঘন হিসাবে বিবেচনা করছেন। কারণ, ঐতিহাসিক সিমলা চুক্তিতে স্থিতাবস্থা বজায় রাখার কথা বলা হয়েছে। উভয় পক্ষের দাবি সঠিক হিসাবে ধরে নিলে এখন আর সিমলা চুক্তির কোন প্রাসঙ্গিকতা পাওয়া যায় না; বরং এটি এখন অকার্যকর ও মৃত চুক্তি।

তবে একথা সত্য যে, পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে ও সময়ের সময়ের প্রয়োজনে আন্তঃরাষ্ট্্রীয় কোন চুক্তি যেকোন পক্ষ বাতিল করতেই পারে। আর ঐতিহাসিক সিমলা চুক্তি যে লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নিয়ে সম্পাদিত হয়েছিলো অর্ধশতাব্দী পরে উভয় দেশের মধ্যে এর ইতিবাচক প্রভাব লক্ষ্য করা যায়নি। দ্বিপাক্ষিক আলোচনার মাধ্যমে কোন সমস্যারই সমাধান করা সম্ভব হয়নি। অধিকৃত কাশ্মীরে শান্তি ফিরে আসেনি। তাই যেকোন পক্ষ এ চুক্তি বাতিল করতেই পারে। কিন্তু সিন্ধু নদীর পানি চুক্তি স্থগিত বা বাতিল কোন সুযোগ নেই। কারণ, সিন্ধু নদীর পানি পাকিস্তানের জন্য কোন দয়া ও দাক্ষিণের বিষয় নয় বরং এটি তাদের অধিকার। চুক্তি থাকুন বা না থাকুন এ নদীর পানি নায্য হিস্যা ভারত পাকিস্তানকে দিতে বাধ্য। এর অন্যথা করা আন্তর্জাতিক আইনের গুরুতর লঙ্ঘন।